আমার বোনু পর্ব-১৬

0
2355

#আমার_বোনু
#Part_16
#Writer_NOVA

সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার সব ভাইকে বাসায় দেখা যায়। এই একটা দিন তারা পরিবারের সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করে। তবে আজকে আদিল নেই। ও একটা সিরিয়াস কেইস ইন্ভিস্টেগিশনের দায়িত্ব আছে। তাই আদাজল খেয়ে সব ছেড়ে সেদিকে মনোযোগ দিয়েছে।

অর্ণব, অনল, ঊষা সোফায় বসে গল্প করছে। গল্পের মূল বিষয়বস্তু হলো অনলের লেখা। অনল সামনের আদর্শলিপি দেখে দেখে তার খাতায় পেন্সিল দিয়ে লিখছে। আর সেটা বাবা,ফুপিকে দেখাচ্ছে। তিন বিচ্ছুকে আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। ইশাত, ঈশান, অরূপ বিপরীত সোফায় বসে লুডু খেলছে। মাঝে মাঝে ছক্কা, ছক্কা বলে চেচিয়ে উঠছে। পুরো ড্রয়িংরুম ওরাই উঠিয়ে ফেলছে।

অর্ণব বোনের দিকে তাকিয়ে বললো,
— তোর পড়াশোনা কেমন চলছে বোনু?

ঊষা চোখ তুলে তাকিয়ে বললো,
— আলহামদুলিল্লাহ ভালোই।

— কলেজে কোন ছেলে ডিস্টার্ব করে?

অর্ণবের কথা শুনে ঊষা ফট করে ঈশানের দিকে তাকালো। ঈশান খেলায় মত্ত। দুই হাতে নিজের গাল ধরে রেখে চার, চার বলে চেঁচাচ্ছে। ইশাতের পাকা গুটি খেতে আর চারের দরকার অরূপের। অরূপ ওর পাকা গুটি খেয়ে ফেলেছে। তাই ও এখন ইশাতকে বলছে অরূপের গুটি কাঁচা করে দিতে। অর্ণব ফের প্রশ্ন করলো,

— আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি বোনু।

— হ্যাঁ, ভাইয়া বলো।

— একটু আগে তো বললাম।

— না ভাইয়া কেউ ডিস্টার্ব করে না। কারো এতো সাহস আছে নাকি যে মির্জাদের বোনকে ডিস্টার্ব করবে?

অর্ণব খুশি হয়ে বোনকে বললো,
— এই তো সব কথার বড় কথা।

ঊষাও ভাইয়ের সাথে তাল মিলিয়ে মুচকি হাসলো। সামান্য বিষয়গুলো ঈশান একাই হ্যান্ডেল করে। তবে সব ভাইকে সেই বিষয়ের খুটিনাটি কথা বলে দেয়। অনল খাতায় একটা মাছ একে ঊষাকে দেখিয়ে বললো,

— দেখো রাণী আমি মাছ এঁকেছি।

ঊষা অনলকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য খুশি হয়ে বললো,
— মা শা আল্লাহ! কত সুন্দর হয়েছে বাবা। কি মাছ এটা?

— এটা জাতীয় মাছ ইলিশ।

— ইলিশ মাছটা তো অনেক সুন্দর হয়েছে। দেখি তো তুমি আরো কি কি পারো।

— আমি পাখি আঁকতে পারি, আম আঁকতে পারি, ফুল আঁকতে পারি, শাপলা ফুলও পারি। তুমি দেখবা রাণী?

— হ্যাঁ, অবশ্যই দেখবো।

অর্ণব এক ধ্যানে বোন আর ছেলেকে দেখতে লাগলো। বোনকে কিছু দিন পর বিদায় দিতে হবে এটা ভেবেই তার বুক কেঁপে ওঠে।

অথৈ, জিনিয়া কিচেনে কাজ করছে। বিকেল থেকে একসাথে টুকটাক কাজ করে দিচ্ছে অথৈ। জিনিয়া অবশ্য মানা করেছিলো। কিন্তু সে শুনেনি।অথৈ সবজির ঝুড়িটা এগিয়ে দিয়ে জিনিয়াকে বললো,

— ভাবী, আমার অপরাধটা কি কখনো তারা মাফ করবে না?

