#আয়নামতী
#পর্ব_১৭
#পুষ্পিতা_প্রিমা
বাচ্চা কোলে নিয়ে হসপিটাল থেকে বের হয়ে আসলো নামিরা। সায়ান কাঁদছে। নামিরার সেদিকে হেলদোল নেই। সে কালো রঙের গাড়িটার পিছু ছুটতে ব্যস্ত। গাড়িটার নাম্বার ঝাপসা দেখাচ্ছে। স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে না।
আয়না ফার্মেসী থেকে এসে নামিরাকে কোথাও দেখতে পেল না। পাগলের মত হন্য হয়ে দৌড়াল পুরো করিডোর। তারপর নাওয়াজ শেখ যখন আসলেন তখন উনাকে নিয়ে বের হলেন হসপিটাল থেকে। তখনি নামিরাকে চোখে পড়লো। আশপাশ না তাকিয়ে হাঁটছে নামিরা। সায়ান ভীষণ রকম কাঁদছে। আয়না ছুটে গেল। নামিরার কোল থেকে সায়ানকে কেড়ে নিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল
‘ ভাবি কি করছ তুমি? সব ধুলোবালি বাতাস ওর নাকে গিয়ে লাগছে আবার। ছেলেটাকে কি তুমি বাঁচতে দেবে না? ভাবি?
নামিরার কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। সে ওই চলে যাওয়া গাড়িটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল
‘ আয়ান? ওই তো আয়ান, চলে যাচ্ছে কেন?
আয়না গর্জে বলল
‘ মাথা খারাপ হয়েছে তোমার? ভাবি চলো।
নামিরা হাত ছাড়িয়ে নিল। নাওয়াজ শেখকে দেখে দৌড়ে গেল। হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল
‘ বাবা আয়ান। বাবা ও বাবুকে কোলে নিয়েছে। আমি সত্যি বলছি।
নাওয়াজ শেখ কিছু বলেন না। শুধু তাকিয়ে থাকেন। দিনদিন মেয়েটার পাগলামো বাড়ছে বৈকি কমছে না।
আয়না বলল
‘ আঙ্কেল বাবুর ক্ষতি হবে। গাড়ি ডাকুন তাড়াতাড়ি।
নামিরা এলোমেলো কেঁদে বলল
‘ আয়না আমি যাব না তো। তোমরা চলে যাও। আমি যাব না। বাবুকে তুমি দেখে রেখো। আমি আয়ানের কাছে যাই।
আয়না চোখের পলক চেপে রাখলো। বিরক্তি নিয়ে খুলে বলল
‘ যা ইচ্ছা করো, কিন্তু আপাতত বাড়ি ফিরতে দাও। তোমার সন্তানের শরীর খারাপ। আর তুমি এখনো পাগলামি করছো? কেন সত্যিটা মেনে নিচ্ছ না?
নামিরা চুপসে গেল। ভেজাগলায় বলল
‘ তুমিই তো আমাকে বলেছিলে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। বলোনি? তাহলে এখন এমন বলো কেন? আয়ান থাকলে এভাবে কথা বলতে পারতে? ও নেই তাই এভাবে বলছো। ও ছাড়া কেউ আমায় বুঝে না। আমাকে ভীষণ রকম বুঝার মানুষটাকেই কেন হারিয়ে যেতে হলো? আমি কখনো কারো সাথে কোনো অন্যায় করিনি।
নাওয়াজ শেখ মেয়েকে বুকে টেনে নেন। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন
‘ এভাবে কাঁদলে লোকে কি ভাববে? দেখ আশেপাশের মানুষ কিভাবে তাকিয়ে আছে। ধৈর্য ধর মা। তোর সন্তানের কথা ভাব। ও তোর একটা পৃথিবী।
নামিরা বাচ্চার দিকে তাকায়। আয়নার বুকে গুঁজে রয়েছে সায়ান। লাল জিহ্বাটা বের করছে, আবার ভেতর নিয়ে নিচ্ছে। বড় বড় চোখদুটো দিয়ে পিটপিট করে তাকিয়ে দেখছে নামিরাকে। নামিরা কোলে নিয়ে নিল বাচ্চাকে। শান্ত চুপচাপ হয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঠোঁট ছুঁয়ালো ছেলের কপালে। এখানেই আয়ান ছুঁয়েছিল। এখনো স্পর্শ লেগে আছে। সেই চিরপরিচিত স্পর্শ। সেই ঘ্রাণ।
__________
আয়শা বেগম নাতি আর ছেলের বউকে ফিরতে দেখে খুশি হয়ে গেলেন। নাতিকে ঝাপটি মেরে নিয়ে নিলেন আয়নার কোল থেকে। সারামুখে অজস্র আদর দিতে দিতে বললেন
‘ ভাই তুই ছাড়া ঘরবাড়ি আন্ধার। কেন এত অসুখে পড়িস? আল্লাহ ভালা রাইখো আমার ভাইরে।
সায়ান দন্তহীন গাল এলিয়ে হাসে। ছোট্ট হাতের তালু লাগায় আয়শা বেগমের মুখে। খুশিতে আনন্দে চোখে জল আসে তার। মনে হয় একদম তার ছেলে হাসছে।
নামিরাকে মলিন চেহারায় দেখে আয়শা বেগম বিভ্রান্ত হলেন। বললেন
‘ কি হইছে বউ? মন খারাপ করে রাখছো ক্যান? তোমার বাবু ভালা হয়ে যাইবো। আল্লাহ আমার ভাইরে ভালা কইরা দিবো। মন খারাপ কইরোনা। আসো, কিছু খাও আগে।
নামিরা ছলছল চোখে আয়শা বেগমের দিকে তাকালো। আয়না চলে যাওয়ায় ফিসফিসিয়ে বলল
‘ আম্মা আমি আয়ানের কাছে যাব। আমাকে যেতে দিবে?
