আয়নামতি পর্ব-২৩

0
1988

#আয়নামতী
#পর্ব_২৩
#পুষ্পিতা_প্রিমা

শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেছে আনহিতার। ভাঙা হাত পায়ের যন্ত্রণা তো আছেই। বুকে ও খানিকটা ব্যাথা পেয়েছে, সব মিলিয়ে খারাপ অবস্থা। কথা বলার অবস্থায় নেই। অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে। ডাক্তার জানিয়েছে যেকোনো সময় খারাপ কিছু ঘটে যেতে পারে। শহরে ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে।
তখন রাত সাড়ে আটটার কাছাকাছি। হসপিটালের সামনে এসে থামলো অনুরাগের গাড়ি। অনুরাগ হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তার পাশে থাকা বধূটিকে দেখলো। বলল
‘ এসে গিয়েছি নামো।
আয়নার হাতে বিয়ের শাড়ি,গহনা আর ওড়নার ব্যাগ। গায়ে লাল সাদা রঙের থ্রি সেলোয়ার-কামিজ। মাথা ঢাকা ওড়নায়। অনুরাগ ব্যাগটা নিয়ে নিল। বলল
‘ নেমে এসো।
আয়নার মুখ ফোলা।
অনুরাগ বলল
‘ কি হলো?
আয়না ফুঁপিয়ে উঠে বলল
‘ আমি বোরকা ছাড়া কখনো বের হয়নি।
অনুরাগ কোমরে হাত দিল। বড় করে শ্বাস নিল। বলল
‘ ওরেহ পর্দারজনী! আমাকে ওই কাপড়ের দোকানে বললো কি হতো? একটা বোরকা ও নিয়ে দিতাম। বলার সময় পেল না।
আয়না আবার ফুঁপালো। বলল
‘ আমি গাড়িতেই বসে থাকব। কোথাও যাব না৷
অনুরাগ বলল
‘ যাবে। আমার সাথে না, তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য মেয়ে পাঠাচ্ছি। ওদের সাথে যাবে।
আয়না কৌতুহল জাগলো। কেন তাকে মেয়েগুলো নিয়ে যেতে আসবে? সে জিজ্ঞেস করে বসলো
‘ আপনি বিয়েটা লুকিয়ে রাখবেন ?
অনুরাগ হেসে ফেলল। আয়নামতী দারুণ চালাক। সে বলল
‘ নাহ লুকাবো কেন?
আয়না বলল
‘ তাহলে আমি যাব আপনার সাথে।
অনুরাগ এদিকওদিক তাকালো। কেউ যদি তার সাথে আয়নামতীকে দেখে নেয় তাহলে কাল খবরের কাগজে উল্টাপাল্টা কথা বেরোবে। আয়নামতীর ও অসম্মানি, তার ও।
মাথায় চট করে বুদ্ধি এল অনুরাগের। বলল
‘ আয়নামতী বোরকা কিনে নিয়ে আসি। তুমি একটুখানি বসো।

