আমার গল্পে তুমি পর্ব-৩

0
2617

#আমার_গল্পে_তুমি
//পর্ব-৩//
#সাদিয়া

আদিবদের বাসা থেকে এসেই সাদিয়া ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করেছে। এখন প্রায় দুই ঘন্টা হতে চললো সে ওয়াশরুমের কল ছেড়ে তার নিজে বসে আছে। কলের পানি আর তার চোখের পানি দুটোই সমান তালে গড়িয়ে পড়ছে। কেউ কারো থেকে কম যায় না তারা যেন তাই বুঝাচ্ছে।

কাদঁতে কাঁদতে এক পর্যায়ে সাদিয়ার হিচকি উঠে যায়। আচ্ছা তার জীবনটা এতো জটিল কেন? একটু সহজ হলে কি খুব বেশি সমস্যা হতো। কেন সবাই তাকে অপয়া অলক্ষী বলে?কেন? ছোট বেলা থেকে অপয়া আর অলক্ষী শব্দ দুটো শুনতে শুনতে এই শব্দ দুটোর প্রতি তার একটা চরম ঘৃনা তৈরি হয়েছে। সে এই দুটো শব্দ কে খুব ঘৃনা করে। প্রচন্ড ঘৃনা করে সে এই অপয়া আর অলক্ষী শব্দ দুটোকে। তবুও তাকে এই দুইটা শব্দ বার বার শুনতে হয়। বার বার লোকজন তার পুরোনো ক্ষতগুলোকে তাজা করে দেয়। ওয়াশরুমের দেওয়ালে মাথা ঠেঁকিয়ে সে তখনকার কথা ভাবতে লাগলো।

তখন আদিবদের বাসায়…..
সাদিয়া ফ্রেশ হয়ে এসে টেবিলে খেতে বসেছে তখনই কলিং বেল বেজে উঠে। কাকীকে খারার দিতে বলে আদিবের মা দরজা খুলতে যায়। কথা বার্তা শুনে বুঝা যাচ্ছে আদিবের বাবার অসুস্থতার খবর শুনে আদিবের ফুফু এসেছেন। তার আসার খবর শুনতেই সাদিয়া কিছুটা ঘাবড়ে যায়। সাথে কিছুটা ভায়ও পায়। তিনি সাদিয়াকে অপদস্ত করার একটা সুযোগও হাত ছাড়া করেন না। তাই সাদিয়া তাকে একটু ভয় পায়।
ভাতের এক লোকমা মুখে দিয়ে আরেক লোকমা মুখে তুলতে যাবে তখন ফুফুর কথায় তার গলায় খাবার আটকে যায়। চোখ দুটো টলমল করে উঠে পানিতে। কেউ সেই পানি দেখার আগেই সে চোখ দুটো মুছে নেয়।

—কি মেয়ে হয়েছেরে বাবা কোথাও গিয়ে কাউকে শান্তি দেয় না। অপয়া মেয়ে একটা।দেখ কি সুন্দর নির্লজ্জের মতো এখানে এসে খেতে বসেছে। বলছি ছেলেটাকে খেয়ে শান্তি হয়নি তোমার মেয়ে এখন অন্ন ধ্বংস করতে এসেছো। লজ্জা বলতে কিছু নেই নাকি তোমার।

তার কথা শুনে সাদিয়ার আর খাওয়া হলো না। সে নিরবে ভাতের বাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। সাদিয়াকে উঠে যেতে দেখে কাকী ওকে বলে,,
—এই মেয়ে খাবার ছেড়ে উঠছিস কেন? খাবারটা শেষ কর আগে।

—না কাকী আমার ক্ষিদে নেই।

—ক্ষিদে নেই মনে কি? আজকে তো সকালেও খাবার খাস নি এখন বলছিস ক্ষিদে নেই।

—তোমাদের আদিক্ষেতা দেখে বাঁচি না ভাবি।এই অপয়া অলক্ষী মেয়েকে এতো মাথায় কেন তুলছো বলো তো। এই মেয়ে তো জন্মের আগেই বাপকে খেয়েছে। জন্মের দুই মাসের মাথায় মাকেও ছাড় দেয় নি। আর বিয়ের পর নিজের স্বামীকেও মেরে ফেললো। এই মেয়ে যেখানে যাবে সব ধ্বংস করে ছাড়বে। এই মেয়ে জীবনে কারো ভালো করেনি কারো ভালো এই মেয়ের সহ্যই হয় না।

