#আনকোরা
#রূবাইবা_মেহউইশ
১৭.
রাতের ঠিক একটা সতেরো চৈতীরা এসে পৌঁছেছে আর্মি কোয়ার্টারে। সকালে বেরিয়েছিলো আর এখন এসে পৌঁছানো৷ পথিমধ্যে দু বার বিরতি নিয়েছিলো মাত্র পনেরো মিনিট করে। ঢাকা টু রংপুরের জার্নি কতখানি হতে পারে চৈতীর জানা ছিলো না। তবে ঢাকার রাস্তায় মোটামুটি কিছুটা জ্যাম পেলেও পরের রাস্তাগুলোতে জ্যাম চোখে পড়েনি তার। আবার হতে পারে চৈতী মায়ের কাঁধে পড়ে ঘুমিয়েছে তাই টের পায়নি৷ আজ গরমও তেমন না থাকায় জার্নিটা বেশি কষ্টের হয়নি। শুধু বসে থাকতে থাকতে তার শরীর ব্যথা হয়ে গেছে। কাল রাতে মা যখন ফোন দিয়ে বলেছিলো, “তোর বাবা এসেছে আমরা কাল সকালে রংপুরে রওনা দিবো। তুই কি একটু আসবি না আমাদের সাথে দেখা করতে?”
মায়ের কথাটা শুনেই চৈতীর প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছিলো৷ দিহান তখনও অফিসে ছিলো আর দিলশাদ নিজের ঘরে। সে কান্না চেপে বলেছিলো, “দেখি, সকালে সবাই অফিসে যায় কাজের ঝামেলাটা একটু বেশিই থাকে।”
চৈতীর কথা শেষ হওয়ার আগেই সুইটি কান্না করে দিলেন, “আর কত রাগ পুষে রাখবি তুই৷ আমি আর তোর বাবা কখনো তোর মন্দ চাইনি৷ তোর বাবা হয়তো মানুষটা কঠিন কিন্তু তারও কষ্ট হয় তোর জন্য। আসার পর থেকে ছটফট করছে তোকে দেখার জন্য অথচ আপার ওপর রাগটা এখনও কমেনি বলে ও বাড়ি যায়নি৷ এই দ্যাখ না একটু আগেই বলছিলো তোকে কি সাথে নিয়ে যাওয়া যায় না?”
সুইটির কান্না বাড়ছে একটু একটু। এপাশ থেকে চৈতীরও কান্না পাচ্ছে কিন্তু সেও তো বাবার মতই শক্ত মনের মানুষ। নিজের কান্না ঠিকই আটকে রাখছে। সে কিছুদিন আগেই শুনেছিলো বাবা এবার মাকে নিয়ে যাবে সঙ্গে করে। শোনার পর থেকেই তার বাবার প্রতি রাগ আরো বেড়ে গেছে। এত বছরও বাবা পরিবার নিয়ে থাকার সুযোগ পেয়েছিলো কিন্তু তখন বাবা পড়াশোনা, এটা সেটার দোহাই দিয়ে নিয়ে যায়নি তাদের। আজ চৈতী ও বাড়িতে নেই বলে ঠিকই নিজের বউকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। সে ভেবেছিলো মায়ের সাথেও কথা বলবে না আর কিন্তু তা কি করে হয়! বাবার দূরত্ব ছোট থেকেই সয়ে গেছে তার কিন্তু মায়ের সাথে দূরত্ব কি করে সম্ভব! কথা শেষ করেই চৈতী ফুপুর ঘরে গেল। দিলশাদ তখন একটা ছোট কাঁথা হাতে সেলাই করছিলেন। চৈতী ঘরে ঢুকতেই ঐশীও এলো সে ঘরে তার হাতে চায়ের কাপ। দিলশাদ দুই ছেলের বউকে একসাথে ঢুকতে দেখেই তাড়াহুড়ো করে হাতের কাঁথাটা লুকিয়ে ফেললেন বালিশের তলায়। এতে অবশ্য বিশেষ লাভ হলো না কারণ কাঁথাটা চৈতী আর ঐশী দুজনেই দেখে ফেলেছে কিন্তু ঐশী কোন প্রশ্ন করলে না। চৈতীর পক্ষে কৌতূহল দমানো কষ্টকর তাই সেই আগে প্রশ্ন করলো, “কি লুকাচ্ছো! কি সেলাই করছিলে তুমি?”
