আমার ভিনদেশি তারা পর্ব -১৩

0
1844

Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ১৩
————————————————
হঠাৎ করেই লিও হো হো করে হেসে উঠল। তারপর হাসতে হাসতেই আমাকে আলতো করে ছেড়ে দিল। এমন ভাবে পেটে হাত দিয়ে হাসতে লাগল যে তার চোখে পানি এসে গেছে। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। বুঝতে পারলাম না এত হাসির কি হল?
“লিও?”
“মিইইইরা নিজের দিকে দেখো? কেমন দেখাচ্ছে তোমাকে? এতটা ভীতু তুমি?
“তুমি আমার সাথে এ-এতক্ষন মজা করছিলে? সিরিয়াসলি লিও?
হাসি মুখেই জবাব দিল লিও
“নট রিয়েলি। আমি মজা করছিলাম না। এতদিন কেন আসো নি চিন্তায় পরে গিয়েছিলাম। প্রফেসার বাড়িও গিয়েছিলাম। তোমাকে খুজতে। কিন্তু তুমি ওখানে ছিলে না।”
হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। একটা প্রশান্তির সুক্ষ বাতাস বুক থেকে বেড়িয়ে গেল।
এত হাসি খুশি প্রাণ চঞ্চল চেহারার পিছনে এরকম টা ভয়ঙ্কর চেহারা থাকতে পারে তা আমি ভাবি নি। কিছুক্ষনের জন্য মনে হচ্ছিল ধুসর চোখ গুলো দিয়ে যেন সব কিছু গিলে খাবে।
“মিইইইরা?”
চোখের সামনে চুটকি বাজাতেই হুশ ফিরে আসলো।
“হুম?”
“আজকে কোর্টে আসিও”
“কিসের কোর্টে”
“রাঘবি কোর্টে!”
“রাঘবি…”
“হুম। আচ্ছা আমি যাই। প্রচুর প্র্যাকটিস করতে হবে। তুমি আসবে কিন্তু।”
“আচ্ছা।”
.
রিচা আর এডালিন কে ক্যান্টিনেই পেলাম। তারা দুজনে আমাকে দেখে খুশি হল। রিচা তার কোকরানো কালচে বাদামী চুল দুলিয়ে আমাকে বলল
“তুমি এত দিন আসো নি কেন? জান তো বেশি ক্লাস মিস করলে সেমিষ্টার ড্রপ করতে হবে।”
“এমনি! একটু অসুস্থ ছিলাম। কাল থেকে আর মিস করবো না।”
“এই তো গুড গার্ল”
“আচ্ছা কার্ল কোথায়? ওকে দেখছি না?”
এডালিন কফি তে চুমুক দিয়ে বলল
“ওদের আজকে ম্যাচ আছে”
“কিসের ম্যাচ? ক্রিকেট?”
“নো রাঘবি। কিছুক্ষন পরেই শুরু হবে।”
“রাঘবি?”
আমি বুঝে উঠতে পারলাম না। রাঘবি টা কি? এডালিন উঠে দাড়ালো
“কোর্টে চল। এতক্ষনে নিশ্চয় শুরু হয়ে গেছে।”
.