আদিবের ফুফুর একেকটা কথা সাদিয়ার গায়ে কাটার মতো লাগছে। তিনি তো সত্যি কথাই বলছে। তার কথায় তো কোনো মিথ্যা নেই। আসলেই তো সে সব শেষ করে দিয়েছে। সব!
সাদিয়া কোনো কথা না বলে সোফা থেকে নিজের ব্যাগটা নিয়ে নিঃশব্দ দরজার দিকে পা চালায়। পেছন থেকে আদিবের মা কাকী আর দাদী অনেক ডেকেছে কিন্তু সে উত্তর দেয়নি। আর কিছুক্ষণ সেখানে থাকলে চোখের পানি যে বড্ড অবাধ্য হয়ে পড়তো!

—সাদি !এই সাদি কোথায় তুই?
আদিবার ডাকে ভাবনার সুতো কাটে সাদিয়ার। সাদিয়ার জবাব না পেয়ে আবারো ডাকে সে সাদিয়াকে।
সাদিয়া তাড়াতাড়ি চোখে মুখে পানি দিয়ে কাপড় চেঞ্জ করে বের হ ওয়াশরুম থেকে।
দরজা খুলার শব্দে আদিবা উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে গেলেই সাদিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে নিরব হয়ে যায়। চোখ বন্ধ করে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাদিয়ার হাত টেনে তাকে বিছানায় বসায়। তোয়ালে দিয়ে সাদিয়ার চুল মুছতে মুছতে বলে,,
—আমাদের পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছে যারা অন্যকে কাঁদিয়ে আনন্দ পায়। অন্যের গভীর ক্ষতগুলোকে তাজা করে আনন্দ পায়। তাদের প্রধান কজই হচ্ছে মানুষের শান্তি নষ্ট করা। আমাদের উচিত তাদেরকে কড়া ভাষায় তাদের নিজেদের অবস্থান বুঝিয়ে দেওয়া। আর তা না পারলে এমন সিক মেন্টালিটির মানুষ জনদের এড়িয়ে চলা। এভাবে কান্না করা না। আর তুই তো অনেক স্ট্রং। তাই না? তুই কেন কাঁদবি?তোর দোষ কোথায়? তোর ভাগ্যের জন্য কি তুই দায়ী? নিশ্চয়ই না! তাহলে কেঁদে কেঁদে কেন সাগর বানাবি তুই? কেন তুই মানুষকে সুযোগ দিবি তোকে কথা শুনানোর?

আদিবার কথায় সাদিয়া আদিবাকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠে। আদিবাও পরম যত্নে সাদিয়াকে আগলে নেয়। কান্নার এক পর্যায়ে সাদিয়া ঘুমিয়ে যায়। আদিবা সাদিয়াকে সযত্নে বালিশে শুইয়ে দিয়ে শরীরে কাঁথা চেপে দেয়। ঘুমন্ত সাদিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওয়াশরুের দিকে পা বাড়ায় সে।

আদিবা। সাদিয়ার বেস্টফ্রেন্ড। স্কুল থেকে তারা একসাথে। এই একটা মানুষ সাদিয়ার খুব কাছের। যে সাদিয়ার না বলা কথা গুলোও খুব ভালো ভাবে বুঝে যায়। স্কুলে সাদিয়ার কোনো বন্ধু ছিলো না। সব বাবা-মা তাদের ছেলে-মেয়েদের সাদিয়ার সাথে মিশতে না করে দিয়েছিলো। কারণ তারা ভাবতো সাদিয়ার সাথে মিশলে তাদের সন্তাদের কোনো না কোনো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সাদিয়া যখন স্কুলে একা বসতো একা থাকতো তখন কিছুটা জোর করেই আদিবা সাদিয়ার বন্ধু হয়ে উঠে। তার পর স্কুল কলেজ এক সাথে আর ভাগ্যক্রামে তারা একই মেডিকেল কলেজে চান্স পায়।

