আয়নামতি পর্ব-১৮

0
1754

#আয়নামতী
#পর্ব_১৮
#পুষ্পিতা_প্রিমা

দারোয়ানের ডাকে হুশ ফিরলো হীরার। মেডিক্যাল ডিপার্টমেন্টে কাল তার রিসার্চ করা ফাইলটা জমা দিতে হবে। খুব ব্যস্ততায় সময় কাটছে তার। সারাদিনে অর্কের ঘরের দিকে ও যাওয়া হয়নি। এমন সময় দারোয়ানের ডাক শুনে ঘর থেকে বের হয়ে এল হীরা। দারোয়ান কিছু বলার আগেই মিরা ডাকটি ভেসে এল বসার ঘর থেকে। দারোয়ানের দিকে তাকালো হীরা। বলল
‘ অর্ক কোথায়?
‘ নিচে ম্যাডাম।
হীরা চলে এল নিচে। অর্ক আবার মিরা ডাকছে কাকে?
কৌতূহল নিয়ে এগোতেই অর্কের মুখোমুখি হীরা।
‘ আপনাকে আমি ডাকছিলাম মিরা।
হাসলো হীরা। বলল
‘ মিরা ডাকলে কি করে বুঝব? আমাকে তো হীরা নামেই ডাকতে হবে।
অন্য কিছু বলল না অর্ক। হীরা বলল
‘ কেন ডাকছিলেন?
‘ বাইরে কে যেন এসেছে। একটা বাচ্চার মা।
দরজার কাছে তাকালো হীরা। এগিয়ে গেল। নামিরাকে দেখতে পেল অতঃপর। আধভেজা এই নারী প্রতিমূর্তি দেখে কিঞ্চিৎ ভুরু কুঁচকালো হীরার। শুধালো
‘ কে আপনি? কাঁদছেন কেন? আপনার বাচ্চা ও তো কাঁদছে।
নামিরা আবার ঠোঁট উল্টে কেঁদে দিল। হীরা বলল
‘ ভেতরে আসুন। কাকে চান? বিপদে পড়েছেন?
নামিরা উপরনিচ মাথা নাড়ালো। হীরা বলল
‘ নাম কি আপনার?
‘ নামিরা।
কপালে আবার ভাঁজ পড়লো হীরার। বলল
‘ আচ্ছা ভেতরে আসুন না। আপনার বাচ্চাকে আমাকে দিন। ঠান্ডা লেগে যাচ্ছে তো। আপনি হসপিটালের খবর রাখেন?
কত বাচ্চা নিউমোনিয়ায় ভুগছে এখন। এদিকে দিন তো। ভেতরে আসুন। কাঁদবেন না। বিপদে যখন পড়েছে তখন উদ্ধার ও হবেন। আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখুন।
দারোয়ান কিছু বলতে চাইলো। নামিরার কান্না দেখে কিছু বলতে পারলো না। তবে হীরার বাবা মা এসে উপস্থিত হলো যখন তখন জানতে চাইলো
‘ কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই তো মেয়ে?
নামিরা হীরার দিকে তাকালো। হীরা বলল
‘ আহা মা কি বলছ এসব? ওনি বিপদে পড়েছেন।
নামিরা তাকালো অর্ক নামক লোকটার দিকে। আবার ঠোঁট উল্টে কেঁদে দিল। সেই আওয়াজ অনুসরণ করে সবাই তাকালো তার দিকে। সেলিনা বেগম বলল
‘ কি রে মেয়ে? ওমা কে গালি দিয়েছে তোমায়? কাঁদছ কেন মেয়ে?
হীরা এগিয়ে গেল। বলল
‘ আমার ঘরে আসুন। আচ্ছা আমার ঘরে ও যেতে হবেনা। আমার পাশের রুমটাতে চলে আসুন। ওখানে থাকতে পারবেন। বাকি কথা ওখানে বলব। আসুন। কাঁদবেন না।
নামিরা যেতে চাইলো না। বলল
‘ আমি ফিরে যাব আম্মার কাছে,গ্রামে। থাকব না এখানে।
হীরা বিস্ময় নিয়ে বলল
‘ এখন কিভাবে গ্রামে যাওয়া যাবে? আজ রাতটা তো থেকে যেতে হবে। একটু বুঝার চেষ্টা করুন৷ আপনার বাচ্চার কথা ভেবে থেকে যান।
নামিরা কাঁদতেই লাগলো। হীরা সায়ানের দিকে তাকালো। ঘুমে ঢুলুঢুলু তার চোখ। ঠোঁট গোল করে কি কি আবোলতাবোল বলছে। হীরা আদর করলো। হৃষ্টপুষ্ট শরীরের বাচ্চাটিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল
‘ আপনার বাচ্চা তো একদম বিড়ালের মতো। ম্যাওম্যাও করে। কি আদুরে। কার মতো হয়েছে? আপনার রঙ শ্যামা। ও তো ধলা বিলাই।
নামিরা চোখ মুছলো। তাকালো অর্ক নামক লোকটার দিকে। অর্ক অন্যদিকে তাকালো৷
নামিরা কান্না থামানোর চেষ্টা করে বলল
‘ ওর আব্বার মতো হয়েছে। ও এমনই ছিল।