“তেমন কিছু না।” স্পষ্টভাবে কথাটা বলেই দিলশাদ ঐশীকে বলল, “চা কি আমার জন্য?”
“হ্যাঁ মা।” বিয়ের পর থেকেই ঐশী দিলশাদকে মা ডাকে। সে চায়ের কাপটা দ্রুত এগিয়ে দিলো দিলশাদকে
“মিথ্যে বলা তোমার চরিত্রে যায় না ফুপি। দেখি আমার ফুপি সুইয়ে কিসের কলিজা ফুঁটো করছিলো!” কথাটা বলতে বলতেই চৈতী সামনে এসে বালিশ সরিয়ে কাঁথাটা উঠিয়ে নিল। তার এমন কাজে হকচকিয়ে গেছে দিলশাদ। তার হাতের কাপ থেকে কিছুটা চা ছলকে পড়লো বিছানার ওপর।কিন্তু চৈতী তো চৈতী সে কোন দিকের পরোয়া না করে কাঁথা উল্টে পাল্টে দেখে বলল, “হায় আল্লাহ! ফুপি এই বয়সেও আমার ভাই বোন আসবে নাকি!”
চৈতীর কথা শুনে ঐশী আর দিলশাদ দুজনেরই মুখ হা হয়ে গেল। এই মেয়েটার আক্কেল বলে এখনও কিছু ঠিকঠাক হলো না। কখন কি বলে কোন ঠিক নেই। ধমকে উঠলো দিলশাদ, “ফাজিল মেয়ে জ্ঞান বুদ্ধি কি তোর এ জন্মে কখনো হবে না?”
“ঐশী আপু তুমিই বলো তো তুমি কি প্রেগন্যান্ট?”
বিয়ের মাত্র ক’দিন হলো এখনই এই প্রশ্ন! ঐশী তো ঝড়ের বেগে মাথা ঝাঁকালো সে প্রেগন্যান্ট নয়৷ চৈতী বলল, “আমিও নই তাহলে বাকি থাকে কে?”
দিলশাদ বড় বড় চোখে তাকালেন চৈতীর দিকে। এই মেয়েটা তাদের বংশের নাম যে অতলে ডুবিয়ে দিচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এই অনার্স পড়ুয়া এত বড় দামড়ি মেয়ে এতটা আক্কেলহীন কথাবার্তা কি করে বলে সে বুঝে পায় না। চোখ গরম করেই সে লুকিয়ে রাখা কথাটা প্রকাশ করে ফেলল, “দিশার ছেলে মেয়ের জন্য সেলাই করছি। সুযোগ হলে প্যাক করে পাঠিয়ে দিবো তাকে।”
যতখানি গরম সুরে দিলশাদ বলল ঠিক ততখানিই চেঁচিয়েই চৈতী বলল, সত্যি!