এই বলে চলে গেল অনুরাগ। তার সাঙ্গপাঙ্গ নাজমুলকে ফোন করে বোরকা কিনে আনতে বলল চটজলদি। নাজমুলের দোকান আছে আগ্রাবাদের নিউমার্কেটে। নাজমুল তার লোক দিয়ে বোরকা পাঠিয়ে দিল। অনুরাগ আনহিতার কাছে পৌঁছে গেল। ফোন করে ড্রাইভারকে বলল যাতে নাজমুলের লোকের কাছ থেকে বোরকা নিয়ে আয়নামতীকে দেয়। তারপর ৩৫৬ নম্বর রুমে নিয়ে আসে।
ড্রাইভার তাই করলো। বোরকা পেয়ে পড়ে নিল আয়না। নতুন ওড়নাটা দিয়ে হিজাব বেঁধে নিল। নাকমুখ থমথমে হয়ে আছে। চোখের কোণা আবছা লাল।
ড্রাইভারের সাথে করে এগোলো আয়না। ৩৫৬ নম্বর কক্ষের কাছে পৌঁছাতেই অনুরাগকে দেখা গেল। চারপাশে সে লোক রেখেছে যাতে কেউ ভুলে ও তার সাথে আয়নাকে টের না পায়। রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে একপাশে গুটিসুটি মেরে দাঁড়ালো আয়না। অনুরাগ তাকালো তার দিকে। ঘনঘন চোখ মুছায় চোখদুটো ফুলছে অসম্ভব রকম। বাবা আর আশরাফ ভাই আসার আগে আয়নামতীকে তার এখান থেকে নিয়ে যেতে হবে। আপাতত এসব কাউকে জানানো যাবে না। আয়নার কাছে এগিয়ে আসলো অনুরাগ। হাতটা ধরে নিয়ে গেল কেবিনের দিকে। আয়না চুপচাপ গেল। অনুরাগ আলতো করে ধরলে ও আয়নার মনে হচ্ছে হাতটা খসে পড়ে যাবে এক্ষুণি। ছোঁয়া অসহ্য ঠেকছে তাই বোধহয় এমন লাছে।
নার্স দুজন বেরিয়ে এল। বলল
‘ পেশেন্টের অবস্থা ক্রিটিকাল। আসলে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টায় আছি। হাত পা ভাঙায় সব ব্যাধি আর ও বেড়ে গিয়েছে।
অনুরাগের মুখ পাংশুটে রঙ ধারণ করলো। ছেড়ে দিল আয়নার হাত। ঝড়ে পড়লো হাতটা। আয়না তাকালো বেডে শুয়ে থাকা আনহিতার দিকে। অনুরাগ ছুটে গেল। মায়ের কপালে হাত রাখলো। নার্সকে বলল
‘ মায়ের তো জ্বর ও এসেছে সিস্টার।
নার্স বলল
‘ জ্বি স্যার। শরীরের ব্যাথায় জ্বর চলে এসেছে।
অনুরাগ বলল
” মা কি আর হাঁটতে পারবে না?
‘ পারবে। তবে এখন না। ওনাকে কয়েকদিন বসে বসে কাটাতে হবে সুস্থ হলে। এখন দোয়া করুন যাতে শ্বাসকষ্টটা কমে যায়।
অনুরাগ মাথায় হাত বুলিয়ে দিল মায়ের। ফিসফিসিয়ে ডাকল
‘ মা? চোখ খুলো। আমি এসেছি।
অনেকবার ডাকার পরে মৃদু মৃদু চোখ খুললো আনহিতা। অক্সিজেন মাক্স খুলে ফেলতে চাইলো। অনুরাগ বাঁধা দিল। বলল
‘ তোমাকে কথা বলতে হবে না। তুমি শুধু চোখটা খোলা রাখো।
আনহিতা কান্নায় ভেঙে পড়ার আগে অনুরাগ বলল
‘ মা কেন এমন করছ? মা দেখো আমার দিকে। তাকাও।
আনহিতা তাকালো। অনুরাগ তার হাতের মুঠোয় হাতটা নিয়ে বলল
‘ মা আমি কখনো আর তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। আর কখনো ওভাবে বাড়ি ছেড়ে যাব না। দেখো আমি কাকে নিয়ে এসেছি।
আনহিতা চোখ নিচে নামালো। টলমলে চোখে ঝাপসা ঝাপসা দেখলো দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আয়নাকে৷ আয়না এক পা এগিয়ে আসলো। ইনি নিশ্চয়ই খুব রেগে যাবে এখন। বলবে এই মেয়েকে কেন বিয়ে করেছ? আমি ঘরে তুলব না এই মেয়েকে।
কিন্তু না আনহিতা এমন কিছুই বললো না। চোখে জমে থাকা জল গড়িয়ে কান ছুঁলো তার। অনুরাগ মুছে দিতে দিতে বলল
‘ মা আবার?
আনহিতা একটানে মাক্সটি সরালো। বললো,
‘ আমি,, আমি সত্যি দেখছি?
অনুরাগ বলল
‘ হ্যা।
আয়না ছলছলে ভেজা কান্নাচোখে চেয়ে থাকলো। আনহিতা আবার মাক্স মুখে পড়ে দেখলো আয়নাকে। মেয়েটা কি খুশি হয়নি এই বিয়েতে? চেহারাটা অমন দেখাচ্ছে কেন? তারমানে সোহাগ ওর সাথে ও ভালো থাকবে না।
আনহিতার শ্বাসকষ্ট আর ও বাড়লো৷ আয়না ভড়কে গেল৷ অনুরাগ উত্তেজিত হয়ে ডাকলো নার্সকে। নার্স এসে হাতের কব্জি ধরে পালস রেট চেক করে বলল
‘ ওনি উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। ধীরে ধীরে শ্বাস নিতে বলুন স্যার। শান্ত করান।
অনুরাগ বলল
‘ মা মা কি হয়েছে? মা আমার দিকে তাকাও। মা?
আয়নার দিকে তাকালো অনুরাগ। বলল
‘ তুমি আমার মায়ের সাথে একটু হাসিমুখে কথা বলতে পারছ না। তোমার সাহায্য লাগছে বলে দামে উঠেছ? তুমি কেন এমন আয়নামতী? মা তো তোমার ও আছে।

