আমার ভিনদেশি তারা পর্ব -১১

0
1890

Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ১১
————————————————
মাথার বাম পাশ টা ব্যাথা করছে। ঘুম ঘুম চোখে মাথা টা তুলে ডান দিকে রাখলাম। আহ্! খুব নরম আর উষ্ণ বালিশ। আরেকটু ভালো করে ঘুমাতে মাথা টা আরেকটু ভালো করে রাখলাম। কিছুক্ষন পর মনে হল বালিশ টা নড়ছে। বিন্দু বিন্দু ভাবে আমার গাল টা কে স্পর্শ করছে। ঘুমের ঘোরে কি মনে হচ্ছে এসব? চোখ বন্ধ অবস্থায়ই মাথা টা তুললাম। মাথা টা এদিক ওদিক হেলছে। ভার্সিটিতে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে নিশ্চয়। কিন্তু তন্দ্রা ভাবটা কাটছেনা। শুধুই ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে এদিক ওদিক পড়ে যাচ্ছি।
একটু করে চোখ টা খুললাম। সবকিছু ঝাপসা লাগছে। মাথার উপরের সব চুল চোখের উপর এসে পড়েছে। সামনের কিছুই দেখতে পারছিনা। খুবই বিরক্তিকর। বিরক্তির সাথেই বাম হাতে চুল গুলো সরিয়ে দিচ্ছি লাম। কিন্তু কেন যেন হাত টা নড়ছেনা। যেন কপালের চুলের সাথেই লেগে গেছে। তার মানে আবারো আমার হাত ঘড়ির সাথে চুল আটকে গেছে। তাই টানা টানি সত্ত্বেও সেটা ছুটছেনা। চোখ খুলে চুল গুলো ছাড়াতে যাব। ঠিক সে সময় একটা উষ্ণ স্পর্শ পেলাম। পরম যত্নে কেউ আমার হাত ধরে ধীরে ধীরে চুল গুলো ছাড়িয়ে নিচ্ছে। আমি খুব কষ্টে আমার ঘুমন্ত চোখ দুটোকে নিদ্রার দেশ থেকে ফিরিয়ে আনলাম। আবছা দৃষ্টিতে দেখলাম আমার কপালের উপর পড়ে থাকা বিরক্তিকর চুল গুলোকে কেউ সরিয়ে কানের পিছনে গুজে দিচ্ছে। চোখের উপর থেকে চুল সরে যাওয়ায় সামনের সবকিছু গোচরে আসল। তাকিয়ে দেখলাম ধুসর চোখের কেউ টোল পড়া মৃদু হাসিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
“লিও?”
“গুড ইভিনিং মিইইইরা!”
এ বলে সে আরো একবার মুচকি হাসলো। ওর হাসি দেখে আমি চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম। আমি কোথায় আছি? এটা কোন জায়গা? কিছুটা চেনা চেনা মনে হচ্ছে। হুট করে দাড়িয়ে গেলাম। ভালো করে চোখ কচলিয়ে দেখলাম এটা সেই কফিশপ। যেখানে আমি সবাইকে ফাঁকি দিয়ে কফি খেতে এসেছি।
মাথায় হাত দিয়ে দেখলাম চুল গুলো সব খুলে এলোমেলো হয়ে আছে। গালের বাম পাশ টা ব্যাথা করছে। নিশ্চয় লাল হয়ে আছে। ইশশশ! এই ভাবে লিওর সামনে! গলায় হাত দিতেই দেখলাম গলা খালি। আমার স্কার্ফ কই? ঘুমের বেঘোরে কোথায় পড়ে গেল?
কেউ স্কার্ফ বিহীন আমির দিকে তাকাচ্ছে কিনা খেয়াল করলাম না। অভ্যাস গত বাম হাত টা নিজের বুকে চাপা দিলাম। যাতে সবার নজর থেকে আড়ালে থাকে। মনে মনে চারদিকে স্কার্ফ টা কে খুজতে লাগলাম। কোথায় পড়ে গেছে সেটা? এদিক ওদিকে তাকিয়ে স্কার্ফ খুজছি।
“তুমি কি এটা খুজছো?”
“হাহ?”
তাকিয়ে দেখলাম লিও মিট মিট করে হাসছে। স্কার্ফ টা ওর হাতে শোভা পাচ্ছে। আমার স্কার্ফ টা ওর হাতে গেল কিভাবে? ওটা নিতে হাত বাড়াতেই লিও ঝট করে হাত সরিয়ে ফেলল।
“লিও? ওটা দাও!”