এবার আর দিলশাদ রাগত নয় নরম স্বরেই বলল, হ্যাঁ শুনলাম পাঁচ মাস চলে।
দিলশাদ উদাস হয়ে পড়লো কথাটা বলেই। চৈতী এসে ফুপির পাশে খাটে বসতে বসতে কাঁথাটা খুব ভালো করে দেখে বলল, “ফুপি৷ কি চমৎকার সেলাই করো তুমি।প্রতিটা ফোঁড়ে একদম নজর আঁটকে যায়।” ঐশীও পাশে বসে সায় দিলো কাঁথাটা সত্যিই সুন্দর। মুহুর্তেই মন ভালো হয়ে গেল দিলশাদের। চমৎকার হেসে সেও বলল, “আল্লাহ আমার ভাগ্যে জলদিই আরো এমন অনেক কাঁথা বানানোর সুযোগ দিক, আমিন।”
দিলশাদের কথার অর্থ চৈতী, ঐশী দুজনেই বুঝতে পেরেছে।সলজ্জে হেসে মুখ নুইয়ে ফেলেছে ঐশী কিন্তু চৈতী কথা পরিবর্তন করতেই কিনা কে জানে তার মায়ের ফোনের কথা বলল।দিলশাদেরও শুনে আবার একটু মন খারাপ হলো ভাই তার এবার আরো দূর হয়ে যাবে বউ চলে গেলে। এতদিন সুইটি আর চৈতীকে দেখেই মনে হতো ভাইটা কাছেই আছে। মনের খারাপটা মনে রেখেই তিনি চৈতীকে বললেন, আজ তাহলে রাতে দিহানকে বলে রাখিস সকালে তোকে যেন ও বাড়ি দিয়ে আসে। চৈতী মাথা নাড়িয়ে জবাব দিলো। কিন্তু সে যে রাতে দিহানকে কিছুই বলেনি এবং সকালেও সে যখন একা বের হলো তখন দিলশাদকেও যাওয়ার কথা বলেনি এটা দিলশাদের খারাপ লেগেছে। সেও অভিমানেই নাকি রাগে আর ভাইয়ের সাথে দেখা করতে যায়নি।তবে সুইটি নিজেই যাওয়ার আগে ফোন করেছিলে দিলশাদকে।
নতুন ঘর, নতুন বাসায় রাতটা কাটাতে বেশি কষ্ট হয়নি চৈতী বা সুইটির। এক ঘরে আগেই বিছানা পাতা ছিলো ফ্লোরে সেখানেই ঘুমিয়েছে চৈতী আর সুইটি৷ তার বাবা ঘুমিয়েছে ভেতরে ঢুকতেই যে খোলা জায়গাটুকু সেখানে পাটি পেতে কাঁথা রেখে৷ তাঁর অভ্যাস আছে শক্ত বিছানা, মাটিতে শুয়েও। সকাল হতেই চৈতী দেখতে পেল দুজন লোক এসেছে তাদের ফার্নিচার গুছিয়ে দিতে। তার বাবা একজনকে রেখে নিজেই হাতে হাতে সব গুছিয়ে নিচ্ছে।চৈতীও মায়ের সাথে হাত লাগিয়ে প্রথমে রান্নাঘরটা গুছিয়ে চা বানালো। কাল থেকে আজকের মধ্যে চৈতী মাত্র একবার কথা বলেছে বাবার সাথে। সকালে চা নাশতা শেষ করে ঘরের অন্য কাজে হাত দিচ্ছিলো চৈতী তখনি তার ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রীণে ‘দিহান ভাই’ নামটা দেখে বেশ চমকালো সে। তারপরই রিসিভ করতে দিহানই আগে বলল, “তোর পরীক্ষার রুটিন বেরিয়েছে বাড়ি আসবি কবে?”
পরীক্ষার রুটিনের খোঁজ নিয়ে দিহান ফোন করেছে ভাবতেই মনে হলো সে ভুল দেখছে ফোনটা নিশ্চয়ই অন্য কেউ করেছে।নাম্বারটা আরেকবার ভালো করে দেখে কনফার্ম হলো কল দিহানই করেছে। সে আবারও কানের কাছে ফোন ধরলো এবার শুনতে পেল ধমকে উঠেছে দিহান।
“কথা বলিস না ক্যান! পড়ালেখার মন নাই তোর তাই না হুদ্দাই ভর্তি হইছিস?”