আয়না ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো৷ ডাক্তার ডাকার জন্য বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে। এসে দেখলো তরতরিয়ে কাঁপতে থাকা হাতটার কাঁপুনি থেমেছে৷ শ্বাস ধীরে ধীরে আদান-প্রদান হচ্ছে। চোখ বন্ধ করে বুকভরে শ্বাস নিল অনুরাগ।

আয়না তার হাতটা আনহিতার হাত থেকে নিয়ে নেওয়ার আগে আনহিতা শক্ত করে ধরে রাখলো। আয়না তাই নিল না। নিভিয়ে আসা চোখদুটো অনুরাগের দিকে তাকালো। ছুটে এল অনুরাগ। মায়ের ইশারায় হাত রাখলো আয়নার হাতটার উপর৷ হাতদুটো একত্রে পেয়ে আনহিতা তার হাতটা দিয়ে মিশিয়ে রাখলো ওই দুহাত। কিছু বলতে চাইলো৷ অনুরাগ বলতে দিল না৷ আনহিতার ভাঙা হাতটা কাঁপা শুরু করলো। অনুরাগ বলল
‘ মা সুস্থ হও আগে,তারপর বাকিসব। আমি তোমার কথা রেখেছি মা৷ এইবার আমার কথা তোমাকে রাখতে হবে। আমি খুব একা হয়ে যাব মা৷ তাড়াতাড়ি সেড়ে উঠো প্লিজ।
ঠোঁটের কোণায় একটুখানি হাসির রেখা দিল আনহিতার৷ অনুরাগের ঠোঁটের কোণায় গিয়ে ঠেকল সেই হাসি৷ হাসলো না শুধু ওই একজন৷ চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার।

_____________

হসপিটাল থেকে সোজা আবার আনন্দমোহন কুটিবাড়িতে চলে আসলো অনুরাগ। আয়না সারা রাস্তায় শুধু চেঁচালো বাড়ি যাব বলে বলে। অনুরাগ চুপচাপ৷ মায়ের অসুস্থতায় চিন্তিত সে। আয়নাকে এখন গ্রামে নিয়ে যাওয়া যাবে না। ওখানে কতকিছু ফেস করতে হবে৷ কে জানে কি হয়?
অনুরাগ ক্লান্তি অনুভব করলো। আয়নার দগদগে লাল মুখাবয়বের দিকে তাকিয়ে বলল
‘ নামো।
আয়না নামলো না। অনুরাগ বলল
‘ আজকে কোথাও যাওয়া হবেনা আর। আমি তোমাকে কাল দিয়ে আসব তোমাদের বাড়ি।
আয়না গর্জে বলল
‘ এক্ষুণি যাব।
অনুরাগ বলল
‘ গেলে যাও। আমি কিছু জানিনা৷
রেগে তাকালো আয়না। সব নষ্টের মূল এই লোক এখন বলে কিছু জানেনা। অনুরাগ চাবি দিয়ে তালা খুলে ঢুকলো বাড়িতে।
আয়না ফুঁপিয়ে উঠলো।
ড্রাইভার তাড়াহুড়ো করে নেমে বাড়ির পেছনের দিকে চলে গেল।

