আমার ভিনদেশি তারা পর্ব -১৪

0
1874

Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ১৪
————————————————
রাতে মামার ফোনে অনেক ট্রাই করলাম। কিন্তু মামার ফোন বন্ধ আসছিলো। হয়ত কোন কারনে ফোন সুইচড অফ। বাইরে থেকে শোরগোলের শব্দ আসছে। এখনো জোড়া কবুতর দুই টা কে কল্পনা জল্পনা চলছে। হোস্টেলের প্রায় মেয়ের বয়ফ্রেন্ড আছে। সুতরাং এটাকে নিয়ে শোরগোল কেন হল?
কারন টা হল ওরা আন্ডার এইজ। ছেলেটা টুয়েন্টি হলেও মেয়েটি সেভেন্টিন। যদিও বা কানাডা তেমন রক্ষনশীল কান্ট্রি নয় তবুও এখান কার প্যারেন্টস রা চায় না তাদের বাচ্চারা আন্ডার এইজে প্রেম করুক। সেটা একদম স্বাভাবিক।
.
ভোরে সকলের চেচামেচিতে উঠতে হলে। চারদিকে আবছা অন্ধকার। আমি ঘুম কাতুরে মানুষ। রোদ যতক্ষণ না আমার চোখে এসে পড়েছে ততক্ষণ আমি ঘুম থেকে উঠি না। তাই অন্ধকারাচ্ছন্ন দেখে বালিশ টেনে আমি আবারো শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ইভিলিন এর কারনে ঘুমাতে পারলাম না। চোখ টেনে খুলতেই দেখলাম অদ্ভুদ পোশাক পড়ে সে আমার সামনে দাড়িয়ে আছে। স্পোর্টস ব্রা সাথে জ্যাকেট, মাথায় পনিটেইল, পায়ে কেডস আর হাতে একটা পানির বোতল। এরকম গেট আফ আমি টিভি সিনেমায় বেশি দেখেছি। বিশেষ করে জগিং, ব্যায়াম বা শারীরিক কসরতের পড়ে থাকে। পিছনে স্কাই আর রেইন তৈরি হচ্ছে। লারা কে কোথাও দেখা গেল না। ইলি মাত্রই বাথরুম থেকে বেড়ুচ্ছে। আমি ইভিলিনের কোমড়ে হাত দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কেডসের ফিতা বাধা দেখে কিছুটা আন্দাজ করতে পাচ্ছি। ইভিলিন আমাকে উঠতে না দেখে বার বার কড়া চোখে তাকাচ্ছে। তার মানে একটাই হতে পারে।
নতুন বলে তোমাকে অনেক ছাড় দিয়েছি। এখন থেকে প্রতিদিন জগিং করতে ভোরে উঠতে হবে। না হলে তোমার খবর আছে।
আমি আস্তে করে ওর নজর এড়িয়ে পাতলা আয়েশি কম্বলটা মাথার উপর দিয়ে এক পাশে সরে শুয়েছিলাম। যাতে ওর নজর টা আমার উপর কম পরে।
কিন্তু বিধি বাম। ইভিলিন ঝট করে আমার মাথার উপর থেকে কম্বল টা সরিয়ে নিল।
“হেই লেইজি গার্ল। কাম অন। গেট আপ!”
“প্লিজ ইভিলিন! একটু ঘুমাতে দাও না। একটু পরেই আসছি।”
“উহু! এমন টা হবে না। উঠো এখনি। না হলে তোমার নামে কমপ্লেইন করব।”
অগত্য উঠতে হল। ঝিমাতে ঝিমাতে ফিল্ডে এসে দেখি আবছা অন্ধকারে হোস্টেলের প্রায় মেয়ে ফিল্ডে। হালকা ফিনফিনে পিউর বাতাসে কেউ দৌড়াচ্ছে, কেউ পুশ আপ করছে, কেউ স্কিপিং রেস দিচ্ছে। কেউ বা সাধারন শরীর গরম করছে। এটা এ হোস্টেলের একটা নিয়ম। নিয়মিত ভোরে শরীর চর্চা করতে হবে।
এসব ব্যাপারে আমি অনভিজ্ঞদের তালিকায়। তাই ইভিলিন দৌড়াতে শুরু করলে তার পিছু পিছু দৌড়াতে লাগলাম। কিন্তু মনে হল ইভিলিন অস্বাভাবিক মাত্রায় দৌড়াচ্ছে। যেখানে আমি এক চক্কর লাগাচ্ছি সেখানে সে তিন চক্কর লাগচ্ছে। তার কসরত দেখে তাকে আমার মানুষ বলে মনে হল না। যেন একটা আস্ত রবার। যেন যেদিকে টানবে সেদিকে যাবে।
ব্যায়াম করে আমার অবস্থা খুবই করুন। পায়ের গিটে গিটে ব্যাথা করছে। ইভিলিন বলেছে
“প্রথম প্রথম এই রকম হবে। এটা স্বাভাবিক। তুমি বরং পেইন কিলার নাও। তাহলে ঠিক হয়ে যাবে”
.