আয়শা বেগম হতাশ গলায় বললেন
‘ বউ, তোমারে কইছি না তোমার বাবুর দিকে মনোযোগ দিতে। তার কথা বারবার কেন মনে করো? সে তো তোমার চিন্তা করে নাই। উলটপালট চিন্তা কইরোনা বউ।
নামিরা কেঁদে দিল এবার। বলল
‘ আমাকে একটু বিশ্বাস করো আম্মা। আমি আয়ানকে দেখেছি। ও বাবুকে কোলে নিয়েছে। আদর করেছে। তুমি জানো বাবু একদম শান্ত হয়ে গিয়েছে। আমি যাই আম্মা? আয়না তো ধমকায়। তুমি যেতে দাও আম্মা।
আয়শা বেগম নাতিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখেন। আয়না আসতেই নামিরা চুপসে যাওয়া চোখে তাকালো। আয়না বলল
‘ কোথায় যাবে তুমি? কার কাছে যাবে? আমি নিয়ে যাব তোমায়? কোথায় যাবে?
নামিরা বলল
‘ সত্যি?
আয়না মাথা নাড়ালো।
নামিরা ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো তাকে। আওয়াজ করে কাঁদলো। আয়না চোখ চেপে ধরলো তার কাঁধে। বলল
‘ পাগলামির একটা সীমা থাকে ভাবি। তোমার মনে হচ্ছেনা তুমি অতিরিক্ত করছ?
নামিরা ছাড়লো না তাকে। শক্ত করে ধরে রেখে অনুরোধ করে বলল
‘ আমাকে একটু বুঝো। একটুখানি।
আয়শা বেগম চোখ মুছতে মুছতে নাতিকে নিয়ে চলে গেলেন৷
____________
থানায় নাওয়াজ শেখের নাম বলতেই পুলিশ নামিরার দেওয়া নাম্বারটা নিল। কার গাড়ি, এবং সেই মালিকের বাড়ির ঠিকানা যোগাড় করে এনে দেবে বললো। নামিরা ততক্ষণ থানায় বসেছিল। আয়না চুপচাপ পাশে বসে আছে। নামিরা কি করছে সে বুঝতে পারছেনা। পুলিশ প্রায় আধঘন্টা পর সমস্ত ডকুমেন্ট নিয়ে হাজির হলো। গাড়ির মালিকের ঠিকানা দিল নামিরাকে। আয়না দেখে বলল
‘ এখন শহরে কিভাবে যাবে ভাবি? বাবুর গাড়ির বাতাস লাগলে ক্ষতি হবে। আর চেনা নেই, জানা নেই কার না কার বাড়ি। জানিনা কি করছ তুমি।
নামিরা হাত ধরলো আয়নার। বলল
‘ তুমি চিন্তা করো না। আমি যেতে পারব। আব্বা তো আছে।
আয়না বলল
‘ আমি তোমাকে একা ছাড়তে পারব না।
নামিরার মুখ অন্ধকার হয়ে এল।
নাহ, আয়নাকে যেতে দেওয়া যাবে না। সে একা যাবে। আয়না তাকে কোনোকিছু করতে দেবে না। তাছাড়া তার মনের ভুল ও হতে পারে।
আয়না বলল
‘ ঠিকানা দাও আমি গিয়ে দেখে আসি ওই বাড়িতে কে কে থাকে।
নামিরা দিল না কাগজটা। বলল
‘ থাক লাগবে না। যাব না আমি। আমার কোথাও ভুল হচ্ছে বোধহয়।
আয়না স্বস্তি পেল। যাক ভাবির পাগলামি অন্তত কমেছে।
কিন্তু আয়নাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে নামিরা তারপরের দিন ঘুমন্ত ছেলেকে নিয়ে আয়নার পাশ থেকে উঠে ভোররাতে বের হয়ে গেল ছেলেকে নিয়ে। নাওয়াজ শেখ মেয়ের আবদার ফেলতে পারেননি। তাই গাড়ি এনে রেখেছেন আয়নাদের বাড়ির কিছুটা দূরে। নামিরা আয়শা বেগমের কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে বেরিয়ে গেল। আয়শা বেগম তখন ও ঘুম। আয়না ও কিছু জানেনা। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে যখন নাতিকে দেখতে গেলেন আয়শা বেগম তখন দেখলেন পুরো ঘর খালি। নেই নাতি, নেই ছেলের বউ। হায়হায় করে কেঁদে উঠলেন তিনি। আয়না চমকে গেল। অজানা আশঙ্কায় বুক ভার হয়ে এল। রাগ হলো নামিরার উপর। বাবুর শরীরটা খারাপ। ঠান্ডা সইতে পারছেনা ছেলেটা। গাড়ির বাতাস লাগলেই ক্ষতি। ভাবি কি যে করছে।
আয়না সান্ত্বনা দিল মাকে। বলল
‘ ভাবিকে আমি নিয়ে আসব।
কিন্তু ওই বাড়িতে পুলিশের সাহায্যে খবর নিয়ে জানা গেল নামিরা নামের কেউ যায়নি ওই বাড়িতে। আয়না চিন্তায় ফেটে পড়লো। আম্মা অসুস্থ হয়ে পড়বে এসব শুনলে। তাকে কে এই বিপদে সাহায্য করতে পারে?
