আমার ভিনদেশি তারা পর্ব -১৭

0
1915

Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ১৭
————————————————
অনুভূতি হীন দৃষ্টিতে লিও আমার দিকে তাকিয়ে রইল। হয়তো সে অবাক হয়েছে। অবাক হওয়ারই কথা। কেননা এ দেশে নন মাহরাম কাউকে ইচ্ছেমত স্পর্শ করার জন্য বিয়ের দরকার নেই। দুজনে রাজি থাকলে কয়েক বাচ্চার পিতা মাতাও তারা হয়ে যায়। বিয়ে প্রেম না হলে কখনোই তারা করে না। বাচ্চা কাচ্চার মা হয়ে যাক তারপরও না।

আমি একটা চোরা নিঃশ্বাস ফেললাম। লিওর মনোভাব বুঝার জন্য তাকে ডাকলাম।
“লিও?”
লিও চোখের পাতা কয়েকবার ঝাপটিয়ে জিজ্ঞেস করল
“মিইইরা! তুমি কি ম্যারিড?”
খানিকটা চমকে গেলাম।
“কি! নো! আমি অবিবাহিত।”
খুব বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে লিও পিছন ফিরে গেলো। মাথায় দুহাত দিয়ে চেপে ধরে। খালি ফ্লোরে কিক করতে লাগল। আমি উৎসুক হয়ে তাকে ডাকলাম।
“কি হয়েছে লিও?”
ঝট করে লিও পিছন ফিরল।
“হাহ? নাথিং।”
একটা ডিম্পল ওয়ালা মুচকি হাসি দিল সে।
“ওকে”
“মিইইরা!”
“হুম”
“আমার বার্থডে পার্টিতে তুমি অবশ্যই আসবে।”
“আমি?”
“হুম। অবশ্যই আসবে। না হলে তোমার খবর আছে।”
“আমি চেষ্টা করবো।”

লিওর কাছ থেকে ছাড়া পেতে বেশ বেগ পেতে হল। তাকে ওয়াদা করতে হল যে তার বার্থডে পার্টিতে উপস্থিত হব।

