Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ১০
————————————————
“Be my student”
“What!”
হা করে রইলাম লিওর দিকে। আমার নিজের কানেও বিশ্বাস হচ্ছে না। সত্যিই কি লিও আমাকে পড়াতে চাইছে? নাকি সে আমার সাথে মজা করছে?
“মিইইইরা!”
“তুমি কি আমার সাথে ফান করছো?”
“অবশ্যই না। আমি সত্যিই বলছি। আমার কাছে প্রতিদিন ৩ ঘন্টা করে ম্যাথ কর। অন্যান্য সাবজেক্টেও আমি সাহায্য করব।”
“৩ ঘন্টা! তোমার সাথে!”
“হ্যা! সমস্যা কি?”
আমি উঠে দাড়ালাম। লিওর সাথে বক বক করার কোনো মানে হয় না। শুধুই সময় নষ্ট। তার চেয়ে বরং লাইব্রেরিতে যায়। ওখানে আমাকে সাহায্যে করার মত কোনো ভালো গাইড অবশ্যই পাব।
.
কিন্তু এখানেও লিও জোঁকের মত আমার পিছু লেগে থাকলো।
“মিইইইরা আই এ্যাম সিরিয়াস। আমার কাছে পড়। তাহলে তোমার এত পেট মোটা বই গুলো পড়তে হবে না।”
“শসসসসসসহ!”
আমি লাইব্রেরিতে একের পর এক বই চেক করে যাচ্ছিলাম আর লিও আমার কানে ফিস ফিস করে ওর স্টুডেন্ট হওয়ার এড দিচ্ছিলো। তার স্টুডেন্ট হলে কি কি বিষয়ে আমি লাভ বান হব সেই ফিরিস্তা ও বর্ণনা করছিলো। আমি বার বার করে চুপ হতে ইশারা করছিলাম। কিন্তু তার বক বক থামছিলনা।
অবশেষে আমি শুধু না শোনার ভান করে রইলাম। প্রায় আধা ঘন্টা ধরে ও আমার পিছু পড়ে আছে শুধু মাত্র আমার গুরু হওয়ার জন্য। অথচ আমরা গুরু বানানোর জন্য গুরুদের পিছু পিছু ঘুরতাম। মনে মনে হাসলাম। তিনটা ঘন্টা লিওর সাথে! অসম্ভব! একে তো সে ছেলে। তার উপর ডিম্পল ওয়ালা! পড়া লেখা আমার লাটে উঠবে। মা বলবে তোরে প্রেম করতে পাঠায় ছিলাম তাই না? ডিগ্রী নিয়ে আসার বদলে বান্দর একটা ধরে নিয়ে আসছিস! বান্দরী মেয়ে! তোর মামা ঠিকই বলে। তুই একটা বান্দরী।
হঠাৎ হাতে হেচকা টান পড়ল। চমকে উঠে পিছু তাকালাম। লিও আমার হাত ধরে রেখেছে। নিঃশব্দের সাগরে এটাই ইশারা থামার জন্য। আমি তীক্ষ্ণ চোখে লিওর দিকে তাকালাম। লিও একবার আমার চোখের দিকে, একবার হাতের দিকে তাকিয়ে হাতটা ছেড়ে দিল। তা পর মাথা নিচু করে বলল
“স্যরি!”
হাত ছেড়ে দিতেই ওর স্পর্শ করা স্থান টুকু মুছতে লাগলাম। কেমন যেন অনুভুতি হতে লাগল। উষ্ণতা ছেয়ে গেল চারদিকে। যেই উষ্ণতা কে আমি খুব ভয় পাচ্ছি লাম। না নাহ্! আমার আরো কঠোর হতে হবে। জোরে জোরে হাতের গিরাটা অপর হাতে ঘষতে লাগলাম। যেন স্পর্শ টুকু চলে যায়। কিন্তু সেটা সেটে রইল বেহায়ার মত। চুপচাপ বসতেই প্লাই উডের টেবিলের অপর পাশে লিও সহ বসলো।
ওকে না দেখার জন্য বইটা খুলে উচু করে এমন ভাবে রেখে পড়তে লাগলাম যাতে ওর চেহারা টা আমার চোখে না পরে। কিন্তু দু আঙ্গুলে বই টাকে ধপাস করে ফেলে কট মটে দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো।
“তুমি কি আমাকে ইগনোর করার চেষ্টা করছো? আমি কি দেখতে এতই খারাপ?”