“আমার পরীক্ষার ডেট আরো আঠারো দিন পর। পরীক্ষার প্রস্তুতিও ঠিকঠাক আছে তোমার ভাবতে হবে না। কি জন্য ফোন দিছো তাই বলো।”
চৈতীরও কড়া কন্ঠ শুনে থতমত খেয়ে গেছে দিহান। সত্যিই তো চৈতীর পরীক্ষার জন্য সে কেন ফোন দিলো৷ আর সে তো রুটিন জানাতে ফোন করেনি কিন্তু কেন করেছে তাই মনে পড়ছে না৷ এখন কি বলা যায় ভাবতে ভাবতে বলল, “আমার নতুন টি শার্ট টা পাচ্ছি না।”
“এ্যাশ কালারেরটা হলে দ্যাখো ময়না খালা ধুয়ে দিয়েছে। ময়লার ঝুড়িতে ছিলো ওটা। আর যদি একেবারে আনইউসড কোনটার কথা বলো তবে সেগুলো তোমার ড্রয়ারে তৃতীয় তাকে৷”
“টিশার্ট না মোজা পাচ্ছি না।”
“তোমার ছোটখাটো জিনিসগুলা মানে মোজা,আন্ডারওয়্যার আর রুমাল সব ভাজে ভাজে আলাদা করে প্রথম তাকেই আছে চোখ মেলে তারপর দ্যাখো। আর যদি সেগুলোও না হয় তবে আগে ঠিক করো তুমি আসলে পাচ্ছো না কোন জিনিসটা।”
দিহানের এবার নিজের ওপরই মেজাজ চড়লো। সে তো এসব বলতে ফোন দেয়নি৷ ফোন দিয়েছে জিজ্ঞেস করতে তারা ঠিকঠাক পৌঁছেছে কিনা আর কখন! আশ্চর্য ব্যাপার তার আজ এত হেজিটেশন হচ্ছে কেন কথা বলতে! সকালে ঘুম থেকে উঠে নাশতা করতে গিয়েই সে টের পেয়েছিলো আজ তার ঘুম ভাঙতে কেউ তাকে জ্বালায়নি। আর এই না জ্বালানোটাই তাকে বিরক্ত করছিলো খুব। প্রতিদিন তো চৈতী এসে কানের কাছে খুব ঘ্যান ঘ্যান করে এতে তার মেজাজ বিগড়ায় আর বিছানা ছাড়তে ছাড়তে সে এক প্রস্থ ধমক দেয়। আজ এই জিনিসটার খুব কমতি লেগেছে। কাল রাতে বিছানাটাতে ঘুমাতে গিয়েও সে বার বার সতর্ক হচ্ছিলো হাত পা না আবার চৈতীর গায়ে লাগে। সাবধান হওয়ার পরই মনে পড়েছে আজ চৈতী নেই। এখন এই হঠাৎ পরিবর্তনীয় আচরণ তাকে খুব বিব্রত করলো। সে আর কোন কথা না বলে ফোন কেটে দিলো।
“কি রে, এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কে ফোন দিলো!”
“দিহান ভাই।”
“কি বলছে? সে ফ্রী হতে পারলে বল চলে আসতে দুদিনের জন্য।” হাতের ফুল দানিটা সেন্টার টেবিলে রাখতে রাখতে বলল সুইটি।এ বাড়িতে তারা বড়সড় কোন ফার্নিচারই নিয়ে আসেনি সাথে করে। মাত্র তো তিনটা বছর এরপরই নিজের বাড়িতে থাকবে চাঁদ খান। ফার্নিচারগুলো টানা হেঁচড়া করে নষ্ট করতে চায়নি সুইটি। আর আশ্চর্য রকম ভাবে চাঁদ তার কথাগুলো শুনে সেই সিদ্ধান্তই নিলেন। সাথে অতি প্রয়োজনীয় ছোট ছোট জিনিসপত্র এনেছেন আর কিছু এখানেই কিনে নিবেন বলে ঠিক করেছেন৷ চৈতী আবারও মায়ের সাথে কাজে হাত দিলো কিন্তু মনে মনে ঠিকই রইলো দিহান কেন ফোন করেছে!