এরপর ছুটলাম প্রফেসর হুডের বাড়িতে। এই ভিনদেশে উনিই আমার শেষ ভরসা। হোস্টেল ফি পেইড করার আর কোন ডলার আমার কাছে অবশিষ্ট নেই। ভাগ্যিস স্কলারশিপ টা নিয়ে এসেছিলাম। তাই কলেজ খরচ টা আমার ওপর পড়ছে না। হাত খরচের যেন যে টাকাটা পাচ্ছি সেটা অপ্রতুল। ভিসা এবং শপিং করেই সব খরচ করে ফেলেছি।
তাই যদি কোন কারনে হোস্টেল ছাড়তে হয় তাহলে প্রফেসর হুড ছাড়া আর কোন গতি আমার নেই।
বাড়ির ছোট গেইটের ভিতর ঢুকতেই টুংটাং শব্দ গুলো কানে আসলো। তাকিয়ে দেখলাম জ্যাক আর জিল সাইকেল চালাচ্ছে। আমাকে ওরা খেয়াল করে নি। আমি দরজায় গিয়ে কলিং বেল চাপলাম। বেশ কয়েকবার। কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া গেল না। বাধ্য হয়ে জ্যাক আর জিল কে ডাকলাম। তারা আমাক দেখে বেশ খুশি হল। আমি হাসি মুখেই তাদের মম কে ডাকতে বললাম। জ্যাক আর জিল এর মম মানে মিসেস আর্থার বেরিয়ে এলে আমি কুশল বিনিময় করেই সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম
“আপনি জানেন প্রফেসর হুড কোথায়?”
“ওহ ডিয়ার! ওরা পরশুই নিউইয়র্ক গিয়েছে।”
“কিহ? পরশু?”
“হ্যা”
“আ-আবার কখন আসবে?”
“মুনসুন শেষ হলেই আমার মনে হয় ফেরত আসবে।”
“এখন কি হবে?”
“কি হয়েছে ডিয়ার? কোনো প্রবলেম?”
একটু শুকনো হেসে বললাম
“নাথিং”
.
ওখান থেকে যখন বেড়িয়ে আসলাম তখন দুপুর পেরিয়ে বিকেল চলে এসেছে। লাঞ্চ তখনো করি নি। চিন্তিত ভঙ্গিতে হেটে যাচ্ছি। যত টুকু বুঝতে পেরেছি তাতে মনে হচ্ছে বাড়িতে নিশ্চয় কোনো সমস্যা হয়েছে। তা না হলে মা কিংবা ছোট মামা কেউই এরকম যোগাযোগ বিহীন থাকতো না। আর টাকার সমস্যা টাও থাকতো না। কিন্তু এখন টাকা কোথায় পাবো?
তীক্ষ্ণ হর্নের শব্দে আমার ধ্যান ভঙ্গ হয়ে গেল। তাকিয়ে দেখলাম এক ক্যাব ড্রাইভার স্থানীয় ভাষায় হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে চিৎকার করছে। চিৎকারের ভঙ্গি বলে দিচ্ছে ড্রাইভার টা গালাগালি করছে। আর সামনে মধ্য বয়স্ক মহিলা তাড়াহুড়া করে রাস্তায় পড়ে যাওয়া গ্রোসারি গুলো তুলছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম চারদিকে বিভিন্ন জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হয়ত বাজারের ব্যাগ ছিড়ে এসব হয়েছে আর দূর্ভাগ্য জনক ভাবে তা রাস্তা পার হতে গিয়েই হয়েছে। একারনে রাস্তায় ছোট খাট জ্যামের সৃষ্টি হচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি দৌড়ে গেলাম। যত দ্রুত সম্ভব উনার সব গুলো গ্রোসারি গুছিয়ে উনাকে এক পাশে নিয়ে আসলাম। সাহায্য করার জন্য উনি আমাকে বার বার ধন্যবাদ জানালো। কাজ থেকে সরাসরি বাজার করে ফিরছিলেন। ঘরে বাচ্চারা অপেক্ষা করে আছে। তাই তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে এ অবস্থা। থলে টাও যাচ্ছে তাই।
মহিলা টি চলে যাওয়ার পর আমি থমকে দাড়ালাম। আরেক বার পিছন ফিরে মহিলাটি কে দেখলাম। মনে মনে কেউ যেন বলে দিচ্ছিলো
“মীরা এবার তোমার কাজের সময়। এখনি তোমাকে পরিশ্রম করতে হবে!”
নিজেই নিজেকে জবাব দিলাম
“আমি?”
“হ্যা তুমি!”
“জমিদারের মেয়ে চাকরি করবে?”
“এখানে তুমি কোনো জমিদারের মেয়ে নও। সাধারন নগন্য স্টুডেন্ট। তোমার জমিদার বাপ টা এখানে নেই। তাই করতে হবে।”
“অসম্ভব! আমাদের হয়ে গ্রামের হাজার লোক কাজ করে, আমার পিতার কথায় উঠবস করে, আমি তার মেয়ে হয়ে চাকরি করবো?”
“তাহলে সে বাপের মেয়ে হয়ে থেকে যেতে। আসলে কেন সদূরে?”
“আমি…”
আমি দমে গেলাম। সদুত্তর পেলাম না দেয়ার জন্য। হঠাৎ করেই সুচের মত ফোটা ফোটা বিধতে লাগল। উপরে তাকাতেই চোখেও বিধতে লাগল। বৃষ্টি? বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে? এমুহুর্তে?