এই বলে সে তার ফোনের স্ক্রীনে নিজের দিকে তাকালো। ঝাকড়া বাদামী চুল গুলো কে কপাল থেকে সরিয়ে দিতে দিতে আপন মনে বলল
“অতটা তো খারাপ না। দেখতে তো বেশ হ্যান্ডসাম আমি”
মনে মনে ভেঙচি কেটে বললাম
“বেশ হ্যান্ডসাম”
.
রুম মেটের পাঁচ জনের মধ্যে ইলি হল সবচেয়ে ভালো। কারো সাথে সাতে ও নেই পাচেও নেই। সব সময় বইয়ে মুখ গুজে পড়ে থাকে। আমার কাছে কেমন যেন স্বার্থপর বলে মনে হল। নিজের কাজ ছাড়া বাকি কারো কাজ সে কখনো করতে যাবে না। যতই খেটে মরুক বাকি জন।
ইভিলিন এর পরিচয় যেদিন এসেছিলাম সেই দিনই পেয়েছি। পড়াশুনার পাশাপাশি স্থানীয় একটা ম্যাগাজিনের জন্য মডেলিং করেসে। প্রায় সময় ডায়েটিং এ থাকতে হয়। সেদ্ধ, আধ সেদ্ধ, কাচা সবজি খেয়েই দিন পার করতে হয়। বেচারির জন্য আসলেই দুঃখ হয়। সে চাইলেও কখনো আমাদের মত হুট হাট বিরিয়ানি খেতে পারবেনা। এমন কেচো শরীর পাওয়ার জন্য যদি বিরিয়ানি কে ছাড়তে বলা হয় তাহলে আমি কখনো রাজি হতাম না।
লারা মিশুক প্রকৃতির। সবার সাথেই ভালো মিশতে পারে। তবে সমস্যা হল সে খুবই অলস। ফোন নিয়ে সারাদিন পরে থাকে। শুনেছি তার বিএফ আছে। কয়েক বার তারা রুম ডেটও করেছে। তার আসল গুণ হল মিষ্টি কথায় তার কাজ গুলো করিয়ে নেয়া।
সবশেষে হল স্কাই আর রেইন। দুজনে টুইন সিস্টার। কিন্তু কোন রুপ মিল তাদের নেই। একজন আরেক জনের বিপরীত। এদের ঝগড়াই অতিষ্ঠ হয়ে এদের প্যারেন্টস এখানে রেখে গেছে। যাতে দুজনে মিল হয়। কিন্তু মিল হওয়াতো দুরের কথা কেউ কারো চেহারা ভালো মত দেখেও না। যেদিন দেখে সেদিনই তুমুল ঝগড়া। আমার কাছে মাঝে মাঝে মনে হয় এরা আপন বোন না।
সারাদিনের ধকল সেরে সন্ধায় হোস্টেলে আসতেই শুনলাম রেইন আর স্কাই এর পানিশমেন্ট হয়েছে ঝগড়ার জন্য।
ব্যাপার টা নিয়ে তত ভাবি নি। কিন্তু গোসলের জন্য হোস্টেলের বাথরুমে যেতেই একটা ভিরমী খেলাম। দুজনে দু প্রান্তে দাড়িয়ে বাথরুমে মেঝে ঘসে ঘসে পরিষ্কারে করছে। কিছুক্ষন পর পর একে অপর জনের দিকে তাকাচ্ছে আর বির বির করে কিছু একটা বলছে। মনে হয় গালি দিচ্ছে।
আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম শাস্তির ধরন দেখে। পিছন থেকে লারা বলল
“এগুলো ঝগড়া করার পানিশমেন্ট! উফফ কি সাংঘাতিক! একটু বিশ্রাম নিতে পারি না দুজনের জন্যে।”
আমি আস্তে করে গোসল সেরে চলে আসলাম। গোসল সেরে কিছুক্ষন পড়তে বসলাম। কিন্তু খিদে পেয়েছে ভীষন। কিন্তু হোস্টেলের খাবার গুলো পেট কোনো ভাবে ভরলেও মনটা ভরে না। আমাকে কালই কোনো বাঙালি রেস্টুরেন্ট খুজে বের করতে হবে। উইনিপেগ শহরে বাঙালি নিশ্চয় কম না। আমার সন্দেহ ভুল না হলে এখানে অবশ্যই বাঙালি রেস্টুরেন্ট থাকবে।
.