ক্যাম্পাসে রিচার সাথে দেখা হল সবার আগে। সে ইতি উতি করে কাউকে খুজছিলো।
“কাকে খুজছো?”
“এডালিন কে! তুমি দেখেছো তাকে?”
‘মাত্রই তো এলাম। এখনো দেখি নি।”
এডালিন এলো লেইট করে। টিচারের বকা খেয়েও যেন তার চেহারায় রক্তিম আভা ফুটে ছিল। মনে হচ্ছিল তাতে বকা দিচ্ছে না। কোনো রোমান্টিক কবিতা শোনাচ্ছে।
একরাশ লাজুকতা নিয়ে এডালিন আমার পাশে বসলো। অনেক খোচাখুচি করেও কিছুই জানতে পারলাম না।
ম্যাথ পিরিয়ডে চারদিকের পরিবেশ টা অন্য রকম মনে হচ্ছিলো। আমার পাশে বসা এডালিন বক বক করছিলো না। শুধু মিটি মিটি হাসছিলো। রাঘব তার পড়ায় মনোযোগী ছিল না। কার্ল আর রিচা সিনেমা দেখা কে নিয়ে ঝগড়া করে দুজন দু দিকে বসে আছে। আর লিওর কোনো পাত্তাই নেই। পুরো ক্লাস টাই থম থমে। এমন ক্লাসে মন কিভাবে টিকে?
লিও প্রবেশ করল তখন ফিফটিন মিনিট লেইট। মিস লি কে স্যরি বলে লিও প্রবেশ করল। যথা রীতি আমার পাশেই বসলো। আমি আজো বের করতে পারলাম না যে কেউ আমার পাশে বসে না কেন? আমার এক পাশের খালি সিট এড়িয়ে পিছনে গিয়ে বসবে তারপরে ও আমার পাশে বসবে না। সেই খালি সিটে সব সময় লিওই বসবে। অন্তত আর কাউকে বসতে দেখিনি। তাই আমি নিশ্চিত যে আমি এশিয়ান তাই এত ডিসক্রিমিনেশন।
লিও পাশে বসেই একটা হাসি দেখালো। বিনিময়ে আমি একটি ভেঙচি দিলাম।
এর পরের পিরিয়ডে রিচা আর আমি বসে আছি। বাকিরা তাদের ক্লাসে। রিচা বিরক্তি কর স্বরে ফ্যাস ফ্যাস শব্দে নোট বুক টা ও একেই চলেছে। কিছু জিজ্ঞেস করতেই আপন মনেই জানালো কার্লের সাথে তার ঝগড়ার কথা। সাথে একরাশ অভিমান। সে নিশ্চয় চাইছিলো কার্ল এসে তাকে স্যরি বলুক।
আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। এসব ব্যাপারে আমার বিন্দু মাত্রও অভিজ্ঞতা নেই।
ক্লাস শেষে বের হতে গিয়ে দেখলাম মাথা চুলকাতে চুলকাতে রাঘব আমার দিকেই আসছে। এরপর এসেই চিন্তিত স্বরে বলল
“তুমি কি এডালিন কে দেখেছো?”
“ক্লাস শেষ করে বেরুলাম মাত্র। এখনো দেখিনি। ক্যান্টিনে হবে নিশ্চয়। এ সময় টাই সবাই ক্যান্টিনে থাকে।”
“হুম”
“কেন খুজছো? কিছু দরকার?”
“নাহ মানে কিছু না। তুমি কি ক্যান্টিনে যাচ্ছো?”
“হ্যা। তুমি যাবে?”
“হুম”
“তাহলে চলো।”
ক্যান্টিনের এক কোনেই এডালিন কে পাওয়া গেল। সে চুপচাপ বিমর্ষ চেহারায় কফি তে চুমুক দিচ্ছিলো। সকালের এত রক্তিম চেহারা এখন কেন এত ফ্যাকাশে হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না।
পাশে গিয়েই বসলাম। রাঘব হালকা ভাবে গলা খাকড়ি দিল। এডালিন কিছু বলল না। একটু আড়চোখে তাকিয়ে কফিতে মনোযোগ দিল।
রাঘব উসখুস করছে। কিছু বলছে চেয়েও যেন পারছে না। এমতাবস্থায় নিজেকে থার্ড পারসন বলেই মনে হচ্ছে। যেন আমার জন্যই এত চুপচাপ। তাই একটা বাহানা দিয়ে উঠে এলাম।
কিছু তো চলছে তাদের মাঝ খানে। তাহলে আর অপেক্ষা করে কাজ কি! বরং হোস্টেলে ফিরে যায়। ক্যাম্পাস ইয়ার্ডে বিশাল দেবদারু গাছটির কাছে আসতেই আচমকা সাইকেল সহ সামনে হাজির লিও। চমকে উঠে কয়েক পা পিছিয়ে গিয়েছিলাম। আর তা দেখে লিওর কি হাসি! ছেলে মানুষ এত হাসে কেন? এত হাসা ছেলে দের জন্য অস্বাস্থ্যকর।
“হোয়াট ইজ দিস লিও? এভাবে কেউ চালায়?”
