আমার ভিনদেশি তারা পর্ব -১৬

0
1845

Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ১৬
————————————————
লিওর মুখে বাংলা ভাষা টা এত চমৎকার শোনাবে কখনো ভাবি নি। হাসতে হাসতে আমার পেটে প্রায় খিল ধরে গেল। পানি আসা ঝাপসা চোখে লিওর দিকে তাকালাম। এক দৃষ্টিতে হা করে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে যেন এমন এলিয়েন সে জীবনেও দেখে নি।
ও আমার দিকে এক পা এগিয়ে এল। আমি এখনো হাসছিলাম। পলকহীন চোখে লিও কি দেখছিল বুঝতেছিলাম না। কারণ চোখের ভাষা বোঝার ক্ষমতা আমার তখনো হয় নি।
ও এগিয়ে এসে বিস্মিত ধূসর চোখে আমার গাল স্পর্শ করতে এগিয়ে এল। একটা অচেনা দ্যুতি খেলা করছিল তার চোখে মুখে। এতটা কাছে তাকে পেয়ে আমার হাসি থেমে গিয়েছিল।
ওর উষ্ণ কাতর স্পর্শ পেয়েই শিউরে উঠলাম। আশে পাশের বাতাস গুলো আমার কানে কানে এসে প্রচন্ড জোরে ধমক দিল। ধমক খেয়ে চমকে উঠলাম। তাকালাম লিওর দিকে। সে এখনো ঘোর লাগানো দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
কি করছি আমি?
এক ঝটকায় লিওর হাত সরিয়ে দিলাম। ওর হাত সরিয়ে দিতেই ওর শরীরের হালকা কাঁপুনী আমি অনুভব করলাম। কিন্তু সরাসরি তাকালাম না ওর চোখের দিকে। হয়তো হারিয়ে যাবো সেই ভয়ে। দ্রুত নিচ থেকে বই গুলো নিয়ে ভৌ দৌড় দিলাম। প্রতিদিন ভোরের এক্সেরসাইজ এভাবে কাজে আসবে কখনো ভাবিনি। পথে বিন্দুমাত্র থামি নি। এক দৌড়ে হোস্টেলে পৌছুলাম। রুমে প্রবেশ করে কোন ভাবেই ব্যাক প্যাক রেখেই গোসলখানায় ঢুকলাম। রুমে লারা ছিল। কিন্তু ফোনে ব্যস্ত থাকায় সে আমাকে খেয়াল করেনি। না হলে অবশ্যই আমার পিছু পিছু দৌড়াতো। গোসলখানায় ঢুকেই ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিলাম। হাপাতে লাগলাম খুব জোরে শোরে। বুকটা হাতুড়ি পেটা আওয়াজ করতে লাগল। হাত পা কাপছিল একটু একটু। চিন্তা ভাবনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে মাথার ভিতর। ধীরে ধীরে আমার হাতটা বুকের বাম পাশে চেপে ধরলাম। যাতে বুকের বাম পাশ টা আওয়াজ করা বন্ধ করে দেয়। তারপর বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে চোখ খুললাম। দেখলাম ৪/৫ জন অর্ধ নগ্ন ব্লন্ডি আমার সামনে দাড়িয়ে। কোথায় আছি সেটা বুঝতেই আমি সরে দাড়ালাম। আর তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকাতে তাকাতে ওরা বেড়িয়ে গেল গোসল খানা থেকে।
.
রাতে পড়াতে কোনো ভাবে মন বসাতে পারলাম না। এদিক সেদিক পৃষ্টা উল্টাতে লাগলাম। এমন সময় হেড অফিস থেকে আমার ডাক এলো। আমার বুঝতে বেশি কষ্ট হয় নি ওরা কেন ডেকেছে। মাস শেষ হয়ে এসেছে। হোস্টেল ফি আমি এখনো পেইড করতে পারি নি। এভাবে চললে আমাকে হোস্টেল থেকে বের হয়ে যেতে হবে।
যা ভেবেছিলাম তাই। হেড অফিস থেকে এসে একরাশ চোখে মুখে অন্ধকার নিয়ে শুয়ে পড়লাম। আবারো মামার ফোনে কল করার চেষ্টা করলাম। নট রিচেবল আসতে লাগল। কি হবে আমার? আটকে যাবো নাতো এই উইনিপেগের সৌন্দর্য্যের গ্যাঁড়াকলে?