আয়না সেই সুযোগে গাড়ি থেকে নামলো। ব্যাগটা শক্ত করে বুকে ধরে যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে চলে গেল।

রুমে এসে গায়ের পাঞ্জাবি পাল্টে নিল অনুরাগ। আয়নামতী ঘুমিয়ে গেলে তাকে বাড়িতে যেতে হবে। এই পাজি মেয়েকে একা ও ছাড়া যাবেনা। পালাতে পারে। রাশেদ ভাইকে বলে কাউকে নিয়ে আসতে হবে।
রাশেদের ফোনে ফোন লাগিয়ে হেঁটে বারান্দায় চলে এল অনুরাগ৷ কথা বলা শেষ করে বাইরে তাকিয়ে বলল
‘ তুমি কি গাড়িতেই রাত কাটাবে ভাবছ নাকি আয়নামতী?
কোনো সাড়াশব্দ এল না। অনুরাগ ড্রাইভারকে ডাকল
‘ ড্রাইভার এল মিনিটখানেক পরে। বলল
‘ স্যার আমি ওই ইয়ে,,,
অনুরাগ কপাল চাপড়ে বলল
‘ শালা ইয়ে করার টাইম আর পাসনি, আয়নামতী কোথায়?
ড্রাইভার ভড়কে গেল। বলল
‘ গাড়িতে।
অনুরাগ বজ্রগম্ভীর গলায় চেঁচিয়ে বলল
‘ তোর মাথা আছে। আয়নামতী কোথাও নেই।
ড্রাইভার ছেলেটা কাঁচুমাচু করে এদিকসেদিক তাকালো। অনুরাগ পকেটে ফোন গুঁজে চাবি কেড়ে নিল ড্রাইভারের পকেট থেকে। গাড়িতে উঠে তাড়াতাড়ি গাড়ি ছাড়লো। এই মেয়ে তো দেখছি তার জীবনটা ত্যানাত্যানা বানিয়ে ছাড়বে। যাবে কোথায় এত রাতে?
গাড়ি রাস্তায় উঠলো। অনুরাগ ধীরগতিতে গাড়ি চালিয়ে বারবার এদিকওদিক তাকায়। আয়নাকে দেখতে পায় না। এই মেয়ে কি শুরু করেছে? দু বছর আগে বিয়ে হলে কি এভাবে পালাতো? আশ্চর্য!

