আমার ভিনদেশি তারা পর্ব -১৫

0
1939

Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ১৫
————————————————
ইদানিং বাংলাদেশে কোন ফোনই যাচ্ছে না। বার বার ট্রাই করে যাচ্ছি। কিন্তু সব নাম্বারই যেন আন রিচেবল। আম্মার টা না হয় কোনো কারনে বন্ধ। কিন্তু ছোট মামার টা কেন বন্ধ?
ভাবতে পারলাম না। এদিকে আমার কাছে থাকা ডলার ফুরিয়ে আসছে। যে ডলার গুলো আছে তাতে কোনো ভাবে এ মাসটা চলতে পারবো। হোস্টেল বিল তো আগাম পেইড করা। কিন্তু আগামী মাস থেকে যদি পেইড না করি তাহলে তো আমাকে পথে নামতে হবে।
দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। বাকি থাকা ডলার গুলো আমাকে হিসেব মতো খরচ করতে হবে। না হলে পথে নামতে হবে বেশি দেরী হবে না।
.
আজ সপ্তাহের বিশেষ দিন। রীতি অনুযায়ী আজ প্রাথর্নার দিন। আর আমার ঘুমানোর দিন। সবাই ভদ্র পোশাকে চার্চে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। সদা ঝগড়া রত দু বোন স্কাই আর রেইন তাদের কোনো একটা পোশাক নিয়ে মিন মিনিয়ে ঝগড়া করে যাচ্ছে। কেউই উচু গলায় কথা বলছেনা শাস্তির ভয়ে।
কিছু একটা ভেবে আমি বেড ছেড়ে তৈরি হয়ে নিলাম। ব্ল্যাক শার্টের উপর লং হোয়াইট স্কার্ট। তার সাথে মিলিয়ে স্কার্ফ। ব্রাশ দিয়ে চুল গুলোকে আঁচড়ে খোপা করে নিলাম। ইলি সাধারনত আমার সাথে তেমন কথা বলেনা। কিন্তু আমাকে তৈরি হতে দেখে বিস্মিত গলায় বললো
“তুমি কোথায় যাচ্ছো?”
লুকিং গ্লাসে নিজেকে একটু দেখে নিয়ে ইলির দিকে ফিরলাম। সোনালী চুলের এই ব্লন্ড মেয়েটির চুল যদি সোনালি না হত তাহলে সহজেই তাকে এশিয়ান বলে চালিয়ে দেয়া যেত।
“চার্চ দেখতে। কি? আমি দেখতে পারবোনা?”
ইলি যেন একটু খুশিই হল
“অবশ্যই”
ইলির হাতে ছোট একটা বুক। হাতে নিয়ে দেখলাম এটা কোন সাধারন বুক না। এটা বাইবেল। খুলে দেখলাম সেটা। গোটা গোটা মুক্তার মত ইংলিশ লেখা। এটা সেই গ্রন্থ যেটা ঈসা আলাইহিস সালামের উপর নাযিল হয়েছিল। ভাবতেই বেশ রোমাঞ্চিত হলাম। পৃষ্টা উল্টিয়ে উল্টিয়ে দেখলাম। কয়েকটা লাইন বেশ চোখে পড়ার মত।
সবার সাথে যখন বেরুলাম তখন সূর্য তার সোনালী রোদ গুলো কে সুন্দর করে উইনিপেগের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে দিয়েছে। গাছের ফাঁকে ফাঁকে রোদ গুলো ছায়ার সাথে লুকোচুরি খেলছে। হালকা বাতাসে স্কার্ফের কোনা টা বার বার উড়তে চাইছে।
আলেকজান্ডার এভে উঠতেই চার্চ গমন কারী আরো অনেকর সাথে দেখা হল। বেশ কয়েক জন তাদের বাচ্চা সহ বেড়িয়েছে।
বাইরে থেকে দেখতে চার্চ টাকে সুদৃশ্য হল রুমের মতই দেখাচ্ছে। উপরে গম্ভুজ আকৃতি হয়ে তার উপর বিরাট ক্রুশ। সে ক্রুশে ক্রুশ বিদ্ধ যীশু। চোখ নামিয়ে ফেললাম।
আলেকজান্ডার এভের এদিক টাই বেশি ঘন সবুজ। এর সাথে যোগ হয়েছে ছোট ছোট সাইড রোড গুলো। তাদের নাম গুলো ও চমৎকার। যেমন ওভেনা স্ট্রীট, চেম্বারস স্ট্রীট।
হাটতে হাটতে আমি ওকেই গ্রোসারি শপ টা ঘুরে প্যাসিফিক এভে তে উঠলাম। এদিক টাই গাছ পালা বেশি। সারি পাইন আর সিডার গাছ দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দেবদারু গাছের ও সাক্ষাত মিলছে।