“উহু। এভাবে না।”
আমি শুধু নার্ভাস ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছি। স্কার্ফ বিহীন ভাবে কারো সামনে দাড়িয়ে থেকে অস্বস্থি হচ্ছিল। বারে বারে দু হাত নিজের বুকে জড়ো করছি।
“লিও প্লিজ ওটা দিয়ে দাও।”
“না।”
“প্লিজ লিও।”
“আমার একটা শর্ত আছে।”
“সব শর্ত মানবো। আগে স্কার্ফ দাও আমার।”
“শিউর তো?”
“সত্যিই বলছি।”
“ঠিক আছে তাহলে।”
লিও স্কার্ফ দিল। তবে আমার হাতে না।
সে নিজে এসে আমি ঠিক যেভাবে দিই সেভাবে পড়িয়ে দিতে লাগলো।
“লিও তুমি কি…”
“শসসসসসহ”
লিও আমাকে চুপ থাকতে বলছিলো। এদিকে আমার জান বেড়িয়ে যাচ্ছিলো। স্কার্ফ টা পড়িয়েই দু হাতে আমার চুল গুলো কে উপরে তুলে দিচ্ছিলো। ঘাড়ের মধ্যে ওর হাতের হালকা স্পর্শে বার বার শিউরে উঠছিলাম। ঠান্ডা লাগছিল ভীষন। এতটা কাছাকাছি তো মনে হয় আমি আমার কোনো বান্ধবীর ও ছিলাম না। আর লিও তো…
কয়েকটা মিনিট আমার মনে হল কয়েক যুগ। স্কার্ফ পড়িয়ে যখন সে একটু দূরে গিয়ে দাড়ালো তখনি আমি বড় একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। অনেক ক্ষন আটকে ছিলাম নিঃশ্বাস টা। গলাটা শুকিয়ে গেছে। সামনের টি টেবিলের উপর রাখা নীল বোতল টা নিয়ে ঢক ঢক করে পুরো বোতল টা শেষ করে দিলাম। এবার খানিক টা শান্তি লাগছে। এরপর আড়চোখে চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম। কেউ তাকাচ্ছে কিনা। নাহ্ যে যার যার কাজে ব্যস্ত। কেউ তাকাচ্ছে না। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
“লিও! তুমি এখানে কি করছো?”
“প্রশ্ন তো আমার করা উচিত। তুমি এখানে কি করছো?”
ঠোট বাকিয়ে জবাব দিল সে। আমার খুব বিরক্তি লাগল।
বই পত্র গুছিয়ে নিলাম। চলে যাব। যতক্ষণ লিওর সাথে কথা বলবো ততক্ষণে সে আমাকে পাগল বানিয়ে ছাড়বে।
“মিইইইরা!”
উদাস দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম।
“কি?”
“তুমি কিন্তু তোমার শর্তের কথা ভুলে যাচ্ছো।”
“শর্ত?”
মনে পড়লো কিছুক্ষন আগের শর্তের কথা। লিও ভ্রু যুগল কে উপরের দিকে তুলে নাচাতে নাচাতে বলল
“মনে পড়েছে?”
“ফাইন। বল কি চাও?”
“নাথিং! জাস্ট ওয়ান কফি উইদ মি!”
“ওকে”
.
লিওর কাছ থেকে ছাড়া পেতে অনেক বেগ পেতে হল। অবস্থা টা মোটেও শুভকর বলে মনে হচ্ছে না। কেন যেন মনে হচ্ছে ওর কাছ থেকে যত দূরে থাকা যায় তত ভালো। আসলে কারো সাথে এ নিয়ে কথা বলতে পারলে খুব ভালো হত। কিন্তু কার সাথে বলবো?
বইয়ের পাতা এদিক ওদিক উল্টাতে উল্টাতে লারার দিকে নজর পড়ল।
বাকি সবার চাইতে ওর সাথে আমার সম্পর্ক ভালো। কিছুটা ইতস্থত করে লারা কে পুরো ব্যাপার টা জানালাম। আমার কথা শুনতেই লারা হো হো করে হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে বেড থেকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হল।
“সিরিয়াসলি টামিনা! তোমার এটাই মনে হয়?”
“হুম। সমস্যা কি?”
“সে কি তোমাকে কিস করেছে?”
“নো!”
“তোমাকে ডেট অফার করেছে?”
“নো!”
“সে কি বলেছে তোমাকে সে পছন্দ করে?”
“নো!”