কিছুদূর গিয়ে বাজার। সুপারশপ,কাপড়চোপড়ের বড় বড় দোকান। তারপরে ছোট ছোট।
অনুরাগ তন্নতন্ন করে খুঁজলো আয়নাকে। কোথাও পেল না। আয়নামতীর হাতে টাকা ও নেই। গাড়ি ও নিতে পারবেনা সে। গেল কোথায় মেয়েটা?
গাড়ি থেকে নামলো না অনুরাগ। নামলেই কেলেংকারি হয়ে যাবে। অনুরাগ আবার ফোন লাগালো রাশেদকে। রাশেদ ফোন তুলে বলল
‘ পাঠাচ্ছি ওদের৷
অনুরাগ বলল
‘ পাঠিয়ে কি হবে? আয়নামতীকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। কেন যে সঙ্গে করে না নিয়ে চলে গেলাম। এত বিচ্ছু এই মেয়ে আমি জানতাম না৷
রাশেদ হেসে দিল। বলল
‘ কম তো প্যারা দিলিনা তাকে। এবার তুই একটু নে। কি আর করবি। খুঁজে দেখ। নইলে লোক লাগা।
অনুরাগ বলল
‘ আমার মনে হচ্ছে ও গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। এখান থেকে তো বেশিদূর না, শহরে হলে একটা কথা৷
রাশেদ বলল
‘ আমার ও তো তাই মনে হচ্ছে। ওর কাছে টাকাপয়সা ছিল?
অনুরাগ বলল
‘ আমার জানামতে নেই। ওই মেয়ের সাহস ও তো কম না। উফফ কি জ্বালা!
রাশেদ হাসলো আওয়াজ করে। অনুরাগ রাগ দেখিয়ে বলল
‘ হাসো কেন রাশেদ ভাই? আমার এমনিতে মাথা খারাপ৷
রাশেদ হাসা থামিয়ে বলল
‘ চলে গেছে গ্রামের বাড়ি। কি আর করবি? তুই ও দৌড় লাগা।
অনুরাগ কপাল ঠেকালো গাড়ির হ্যান্ডেবারে। বলল
‘ আচ্ছা ফোন রাখো। আমি দেখছি।
রাশেদ ফোন রেখে দিল। অনুরাগ ড্রাইভারকে ফোন করে বলল
‘ তুমি রাতটা সেখানে কাটিয়ে দাও। আমি সকাল সকাল আসব। চাবি আমার কাছে।
ড্রাইভার বলল
‘ জ্বি স্যার।

অনুরাগ গ্রামের উদ্দেশ্যে ছুটতেই রাস্তার পাশে একটি ছোট্ট চায়ের দোকান দেখলো। বড় হারিকেন জ্বলছে দোকানটাতে৷ জ্যোৎস্না রাত হওয়ায় সবটা পরিষ্কার৷ দোকানের সামনে লাল ওড়না মাথায় একটা মেয়েকে দেখা গেল। টুলে বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে চায়ের পেয়ালায় চা টানছে।
অনুরাগ গাড়ি থেকে নামলো আশপাশ দেখে। এখানে আপাতত কেউ আসার সম্ভাবনা নেই।
কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালো অনুরাগ । এই মেয়ে তাকে যন্ত্রণায় রেখে চা টানছে? অসভ্য মেয়ে!