পরদিন ক্লাসে বসে স্কার্ফ টা ঠিক করছিলাম। রাঘব আসতেই আমি তাকে ডাকলাম
“হেই রাঘব! প্লিজ সিট!”
উদ্দেশ্য ছিল ওকে সহ বাঙালি বা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট খুজে বের করা। কারন হোক না হোক সেও আমার মত খাবার কে ভীষন মিস করছে।
কিন্তু সে বসার জন্য কয়েক কদম এগিয়ে এসে আবার পিছু হটে গেল। তারপর অন্যত্র গিয়ে বসে পড়লো। ভুলেও আমার দিকে ফিরে তাকালো না। এভাবে সে ইগনোর করায় আমি খানিকটা কষ্ট পেলাম। কিছু বলতে যাবো তার আগেই পুরো গ্যাং মানে এডালিন, কার্ল, রিচা এবং সব শেষে লিও এসে ধপ করে আমার পাশে বসে গেলে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে ডিম্পল দেখিয়ে বলল
“হেই মিইইইরা! দ্যাটস মাই সিট।’
“এই সিট টা তোমার উইল করা সিট নাকি লিও?”
“হুম! এটা আমার উইল করা। দেখোনা এটা তে কেউ বসে না। সব সময় খালি থাকে।”
আমি শুধু লুকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কিছু একটা ভালো হচ্ছে না। একটু বাড়াবাড়ি বলে মনে হচ্ছে।
.
ফ্রি পিরিয়ডে সবাই ক্যান্টিনে গেলেও আমি তাদের দৃষ্টির আড়ালে সরে এলাম। উদ্দেশ্য দূরে থাকা। সবার থেকে না। শুধু মাত্র লিও থেকে। তার টোল পড়া হাসি থেকে। কখন মনের কোন দিক টাকে ঘায়েল করে হিসেব নেই। যখনি সে এক বিঘত গর্ত ওয়ালা ডিম্পল দেখিয়ে হাসতে দেখে তখনি মনে মনে সুরা নাস পড়তে থাকি যেন শয়তান আমার মাথায় না ঢুকে।
ব্রুডি সেন্টারের অপর পাশে স্টার বাক। প্রফেসর হুডই এটা আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। খুব ভালো কফি বানায় সেখানে। হাটতে হাটতে আমি সেখানে চলে এলাম।
বসে বসে কফি পান করছি। সামনে বই খোলা। কিন্তু পড়ার দিকে আমার তেমন নজর নেই। নজর কেড়ে নিচ্ছে বাইরে থাকা প্রকৃতি। হাতছানি দিয়ে যেন আমাকে ডাকছে। কাচের দেয়াল ভেদ করে পাইন আর সিডার গাছের মাঝে মাঝে সারি ম্যাপল গাছ কে দেখছি। বলিষ্ট বাতাসে সেগুলো দুলছে। যেন সুরের তালে নৃত্য করছে। বেশ চিকন শব্দে নর্দান কার্ডিনাল নামক লাল পাখি টি গেয়ে যাচ্ছে।
আকাশে এক ঝাক সোয়ালো পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। যেন তারা ভ্রমনে বেড়িয়েছে। রাস্তার মধ্যে কয়েক জন পথ চারি কেও দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ বাচ্চা নিয়ে হাটতে বেড়িয়েছে।
মনটা বেশ আয়েশি হয়ে গেল। চোখ বন্ধ করতেই যেন এক জোড়া ধুসর চোখ ভেসে উঠল। রবীন্দ্রনাথের মতই বলতে ইচ্ছে করছে
.
এমনও দিনে তারে বলা যায়-
এমন ও ঘোর হরষায়…
.
ঘোর বরিষা বলতে পারলাম না। বরষা ছাড়া ও যে এত সুন্দর একটি রুপ উইনিপেগে দেখতে পাওয়া যায় সেটা বোধ হয় রবীন্দ্রনাথ জানতেন না। জানলে বরষা হয়ত রবীন্দ্রনাথের এক্স হয়ে যেত।
.
(চলবে)
.
প্রেমের সুরভি আকাশে বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে। সেই বাতাসে ভূলে ও কেউ উড়তে যাবেন না। না হলে ঘূর্নিঝড়ের কবলে পড়বেন। ♥