আয়নামতি পর্ব-৮

0
1767

#আয়নামতী
#পর্ব_৮
#পুষ্পিতা_প্রিমা

ছাপাখানায় ভীড় কমে এল। স্কুলের কয়েকটা মেয়ে এসে ভীড় জমালো তারপর পরই। আয়ান বলল
‘ কি ছাপাবে পিচ্চিরা?
মেয়েগুলো বলল
‘ ছবি তুলব ভাইয়া। তারপর আম্মুর এনআইডি কার্ড ফটোকপি করব।
আয়ান বলল
‘ কিছুক্ষণ বসো। আমি কাজটা সেড়ে নিই। তারপর তোমাদের করে দিচ্ছি।
নামিরা দোকানের বাইরে অনেক্ক্ষণ ধরে দাঁড়ানো। প্রায় তিনদিন পর সে আয়ানকে দেখছে। আয়ান তাকে এখনো দেখেনি। মেয়েগুলো বের ও হচ্ছে না। প্রায় দশ মিনিট পর আয়ান মেয়েগুলোর ছবি তুলে ছাপাতে দিল। ছবিগুলো দিতেই মেয়েগুলো টাকা দিয়ে চলে গেল। নামিরা হুড়মুড়িয়ে ঢুকে এল দোকানে। আয়ান চমকে গেল তাকে দেখে। নামিরা ব্যাগ রেখে ঝাপটে ধরলো তাকে। আয়ান দু পা পিছু হেঁটে গিয়ে বলল
‘ মিরা তুমি? যে কেউ চলে আসতে পারে। কি করছ?
নামিরা ছাড়লো না। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো। আয়ানের শার্টে মুখ ঘষতে ঘষতে বলল
‘ চলে যাব। কলেজের নাম দিয়ে এসেছি। বাবার গাড়ি আছে কলেজ গেইটে। আরেকটু থাকতে দাও।
হাসলো আয়ান। বলল
‘ তোমার পাগলামি কমার নয় মিরা। হয়েছে এবার ছাড়ো। কেউ চলে আসলে আমি লজ্জায় পড়ে যাব।
মিরা হাতের বাঁধন আলগা করে মুখ তুলে আয়ানের দিকে চাইলো। তারপর ছেড়ে দিয়ে দোকানের দরজা একটুখানি ঠেলে দিল। নিজের ব্যাগ থেকে হটবক্স বের করলো। একটা পিৎজা আর এক বাটি পায়েস বের করলো। আয়ান বলল
‘ এগুলো কি?
নামিরা বলল
‘ শ্বশুরের ছেলের জন্য নিজের হাতে বানিয়েছি।
আয়ান বোতল নিল নামিরার কাছ থেকে। গলা ভিজিয়ে বলল
‘ কেউ কিছু বলেনি?
নামিরা বক্স খুলতে খুলতে বলল
‘ কার কথায় কি আসে যায় আমার? আমার বরের জন্য আমি নাশতা বানাচ্ছি।
আয়ান চওড়া হাসলো। নামিরা বলল
‘ বাড়িতে সবাই কেমন আছে?
‘ ভালো। আব্বা আম্মা তার বউমাকে চোখে হারাচ্ছে। টুনি তো আছে তার বাগান নিয়ে। তাড়াতাড়ি ভাবিকে ফিরিয়ে আনার আদেশ জারি করেছে।
হেসে ফেলল নামিরা। পিৎজার স্লাইস ছিড়তে ছিঁড়তে বলল
‘ আর শ্বশুরের ছেলে আমাকে চোখে হারায় না?
আয়ান সরু চোখে তাকালো। নামিরা তার হাত টান দিয়ে তার পাশে বসালো টুলের উপর। পিৎজা বাড়িয়ে দিয়ে বলল
‘ খাও। চিকেন পিৎজা।
আয়ান খেল। নামমুখ কুঁচকে ফেলল। নামিরা কৌতূহলী হয়ে বলল
‘ খেতে ভালো হয়নি না? এই প্রথম বানিয়েছি তো তাই। পরের বার ভালো করে,
আয়ান বলল
‘ মিরা আমি তোমায় কিছু বলেছি?
নামিরা বলল
‘ তো চেহারা ওরকম করলে কেন?
মৃদু হাসলো আয়ান। নামিরার গালে টোকা দিয়ে বলল
‘ দারুণ হয়েছে। তোমার হাতের রান্না খাচ্ছি, নিজেকে স্পেশাল লাগছে।
নামিরা খুশি হয়ে গেল। দুচোখ চকচক করে উঠলো খুশিতে। দুহাত মেলে গলা জড়িয়ে ধরলো আয়ানের। গালে ঠোঁট চেপে ধরলো৷ তারপর আবার খাইয়ে দিতে দিতে বলল
‘ তাহলে রোজ নিয়ে আসব কেমন? তুমি খাবে না? খাবে? বলো।
আয়ান বলল
‘ নাহ। রোজ আনলে খাব না। আর তুমি আসবে ও না।