সারাদিন অফিসের কাজে ভালো ব্যস্ততায় কাটলো দিহানের। এক ফাঁকে দিশান এসে কফির অফার করলে দু ভাই মিলে রেস্টুরেন্টে গিয়ে কফি খেয়ে আসলো৷ আবার সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দরজায় মাকে দেখে মনে পড়লো চৈতীর কথা। খাবার খাওয়ার সময়ও মাথার পাশে দাঁড়ানো কেউ নেই, ঘরে আজও কাপড়গুলো মাস তিনেক আগের মতোই অগোছালো এমনকি তার বিছানার চাদরটার কোণাও ঠিকঠাক নেই দেখে মনে হলো তার অভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে। মনের কোণে দিনভর মৃত একজনের স্মৃতি বহন করে চলছে আজ বছর ঘুরে গেল অথচ হুট করে নতুন এক অভ্যাসও তৈরি হয়ে গেল! রাতে নিজেই বিছানা গুছিয়ে গা এলিয়ে দিতেই মনে হলো বিছানার বা পাশটা আজ কয়েক মাস ধরে চৈতীর দখলে। এ পাশটাতে শুতে গেলেই তার কলিজা ছ্যাৎ করে উঠে এই বুঝি চৈতী খেঁকিয়ে উঠবে। দু চোখের পাতায় কিছুদিন একদমই ঘুম নামতো না মাত্র কিছুদিন হলো সে ভালোই ঘুমায় রাতে। চৈতী ঘরে থাকে বলেই হয়তো সে আর সুযোগ পায় না একান্তে বসে প্রিয়ন্তির ছবি কিংবা তার সাথে জড়িত কোন জিনিস ছুঁয়ে দেখতে। আর তাতেই তার বিষাদের সময়গুলো কমে এসেছে। দিনের সময়গুলোও অফিসের ব্যস্ততায় বাধ্য হয়েই স্মৃতিরোমন্থনের সুযোগ হয় না। বলা যায় দৈনন্দিন কিছু পরিবর্তনই তাকে প্রিয়ন্তির সময়গুলো থেকে দূর করে দিয়েছে আর চৈতীকে অভ্যাসের খাতায় যুক্ত করে দিয়েছে। এই অভ্যাস ভালোলাগা বা ভালোবাসা কোনটাই নয় নেহায়েতই সময়ে গড়া অভ্যাস মাত্র। রাতে আজও বাড়ি এসে ঘর ফাঁকা লাগলো দিহানের। সে খেতে বসে গাঁইগুঁই করে বলেই ফেলল তার কাপড়চোপড় এলোমেলো। কিছুই ঠিকঠাক খুঁজে পায় না সে আর না বিছানা গোছানো থাকে। তার কথা শুনে তার পাশে বসে খেতে থাকা তার বাবা খাওয়ায় মনযোগ রেখেই বলল, “বউ বাপের বাড়ি গেলে এমনই হয়।”
দিহান অবাক হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকায় আর দিশান তো ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে বিষমই খেল। খাওয়া শেষ করে ঘরে ঢুকতেই দিহান চেঁচিয়ে মাকে ডাকে। দিলশাদ ডাইনিংয়ে বসেই বলল, “তোর ব্যাগ গোছানো আছে ডিভানের ওপর।তোর মামী বা চৈতীকে ফোন করে ঠিকানা নিয়ে বেরিয়ে পড়। বাসের টিকেট কেটে রেখেছে তোর আব্বু।”
দিলশাদের কথা শেষ হতেই দিহান দরজা থেকে মাথা বাইরে এনে মায়ের দিকে তাকালো কড়া নজরে আর দিশান এবার উচ্চস্বরেই হাসি শুরু করে দিলো।