রিচা আর এডালিন এর সাথে কোর্টে প্রবেশ করলাম। অনেকটা ভলিবল কোর্টের মতই। চারপাশে ফুটবল মাঠের মতই ছোট খাট গ্যালারী আছে। পুরো ইউনিভার্সিটি এখানে উপস্থিত না থাকলেও অনেকেই দেখলাম ছোটখাট পতাকা, ব্যানার আর প্ল্যাকার্ড হাতে। যেন জম জমাট ফুটবল ম্যাচ শুরু হবে। আমার অবশ্য ফুটবল পছন্দ না। একটা বলের পিছনে ২২ জন প্লেয়ার হুড়োহুড়ি করে দৌড়ায়, মারামারি করে কি মজা টা পায় আমি এখনো বুঝতে পারি নি।
আমার তিনজন মাঝামাঝি সিটে বসলাম। এডালিন ব্যাগ থেকে বের করে আমার হাতে একটা প্ল্যাকার্ডের ন্যায় একটা কাগজ দিল। সেখানে বড় বড় অক্ষরে কার্লের নাম লিখা। সে ও একটা নিল। আর রিচার হাতে ছোট্ট রুমাল।
কয়েক মিনিটের মধ্যে প্লেয়াররা কোর্টে প্রবেশ করল। ওরা ঢুকতেই সবাই চিৎকার করে তাদের কে স্বাগত জানাচ্ছিল। রিচাও লাফাতে লাফাতে চিৎকার করতে লাগল। আমার কাছে সবকিছু অদ্ভুদ লাগছিল। প্লেয়ার দের পোশাক টাও ফুটবল জার্সির মত লাগছিল। খেলাটাও বিদঘুটে। কাজু বাদামের মত বড় সাইজের বল হাতে নিয়ে দৌড়াচ্ছিল। এদের মাঝে অনেক কষ্টে কার্ল আর লিও কে খুজে বের করলাম।
খেলা জম জমাট ভাবে শুরু হয়েছে। সবাই খেলা উপভোগ করছে। না বুঝলেও আমি লিওর দলকে সাপোর্ট করে যাচ্ছি। এরই মধ্যে রিচা বড় একটা প্যাকেটে পপকর্ন নিয়ে এলো। খেতে খেতেই চারদিকে তাকাচ্ছিলাম। এমন সময় চশমা পরা চিকন শরীরের রাঘব কে এগিয়ে আসতে দেখলাম। সে এদিক ওদিক ইতি উতি তাকিয়ে সুবিধা জনক সিট খুজছিলো নিশ্চয়। আমার সাথে চোখাচোখি হতেই আমি ইশারা করলাম হাত দিয়ে। ইশারা পেয়ে সে প্রথমে চশমা ঠিক করল। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। ও আসলে আমি তাকে আমার পাশের সিট অফার করলাম বসার জন্য। আমাকে থ্যাংকস জানিয়ে সে বসে গেল।
রাঘব নামের শ্যামলা ছেলেটা আসলেই ভালো। মেধার জোরে উত্তর প্রদেশের কোনো এক অখ্যাত গ্রাম থেকে সে এখানে উঠে এসেছে। যেটা অনেক টা ভাগ্যের ব্যাপার। ওর সাথে কথা বলতে বলতে সময় কোনো দিকে চলে গেল বুঝতেই পারলাম না।
খেলা শেষে সকলের হাত তালিতে হুশ ফিরল। রিচা আর এডালিন প্ল্যাকার্ড উচিয়ে লাফাচ্ছে। ওকে জিজ্ঞেস করতেই বলল ওদের সাপোর্ট করা দলটাই জিতে গেছে। তারমানে লিও রা জিতে গেছে। কিন্তু লিও কোথায়? তাকে তো দেখা যাচ্ছে না। কার্ল কে তো দেখা যাচ্ছে। কোথায় গেল সে?
.
কোর্টের বাইরে আমরা চার জন দাড়িয়ে আছি। আমি, এডালিন, রিচা আর রাঘব। বিজয়ী দল হিসেবে লিও আর কার্লের ট্রিট দেয়ার কথা।
আমার দেখাদেখি এডালিন আর রিচা রাঘবের সাথে কথা বলছে। মনে হচ্ছে তারা এই ঘন ঘন চশমা ঠিক করা ভারতীয় ছেলে টিকে বেশ পছন্দ করেছে। এডালিন ওর লাজুকতা টা বেশ উপভোগ করছে। কিছুক্ষন হাসলাম ব্যাপার টা নিয়ে। এরই মধ্যে হঠাৎ করে লিও কোথ থেকে উপস্থিত হল। ঘমার্ক্ত শরীরে হাত কাটা গেঞ্জিতে কাধে ব্যাগ নেয়া। সে এসেই মাত্র বলল
“মিইইইরা তোমার সাথে আমার কথা আছে”
ওর শক্ত চোখ মুখ দেখে সবার হাসি মিলিয়ে গেল। আমি একটু হাসার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। রিচা ওর দৃষ্টি আকর্ষন করার চেষ্টা করল। কিন্তু ও কারো দিকে তাকালো না।
“বল”
“এখানে না”
“তাহলে কোথায়?”