অনুরাগকে দেখে দোকানদার দোকান থেকে বের হয়ে এল। অনুরাগ ইশারায় চুপ থাকতে বলল। দোকানদার চুপ হয়ে গেল। অনুরাগ ধীরপায়ে হেঁটে গেল আয়নার পেছনের টুলটার দিকে। বসলো বেশ আয়েশ করে। গম্ভীরমুখে দোকানদারকে বলল
‘ মামা গরম এক কাপ চা দেন তো। চিনি কম।
আয়নার মুখের চা পড়ে গেল। ভয় নিয়ে পেছনে তাকালো সে। চায়ের পেয়ালা রেখে ভয়ার্ত চোখে তাকালো অনুরাগের দিকে। অনুরাগ ভুরু উঁচিয়ে বলল
‘ কি?
আয়না ব্যাগটা তুলে দৌড় দিতে চাইলো। অনুরাগ পা বাড়িয়ে দিল। ধপাস করে পড়ে গেল আয়না। ব্যাথায় মুখখানা কুঁচকে এল। অনুরাগ তাড়াতাড়ি তুললো তাকে। আয়না খামচে ধরলো তার হাত। ঝামটি মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল
‘ আপনি আমাকে শান্তি দিচ্ছেন না কেন? যেদিকে যাচ্ছি সেদিকে।
অনুরাগ বলল
‘ সোজা গাড়িতে গিয়ে বসো। গ্রামে ছেড়ে আসছি।
আয়না অবিশ্বাস্য গলায় বলল
‘ সত্যি?
‘ হ্যা।
খুশি হলো আয়না। কিন্তু তা দেখালো না। চোখে তার কান্না। গলার স্বর আটকে যাচ্ছে বারবার। অনুরাগ গাড়িতে গিয়ে বসলো। আয়না পেছনের সিটে গিয়ে বসলো। বলল
‘ এই শাড়ি গয়না আমি নিয়ে যাব না।
অনুরাগ ধমকে বলল
‘ চুপ। আমাকে চিন্তায় ফেলে চা টানছিলে পা দুলিয়ে দুলিয়ে। সাহস তো কম না।
অনুরাগ গাড়ি ছাড়তে চাইলো। আবার থেমে গেল। দোকানদারকে ডেকে টাকা দিল। দোকানদার নিতে চাইলো না। বলল
‘ সাহেব আপনের বউ আমাগো দোকানের চা খাইছে,এইডা তো মোর সৌভাগ্য। কিন্তু বউমণি রাগে ক্যান?
অনুরাগ বলল
‘ টাকাটা নিন। আর কাউকে বলবেন না আপনি আমাকে এখানে দেখেছেন। ঠিক আছে?
ধমক পেয়ে টাকা হাতে নিল দোকানদার। খুশি ও হলো।
গাড়ি ছাড়তেই আয়না নাক টেনে বলল
‘ অভদ্র লোক।
অনুরাগ গাড়ি চালানোতে মনোযোগ দিল। বলল
‘ এই সপ্তাহেই ঘরে নিয়ে যাব তোমাকে। প্রস্তুত থাকবে।
আয়না বলল
‘ তার আগেই আমি গলায় ফাঁস দেব। তবু ও যাব না আপনার সাথে। আপনার সাথে আমি কিছুতেই থাকব না। মগের মুল্লুক পেয়েছেন? আপনি বুঝতে পারছেন না আপনাকে ঘেন্না করছি আমি। অতটা অবুঝ আপনি তো নন। যে মানুষের কাছে একজন আদর্শ সে এমন জঘন্য কাজ করতে পারে সেটা আমার ধারণার বাইরে ছিল।
নিজেকে সামলে অনুরাগ বলল
‘ চুপ থাকো। বেশি কথা বলবে না। একদম দামে উঠবেনা। আমি একশটা বিয়ে করব তোমার কি?
‘ করেন বেয়াদব পুরুষ মানুষ।
হো হো করে হেসে দিল অনুরাগ। রাগে ফোঁসফোঁস করলো আয়না। অনুরাগ বলল
‘ নাগিনী!

_________________

উঠোনে গাড়ি থামতেই আয়শা বেগম আর নামিরা বের হয়ে এল। রূপা ও এল। তার কোলে সায়ান। আয়শা বেগম অনুরাগকে দেখে বেরিয়ে এল না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো মুখ শাড়ির আঁচলে ঢেকে। সামনে যাওয়া যায় না।
নামিরা এল। আয়নাকে বলল
‘ কোথায় ছিলে আয়না? তোমার ভাইয়া তো সেই কবে বেরিয়েছে। এখনো ফেরেনি। ফোন ও নিয়ে যায়নি।
আয়না শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আঁড়চোখ মায়ের দিকে তাক করা। অনুরাগ ব্যাগটা নিয়ে নামিরার হাতে দিল। বলল
‘ এগুলো রেখে দিন। আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে।
নামিরা ব্যাগটা হাতে নিল। বলল
‘ এগুলো কি? মানে কি? কেন? আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা৷
অনুরাগ বলল
‘ আপনার ননদিনী সব জানে। আপনারাও কিছুই জানেন না এমনটা নয়।
নামিরা ঘরে চলে গেল ব্যাগটা নিয়ে। আয়শা বেগম ঘরে ঢুকে গেল। মুখে শাড়ির আঁচল গুঁজে আজহার সাহেবকে গিয়ে বললেন
‘ দেখে এসো কি আকাম করে ফিরেছে তোমার আদরের ঝি।
আজহার সাহেব হেঁটে বাইরে গেলেন না। তবে আয়শা বেগমকে বললেন
‘ দু বছর আগে তো বিয়ে ভাঙাই কেঁদেছিলে। আজ আবার বিয়ে হওয়ায় কাঁদছ কেন?
আয়শা বেগম তেজগলায় বললেন
‘ তো কি ঢোল পিটিয়ে নাচব?
হাসেন আজহার সাহেব। বলেন
‘ বিয়ে বলে কথা। নাচার দরকার পড়লে নাচতে তো হবেই। আনাকে ঘরে নিয়ে এসো। আজ এসব কথা আর ওর সামনে তুলো না। আমার মেয়েটার উপর অনেক দখল গেছে। পরের সিদ্ধান্ত কাল।
আয়শা বেগম বলল
‘ আমার বাবু তো এখনো বাড়ি ফিরলো না। ও মেনে নেবে না এই বিয়ে।
‘ বিয়ে তো হয়ে গেছে আয়শা।