নামিরা মুখ কালো করে ফেলে বলল
‘ কেন?
আয়ান নড়েচড়ে বসলো। বলল
‘ মিরা তুমি বেড়াতে গিয়েছ। ভালো করে বেড়াও। সবার সাথে কয়েকটা দিন ভালো করে কাটাও। তারপর নিয়ে আসব। নামিরা মাথা নাড়ালো। পায়েসের বাটি নিয়ে বলল
‘ আসো এটা খাইয়ে দেই?
আয়ান বলল
‘ পায়েস ও রাঁধতে পারো।
নামিরা মাথা নাড়ালো। পায়েস খাইয়ে দিল। আরেক চামচ করে খাইয়ে খাইয়ে দিতে দিতে নাকমুখ তুলে বলল
‘ অ্যাই শ্বশুরের ছেলে তোমাকে ছাড়া আমি ঘুমাতে পারিনা। ভালো লাগেনা।
হেসে ফেলল আয়ান। নামিরার নাক টেনে দিয়ে বলল
‘ তাই?
নামিরা ছোট্ট করে আওয়াজ করলো।
‘ হুহ।
আবার ও হাসলো আয়ান। পায়েসটা খেতে খেতে বলল
‘ এবার তুমি খাও। দাও খাইয়ে দেই।
নামিরা বলল
‘ আমি খেয়েছি তো। তুমি খাইয়ে দেবে তাহলে খাই।
আয়ান হাসলো। চামচ নিয়ে নামিরার মুখে তুলে দিয়ে বলল
‘ আর আসবে না এভাবে। প্রমিজ করো।
নামিরা বলল
‘ কেন? আসি না? তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে।
আয়ান বলল
‘ নাহ। বলেছি না আমি নিয়ে আসব। তোমার বাবা জানে এসেছ?
‘ নাহ।
আয়ান বলল
‘ ঠিক আছে আজ এসেছ। আর কক্ষণো আসবে না। ঠিক আছে?
নামিরা মাথা দুলালো। ব্যাগ থেকে আর ও কয়েকটা হটবক্স বের করে বলল
‘ এখানে পায়েস আছে। আব্বা পছন্দ করে। আর আয়নার জন্য পিৎজা দিয়েছি। আম্মার জন্য পান সুপারি আর ঝাল পিঠা। নিয়ে যাবে। কেমন?
আয়ান ভুরু কুঁচকে চাইলো। বলল
‘ এসব আমি নিয়ে যেতে পারব না মিরা। আমি পারব না।
নামিরা বলল
‘ কেন? আমি কি কিছু দিতে পারিনা?
আয়ান বলল
‘ অবশ্যই দিতে পারো। কিন্তু তোমার বাবার টাকায় না। আমি চাইনা কারো কথার নিচে থাকতে। আমাকে আর ঋণী করোনা মিরা।
নামিরা দুচোখ ছলছল করতে করতে ভিজেই গেল। সে বলল
‘ এগুলোর উপকরণ আমি আমার জমানো টাকা দিয়ে কিনে এনে করেছি। টাকাগুলো ও তো তোমার দেওয়া। আর নিজ হাতে রেঁধেছি। কছম বলছি। একদম সত্যি। আমি কি এমনি এমনি দিচ্ছি?
আয়ান বলল
‘ আচ্ছা ঠিক আছে? চোখে কান্না কেন? আমি তো না জেনেই বলেছি৷ আচ্ছা নিয়ে যাব। কান্না থামাও। চোখ মুছো।
নামিরা দাঁড়িয়ে বলল
‘ মুছব না।
আয়ান হেসে ফেলল তার বাচ্চামো দেখে। বুকে টেনে নিল। মাথাটা বুকে ঠেকিয়ে দুহাতের বন্ধন জোড়ালো করে বলল
‘ তোমাকে কে বলেছে আমাকে এত ভালোবাসতে? আমি তো পারিনা মিরা। ঋণী হচ্ছি তো।
নামিরা চুপটি মেরে পড়ে রইলো তার বুকে। অনেকটা সময় পার হওয়ার পর মুখ তুলে বলল
‘ একটু ভালোবাসা দাও। চলে যাব। আর কখনো আসব না। প্রমিজ শ্বশুরের ছেলে।
আয়ান কপাল ঠেকালো তার কপালে। দুহাতে মুখ আগলে ধরে ভালোবাসা দিল। অতঃপর বলল
‘ এবার যাও। আর আসবে না মানে আসবে না। ঠিক আছে?
নামিরা কথা বলল না। ব্যাগ তুলে হনহনিয়ে বের হয়ে গেল দোকান থেকে। আয়ান পিছু ডাকলো
‘ মিরা কি হয়েছে? মিরা?
নামিরা একবার ও পিছু ফিরলো না। চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল। আয়ান আটকালো না।