নামিরা বলায় নাওয়াজ শেখ কাউকে কিছু বললেন না। নামিরা সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি শহরে তার বড় খালামণির বাসায় ছিল। তারপর বের হলো ওই বাড়ির উদ্দেশ্যে তার ছোট খালাতো ভাইকে নিয়ে। তখন ঝড়ের প্রকোপ বেড়েছে। শাঁ শাঁ বাতাসে ভারী পরিবেশ। গম্ভীর, থমথমে চারপাশটা। নামিরা তার খালাতো ভাইকে চলে যেতে বলল। তাহিম যেতে চাইলো না। বলল
‘ আপু ওই বাড়ির গেইটে গাড়ি ঢুকলে সমস্যা হবে না। নইলে বাবুর গায়ে বৃষ্টি পড়তে পারে।
নামিরা ঢেকে নিল সায়ানকে ভারী পাতলা নকশা করা কাঁথা দিয়ে। বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল
‘ গাড়ি গেইটের কাছে থামুক। আমি নেমে যাই। তুই গাড়ি নিয়ে চলে যাহ।
তাহিম যেতে চাইলো না। পরক্ষণে যেতেই হলো। নামিরা গাড়ি থেকে নেমে গেল বৃষ্টি মাথায়। দাঁড়োয়ান বলল
‘ কোথায় যাবেন?
নামিরা বলল
‘ আমি এই বাড়িতে যাব। আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে দিন। আমার বাচ্চার গায়ে বৃষ্টির ফোটা পড়ছে।
দারোয়ান যেতে দিল। ছাতা বাড়িয়ে দিল। বলল
‘ দিনের বেলা আসতে পারেন নাই? এমন সন্ধ্যায় কেউ বাচ্চা নিয়ে বের হয়?
নামিরা কিছু বললো না। দুরুদুরু বুক নিয়ে, একবুক আশা নিয়ে পা দিল শেখওয়াত বাড়ির বারান্দায়। দারোয়ান দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল। গেল যে গেল, আর আসার নাম নেই। নামিরা দাঁড়িয়ে রইলো দরজার কাছে। ভেতরে উঁকি দিল না। সায়ানের কান্না শুরু হয়েছে। ছেলেটা একদম বাবার মতো পাজি হয়েছে। অন্ধকার পছন্দ করে না। তাছাড়া বৃষ্টির ফোটা ও পড়েছে। নামিরা মুছতে লাগলো। নিজের মুখ থেকে সরাতে লাগলো বৃষ্টির পানি।
ছেলেকে দুলাতে দুলাতে বললা
‘ এই তো এখনি আলো আসবে। এখুনি আসবে আব্বা। সারাক্ষণ কান্না।
বলতে না বলতেই কেউ দরজা খুলে দিল। নামিরা সায়ানের মুখ থেকে চোখ তুলে তাকালো। আলো আধারিতে দেখলো সৌষ্ঠব একটি পুরুষ অবয়ব। মুখ ভেজা থাকায় চোখের পানি টের করা গেল না নামিরার। সায়ান আর ও জোরে কাঁদছে। লোকটি দরজার হাতল ছেড়ে দিল। নামিরার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ডাকলো
‘ মিরাহ!!!!
টপটপ করে নামিরার কপোল বেয়ে জল গড়ালো। থুতনি বেয়ে চোখের জল পড়ে ভিজে গেল সায়ানের মুখ। ঠান্ডা পানি মুখে পড়ায় হাত পা নেড়ে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলো সায়ান। নামিরা আরও একবার নিজের নামটা শোনার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো। অতিআগ্রহে চেয়ে রইলো তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির দিকে।
চলবে,,
টাইপিং মিসটেক থাকতে পারে পাঠক।