আমার ভিনদেশি তারা পর্ব -১২

0
2015

Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ১২
————————————————
মামার সাথে কথা বলে মনটা কেমন ছট ফট করছে। বুঝতে পারছিনা কেন এমন হচ্ছে। চোখে ঘুম আসছেনা। এ মুহুর্তে কি করলে মনটা হালকা হবে?
আম্মা থাকলে উনার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়তাম। কিন্তু আম্মা এখন আমার চাইতে হাজার হাজার মাইল দূরে।
.
কি করে ফেললাম আমি এসব? করার আগে এর পরিণতি কেন এক বারও ভাবলাম না। কি হয়ে যেত বিয়ে টা করলে? আমি এত পাগল কেন? কি আছে এ ভিনদেশে? কেন এলাম আমি?
নিজেকে নিজে প্রবোধ টাও দিতে পারতেছি না। ঝাপসা দেখছি সব কিছু। এখন কি হবে? কি করবো আমি?
বাইরে রাতের আকাশ টা গাঢ় নীল রং ধারন করেছে। জ্বল জ্বল তারা গুলো কে কান্নার ফোটা বলে মনে হচ্ছে। আজকে একদমই মনে হচ্ছে না হীরা খচিত নীল শাড়ি পরিহিতা কোনো রমণী। বরঞ্চ মনে হচ্ছে দুঃখ বিলাসী কন্যার দুখী রুপ।
.
এ প্রথম প্রবাসে নিদ্রা বিহীন রজনী কাটালাম। ভাবতেই পারলাম না কোন দিকে রাত টুকু কেটে গেছে। সবাই বেড থেকে উঠে যে যার যার কাজে চলে গেলেও আমি বেড থেকে উঠলাম না। মৃত মানুষের মত শুয়ে রইলাম।
পুরো দিন রুমের বাইরে বেরুই নি। খেতে যাই নি, ভার্সিটিতে যাইনি। মন খারাপ গুলো পুরো মনে কব্জা করে রেখেছে। চোখ দুটো বিশ্রাম চাইছে। কিন্তু পানি দিয়ে মুখ দিয়ে, কান্না করে তাদের কে শাস্তি দিচ্ছি।

ফ্লোরে মাথা রেখে ভারী আশ্চর্যের মত আকাশ পাতাল ভাবছিলাম। ফোনের স্ক্রিনে হাত ঘুরিয়ে ফোন টা একবার লক করছিলাম একবার আনলক করছিলাম। কয়েকবার মামা কে ফোন করে তার হাল চাল জিজ্ঞেস করেছি। সন্তোষজনক কোনো উত্তর পাচ্ছি না। মামা বার বারই বলছে ভালো আছে। তারপরও কেমন যেন স্বস্তি পাচ্ছি না।
হঠাৎ করেই ফোন টা বেজে উঠল। ফোনের স্ক্রীনে প্রফেসর হুড এর নাম ভেসে উঠছে।
“হ্যালো”
“টামিনা?”
“ইয়েস প্রফেসর!”
“তুমি কি একটু এখানে আসতে পারবে? তোমার সাথে একটা জরুরী কথা ছিল।”
“আমার ও কিছু কথা আছে।”
“তাহলে চলে এসো। আমি অপেক্ষা করছি।”
হঠাৎ করেই যেন একটা সিগ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। গায়ের উপর জিনসের কোর্ট টা চাপিয়ে স্কার্ফ হাতে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। যেতে যেতে স্কার্ফ টা গলায় পেচিয়ে নিলাম। প্রফেসর হুডের বাড়ি বেশি দুরে না। ক্যাবে করে গেলেও কয়েক ডলারের পথ। হেটেও যাওয়া যায়। তবে আমি ক্যাব নিলাম।
যখন সেখানে পৌছলাম প্রফেসার হুড চিন্তিত ভাবে এদিক ওদিক ভাবে পায়চারী করছিলেন। আমাকে দেখে প্রায় দৌড়ে এলেন।
“গুড ইভিনিং স্যার”
“গুড ইভিনিং টামিনা। কেমন আছো তুমি?”
শুকনা হাসি হেসে বললাম
“ভালো স্যার। আপনি?”
“আমি একটু চিন্তিত টামিনা।”
“কি হয়েছে?”
“তুমি নাকি দু দিন ধরে ভার্সিটিতে যাচ্ছো না?”
“হ্যা স্যার। কিছু সমস্যার কারনে যাওয়া হয় নি।”
“এডওয়ার্ডের সাথে দেখা হয়েছিলো?