তাড়াতাড়ি ব্যাক প্যাক টা মাথায় দিয়ে আশ্রয়ের আসায় কিনারে দৌড় দিলাম। একটা কাচ ঘেরা দোকানের সামনে। কাচের দরজার সামনে Open প্ল্যাকার্ড ঝুলানো। ভিতর থেকে মানুষ বেরুচ্ছে অথবা ঢুকছে। আমি আবার সামনে তাকালাম। কাপড় চোপড় পানির বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাই নি। তাই ঝাড়তে লাগলাম। উফফ্ এটা কোন ধরনের বৃষ্টি? এ অসময়ে? নাকি মুনসুন শুরু হয়ে গেছে?
ঝম ঝম শব্দের বৃষ্টি তো সেটাই বলে দিচ্ছে।
আমি বৃষ্টির দিতে তাকালাম।সেই সাথে আরো অনেকে আশে পাশে দাড়িয়ে আছে। কেউ মুনসুনের প্রথম বৃষ্টি কে উপভোগ করছে, কেউ বিরক্তির সাথে বির বির করছে। আবার কেউ কেউ ছাতা মাথায় হেটে বেড়াচ্ছে। বেশ কিছুক্ষন পর ছাতা মাথায় দুজন যুবক যুবতী কে হেটে যেতে দেখলাম। যেভাবে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে হাটছে তাতে মনে হচ্ছে এরা লাভ বার্ডস।
আমি বাইরে আর দাড়ালাম না। ভিতরে ঢুকে গেলাম। ঢুকে দেখলাম এটা একটা কফি শপ। আবার বাইরে তাকালাম। বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষন নেই। তার চেয়ে বরং এখানে বসে কফি পান করা যাক। সরাসরি বৃষ্টি দেখা যায় এমন একটা সিটে বসে কফি অর্ডার করলাম। পাশের সিটে এক জোড়া কাপল বসে আছে। এক নাগাড়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে প্রেম বিনিময় করছে। দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম।
কফি হাউজ টাকে আমার কোনো ধরনের অত্যাধুনিক কফি হাউজ বলে মনে হল না। শুধু কফি না, অন্যান্য সাধারন রেস্টুরেন্টের মত সব পাওয়া যায় বলে মনে হল।
যাচ্ছে তাই অবস্থা কফি হাউজ টার। এত পরিষ্কার কানাডিয়ান বাসীর সাথে এ কফি হাউজ টা যাচ্ছে না। সিট গুলো ভালো ভাবে মোছা নেই। ওয়েটার দের অসংলগ্ন ড্রেস কোড, কাচের দরজায় মিষ্টি দ্রব্য কিছু লেগে সেখানে মাছি ভন ভন করছে। আমার পায়ের উপর দিয়েও মনে হল একটা তেলাপোকা হেটে গেল।
বেশ কিছুক্ষন পর চওড়া, মোটা আর জাদরেল ধরনের এপ্রোন পরিহিত মহিলা বেড়িয়ে এল। এসেই এক ওয়েটার কে কানাডিয়ান ভাষায় কিছু বলতে লাগল। একদম বাঙ্গালী গালি গালাজের মত। আমি নির্ঘাত হলফ করে বলতে পারবো এ মহিলাটি ওয়েটার কে গালি গালাজই করছে। সম্ভবত ম্যানেজার কিংবা মালিক হবে মহিলাটি।
আমার কফি চলে এল। চুমুক দিতেই মনটা ভরে গেল। বুঝতে পারলাম এত অব্যবস্থাপনার পড়েও কিভাবে হাউজ টা ঠিকে আছে। বেশ আয়েশ করে কফি খেলাম। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। তবে রেশ টা রয়ে গেছে। শো শো বাতাস বইছে। রেইন ট্রি গাছ গুলো থেকে টপ টপ শব্দে পানি ঝড়ছে। জানান দিচ্ছে মুনসুনের প্রথম বৃষ্টি কিন্তু শেষ নই। আমি বেড়িয়ে আসতে যাবো তখনি একটা লিফলেট এর মত ছোট পোষ্টারে চোখ আটকে গেল। কাচের দরজার এক কোনে লাগানো। সহজেই যে কারো চোখ পড়বে। আমি ভালো করে পড়ে দেখলাম। একটা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। ওয়েটার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। আমি সেটা না দেখার ভান করে বেড়িয়ে এলাম। একজন জমিদারের মেয়ে এখানে এসে ওয়েটার গিরি করবে! অসম্ভব কথা।
.
(চলবে)
.
গত বার যারা #ছাপাখানা_সাহিত্যে_মেলায় লাইক দিয়ে আমাকে ২য় হতে সাহায্য করেছিলেন তাদের ধন্যবাদ জানায়। আবারো বলতে আমার লজ্জা হচ্ছে। কিন্তু পুরষ্কার হিসেবে #বই আছে বলে সব লজ্জার মাথা খেয়েই বলছি। #ছাপাখানা_সাহিত্যর_মেলা ডায়লগ কথন প্রতিযোগিতার ১ম পুরষ্কারের বইটা আমি চাই। প্লিজ আমাকে লাইক দিয়ে প্রথম হতে সাহায্য করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here