__________

দুপুর নাগাদ আয়ান বাড়ি ফিরলো। তার হাতে ব্যাগ দেখে আয়না দৌড়ে এল। কেড়ে নিয়ে বলল
‘ কি এনেছ?
আয়শা বেগম তেড়ে এসে বললেন
‘ আমার ছেলেটা কাজকাম করে এল। তুই আছিস রংঢংয়ে।
আয়না মুখ কালো করে ফেলল। আয়ান বলল
‘ আহা আম্মা ওকে বকো কেন? টুনি তোর জন্য পিৎজা পাঠিয়েছে মিরা। পায়েস আর ঝাল পিঠা ও দিয়েছে।
আয়না বলল
‘ তাই? ভাবিকে একটা থ্যাংকস বলে দেবে আমার পক্ষ থেকে। আমি যাই যাই।
আয়শা বেগম ভুরু কুঁচকে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন
‘ বউ কোত্থেকে আসলো রে বাবু?
আয়ান বলল
‘ ও এসেছে কলেজে। ওখান থেকেই,,
আয়শা বেগম এগিয়ে আসলেন। শাড়ির আঁচল দিয়ে ছেলের ঘর্মাক্ত মুখ মুছতে মুছতে বললেন
‘ আমার বাচ্চা। কষ্ট হইতেছে নাহ? ওই মানুষটা ঘর বসা না হলে তোরে এত কষ্ট করতে হইতো না। একটা কামের মানুষ রাখ তোর কাজে সাহায্য করবো।
আয়ান বলল
‘ কি বলো আম্মা? যাকে রাখব তাকে টাকা দিতে হবেনা? এখন যা কামাচ্ছি আমি একাই। এসব বাদ দাও তো। আমি গোসল সেড়ে আসি। তাড়াতাড়ি খেতে দাও। আমাকে আবার যেতে হবে।
আয়শা বেগম চলেই যাচ্ছিলেন । আজহার সাহেব হুইল চেয়ার টেনে এলেন। বললেন
‘ বাবু আনারে তো নিয়ে যেতে পারিস। তোর কাজে সাহায্য করবে। ওরে শিখায় দিবি।
আয়শা বেগম বলল
‘ হ। একদম ভালা কথা কইছে তোর আব্বা।
আয়ান বলে উঠলো।
‘ না আম্মা। ওখানে ভার্সিটির বড় ভাই আর তার সাঙ্গ পাঙ্গরা সারা দিনরাত বসে থাকে। টুনিকে দেখলে খারাপ মন্তব্য করতে পারে। না না।
আয়শা বেগম বলল
‘ ও তো বোরকা পড়া থাকবে। কিছু হবে না। তোর ও ভালো লাগবে আব্বা। ভাইবোন একসাথে করলে তোর উপর চাপ কম পড়বে।
আয়না পিৎজা হাতে নিয়ে ছুটে এল। খেতে খেতে বলল
‘ আম্মা কোথায় যাব আমি? আবার জেলখানায় পাঠানোর কুমতলব করছো না তো?
আয়ান আর আজহার সাহেব হেসে দিলেন। আয়ান বলল
‘ না না। টুনি তুই তো জেলখানার সর্দারনী। তোরে আবার জেলখানায় কে নিয়া যাবে?
আয়না গাল চওড়া করে হাসলো। বলল
‘ জানো আমার বাগান,,
আয়শা বেগম থামিয়ে দিয়ে বলল
‘ এই দেখো শুরু করে দিয়েছে, বাগান বাগান বাগান। হারামজাদি বাগান বাগান না করে তোর ভাইয়ের লগে কাজ কর। আমার পোলাটার উপর চাপ কম পড়বো।
আয়না বলল
‘ ভাইয়ার কাজ? আমি?
আয়ান চোখ বন্ধ করে আবার খুললো। আয়না দৌড়ে এসে পড়লো ভাইয়ের বুকে। খুশিতে বাকুমবাকুম হয়ে বলল
‘ আমি কম্পিউটার শিখবো? ওহহো কি খুশি?
আয়শা বেগন বলল
‘ এই দেখো। আমার পোলাটারে এভাবে চিপায় ধরছিস ক্যান?
আয়ান হেসে ফেলল। আয়না আর ও শক্ত করে ধরে বলল
‘ এই দেখো তোমার ছেলেটারে মাইরা ফেলতাছি। দেখো দেখো।
আয়শা বেগম বেত খোঁজার জন্য এদিকওদিক তাকালেন। আয়ান হাসতে হাসতে বলল
‘ আম্মা টুনি তোমাকে রাগায়, আর তুমি ও রাগো। বুঝোনা ও মশকরা করছে?
আয়না বলল
‘ ও ভাইয়া আমি সত্যি যাব?
আয়ান বোনের নাক টেনে দিয়ে বলল
‘ হুহ। আয়না বলল
‘ তাহলে আমার বাগানের কি হবে?
আয়ান বলল
‘তুই সকালবেলা যাবি। দুপুরে আবার আমার সাথে চলে আসবি। তোর কাজ সকালে। দশটার দিকে অনেক কাজ থাকে।
আয়না বলল
‘ তাহলে তো বাগান ও দেখাশোনা করতে পারব। আব্বাকে ও। সব পারব না?
আয়শা বেগম বলল
‘ হ আমার হবে যত্ত সর্বনাশ। সারাক্ষণ আমার লগে বউটা থাকতো এখন সে ও বাপের বাড়ি। আমার একা একা ভাল্লাগেনা। এই বজ্জাত তো আছে টংটং টংটং।
আয়না বলল
‘ সবসময় আমার সাথে খ্যাঁকখ্যাঁক না করলে তোমার ভাল্লাগেনা আম্মা? আমি না থাকলে বুঝবা।
আয়শা বেগম বলল
‘ যাহ যাহ। তোর লগে আমার পরাণ জ্বলবো না।
আয়না মন খারাপ করে ফেলল। আয়ান বলল
‘ আরেহ টুনি তুই ও পারিস আম্মার সাথে।
আয়না বলল
‘ ওটা তোমার আম্মা, আমার না।
আয়ানের হেসে দিল। আজহার সাহেব ও। আয়শা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বলল
‘ হ তোরে তো আমি জঙ্গল থেইকা কুড়াইয়া আনছি। নারে বাবুর আব্বা?
আজহার সাহেব বলল
‘ হয়ত!
আয়নার চোখ পিটপিট করলো। আয়ান মিটিমিটি হাসলো। বলল
‘ আব্বা তুমি ও মায়ের দলে চলে গেলে। টুনি চিন্তা নেই আমি তোর দলে আছি।
আয়না গটগট করে হেঁটে চলে যেতে যেতে বলল
‘ লাগবে না কাউকে আমার। আমি একাই একশ।
তার কথা শুনে হাসিতে ফেটে পড়লো আয়ান আর তার বাবা৷

