উপন্যাস প্রপর্ণ পর্ব-৩০

0
2657

#উপন্যাস_প্রপর্ণ(৩০)
#কুরআতুল_আয়েন

(আগে কিছু কথা বলিঃদু’এক পর্বের মধ্যে উপন্যাসে কয়েক বছরের পরের থিম চলে আসবে।বলতে গেলে,অপরাধীদের শাস্তি পাওয়ার সময় চলে এসেছে।আর,সবচেয়ে বড় কথা!আমি তাড়াতাড়িই উপন্যাস টা শেষ করতে চাচ্ছি।)
______________________
বুরাগ দরজা খোলা রেখেই বিছানায় এসে শুয়ে পড়েছে।চোখ বন্ধ করে বেলীর কথা ভাবছে।হুট করে বুকে ভারী কিছু অনুভব করতেই বুরাগ চমকে উঠলো।নিজের বুকের উপর মৌমিকে দেখে একপ্রকার হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলো।কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে মৌমির দিকে।মৌমির ঠোঁটে লজ্জামিশ্রিত হাসি লেগে আছে।তা দেখে বুরাগ কিছুটা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

–“কি ব্যাপার মৌমি!তুই আমার রুমে কেনো এসেছিস এতো রাতে।”

মৌমি বুরাগের কাছ ঘেঁষে বসে বুরাগের হাত দুটো আঁকড়ে ধরে বললো,

–“তোর সাথে সময় কাটাতে এসেছি।”

–“মৌমি এখন রাত!আমরা দিনে একসাথে বসে আড্ডা দিবো।আপাতত,আমি এখন ঘুমোতে চাই।তুইও তোর রুমে যা।”

মৌমি ভিতরে ভিতরে রেগে যাচ্ছে বুরাগের এরূপ কথা শুনে।কতক্ষণ সময় নিয়ে রূপচর্চা করলো তাও বুরাগ একটিবার তাকালো না পর্যন্ত।তাও,নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললো,

–“প্লিজ বুরাগ!না করিস না।আজকে তোর ওয়াইফ নেই,সময়টা কাজে লাগাবি তা না করে আমাকে শুধু চলে যেতে বলছিস।”

বুরাগ কিছুটা তিক্ত মেজাজ নিয়ে বললো,

–“আমার এখন ভালো লাগছে না মৌমি।আমি একটু একা থাকতে চাই।”

বুরাগের এমন তিক্ত যুক্ত কথার পিঠে মৌমি আর কিছু বলার সাহস পায় নি।অগ্যাতা তাকে উঠতে হয়।বুরাগের দিকে একরাশ বিতৃষ্ণা নিয়ে তাকিয়ে পরমুহূর্তেই গটগট করে চলে যায়।

মৌমি যেতেই বুরাগ স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস নিলো।মৌমির আজকের আচরণ টা তার কাছে অন্যরকম লেগেছে।কেমন গায়ে পড়া স্বভাবের মতো।বিছানায় মাথা এলিয়ে দিতেই বুরাগের চোখ পড়লো দরজার দিকে।দরজা খোলা পেয়ে বুরাগ তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালো।দ্রুত গতিতে এগিয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়ে পুনরায় শুয়ে পড়লো।না হলে,ঘুমের মধ্যে মৌমি আবার তার রুমে চলে আসতে পারে।তার আজকের আচরণে অত্যন্ত এতোটুকু বুঝেছে বুরাগ।
—-
বেলী হাতে একটা বই নিয়ে বসে আছে আর নিঃশব্দে কান্না করছে।তার এইখানে থাকতে একদন্ডও ভালো লাগছে না।এখন নিজের উপরেই নিজের খুব রাগ হচ্ছে।কেনো এতো জেদ দেখিয়ে চলে আসতে নিয়েছিলো।এখন আবার নিজেই কষ্ট পাচ্ছে।বেলীর নিজেকে কি বলা উচিত তা বেলীই বুঝতে পারছে না।তবে,সে নিজের উপর খুবই ক্ষেপে আছে।এবারে আসার সময় বুদ্ধি করে ফোন টা নিয়ে এসেছে।আলমারির এককোণায় ফোন টা পড়ে ছিলো।যেভাবে আনা হয়েছিলো ঠিক সেভাবেই ছিলো।