চোখ তুললো হীরা।
‘ ছিল?
উপরনিচ মাথা নাড়ালো নামিরা। ঠোঁট টেনে কেঁদে বলল
‘ এখন নেই। হারিয়ে গেছে।
ভাবনায় পড়লো হীরা। বলল
‘ আচ্ছা ঘরে আসুন। আপনার বোরকা ভিজে গেছে। আসুন। চিন্তা করবেন না। আপনার কোনো অসুবিধা হবে না।
সায়ান হাত পা নেড়ে চেঁচিয়ে উঠলো। হীরা হেসে ফেলল। শক্ত করে আষ্টেপৃষ্টে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল
‘ কি দুষ্টু ছেলে? দেখো তোমার মা কিভাবে কাঁদছে। দুষ্টু বিড়াল। মাছ খাবে? নাকি মাছের কাঁটা খাবে।
হীরা হাত ধরলো নামিরার। নামিরা যেতে চাইলো না। হীরা টেনে নিয়ে গেল তাকে। যেতে যেতে বারবার অর্কের দিকে ফিরে তাকালো নামিরা। অর্ক তাকে তাকাতে দেখে আবার চোখ সরিয়ে নিল। সেলিনা বেগম লক্ষ করলেন ব্যাপারটা। অর্কের কাছে গিয়ে বললেন
‘ চেনো মেয়েটাকে?
অর্ক মাথা নাড়ালো দু পাশে। সেলিনা বেগম হাত বুলিয়ে দিল তার মাথায়। মৃদু হাসলো অর্ক।
সেলিনা বেগম বললেন
‘ হীরা টা কি যে করে। চেনেনা জানেনা কোন একটা মেয়েকে ঘরে নিয়ে গেল। খারাপ মতলব নেই কে বলতে পারে?
আমিন সাহেব খবরের কাগজ মুখ থেকে সরিয়ে বললেন
‘ সবকিছুতেই তোমার খারাপ মন্তব্য করা লাগবেই।
চুপ হয়ে গেল সেলিনা বেগম।