জিনিয়া অথৈ এর দিকে না তাকিয়ে ছুড়ি দিয়ে আলুভাজির জন্য আলু কুচি কুচি করতে করতে বললো,

— মৌমাছির চাকে ঢিল দিলে তো তারা তোমায় হুল ফুটাবেই। তুমি সুস্থ নাকি অসুস্থ, পাগল নাকি মাতাল তাতো দেখবে না। তুমিও মৌচাকে ঢিল মেরেছো। তবে আল্লাহ তোমায় বাঁচিয়েছে। তুমি প্রেগন্যান্ট বলে আজও এই বাড়িতে। নয়তো চিরদিনের জন্য আদিল কে আর এই বাড়ি হারাতে তুমি। এখানে যে থাকতে পারছো তাতেই আলহামদুলিল্লাহ বলো।

অথৈ অসহায় গলায় বললো,
— আমি আমার কাজের জন্য অনুতপ্ত।

জিনিয়া এক পলক ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
— শুনো অথৈ কিছু কথা বলি। শুনতে খারাপ লাগবে আমি জানি। তবুও বলছি।

— হ্যাঁ ভাবী বলো।

— তুমি মোটেও অনুতপ্ত নয়। তুমি মুখে মুখেই বলছো তুমি অনুতপ্ত। কিন্তু তোমার কাজের মধ্যে সেই অনুতপ্ততা আমি খুঁজে পাচ্ছি না। তোমার মধ্যে কি বিবেক বলতে কিছু নেই? তুমি কোন সাহসে নিজের সুখের সংসার ভাঙতে গিয়েছিলে? তাও একটা অযৌক্তিক বিষয় নিয়ে? সত্যি বলতে তুমি ঊষাকে নিজের বোনের মতো ভাবতেই পারোনি। যদি ভাবতে পারতে তাহলে কখনও এসব কথা চিন্তা করতে পারতে না। তোমার ওপর আমার নিজেরও অনেক রাগ হয়েছিলো। কোন টাইপের মানুষ তুমি? তুমি তো নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে এসেছো। কখনো কি তোমার পরিবার কিংবা তোমার স্টাটাস নিয়ে কেউ কথা বলেছে বলো? কেউ বলেনি। তোমায় নিজের মানুষ বলে সবাই আপন করে নিয়েছে। কিন্তু তুমি কি করলে? তাদের বিশ্বাস ভেঙে তাদের কলিজার টুকরোর বোনকে আঘাত দিলে। তুমি শুধু তাদের বোনকে আঘাত করোনি বরং তাদের হৃৎপিণ্ড বরাবর ছুরি চালিয়েছো। সেই জখম কবে সারবে তা একমাত্র তারা আর আল্লাহ ভালো জানে। তুমি এটাকে সামান্য বিষয় ভেবে হেয়ালি করছো। কিন্তু তুমি এর জন্য এখুনি নিজেকে শুধরে না নিলে ভবিষ্যতে বহুত পস্তাবে।

একটু থেমে জিনিয়া পুনরায় বললো,
— কথাগুলো তোমার ভালোর জন্যই বললাম। আমায় আবার ভুল বুঝো না। নিজের বিবেকবোধকে জাগিয়ে তুলো। আর কত তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখবে? এখনও সময় আছে কোনটা ঠিক কোনটা ভুল তা বুঝতে শিখো। অন্যের কথায় নিজের মস্তিষ্ক চালনা করো না।

জিনিয়া ঝুড়িতে আলু কুচি নিয়ে বেসিনে গিয়ে ধোওয়ার কাজে ব্যস্ত হয়ে পরলো। অথৈ থুম মেরে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করতে লাগলো। আদোও সেকি ঠিক কাজ করেছে!