______________

অনুরাগের বিয়ে পেছনের কারণ জানতে চাইলে অনুরাগ বলল
‘ তার এই সময় বিয়ে করার ইচ্ছে নেই। আর কিছুদিন পর।
আনহিতা ছেলের এমন হেলাফেলা দেখে ভীষণ অবাক হলো। ছেলের কি আদৌ বিয়ে করার মন আছে? ওদিকে কুহেলীর বাবা তাড়াতাড়ি বিয়ের আয়োজনের তাগিদ দিচ্ছে। আনহিতার ও তর সইছেনা। এত ভালো মেয়ে না আবার হাতছাড়া হয়ে যায়। অনুরাগের অগোচরে দুলক্ষ টাকা পণ দাবি করলো তারা। পণ ছাড়া বিয়ে হয় নাকি? তা ও আবার চৌধুরী বাড়ির একমাত্র ছেলের?

সপ্তাহ খানেক পরের কথা,

অনুরাগ শহরের পাবলিক ভার্সিটির অধ্যাপক। সে শহরে থাকেনা। আসা যাওয়া করে। শহরের অদূরেই এই গ্রামটি। বেশিদূর না হওয়ায় আসা যাওয়ায় কোনো সমস্যা হয় না। দুপুর তিনটে নাগাদ ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরতেই সে দেখলো বাড়িতে সবার গায়ে নতুন জমকালো পোশাকআশাক। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই অনিমা এসে বলল
‘ ভাই তোর আকদ হবে আজ। তাড়াতাড়ি ঘরে যাহ। পাঞ্জাবি পড়ে রেডি হয়ে চলে আয়।
অনুরাগ বলল
‘ হঠাৎ আকদ কেন?
আনহিতা বলল
‘ আমি বিয়েটা তাড়াতাড়ি সেড়ে ফেলতে চাইছি। আগামী সপ্তাহে বউ নিয়ে আসব। তুমি যদি তোমার মাকে খুশি দেখতে চাও। চুপচাপ রেডি হয়ে নাও। আমরা কিছুক্ষণের ভেতর রওনা দেব।
অনুরাগ গর্জন করে বলল
‘ আমি এখন প্রস্তুত না মা। তোমরা কি করছ এটা?
শায়খ চৌধুরী আসলেন। বললেন
‘ তুমি কি আমাদের সবার অপমান হোক সেটা চাইছো? এমনিতে একবার বিয়ে ভেঙে অনেক বদনাম রটেছে গ্রামে। তুমি জানো এটা কতটা এফেক্ট পড়বে আমার সুনামে?
অনুরাগ চুপসে গেল। আনহিতা ছেলের কাছে গেলেন। মুখ হাত বুলিয়ে বললেন
‘ এরকম করোনা সোহাগ। আমরা তো তোমার ভালো চাই নাহ? মেয়েটার ভাই বিদেশ চলে যাবে তাই তাড়াতাড়ি সেড়ে ফেলতে চাইছে।
অনুরাগ হনহনিয়ে চলে গেল। সে বিয়েটা করতো। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি না। কি আর করার?
কনের বাবা খোরশেদ খন্দকার মেয়ের আকদে বিরাট আয়োজন করলেন। মনে হচ্ছে বিয়ে বাড়ি। বিয়েটাই হয়ে যাচ্ছে। অনুরাগের মুখ থমথমে। আনহিতা অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে একটু স্বাভাবিক করলো। খাওয়া দাওয়া আলাপচারিতার পর বিয়ে পড়ানো শুরু করলো কাজী৷ বিয়ে পড়ালো। অনুরাগ আর কুহেলীকে কবুল বলতে বললো। তারা কবুল বলল। অতঃপর আকদটা হয়ে গেল।