বাথরুম থেকে ভালো করে মুখ হাত ধুয়ে কাপড় বদলে নিয়েছে দিহান।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাত দিয়েই চুলগুলো গুছিয়ে নিলো। শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে আলমারির কাছে এগিয়ে গেল। প্রথম তাকের ভেতরই লাগোয়া ছোট্ট আরেকটা ড্রয়ারে প্রিয়ন্তি আর তার ছবি। তাতেই রাখা প্রিয়ন্তিকে দেওয়া তার ছোট্ট কানের দুলের একটা। আরেকটা হারিয়ে গেছে হাসপাতাল থেকে যেদিন লাশ আনা হয়েছিলো মেয়েটার। একটা দুলই হাতে নিয়ে ঘ্রান শুঁকে দিহান। প্রিয়ন্তির গায়ের ঘ্রাণ অমলিন এই স্বর্ণের টুকরোটাতে। ছবিটা তুলে বুকে মিশিয়ে রাখে কিছুটা সময়। চোখ ঝাপসা হয় কিন্তু তার গাল সিক্ত হয় না আর এ কারণেই হয়তো দিহান প্রিয়ন্তিকে একটুও আলাদা করতে পারে না নিজের থেকে। বেঁচে থাকতে হবে তাকে যতদিন না যমদূত এসে নেয় তাকে৷ অন্তত ততদিনের জন্য হলেও তাকে অভ্যাসে আসা চৈতীকে মেনে নিতে নিতে হবে। অনুভূতির খোলাসা এ জীবনে কখনো হবে না হয়তো চৈতীর জন্য কিন্তু নিঃশ্বাসকে হালকা করার জন্য তো লাগবে তাকে৷ কাগজের ছবিটাতেই ঠোঁটের কোমল স্পর্শ দিয়ে রেখে দেয় সযত্নে তারপরই ব্যাগ নিয়ে বের হয় ঘর থেকে। দিলশাদ তখনও খাবার হাতে বসেছিলেন৷ পাশেই ঐশী আর দিহান। তিনজনেরই মুখ উজ্জ্বল হলো দিহানের হাতে ব্যাগ দেখে।
“আব্বু কোথায়?”
“ঘরেই আছে যা।” দিলশাদ কথা শেষ করতেই দিহান বাবার কাছে যায়। দিহানের বাবা যেন জানতেন ছেলে এখনই আসবে টিকেটের জন্য । তিনি টিকেট আর হাজার পাঁচেক টাকা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দিহান ঘরে ঢুকতেই টিকিট আর টাকাটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, “এখন তো কিছু কিনতে পারবি না৷ সকালে রংপুরে নেমেই সদর থেকে ভালো মিষ্টি আর ফল বা অন্যকিছু কিনে নিয়ে যাস তোর মামা মামীর জন্য।”
দিহান বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল সাড়ে নয়টার দিকে। তার যাওয়া দেখেই যেন একবুক আশা মেঘের মত জমে উঠলো দিলশাদের বুকে। আল্লাহকে ডাকলে তা কখনও বিফলে যায় না তা যেন তার জীবনে প্রতি পদে পদে প্রমাণ হচ্ছে৷ এবার দিশাকে নিয়ে চাওয়া দোয়াও তার আল্লাহ পাক কবুল করুক এমনটা প্রার্থনা করছে সে।
রাত বারোটা। চৈতী আজ একা ঘুমিয়েছে। তার জন্য ঠিক করা রুমটাতে একটা বারান্দা আছে সেই সাথে ঘরে বড় একটা জানালাও। আজ রাতে বাবা, মা দুজনের সাথে খেতে বসে সে বারবার এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছিলো বাবা- মাকে। তার বারবার মনে হচ্ছিলো সে ফুপির বাড়িতেই আছে আর ফুপি ফুপা খেতে বসেছে। নিজের অজান্তেই সে খাবার সার্ভ করছিলো যেন অভ্যাস তার কত বছরের। রাতে ঘুমাতে এসেও বিছানা পরিপাটি করে সে খাটের বা পাশেই শুলো। বারবার ভুলে যাচ্ছিলো এ ঘরে দিহান আসবে না সে একাই ঘুমাবে। আজ চোখে ঘুম নামছে না। পাশ ফিরে শুতেই ফোন বাজলো তার। এতরাতে কে ফোন করবে ভেবে ফোন হাতে নিলো। স্ক্রিনে দিহানের নামটা জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু রিসিভ করার পর ওপাশ থেকে কোন জবাব এলো না।
চলবে
(মন্তব্যের অপেক্ষা রইলো)