“চল আমার সাথে”
এ বলে আমার জবাবের অপেক্ষা করল না। আমার হাতটা ধরেই টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। লিওর হঠাৎ এরুপ আচরনে আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। বুঝতে পারলাম না হঠাৎ কি হল।
“কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমাকে? ছাড়ো বলছি! লিও?
লিও আমার কোন কথায় শুনলো না।
ক্যাম্পাসের শেষ মাথায় এসে লিও আমার হাত ছাড়ল।
“কি সব পাগলামি করছো তুমি? সবার সামনে থেকে এভাবে টেনে নিয়ে এলে কেনো?
“আমি পাগলামি করছি তাই না? তাহলে রাঘব কি করছিলো? তার সাথে কিসের এত সখ্যতা?”
আমি খানিকটা সন্ধিগ্ন চোখে বললাম
“Are you jealous leo? Tell me!”
“একদম না। আমি কেন জ্বলুনি অনুভব করব?”
লিওর চেহারা দেখে আমি হেসে দিলাম। ফর্সা চেহারা টা খেলার কারনে আগেই রক্তিম আকার ধারন করেছিল। কিন্তু এখন ফোলা ফোলা নাকে পুরোটাই বিদেশী টমেটোর মত মনে হচ্ছে।
.
“কাম অন লিও। ও খুব ভালো ছেলে।”
এরই মধ্যে সবাই এসে গেলে। সবাই কে লিও আর কার্লের পক্ষ থেকে লাঞ্চ করানো হল।
চলে আসার আগে পিছন থেকে লিও আমাকে ফিস ফিসিয়ে বলল
“হেই ফ্লাওয়ার গার্ল! কালকে থেকে আমার কাছ থেকে লেসন নেয়ার জন্য তৈরি থেকো।”
আমি হা করে ওর দিকে তাকালাম। বিনিময়ে সে তার এক বিঘত গর্ত ওয়ালা ডিম্পল টা দেখিয়ে এক চোখ টিপ মারলো। বলতে গিয়েও কিছু বলতে পারলাম না আমি। গলায় কথা আটকে গেলো।
.
হোস্টেলে আসার পর মজার একটা ব্যাপার শুনলাম। গার্লস হোস্টেলের পাইপ লাইন বেয়ে গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে এসে বয় ফ্রেন্ড ধরা খেয়েছে।
এখন জোড়া কবুতর দুটোকে ডিন অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সাথে তাদের গার্ডিয়ান কেও খবর দেয়া হয়েছে।
পুরো ব্যাপার টা জানলাম লারার কাছ থেকে। সে বলল বয়ফ্রেন্ডেরর সাথে রাগ করে নাকি মেয়েটা দেখা করা বন্ধ করে দিয়েছিলো। এমন কি ফোনেও কথা বলছিলো না। মাত্র একদিনের ব্যাপার। এরই মধ্যে বয়ফ্রেন্ড বিরহে পাইপ বেয়ে গালর্ফ্রেন্ডেরর কক্ষের কাছাকাছি আসতে গিয়ে হাত ছুটে চামচিডের ওপর পড়ে। পরে তার চিৎকার শুনে সবাই এসে তাকে সেখান থেকে রক্ষা করে।
শুনে কতক্ষণ হাসলাম। আল্লায় জানে পৃথিবী তে কত ধরনের পাগল আছে।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here