“এডওয়ার্ড…”
“মানে লিওর কথা বলছিলাম।”
“নো স্যার।”
প্রফেসারের কুঞ্চিত ভ্রু সিধা হল। তিনি একরাশ হাসি দিয়ে বলল
“এমনিই বলছিলাম। কোনো সমস্যা নেই।”
“আচ্ছা।”
মনে মনে বললাম ওর সাথে আর দেখায় হবে না। প্রফেসার হুড বলল
“তুমি কি বলতে চাইছিলে?”
“স্যার আমি বাংলাদেশে ফিরে যেতে চাই। আমি এ সেমিষ্টার ড্রপ করতে চাই।”
“হোয়াট! নো টামিনা! কি বলছো এসব? পাগল হয়েছো নাকি? কি সমস্যা আমাকে খুলে বল।”
একটু স্মিত হেসে বললাম
“না স্যার তেমন কোনো সমস্যা নেই। আমার এখানে ভালো লাগছে না। তাই চলে যেতে চাইছি।”
“টামিনা ভুল করিও না। এ সুযোগ টা আরেক বার পাবেনা। ভেবে দেখো।”
মনে মনে হেসে বললাম এই তুচ্ছ ডিগ্রির চাইতে দামী জিনিস আমার হারিয়ে যেতে বসেছে।
“দেখবো স্যার”
বেড়িয়ে এলাম ওই খান থেকে। আসার সময় জ্যাক আর জিল এর সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম। বলতে চেয়েছিলাম তাদের ভালোবাসা কে আমি যত্নে রেখেছি। কিন্তু তাদের কে পেলাম না। কোথায় নাকি গেছে।
প্রায় কয়েকদিন ভার্সিটিতে যাওয়া হলো না। পড়ালেখা থেকে আগ্রহ হারিয়ে গেছে। সারা দিন মন মরা হয়ে থাকি। কারো সাথে কথা বলতেও ইচ্ছা হয় না। প্রায় সময় ফোন টা সুইচড অফ থাকে। বাড়িতে যেতে চেয়েও পারছিনা। ভিসা সংক্রান্ত ঝামেলায় আটকে পড়েছি। ভার্সিটিতে ও কিছু কাজ বাকি পড়ে গেছে। কিছু নোট ফেরত দিতে হবে।
এ সময় টুকুতে আমার রুম মেটরা যে আমার দেখাশোনা করেনি তা কিন্তু নয়। বিশেষ করে লারা আর ইভিলিন আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। লারা মনে করে আমি লিওর প্রেমে হাবু ডুবু খেয়ে এ অবস্থা হয়েছে। প্রায় ডিনারে আমাকে সে সিজার অফার করে। আমি হাসি মুখেই অফার টা ফিরিয়ে দিই।
পরদিন আমি ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বের হই। আজকে আর নিজেকে উৎফুল্ল বলে মনে হচ্ছে না। ম্যাপল গাছ গুলো কেমন নিস্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছে। সিডার গাছ গুলোর পাতা আজ একটু নড়ছে না। সোয়ালো পাখি গুলো আজ আকাশ জুড়ে উড়ছে না।
কাঁধের ব্যাক প্যাক টা আজ ভীষন ভারি লাগছে। স্কার্ফ টা গলা ছেড়ে ওড়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমি থামানোর কোনো চেষ্টায় করছি না।
ভিতরে ঢুকতেই বেশ হালকা সুগন্ধি যুক্ত বাতাস নাকে ধাক্কা মারলো। কারো পারফিউম হবে। আমি এগিয়ে গেলাম। হেড অফিসের কিছু কাজ সেরে লনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। অনেক টা মুখ চোরা ভাবে। যাতে কারো নজরে না পড়ি। খানিকটা মাথা নিচু রেখে হেটে যাচ্ছি। সামনে থেকে কে আসছে কে যাচ্ছে দেখছিই না। এভাবে করিডোর বেয়ে যেতেই দেয়ালের সাথে দুম করে মাথায় একটা বাড়ি খেলাম।
“উহ্ আল্লাহ”
মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে সামনে তাকালাম। আমার জানামতে এখানে কোনো দেয়াল থাকার কথা না। কিন্তু সামনে তাকাতেই আমার হৃদ কম্পন বেড়ে গেলো। কারন সামনে লিও দাড়িয়ে আছে। ধুসর চোখ দুটোর চার পাশে কালচে ভাব চলে এসেছে। ফর্সা মুখ মন্ডল টা এক রকম লাল হয়ে আছে। বাদামী চুলো গুলো কেমন রুক্ষ রুক্ষ হয়ে এদিক সেদিক উড়ছে। টোল টা একদমই দেখা যাচ্ছে না। নেভী ব্লু রংয়ের শার্ট টা তাকে আপোষ হীন ভাবে জড়িয়ে ধরেছে। প্রথম কয়েকটা বোতাম খুলে দেওয়ায় ফর্সা বুকটা নজরে চলে আসছে। বুকের উপর আলতো ভাবে লকেটের ক্রস চিহ্ন টা বসে আছে। দু বাহুর পেশি ফুলে উঠেছে। বেশ কিছুটা শুকনা লাগছে তাকে। জিন্স কোট টা ভাজ করে হাতে নেওয়া।
এক দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণ চোখে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এমন কি পলক ও ফেলছে না। এমন তীক্ষ্ণ ভাবে দেখার কি আছে?