“তাহলে কিভাবে এত কিছু বুঝলে? ডোন্ট মাইন্ড টামিনা! জাস্ট থিংক। ভার্সিটিতে এত হোয়াইট ককেশিয়ান সুন্দরি থাকতে ওই ছেলে কেন পুওর থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রির কালো চামড়ার মেয়ের পিছনে ঘুরবে?”
আমি দমে গেলাম। সত্যিই তো! আমি কিভাবে এত কিছু বুঝলাম? অনেক ভাবলাম। কোনো যৌক্তিক কারন পেলাম না। কিন্তু আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে অন্য কথা। মাথা থেকে সব ঝেড়ে দিলাম। এসব ভাবলে চলবেনা। সব আমার গোবর ভরা মাথার অতি উচ্চ কল্পনা। আমাকে পড়তে হবে।
বাংলাদেশ থেকে মামা কিছু টাকা পাঠিয়েছে। সকালে সেগুলো এক্সচেঞ্জ করে নিয়ে আসতে আসতে ভার্সিটির টাইম ওভার হয়ে গেল। যদি ও বা ১/২ ক্লাস করতে পারতাম। কিন্তু ক্লান্ত শরীরে করতে পারি নি। এসেই ঘুমিয়ে পড়লাম। বিকেলে তৈরি হয়ে বাইরে বেরুলাম। কিছু কেনাকাটা বাকি আছে। স্কার্ফ টা গলার সাথে জড়াতেই বিপ বিপ শব্দ আসলো। ফোনের মেসেজ টুন। বেশ কয়েক ঘন্টা ধরে ফোনটা বন্ধ হয়ে ছিল। সবে ওপেন করেছি । সাথে সাথে মেসেজ। ওপেন করলাম। একটা আননোন কানাডিয়ান নাম্বার থেকে মেসেজ
“তুমি কোথায়? আসো নি কেন আজকে?
কে হতে পারে? কোথায় আসি নি? ক্যাম্পাসে? ক্যাম্পাসে কে করবে? সবার নাম্বার তো আমার কাছে আছে।
বিষয় টা পড়ে দেখবো ভেবে ফোন টা রেখে দিলাম।
আলেকজান্ডার এভে রোডেরর উপরেই একপাশে চার্চ টা পড়ে। সালিম মেনোনিট ব্রেথ্রেন চার্চ। চার্চ আমি প্রথম বার দেখছি। অনেক কৌতুহল হলেও ঢোকার সাহস হল না। পাশ কাটিয়ে চলে গেলাম। ও কেই নামক গ্রোসারি শপ থেকে হালকা কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনে শপিং মলে ছুটলাম। যদিও বা আমার বাজেট কম তারপরও দেখলাম কম বাজেটের চাহিদা অনুযায়ী শপিং করা যাচ্ছে।
.
রাতে মামা কে ফোন করলাম। উদ্দেশ্য এটা বলা যে আমি টাকা ঠিক মত উত্তোলন করতে পেরেছি। কিন্তু ফোন ধরল মামী।
“কেমন আছো তাহমিনা?”
“ভালো। আপনি কেমন আছেন মামী?”
“এইতো। তুমি যে রকম রেখে গিয়েছিলে!”
উত্তর টা আদৌ আমার পছন্দ হল না। তারপরও মুখে হাসি টেনে বললাম
“মামা কোথায়?”
“তোমার মামা হাসপাতালে। আর আমি তোমার মামার পাশেই বসে আছি।”
বুক টা ধক করে উঠল।
“কি হয়েছে মামার?”
“তুমি জানো না কি হয়েছে? সত্যিই কি জানো না নাকি ন্যাকামো দেখাচ্ছো তাহমিনা?”
“মা-মামিই?”
হঠাৎ করে মামার কন্ঠ শুনতে পেলাম।
“তাহমিনা!”
“মামা! কেমন আছো? কি হয়েছে তোমার?”
মামার হাসির শব্দ শোনা গেল।
“কিছু হয় নি আমার। আমি ভালো আছি।”
“তাহলে তুমি হাসপাতালে কেন?”
“ও কিছু না। সামান্য আঘাত পেয়েছিলাম। এজন্য এসেছি। তোর মামী বাড়িয়ে বলছে। তেমন কিছু হয় নি।”
“মামা সত্যি বলছো তো?”
“সত্যি রে বাদরী। আচ্ছা বল টাকা পাঠিয়েছিলাম। পেয়েছিস?”
“হ্যা মামা।”
“ভালো তাহলে। এখন রাখ। কানাডা তে এখন নিশ্চয় রাত?”
“হুম”
“তাহলে ঘুমিয়ে পড়। বেশি রাত জাগিস না।”
“আচ্ছা।”
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here