ভাইকে দেখেই অদিতি পাগলামি থামিয়ে দিলো। দৌড়ে ভাইকে জড়িয়ে ধরে বললো,

— আমি ঔষধ খাবো না ভাইয়া। এই ঔষধ খেলে আমার খুব কষ্ট হয়। নিজেকে নিজে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে।

রূপা চাচী যিনি অদিতির দেখভাল করে সে করুন সুরে মাসফিকে বললো,

— বুঝিনা মাসফি বাবা, মাইয়াডা কিছুতেই ঔষধ খাইবার চায় না। ঔষধ দেখলেই ওর পাগলামি বাইড়া যায়। কি করমু আমি তুমি কও।

মাসফি বোনকে একহাতে আগলে রেখে রূপা চাচীকে বললো,
— ঔষধগুলো আমার হাতে দিন চাচী। আপনি বরং বোনের জন্য এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে আসুন।

রূপা চাচী মাথা হেলিয়ে বললো,
— আইচ্ছা বাবা। তবে ঔষধগুলান কিন্তু খাওয়ায় দিও। দুপুরেও খায় নাই।

রূপা চাচী পাশ কাটিয়ে কিচেনে চলে গেলো। মাসফি অদিতিকে নিয়ে ডিভানে বসলো। বোন তার গুটিসুটি মেরে বুকের সাথে মাথা হেলিয়ে রাখছে। ধীর কন্ঠে মাসফি ডাকলো,

— অদিতি!

অদিতি ক্ষীণ সুরে উত্তর দিলো,
— হুম!

— ঔষধ না খেলে তো তুমি সুস্থ হবে না। সুস্থ না হলে কি তোমায় তোমার ভালোবাসার মানুষ ফিরিয়ে নিবে বলো?

অদিতি দুই কান ধরে জোরে চেচিয়ে বললো,
— আমি ঔষধ খাবো না। আমি ঔষধ খাবো না।

মাসফি বোনকে সান্ত্বনা করার উদ্দেশ্য বললো,
— আচ্ছা ঠিক আছে। তোমার ঔষধ খেতে হবে না। তোমায় আমি রূপকথার গল্প বলি। তুমি শুনবে?

অদিতি মাসফির বুকের থেকে মাথা উঠালো। ঠোঁট ফুলিয়ে মাথা উপরনিচ নাড়িয়ে বুঝালো সে গল্প শুনতে রাজী আছে। মাসফি হাসিমুখে গল্প বলা শুরু করলো। বিয়ের বয়সী এক মেয়েকে কিনা রূপকথার গল্প শুনচ্ছে। লোকে শুনলে হাসবে। কিন্তু অদিতি এখন পুরো বাচ্চাদের মতো বিহেভ করে। ওকে সামলাতে হয় পুরো বাচ্চাদের মতো।

গল্প শুনতে শুনতে ভাইয়ের বুকে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে গেছে অদিতি। মাসফির মনে হলো সে ছোট বাচ্চা ঘুম পারালো। বোনকে সেভাবে ধরে রেখে দৃষ্টি দিলো সামনের একটা ছবির ফ্রেমের দিকে। তবে মাথায় চিন্তা তার অন্য কিছুর। এই বিষয়টা সে আগে ততটা পাত্তা না দিলেও এখন তাকে ভাবাচ্ছে। বোন তার ঔষধ খাওয়ার পরই পাগলামি করে। নয়তো অনেকটা স্বাভাবিক থাকে। যদিও অনেক আচার-আচরণ বাচ্চাদের মতো হয়ে গেছে। তবে ঔষধ খাওয়ার পর হিংস্র হয়ে যায়। কোনভাবে এই ঔষধের মধ্যে কিছু নেই তো? মাসফি মনে মনে ভাবলে আজই অদিতির ডাক্তারের সাথে কথা বলতে হবে।

বোনকে কোলে করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ব্লাংকেট টেনে দিলো। একটা ঝড়ে বোনের জীবনটা তছনছ হয়ে গেছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মাসফি বিরবির করে চোয়াল শক্ত করে বললো,

— যে বা যারা তোর এই অবস্থার জন্য দায়ী তাদের আমি কাউকে ছাড়বো না। কাউকে না।

~~~জীবনের চলার পথে যখন আপনি পাশে কাউকে চাইবেন তখন একটা কাকপক্ষীও পাবেন না।আর যখন নিজেকে গুছিয়ে একা চলতে শিখে যাবেন তখন পাশে থাকা মানুষের ভিড় পরে যাবে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here