পরিস্থিতি ভালো ঠেকছে না। ক্লাস টাইম হওয়ায় চারপাশে স্টুডেন্ট এর সংখ্যা ও নগন্য। একটা ঢোক গিললাম। অস্বস্থি টা কাটানোর জন্য একটু হাসলাম। কিন্তু ওর চেহারায় কোনো ভাবান্তর নেই।
“হা-হাই লিও”
সব নিঃশব্দ। শুধু একটু একটু বাতাসের শো শো আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। আমার হার্ট বীট বেড়ে যাচ্ছে। গরম লাগতে শুরু করেছে।
“তুমি কেমন আছো?”
এবার জবাবের বদলে এক পা সামনে এগুলো। আমি খানিকটা চমকে উঠলাম।
“লিও?”
কোনো জবাব না দিয়ে লিও আরো কয়েক পা এগিয়ে এলো। আমি দূরত্ব সৃষ্টির জন্য পিছু হটছি।
“লি-লিও কি-কি হয়েছে?”
জবাব বিহীন দৃষ্টিতে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
এবড়ো থেবড়ো ভাবে পিছু হটতে হটতে শেষ মাথায় পৌছেছি। বেশি অসতর্ক হলে কয়েক তলা থেকে নিচে পড়ে একদম উপরে আল্লাহর কাছে পৌছে যাব। মাঝ খানে ব্যবধান শুধু কোমড় অবধি স্টিলের বেষ্টনী। পিঠ ঠেকে গেলে অসহায় দৃষ্টিতে লিওর দিকে তাকালাম। এরকম পরিস্থিতিতে আমি কখনোই পরি নি। করুন স্বরে ডাকলাম
“লিও?”
একটুর জন্য ওর চোখ দুটো কেঁপে উঠলো। কিন্তু পরক্ষনেই সে নিজেকে সামলে নিল। ভ্রু দুটো কুঞ্চিত হল। চোখ দুটো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো।
দু হাতে আমার কোমড় টা এক ঝটকায় তুলে লোহার চেপ্টা বেষ্টনীর উপর বসিয়ে দিল। আমি পিলে চমকে উঠলাম। পড়ে যেতে গিয়েও লিওর শার্ট টা খামছি দিয়ে ধরলাম।
“লি-লিও কি-কি করছো তুমি? ছাড়ো আমাকে! আমি পড়ে যাবো”
একবার নিচে তাকাচ্ছি একবার লিওর দিকে। ওর কোনো ভাবান্তর নেই।
“লিও আমার ভয় করছে। ছাড়ো বলছি। ও আল্লাহ”
প্রথম বারের মত লিও কথা বলল
“আর কখনো আমাকে না জানিয়ে গায়েব হবে?”
ও কি বলছিলো বুঝতেছিলাম না। আমার গায়েব হওয়ার সাথে ওর সম্পর্ক কি?
“লি-লিও?”
“আমি যেটা জিজ্ঞেস করেছি উত্তর দাও।”
আমি মাথা নাড়লাম।
“না নাহ্ একদম না”
“আমার ফোন ইগনোর করবে?”
“করবোনা!”
“আমার টেক্সটের রিপ্লাই দিবে?”
“দি-দিব”
“আমাকে হোস্টেলের ঠিকানা দিবে?”
“দি-দিব”
“আমার স্টুডেন্ট হবে?”
“হব”
“শিউর তো?”
কাঁপা কাঁপা গলায় জবাব দিলাম।
“হুম!”
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here