হাত দুটো কে পিছনে মুড়ে হাটছি। দু এক জন মানুষের সাক্ষাত মিলছে। কেউ বেঞ্চিতে নিরিবিলি বই পড়ছে। কিংবা দুজন এক সাথে বসে চুটিয়ে প্রেম করছে। কেউ কেউ তাদের লোমশ পোষা কুকুর টাকে নিয়ে বেড়িয়েছে। বাতাস টা বেশ জোড়ালো। জোড়ালো বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে এক ঝাক সোয়ালো উড়ে যাচ্ছে।
সামনে বিশাল সবুজ গ্রাউন্ড। নিশ্চয় প্লে গ্রাউন্ড। এখন অবশ্য খালি। কাউকে প্র্যাকটিসে দেখা যাচ্ছে না।
প্যাসিফিক এভের পাশে কিছু দুর পর পর ছোট ছোট ঝোপ। সেখানে বুনো টগরের মত সাদা সাদা ফুল ফুটে আছে। দেখতে কি ভীষন। ছবির মতই সবকিছু। কানাডিয়ান রা কি রকম যে পরিচ্ছন্নতা ভালোবাসে তা না আসলে না দেখলে অনুভব করা যাবে না। সার্থক আমার চোখ দুটো।
—————————
লিওর পড়া প্রথম প্রথম আমার কাছে দুর্বোধ্য লাগত। মনে হত এত কঠিন কেন সব কিছু। কিন্তু ইদানিং বেশ সহজ লাগছে। আগে সবকিছু গুলিয়ে ফেলতাম। এখন আর তেমন হচ্ছে না। সহজে বুঝতে পারছি সবকিছু। তার পুরোটা ক্রেডিট লিওর। কারন পড়াতে বসলে সে দুইটা ঘন্টা ধৈর্য্য ধরে আমাকে ম্যাথ বোঝাত। ম্যাথের পাশাপাশি বিভিন্ন সাবজেক্ট ও তার কারনে আমার কাছে সহজ হয়ে এসেছে।
আগে যেরকম বিরক্তি বোধ করতাম তেমন টা আর মনে হয় না। চমৎকার বন্ধুত্ব হয়েছে আমাদের মাঝে। যতটুকু বুঝেছি মানুষ হিসেবে তার মন টা প্রচন্ড রকমের সরল। সরল দৃষ্টিতে তার কাছে যেটায় সঠিক মনে হবে সেটায় করবে সে। সবাই যেরকম প্যাচাল বুদ্ধির বলেছিল। আমার বিন্দু মাত্র তেমন মনে হয় নি।
.
আজকে ক্লাস টেস্ট এক্সামের রেজাল্ট দিয়েছে। টপ না হলেও রেজাল্ট আমার খারাপ হয় নি। মোটামুটি ভালো করেছি। টপ করেছে লিও। কিন্তু তাকে কোথাও খুজে পাচ্ছি না। এডালিন কে জিজ্ঞেস করলাম। সে বলল আজকে আসার পর থেকেই নাকি তার সাথে দেখা হয় নি। কার্ল আর রিচাও কিছু জানেনা। কার্ল সবাইকে ট্রীট দিচ্ছে। তার নাকি রেজাল্ট ভালো হয়েছে। অথচ টপার হিসেবে ট্রীট দেয়ার কথা লিওর। আমি আরো কয়েক জনের কাছ থেকে খোজ নিলাম। কিন্তু কেউই জানেনা। অথচ লিও কে রেজাল্ট না জানিয়ে আমি যেতে চাচ্ছি না। কারন আমার রেজাল্টে লিওর ক্রেডিট বেশি।
খুজতে খুজতে আমি লাইব্রেরির সামনে এসে দাড়ালাম। লিও কে তেমন লাইব্রেরিতে আমি দেখি না। তারপরও চেক করার উদ্দেশ্যে ভিতরে ঢুকলাম। ভিতরে ঢুকেই চোখ বুলাতেই কোনার সরু প্লাইউডের টেবিলে আমার নজর গেল। ধুসর শার্ট পরিহিত ঝাকড়া চুলের কেউ বেশ মনযোগে কিছু একটা লেখার চেষ্টা করছে। কাছে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম কলমের পিছনের অংশ মুখে দিয়ে লিও বেশ মনোযোগে কিছু একটা ভাবছে। আস্তে করে তাকে আমি ডাকলাম
“লিও?”
হালকা স্বরে ডাকা সত্ত্বেও সে বেশ চমকে উঠল।
“ওহ্ মিইইইরা! তুমি!”
উদভ্রান্তের মত চেহারা তার। ঘোলাটে ধুসর চোখ আরো ঘোলাটে বলে মনে হচ্ছে। যেন কোথায় হারিয়েছে। তার চুলো গুলো বেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অথচ তার চুল সব সময় পরিপাটি অবস্থায় থাকে। আমাকে দেখে হাতের কাগজ টা লুকিয়ে জিন্সের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল। যেন আমাকে দেখতে দিতে চাইছেনা। মাথা চুলকাতে চুলকাতে আমতা আমতা করতে লাগল। অপরাধীর মত ভঙ্গিতে আমার সামনে দাড়িয়ে আছে।
“লিও তুমি এখানে লুকিয়ে বসে আছো আর আমি তোমাকে পুরো পৃথিবী খুজে বেড়াচ্ছি।”
শুনে একটু লাজুক হাসি দিল সে। তারপর বলল
“সত্যিই তাই!!”