অনুরাগ চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। আবার হেঁটে আসলো আয়নার পাশে। বলল
‘ ঘরে যাও। আমি কাল ও আসতে পারি, পরশু ও আসতে পারি। দুই সেকেন্ড কিংনা ঘন্টার পরেও আসতে পারি।
আয়না গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল
‘ জীবনে ও আসবেন না। খুন করব আমি।
হাসলো অনুরাগ। বলল
‘ বাসর রাতটা মাটি করে আবার রাগ দেখাও। অসভ্য মেয়ে।
আয়না গর্জে উঠে কিছু বলতে চেয়ে আবার কেঁদে দিল।
অনুরাগ বলল
‘ আরেহ ভাই কাল আসব। আর কেঁদোনা।
আয়না সরে দাঁড়ালো।
হেসে চলে গেল অনুরাগ।

__________

আয়শা বেগম যখন তর্ক করছিলেন আজহার সাহেবের সাথে।
রূপার কোলে থাকা সায়ান ডেকে উঠলো
‘ আহ?
আয়শা বেগম চোখ ফিরালো। রূপা বলল
‘ জেম্মা ছোটসাহেব তো চলে গেছে। আপা এখনো বাইরে দাঁড়ায় আছে।
আয়শা বেগম কোলে নিয়ে নিলেন সায়ানকে। বুকে জড়ায় ধরে বললেন
‘ মরতে বল হারামজাদিরে। কোনোকিছুই ভালা ভালা হয় না তার।
রূপার মন খারাপ হয়ে গেল। বলল
‘ ছোটসাহেব তো অনেক ভালা মানুষ জেম্মা। আপার বর হিসেবে খুব ভালো হবে। দেখো।
‘ ভালা হবে না কালা হবে আমি জানতে চাইছি হারামজাদি? মুখে মুখে তর্ক করিস?
রূপা চলে গেল। উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা আয়নাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে বলল
‘ ছোটসাহেব আমাকে খুব দেখতে পায় আপা। তোমাকে তো আর ও বেশি দেখতে পায়। এইবার আমি তোমার সাথে চলে যাব। কিন্তু ছোটসাহেবের বাড়ির সবাইকে আমার ভয় করে। তোমাকে দেখতে পারবে তো?

আয়না বলল

‘ যাব না আমি ওখানে। মরে যাব তবুও যাব না। কি পেয়েছে ওই লোক? যা ইচ্ছে তাই করবে? কিছুতেই যাব না আমি।

__________

পরদিন সকাল আটটা। আয়না রাত করে ঘুমাতে গিয়েছে তাই আজ তাড়াতাড়ি উঠতে পারেনি। চারজন লোক আর দুইজন মহিলা কতগুলো ঢালাই আর ব্যাগপত্র নিয়ে উপস্থিত তাদের বাড়ি। আয়শা বেগম আর নামিরা হতবাক। আয়ান ও ঘুম। আয়নার সাথে তার সামনাসামনি দেখা হয়নি। সে ফিরেছে রাত দেড়টার দিকে। হসপিটালে গিয়েছিল সে। আনহিতাকে দেখে এসেছে সাথে।