লাল টকটকে বেনারসি পড়া বধূটাকে অনুরাগ দেখলো আকদ হয়ে যাওয়ার পর। কবুল বলে বিয়ে করে নিয়েছে সে। কুহেলীকে দেখে দারুণ অবাক হলো অনুরাগ। লাল টকটকে বেনারসি পড়া মেয়েগুলোকে মাথা উঁচু করে রাখলেই ভালো দেখায়। কিন্তু এই মেয়ে তো মাথা নামিয়ে রেখেছে। আর কবুল বলেছে মিনমিনিয়ে। সে যাইহোক মেয়েটা তো আজ থেকে তারই বউ।

অনুরাগকে কুহেলীর সাথে কথা বলতে দিল। না কুহেলী কথা বললো। না অনুরাগ। অনুরাগ ভাবলো মেয়েটা হয়ত লজ্জা পাচ্ছে তাই কিছু বলল না। তবে চলে আসার সময় কুহেলী নিজেই মুখ খুললো। মাথার ঘোমটা সরিয়ে অনুরাগকে বলল
‘ আপনার আগের বিয়েটা কেন ভেঙে গিয়েছিল জানতে পারি?
অনুরাগ সরু চোখে তাকিয়ে থাকলো বধূবেশে মেয়েটার দিকে। চুলের মাঝখানে লম্বা সিঁথি, ঝুলছে টিকলি। লাল টকটকে রক্তজবার মতো ঠোঁট। আর চোখের কাজলে টানা চোখ। কুহেলীর প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই অনুরাগ ভাবলো,
‘ এই মেয়ে কি সত্যিই সুন্দর? নাকি অসুন্দর?
কুহেলী আবার বললো
‘ আমি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি।
অনুরাগ এবার উত্তর দিল
‘ আগের বিয়েটা ভাঙার কারণ, আগের কনেটা বেকুব মানুষ পছন্দ করেন না। আমি তার কাছে নিতান্তই একজন বেকুব। তাই।
কুহেলী মাথা দুলালো। বলল
‘ বুঝতে পেরেছি। এবার ছোট্ট একটা প্রশ্নের উত্তর দিন।
অনুরাগ বলল
‘ জ্বি বলুন। আগের কনেটা বেশি সুন্দর নাকি আমি?
অনুরাগ বলল
‘ আপনি। যদি আগেরটার সাথে বিয়ে হত নিশ্চয়ই উনাকে সুন্দর বলতাম।
কুহেলী বলল
‘ তারমানে আপনি সম্পর্কের জোরেই সুন্দর বলছেন?
‘ জ্বি৷
কুহেলী অবাক হলো। এ কেমন মানুষের পাল্লায় পড়লো সে?
অনুরাগ বলল
‘ আগামী সপ্তাহে আপনাকে নিয়ে যেতে আসব। ততদিনে ভালো থাকবেন।
কুহেলী বলল
‘ আমাকে আপনি করে না বললে খুশি হবো। আপনার আটাশ বছর হলে আমি আপনার ছয় বছরের ছোট।
অনুরাগ চমৎকার করে হাসলো। বলল
‘ তাতে কি? আমি আমার চাইতে দশ এগারো বছরের ছোট মানুষকে ও আপনি করে বলি। তবে আপনার ভালো না লাগলে তুমিই বলবো। তাছাড়া এখন আপনি আমার স্ত্রী। আসি ভালো থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ।