.
সকালে ভার্সিটিতে গেলাম মুখ চোরা ভাবে। রিচার সাথে ম্যাক ডারমোটেই দেখা হয়েছিল। সে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিলো। কিন্তু আমার কানে একটা কথাও যাচ্ছিলো না।
ক্যাম্পাসে এডালিন আর রাঘব কে এক সাথেই পেলাম। একে অপরের হাত ধরে আছে। আমাদের দেখতেই ঈষৎ হেসে হাত ছেড়ে দিল। লালিমায় ছেয়ে আছে পুরো মুখ। যদি দুশ্চিন্তায় না হতাম তাহলে হয়তোবা এ বিষয় টি আমার নজর এড়াতো না।
ক্লাসের পিরিয়ডে অন্যমনষ্ক ভাবে বসেছিলাম। আমার পাশে এডালিন ছিল। কিন্তু সে রাঘবের সাথে দৃষ্টি বিনিময়ে ব্যস্ত ছিল। আমার দিকে তাকানোর ফুরসত তার ছিলো না। খালি প্যাডের উপর কলম টাকে চক্রাকারে ঘোরাতে ঘোরাতে একটা উষ্ণতা অনুভব হল। কলম থামিয়ে পাশে তাকাতেই দেখলাম লিও আমার দিকে তাকিয়ে একটু করে হাসি দিল। আমি নজর ফিরিয়ে ফেললাম। কালকের ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। আমি জানি না লিও কি ভাবছে বা তার মনে আমার জন্য কোনো অনুভূতি আছে কিনা? আমি শুধু জানি ওর কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে। না হলে আমি ফেসে যাবো।
পুরো ক্লাস টাইমে আমি কোনো ভাবেই লিওর দিকে তাকাই নি। লিও কয়েক বারই আমাকে ফিস ফিসিয়ে ডেকেছে। কিন্তু টিচার দের কারনে তেমন কিছু করতে পারে নি।
ক্লাস শেষ হতেই আস্তে করে সবার চোখ কে ফাকি দিয়ে বাইরে বেড়িয়ে এলাম। আমাকে একটু করে প্রফেসার হুডের সাথে দেখা করতে হবে। তড়িগড়ি করছিলাম। না হলে এদের সাথে না চাইতেও ক্যান্টিনে যেতে হবে।
নোটিশ বোর্ডে নজর বুলিয়ে ক্যান্টিনের বিপরীতে ঘুরে চলে আসছিলাম। ল্যাবের কাছাকাছি করিডোরের নিকট আসতেই হঠাৎ করেই কে যেন আমার মুখ টা চেপে ধরলো। আমি বুঝতেও পারলাম না। চোখ মুখে অন্ধকার দেখতে শুরু করলাম। মুখ দিয়ে গো গো শব্দ ছাড়া আর কিছুই বেরুচ্ছিলো না। তারপর আমাকে টেনে হিচড়ে ল্যাবের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। তারপর পা দিয়ে ল্যাবের দরজা টা ধাক্কা দিয়ে খুললো। এদিকে আমার বুকে প্রচন্ড জোরে হাতুড়ি পেটা শব্দ হচ্ছিল। ভয়ে জান চলে যাওয়ার মত অবস্থা। ডুকরে কান্না চলে আসছিল। কিন্তু লোহার মত শক্ত বলিষ্ট হাতের পিষে শব্দ গুলো নিঃশব্দ হয়ে রইলো।
ল্যাবের ঢুকতেই লোকটি আমাকে ধাক্কা মারলো।
ধাক্কা খেয়ে আমি সজোরে ফ্লোরে ছিটকে পড়লাম। তবে ভাগ্যিস অতটা জোরে লাগেনি। আমি তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে উঠে দাড়ালাম। পিছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম লোকটি খট করে ল্যাবের দরজা ভিতর থেকে আটকে দিল। তারপর আমার দিকে তাকালো। ব্লু ডেনিম জিনসের সাথে ব্ল্যাক হুডির জ্যাকেট পরিহিত সাথে রুমাল দিয়ে নাক পর্যন্ত মুখ বাধা। হুডি মাথার উপর তোলার কারনে চোখ দুটো কে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। তারপরও কেন যেন পরিচিত একটা সুবাস ভেসে বেড়াচ্ছে। আমি এক পা পিছু হটে গেলাম। কানাডিয়ান মাফিয়াদের কু খ্যাতি বিশ্বজোড়া। এ কোনো মাফিয়া নইতো? কি চাইছে আমার কাছে? একটা ঢোক গিললাম।
“কে-কে তু-তুমি?”