রূপা লোকগুলোকে কতকিছু জিজ্ঞেস করলো কেউ একটা প্রশ্নের উত্তর ও দিল না। চুপচাপ ব্যাগপত্র, আর আয়নার জিনিসপত্র দিয়ে নামিরাকে বলল
‘ এগুলো ম্যাডামের। আর এই কাগজটা। ম্যাডাম ছাড়া চিরকুটটা কারো পড়া নিষিদ্ধ।
নামিরার হাসি পেল। চিরকুট?
আয়না ঘুম থেকে উঠে শাড়ি গয়না, পায়ের জুতো, সাজগোছের জিনিস,এমনকি মাথার চিরুনি পর্যন্ত পাঠিয়েছে দেখে হতবাক। কান্নারা ভীড় করলো গলায়। এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এগুলো কেন পাঠিয়েছে ওই বেয়াদব লোক? এগুলো দেখে গলে যাবে আয়নামতী?

রাগ খানিকটা কমে আসায় নামিরা চিরকুটটা দিল আয়নাকে। আয়না সেটি ছিঁড়ে ফেলল।
নামিরা হেসে বলল
‘ আমি জানি তুমি ছিঁড়বে তাই তোমাকে আসলটা দিইনি। নকলটা দিলাম। এই নাও আসলটা। পড়ো নইলে আমি পড়ে শোনাবো।
আয়না কেড়ে নিল। কি আজেবাজে কথা লিখেছে কে জানে ওই অভদ্র লোকটা। চিরকুটটা মেলল আয়না। তাতে লিখা,

‘ শুভ সকাল আয়নামতী।

আয়না বিড়বিড় করলো

‘ মরা।

‘ শোনো বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তুমি বাঙালি বধূ। শাড়ি পড়বে এখন থেকে। খবরদার সেলোয়ার-কামিজ পড়বে না। কালো বেল্টের জুতো দিয়েছি শাড়ির সাথে ওগুলো পড়বে। মেয়েদের আরও যত জিনিসপত্র লাগে সব দিয়েছি। বিয়ে করেছি বউয়ের ভরনপোষণ তো এখন আমাকেই নিতে হবে। আর কতদিন বাবার কাঁধের উপর বসে বসে খাবে? এইবার স্বামীর কাঁধের উপর চেপে বসো। একটু আস্তে হ্যা?
বুঝোই তো নরম বেকুব মানুষ আমি।

আয়না ছিঁড়ে ফেলতে চাইলো। দেখলো নিচে আর ও লেখা আছে। তাতে লিখেছে

‘ শোনো আয়নামতী আমি খেয়াল করেছি তুমি কাজল পড়ো না চোখে। এখন থেকে পড়বে । কাজল পড়লে তোমাকে ভীষণ মায়াবি দেখাবে। আমি কাজলচোখী ডাকার সুযোগ পাব৷
আর বেশি প্রসাধনী মাখবে না। কারণ তোমার আসল সৌন্দর্য তাতে লুকিয়ে পড়বে।
মাথার খোঁপায় রজনীগন্ধা ফুলের মালা জড়াবে। আমি তোমাকে রজনীগন্ধা ডাকার সুযোগ পাব। ফুল পাঠিয়েছি। দেখে নিও। ও হ্যা এগুলো তোমারই বাগানের ফুল। রাগ করোনা টাকা দিয়ে দেব। আমার বউয়ের জন্য কিনে নিলাম।
সে যাইহোক আর ও একটা কথা, মাথায় ঘোমটা পড়ে থাকবে সবসময়। ঘোমটাহীন শুধু আমি তোমায় দেখব।
আরেকটা কথা আয়নামতী আমি আসব, আর তোমাকে নিয়ে যাব।

আয়না প্রথম দিকের লিখাগুলো ছিঁড়লো। শেষের দিকের লেখাগুলো দ্বিতীয় বার পড়লো। তারপর ছিঁড়লো। নামিরা ভুরু উঁচিয়ে বলল
‘ কি লিখলো জামাইবাবু?
‘ আমার মাথা লিখেছে।
হেসে উঠলো নামিরা। কোলে থাকা সায়ান দন্তহীন গালে মায়ের সাথে খিকখিক করে হেসে উঠলো।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here