______________

রাত দশটার দিকে চারপাশটা কাঁপিয়ে ঝড় এল। অনেক জায়গায় গাছ ও পড়ে গিয়েছে। বজ্রপাত হচ্ছে। আয়ান এখনো বাড়ি ফিরেনি। আয়শা বেগম আর আজহার সাহেবকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। আয়না নিজের ঘরের জানালা খোলা রেখেছে। ভাইয়া আসলে দেখতে পাবে। কিছু সময় পার হতেই আয়ানের দেখা মিলল। জোরে বজ্রপাত হলো। আয়শা বেগম বের হয়ে এলেন ঝড়ের মাঝে। ছেলেকে ধরলেন। আয়ান বলল
‘ ওহ আম্মা কি করছ? আমি চলে এসেছি তো।
আয়শা বেগম ছেলেকে ঘরে ঢুকিয়ে শাড়ির শুকনো অংশ দিয়ে মুখ মুছে দিলেন। কাঁদোকাঁদো হয়ে বললেন
‘ আমার রুহটা যেন ফিরে এসেছে। তুই বাইরে থাকলে আমার কত যে চিন্তা হয় আব্বা। তুই বুঝবি না।
আয়ান মায়ের কপালে চুমু খেল। বলল
‘ এজন্যই তুমি মা।
আয়শা বেগম চুপিসারে বললেন
‘ জানিস চৌধুরী বাড়ির ছেলের নাকি বিয়ে হয়ে গেছে? অনেক ভালো পরিবারের মেয়ে পেয়েছে। আমার মেয়েটার কোনো একূল ওকূল হলোনা।
আয়ান ভেজা শার্ট খুলে ঝাড়তে ঝাড়তে বলল
‘ উফফ আম্মা। টুনির জন্য অনেক ভালো বর আসবে দেখো। চিন্তা করোনা তো। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।

ভাইকে ফিরতে দেখে আয়না জানালা বন্ধ করে দিতে গেল। বাগানটার দিকে চোখ বুলাতে বুলাতে বজ্রপাত হলো বিকট শব্দ করে। জোরে ঝাপটা বাতাস ঢুকে পড়লো ঘরে। বাঁশের ফুলদানি, পুরোনো টিস্যুবক্স পড়ে গেল টেবিল থেকে। আয়না তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করে দিল। ফুলদানি তুলতে গিয়ে দেখলো শুকনো একটি রজনীগন্ধা। একদম শুকিয়ে গেছে। ফুলটা নড়াচড়া করে একই জায়গায় রেখে দিল আয়না। তারপর পাশে থাকা খালি টিস্যু বক্সটা ঝাড়তেই পড়লো টুকরো টুকরো কয়েকটা কাগজ আর একটা ছবি। ছবিটা উল্টাতেই চোখে পড়লো একটা অধ্যাপকের ছবি। ছবি আর রজনীগন্ধার ফুলটা একসাথে নিয়ে ফুলদানিতে ফেলে রাখলো। কাগজগুলো দিয়ে কাগজের নৌকা বানালো। তারপরে বৃষ্টি জলে সেগুলো ভাসিয়ে দিল।

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here