তার গালের লালিমা দেখে আমি তাকে ধমক দিলাম
“লিও আজকে রেজাল্ট দিয়েছে।”
“ওহ্ এ আর নতুন কি?”
“তুমি টপ হয়েছো”
“সে তো প্রতিবারই হই। তোমার রেজাল্ট কেমন হয়েছে?”
আমি ওর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে চুপ করে রইলাম।
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ও উৎকন্ঠিত কন্ঠে বলতে লাগলো
“মিইইইরা! ইটস ওকে। আগামী টেস্টে নিশ্চয় ভালো করবে। মন খারাপ করার কিছু নেই।”
“লিও”
“হুহ?”
“চলো সবাই অপেক্ষা করছে!”
“হাহ কোথায়?”
“ক্যান্টিনে”
ক্যান্টিনে জম্পেশ খাওয়া দাওয়া হল। খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই লিও কে চেপে ধরল ট্রিট দেয়ার জন্য। চাপে পরে লিও সবাই কে তার বার্থ ডে উপলক্ষে তার বাড়িতে ইনবাইক করলো। শুনে খুশিতে সবাই লাফিয়ে উঠলো।
ওখান থেকে বের হয়ে আসার পর এডালিন আর রাঘব আলাদা হয়ে গেল। তাদের নাকি এ্যাসাইনমেন্ট আছে। রিচা, কার্ল আর লিও প্যাসিফিক এভের দিকে যাওয়ার কথা থাকলেও লিও ওদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেল বুক স্ট্রীট যাওয়ার কথা বলে।
বুক স্ট্রীটের দিকে যাওয়ার কথা থাকলেও সে সেদিকে এগুলো না। পাশে হাটতে হাটতে লিও বেশ ঘামাচ্ছিল। ব্যাপার টা আমার নজর এড়ালো না। বার বার ঝাকড়া চুল গুলো তে হাত বুলিয়ে আরো ঝাকড়া করে তুলছিল। বুকের ভিতর থেকে ক্রুশ বিদ্ধ লকেট টা বেড়িয়ে জ্বল জ্বল করছে। তার ধুসর শার্টের সাথে ধুসর চোখ! সবকিছুই যেন ধুসর করে দিয়েছে। আমি তাকে থামিয়ে দিলাম।
“লিও? কি হয়েছে?”
শুনে একটু হাসলো সে। তারপর আমাকে ডাকলো
“মিইইইরা!”
“হুহ”
লিওর নাকে হীরের ছোট ছোট টুকরার মত বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। পকেট থেকে একটা টিস্যু বের করে সে নাকটা মুছলো। মুখে এক প্রকার লালিমা সৃষ্টি হয়েছে। ফর্সা মানুষের গালের লালিমা স্পষ্টই বোঝা যায়। মাঝে মাঝে ডিম্পল টা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। সে পকেট থেকে একটা কাগজের টুকরা বের করলো। যেটা লাইব্রেরি তে দেখেছিলাম।
তারপর বিশুদ্ধ ইংরেজিতে লাজুক দৃষ্টিতে সে বলল
“What is love, oh my friend
what is love, oh my friend
you are deep in my heart
I can’t tolerate any more this pain”
আমার মুখ এক বিঘত পর্যন্ত হা হয়ে গিয়েছিল। কয়েক সেকেন্ড নাম্ভ হয়েছিলাম। হুশ আসতেই আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম
“What is this leo?”
সে নার্ভাস ভাবে একটা হাসি দিল। তারপর বলল
“সং! বেঙ্গলী লোকাল সং! আ-আমি ট্রান্সলেশন করেছি!”
সন্দিগ্ন চোখে জিজ্ঞেস করলাম
“কোন সং টা?”
সে খানিকটা ইতস্থত করলো। একটা ঢোক গিলে তারপর মাথা চুলকে মাটির দিকে তাকাতে তাকাতে বলল
“সোওওকি ভালোওবাচা খা-রেহ কই
সোওওকি ভালোওবাচা খা-রেহ কইইই
রি-রি…..
এখানে সে আটকে গেল। আমি ঠিক করে দিলাম।
সে আবার বললো
“রিডোয়ের মোন্ডিরে আচু টুমি গিইরে
এ বেটা পানে নায় সয়।
.
পুরো ১০ সেকেন্ড আমি হা করে লিওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর আর হাসি চেপে রাখতে পারলাম। হা হা করে হেসে উঠলাম। হাসির ধমকে হাতে থাকা বুকস গুলো নিচে পরে গেল। কিন্তু হাসি থামাতে পারলাম না।
.
(চলবে)
.
দেরি হওয়ার জন্য দুঃখিত সবার কাছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here