___________

ঘর থেকে বের হওয়ার আগেই অনুরাগের সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো শায়খ চৌধুরী। অনুরাগ চোখ তুলে বাবার দিকে চাইলো। বলল
‘ কি সমস্যা বাবা?
শায়খ চৌধুরীর পেছনে আনহিতা এসে দাঁড়ালো। শায়খ চৌধুরী বললেন
‘ কোথায় যাচ্ছ তুমি? তুমি কি ভুলে যাচ্ছ তোমার লড়াইটা কার সাথে হতে যাচ্ছে। সামনেই তোমার একটা প্রোগ্রাম।
অনুরাগ বলল
‘ আশ্চর্য তো? আমি তো সবটা জানি। কিন্তু এখন আমার পথ আটকানো হচ্ছে কেন বাবা?
আনহিতা বলে উঠলো।
‘ তুমি একা একা কোথায় যাচ্ছ সোহাগ? দেখো তোমার একা একা কোথাও যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ।
অনুরাগ হতাশ হলো। বলল
‘ আমি ছোট নই মা। বড় হয়েছি। আরেক কি আশ্চর্য!
শায়খ চৌধুরী বলল
‘ ওই পেঁয়াজ ব্যবসায়ীর মেয়ের সাথে তোমার কি?
অনুরাগ অদ্ভুত চোখে চাইলো। বলল
‘ মানে?
‘ আমি অনেকদিন ধরে অনেককিছু শুনছি। তুমি ওই মেয়ের বাগানের দিকে কি করতে যাও? ওই মেয়ের সাথে তোমার কিসের এত লেনদেন?
অনুরাগের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো। সে বলল
‘ আপনারা আমাকে ছোট্ট বাচ্চার মতো জেরা করছেন বাবা। যা অনুচিত। ভালোমন্দ বাছবিচার করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আমার আছে। এবং আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি। আমাকে নিজের মত করে থাকতে দিন। অনেক তো শুনেছি আপনাদের কথা। ভালো কিছু তো হলো না।
শায়খ চৌধুরী বড় গলায় অনুরাগের নাম ধরে ডেকে উঠলেন
‘ অনুরাগ?
অনুরাগ সামান্য ঠললো না এই ধমকে। বরঞ্চ সেই ধমককে ঠেলে দিয়ে বললো
‘ আপনাদের কারণে আমার মানসম্মান ডুবেছে, নিশ্চিন্তে থাকুন আমি আপনাদের মানসম্মান ডুবাবো না।
শায়খ চৌধুরী সরে পড়লেন। অনুরাগ বের হয়ে গেল হনহনিয়ে।
শায়খ চৌধুরী গর্জে আনহিতাকে বললেন
‘ তোমার ছেলে দিনদিন অবাধ্য হয়ে উঠছে আনহিতা। আমি এসব সহ্য করব না। ওর ভালো চেয়ে এসেছি আমি সবসময়, খারাপ হয়েছে এতে কি আমার হাত ছিল? ওই মেয়েটা খারাপ ছিল তাতে কি আমার দোষ?
আনহিতা চুপ করে থাকলো। শায়খ চৌধুরী চিল্লিয়ে বাড়ি এক করলেন। শায়লা বেগম লাঠিতে ভর দিয়ে হেঁটে হেঁটে ছেলের দিকে এগিয়ে গেলেন। সোফায় বসলেন। শান্ত গলায় বললেন
‘ ওকে ওর মত করে থাকতে দে। ওর উপর আর কোনোকিছু চাপিয়ে দিস না। ভুলে ও বিয়েশাদির কথা তুলিস না। রাগের মাথায় কি না কি করে বসে।
আনহিতা এসে বলল
‘ মা ও একটা পরিচিত মুখ এই জেলার। ওর সবকিছু পার্ফেক্ট থাকা দরকার। নাহলে জনতা প্রশ্ন তুলবে। আপনি কেন বুঝতে চাইছেন না। অনুরাগকে বুঝতে হবে ব্যাপারটা। কুহেলী খারাপ ছিল তার মানে এই নয় সব মেয়েরাই এমন।
শায়লা বেগম বললেন
‘ ওর যাকে মনে ধরবে, ও তাকেই বিয়ে করুক। চাও না?
আনহিতা শায়খ চৌধুরীর দিকে তাকালেন। মৃদুস্বরে বললেন
‘ চাই।
‘ তাহলে চুপ করে থাকো। সময়টা একদিন আসবে। তখন কিছু হলেও তোমাদের দোষ থাকবে না।
আনহিতা বলল
‘ কিন্তু মা, আমি চাইছি ওর একটা সংসার হয়ে যাক। আমি বেঁচে থাকতে ওর একটা গোছানো সংসার হয়ে যাক। সেসব কবে হবে? দেড়টা বছর তো চলেই গেল এমনি এমনি।
শায়লা বেগম আর কিছু বললেন না। বলতে চাইলেন না।