জবাব না দিয়ে লোকটি আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। এদিকে আমার জান বেড়িয়ে যাচ্ছে। পিছনে বেঞ্চে আমার পিঠ ঠেকে গেলো। এরপর আমার এক হাত দুরত্বে এসে লোকটি হুডি নামিয়ে দিল। নাক পর্যন্ত রুমাল বাধা থাকা সত্ত্বেও বড় বড় স্বচ্ছ টলমলে ধুসর চোখ আর উসকো খুসকো চুল আমাকে কারো কথা মনে করিয়ে দিল। সন্দেহ কাটাতে আমি তার ডান হাতের দিকে তাকালাম। সেখানে হাতের কবজিতে সিলভারের ব্রেসলেট জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। চোখে মুখে আমার বিস্ময় ফুটে উঠলো।
“লিও!”
লিও মুখ থেকে রুমাল টা সরিয়ে নিল। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে পুরো মুখে। ঠোট দুটো হালকা ভাবে কাপছে। খুব জোরে জোরে নিঃশ্বাসের শব্দ আসছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতেই সে আমাকে ডাকলো
“মিইইইরা?”
“তু-তুমি…”
আমার কথাকে কেটে দিয়ে বললো
“আমাকে কেন ইগনোর করছো?”
“লিও আ-আমি তো-তোমাকে ইগনোর…”
আবারো কথা কেটে গেল লিও এক পা এগিয়ে আসতেই। পলক হীন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল
“নিজের অনুভূতি প্রকাশ করা কি সিন মিইইইরা?”
আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। কি জবাব দিব বুঝতেছিলাম না। ওর নিষ্পাপ টলমলে ধুসর দৃষ্টি আমাকে এফোড় ওফোড় করে দিচ্ছিলো। বোকা বোকা কন্ঠের কথা দিয়ে সে আমাকে তীক্ষ্ণ ভাবে আমার কলিজায় আঘাত করছিল। আমি যথা সম্ভব প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছিলাম আঘাত টা।
“লি-লি…
“আনসার মি মিইইরা!”
আমি শিউরে উঠলাম খানিকটা। ঢোক গিলে কিছু বলার চেষ্টা করলাম। মনে মনেই যেন লিও কে বললাম Leo… you can’t express your emotion! anywhere, anytime.
মুখে বললাম
“লিও! দেখ আ-আমি থার্ড ওয়ার্ল্ডের একটি অনুন্নত কান্ট্রির মেয়ে। আ-আমাদের দেশে এ-এটা কখনো এলাউড না।”
“কোনটা এলাউড না?”
উৎসুক কন্ঠে লিও জিজ্ঞেস করলো
আমি আবারো ঢোক গিললাম
“তু-তুমি যখন তখন আ-আমাকে স্পর্শ করতে পারো না। যখন তখন তোমার অনুভুতি প্রকাশ করতে পারো না।”
উদ্ভিগ্ন কন্ঠে সে জিজ্ঞেস করলো
“তাহলে কে পারবে? তোমাকে স্পর্শ করতে, তোমার কাছে নিজস্ব অনুভূতি গুলো প্রকাশ করতে?”
এরকম হাবাগোবা টাইপ প্রশ্ন করে আমি নিজেই অকুল পাথারে পড়ে গেলাম। ভাবতে লাগলাম কে পারে?
“টেল মি মিইইইরা হু ক্যান?”
শুকনো জিহ্বা কে একটু করে ভিজিয়ে বললাম
“আমার হাজবেন্ড!”
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here