“স্যরি মিইইরা। কোথায় যাচ্ছো”
“ফিরে যাচ্ছি। আমার আর ক্লাস নেই।”
“ওয়েট। তোমার তো এখনো ক্লাস বাকি আছে। তুমি তার ক্লাস করবেনা?”
ভ্রু কুচকে বললাম
“কোন টিচারের?”
সে বুক ফুলিয়ে রাজকীয় ভঙ্গিতে বলল
“মি. উইলিয়াম এডওয়ার্ড ওরফে লিও এর।”
“বুলশীট”
“সিরিয়াসলি মিইইইরা চলো।”
“নো লিও!”
“কাম অন মিইইরা! জাস্ট চেক মি!”
.
অতপর আমার টিউশন শুরু হল। ক্যাম্পাসের ইয়ার্ডের বেঞ্চে। পড়াতে শুরু করে লিও রীতিমত যুদ্ধ শুরু করল। এমন তড়িৎ গতিতে বোঝাতে লাগল যে আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম।
“মিইইইরা বুঝছো?”
মাথা নাড়লাম বুঝি নি। এতক্ষনের পরিশ্রম তার পন্ডশ্রমে পরিণত হল। বেচারা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর বলল
“বিশ্বাস কর মিইইইরা। তুমি আমার ফার্স্ট স্টুডেন্ট।”
“তো!”
“আমি বুঝতে পারছিনা স্টুডেন্ট এত স্টুপিড কিভাবে হয়?”
“লিও!”
লিও আবার শুরু করল। শুরু থেকে শুরু করল। যেমন ইংরেজি শিখতে আগে এ বি সি ডি শিখতে হয় ঠিক তেমনি। আমি মনোযোগ দিলাম। গম্ভীর ভঙ্গিতে নোট প্যাডে খস খস শব্দে বার বার এক্সাম্পল দিয়ে বিষয় গুলো আমার আয়ত্ত্বে আনার চেষ্টা করছিল। আমি বোঝার চেষ্টা করছিলাম।
প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে লিওর কাছে পড়ছি। এ দেড় ঘন্টা সে বিন্দু মাত্র আমার সাথে ফ্লার্ট করেনি। সত্যিকারের টিচারের মত আমার নিরক্ষর কে অক্ষর দান করল। শেষে আমাকে একটা ম্যাথ করতে দিয়ে সে প্লাই উডের বেঞ্চে মাথা রাখলো। তার চোখ মুখ বলছে সে ভীষন ক্লান্ত। আমার মনে মনে খুব হাসি পেল। ফুর ফুরে মনে ম্যাথ সলভ করতে একটা গান মনে পড়ে গেল। গুন গুন করে গাইতে লাগলাম
সখি ভালোবাসা কারে কয়
সখি ভালোবাসা কারে কয়
হৃদয়ে মন্দিরে
আছো তুমি ঘিরে
এ ব্যাথা প্রাণে নাহি সয়
এ গান টা আমার এক হাই স্কুলের বান্ধবী গাইত। ক্লাস মেট এক ছেলের প্রেমে সে হাবুডুবু খেত। যখন স্কুল শেষে পড়ন্ত রোদে বাড়ি ফিরতাম তখন গুনগুন করে সে এ গান টা গাইত।
উইনিপেগের এই পড়ন্ত সোনালী বিকেলে গুন গুন করতে মোটেও খারাপ লাগছে না।
গুন গুন করতে করতে ম্যাথ টা সলভ করে লিওর দিকে দিকে এগিয়ে দিলাম। কিন্তু ততক্ষণে সে মাথা তুলে বড় বড় চোথে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
“হোয়াট হ্যাপেন্ড লিও?”
“তুমি এটা কি গাইছিলে?”
“গান!”
“এটা গান?”
“হুম”
হো হো করে হেসে উঠল।
“সিরিয়াসলি মিইইরা! এটা গান! আমি মনে করেছি তুমি ভজন (প্রাথর্না সংগীত) গাইছো!”
কটমটে চোখে লিও কে বললাম
“লিও এটা গান। বাংলাদেশি লোকাল গান।”
হাসতে হাসতে লিও জবাব দিল
“আই এ্যাম স্যরি মিইইরা রিয়্যালি এটা গান?”
আমি ফোস ফোস করতে করতে কোন কিছু না বলে ব্যাক প্যাক গুছিয়ে নিলাম।
চলে আসতে লাগলে সে হাসতে হাসতেই স্যরি বলতে লাগল
“স্যরি মিইইরা আর কখনো বলবো না এটা ভজন গান”
বলেই আবার পেট ধরে হাসতে লাগলো।
মনে মনে বললাম
“ইডিয়ট কোথাকার!”
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here