________

থানা থেকে বেরিয়ে আসলো অনুরাগ। আয়নার বাড়ির ফোনে ফোন লাগালো তারপর পরই। আয়না রান্না বসিয়েছিল রান্নাঘরে। রূপা এসে ফোন হাতে নিল। কানে নিতেই অনুরাগের গলা শুনে দৌড়ে গেল। আয়নাকে বলতেই আয়না দূরে দাঁড়িয়ে বলল
‘ তুই কথা বল। আমি বলব না।
রূপা সালাম দিল।
‘ অনুরাগ সালাম নিয়ে বলল তোমার আপাকে দাও ফুলটুসি।
রূপা ভয়ে ভয়ে বলল
‘ আপা কথা বলবেনা বলছে। শরম পায়।
আয়না চোখ লাল করে তাকালো।
অনুরাগ বলল
‘ আচ্ছা ঠিক আছে। তোমার আপাকে বলো সায়ানের খোঁজ পেয়ে গেছি।
রূপা বলল
‘ সায়ানের খোঁজ?
আয়না ফোন কেড়ে নিল। বলল
‘ কোথায় পেয়েছেন? তাড়াতাড়ি বলেন। আমি এক্ষুণি যাব।
অনুরাগ থামলো। খানিক্ষন পরে বলল
‘ বাহ কথা তো বলতে জানো। ভেবেছি কথা বলতে ভুলে গেছ।
আয়না ফোনটা রূপাকে দিয়ে দূরে সরে পড়লো। ফিসফিস করে বলল
‘ সায়ান কোথায় সেটা বলতে বল।
রূপা হেসে ফেলল। অনুরাগকে বলল
‘ সায়ানের খোঁজ দিতে বলতেছে। নইলে ফোন রাখতে বলতেছে।
অনুরাগ বলল
‘ শহরের ওই বাড়িটাতে উঠেছে সন্ধ্যায়। ওই বাড়ির কর্তার সাথে আমি কথা বলেছি। তোমার আপাকে জিজ্ঞেস করো কখন যেতে চায় ও।
রূপা জিজ্ঞেস করলো। আয়না বলল
‘ কাল সকাল সকাল৷ এখন তো আম্মার জ্বর। শহর তো অনেকদূর।
অনুরাগ বলল
‘ ঠিক আছে।

__________

এক বাচ্চার কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল অর্কর৷ এপাশ ওপাশ করতে করতে সে উঠে গেল শেষমেশ। দরজা খুলে বের হয়ে এল রুম থেকে। কান্নার আওয়াজ অনুসরণ করে হাঁটতেই দেখতে পেল হীরার পাশের রুমটা থেকেই শব্দটা আসছে। হেঁটে গেল অর্ক। দরজাটা ঠেলে ঢুকলো রুমটাতে। ছেলেকে বুকে নিয়ে ঘুম পাড়ানো মেয়েটির চোখ বন্ধ। দরজাটা লাগিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো অর্ক৷ বাচ্চাটার কান্না থামলো৷ হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছে৷ মা শুইয়ে দিল বাচ্চাকে৷ নিজের ভেজা গাল মুছে শোয়ার আগেই চোখ গেল দরজার কাছে। দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা তার না?
দ্রুতপায়ে হেঁটে গেল নামিরা৷ একদম মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালো৷ হাত তুলে ছুঁলো মুখ,গলা,বুক। তারপর ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। মিনমিন করে বলল
‘ আমাকে আমার সেই হারিয়ে যাওয়া রঙিন দিনগুলো ফিরিয়ে দাও। আমার সন্তানের কাছে তার আব্বাকে ফিরিয়ে দাও। আমাকে আমার মানুষটাকে ফিরিয়ে দাও৷ আমাকে একটু ভালোবাসো। আমি কতদিন তোমাকে ছুঁই না, তোমার বুকে মাথা রাখিনা৷ তোমার ভালোবাসার অভাবে আমি রোজ রোজ মরছি আয়ান। আমার কাছে ফিরে আসো। আমার তোমাকে ভীষণ প্রয়োজন আয়ান । আমাকে খুব করে বুঝার আর ভালোবাসার মানুষটাকে আমার ভীষণ প্রয়োজন।
অর্ক নড়লো না, সরলো না। শুধু দাঁড়িয়ে থাকলো শক্ত হয়ে।
নামিরা তার বুকের কাছে শার্ট ভিজিয়ে দিল৷

চলবে,
অনেক দিন পর😌😌😌😌

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here