..
অন্ধকার একটা ঘরে একটা লোক ইজি চেয়ারে বসে আছে। তার ঠোঁটে তাছ্যিল্যের হাসি। দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলছে,
—যতটা আঘাত তোমরা আমাকে আর আমার ভালোবাসাকে দিয়েছো তার ডাবল আঘাত তোমাদের আমি ফিরিয়ে দেব। তোমরা ভেবেছো খেলা শেষ। কিন্তু নাহ! খেলা তো সবে শুরু। এতো সহজে কি সব কিছু শেষ হয়? তোমরা মনে করছো খেলা তোমাদের নিয়মে চলছে। নোপ! খেলা তো চলছে আমার নিয়মে।আর চলবেও আমার নিয়মে তা যতদিন পর্যন্ত আমি চাইবো। আমার আর আমার ভালোবাসার মাঝে যে বা যারা আসবে তাদের সবাইকে এক এক করে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেব। আমার আর আমার ভালোবাসার মাঝে আমি কোনো তৃতীয় পক্ষ চাই না।এক এক করে সবাইকে সরিয়ে দেব। যেমন দিয়েছিলাম অর্ধযুগ আগে!

🍁
মাত্র অপারেশন শেষ করে ওটি থেকে বের হলো আরনাফ। নিজের কেবিনে ঢুতেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠে। সে পা টিপে টিপে গিয়ে চেয়ারে বসা মানুষটাকে জরিয়ে ধরে।

—ইইইই মামা ছাড়ো ছাড়ো। তুমি মাত্র আপাশন করে এলে।ছাড়ো আমাকে।

—আমি আমার মাকে ধরেছি তাতে আপনার কি? আর এটা আপাশন নয় এটাকে অপারেশন বলে।

—হে তো আমিও তো এটাই বললাম আপাশন।

—ওক্কে মেরি মা ঠিক আছে। কিন্তু আপনি এখানে কার সাথে এলেন?

—আমি তো বাবাইয়ের সাথে এসেছি। বাবাই আমাকে এখানে বসিয়ে রেখে গেছে।

—আচ্ছা। তো বলুন আপনি কি খাবেন।

আফিয়া নিজের সব কয়টা দাঁত বের করে বললো,
—চকলেট আর আইসক্রিম।

আরনাফ ছোটো ছোটো চোখ করে আফিয়ার দিকে তাকাতেই সে খিলখিল করে হেসে উঠলো।আফিয়ার হাসি দেখে আরনাফও আলতো হেসে নিজের এ্যাসিস্টেনকে ফোন করে তার কেবিনে চকলেট আর আইসক্রিম পাঠাতে বলে।

আরনাফ পেশেন্ট দেখছে আর আফিয়া সোফায় বসে চকলেট আর আইসক্রিম খাচ্ছে। খাচ্ছে বললে ভুল হবে কারণ সে খাচ্ছে কম আর মাখছে বেশি। সে তার পুরো মুখ চকলেট আর আইসক্রিম দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে। তাকে দেখতে অনেকটা বিড়ালের মতো লাগছে। পেসেন্টের সাথে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে আরনাফ আফিয়াকে দেখছে। আফরার পুরো মুখে চকলেট মাখানো দেখে আরনাফ হেসে উঠে।

—মামা তুমি হাসছো কেন?উনি কি কোনো জোস বলেছে?

আফিয়ার কথায় পেশেন্টটা ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকালো।কিছু বুঝতে না পেরে বললো,

—জোস কি?

আরনাফ হেসে হেসেই উত্তর দিলো,,
—এটা জোস নয় এটা জোকস।

—-ওওওহ্। আচ্ছা তাহলে এবার আমি আসি।

—জ্বী আর নিজের খেয়াল রাখবেন। ওষুধের অনিয়ম করবেন না।

—জ্বী।

পেশেন্ট চলে যেতেই আরনাফ চেয়ার থেকে উঠে আফিয়ার কাছে গিয়ে বসে সুন্দর করে টিস্যু দিয়ে সযত্নে আফিয়ার মুখে লেগে থাকা চকলেট আর আইসক্রিম মুছে দিয়ে আফিয়ার গালে ছোট্ট একটা চুমু খায়।আরনাফের কাজে আফিয়া খিলখিল করে হেঁসে উঠে।

#চলবে……ইনশাআল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here