বেলীর মন টা অনেক উশখুশ করছে একটিবার বুরাগকে ফোন দেওয়ার জন্য।কিন্তু,মনের ভিতর কেমন দ্বিধা বোধ কাজ করছে।ফোন টা নিচ্ছে তো আবার রেখে দিচ্ছে।কয়েকবার এমন করার পর সিদ্ধান্ত নিলো সে ফোন দিবে না।কেনোই বা দিবে!বুরাগ তো তাকে বলে দিয়েছে সে যেনো তার আশেপাশে না থাকে।
কথাগুলো ভেবেই বেলী আবারও নিঃশব্দে কেঁদে উঠলো।হাতে থাকা বই টা পাশে রেখে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।বালিশটা বুকের মধ্যে চেপে ধরে চোখ দুটো বন্ধ করে রেখেছে।বারবার নিজের চোখের সামনে বুরাগের মুখের প্রতিচ্ছবি টা ভেসে উঠছে।সেই সাথে বুরাগের কথাও খুব মনে পড়ছে।এতে যেনো কষ্ট আরো দ্বিগুণ বেড়ে যাচ্ছে।

জাবেদা ঘরে এসে দেখলেন,বেলী বেঘোরে ঘুমিয়ে আছে।তাই তিনি বেলীকে ডাক না দিয়ে উত্তরের জানালাটার ধারে এগিয়ে গেলেন।বাহিরের বিকেলের মিষ্টি রোদ বেলীর চোখে,মুখে এসে পড়ছে।বেলীর ঘুমের যাতে ব্যাঘাত না ঘটে তাই তিনি পর্দা টা টাঙিয়ে দিতে আসেন।কিন্তু,বাড়ির কিছুটা দূরের লিচু বাগানের কাছে রোকসানা কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ খানিকটাই অবাক হলেন।তার উপর রোকসানার ফুঁসুরফুঁসুর কথায় জাবেদার কেমন যেনো একটা খটকা লাগছে।কিন্তু জাবেদা ভেবে পাচ্ছেন না,রোকসানা এইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে ফোনে কার সাথেই বা কথা বলছে।রোকসানার মতিগতি দেখে জাবেদা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছেন রোকসানা যে লুকিয়ে লুকিয়ে ফোনে কথা বলছে।জাবেদা কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলেন।বেশি ঘাটাঘাটি না করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন।
—-
রোকসানা ধীর গতিতে বললো,

–“অনেক দিন হইলো তো পলাই আছো।কবে আইয়া আমারে বিয়া ডা করবা।”

ফোনের অপাশে করিমের মন তিক্ততায় ভরে উঠলো।সামনে থাকলে এতোক্ষণে সে রোকসানা কে জ্যান্ত পুঁতে দিতো।করিম রোকসানার মুখে’বিয়া কবে করবা’এই কথাটি যতোবার শুনেছে ততবারই নিজের কপাল নিজেই চাঁপড়িয়েছে।এবার তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছে।কিছুটা চেঁচিয়ে বললো,

–“তোমার মুখে কি এই কথা ছাড়া আর কথা আহে না।এহনো বাড়িই আইতেই পারলাম না আবার বিয়া করার কথা কইতাছো।আগে আমারে সহিসালামত আইতে দাও বাড়িত।আব্বা আমার কাছ থাইক্কা মুখ ফিরাই নিছে।মুখের উপর কইয়া দিছে আমার লাইজ্ঞা কিছুই করতে পারতো না।নিজের পথ নিজেরে দেখতে।আর তুমি,বিয়া নিয়া ঘ্যাঁনঘ্যাঁন করতেই আছো।”

রোকসানা ভ্রু কুটি কুঁচকে বললো,

–“এতো কিছু আমি জানি না।আমারে বিয়া না করলে আমি সবাইরে কইয়া দিমু তুমি যে শিউলিরে ধর্ষণ কইরা মারছো।”

–“শিউলিরে আয়ত্ত্বে আনার দায়িত্ব কার আছিলো।আমার নাকি তোমার?”

–“তাতে কি!আমি আয়ত্ত্বে আনলেও তুমি তো মাইরা ফেলছো।সবাই রে কইয়া দিলে কেমন হইবো।একবার ভাইবা দেখছো।”

করিম রাগে ফোন কেটে দিয়েছে।একদিকে রোকসানার এইসব কথা অন্যদিকে খিদের তাড়না।পেট মনে হয় জলন্ত কয়লার মতো পুঁড়ে যাচ্ছে।অবশ্য,দু’দিন খাবার না খেলে যা হয় আর কি।আর,এইভাবে পলায়িত ভাবে অন্যের বাসায় কয়দিনেই বা থাকা যায়।তাও,ইনিয়েবিনিয়ে করিম অনেকদিন থেকে গিয়েছে।তবে,এই কয়েকদিনে রোকসানাকে নিয়ে খুব ভয় হচ্ছে তার।না জানি,রোকসানা কোনদিন মুখ খুলে দেয়।আর,পুলিশ তো আজেই।করিমের এখন মনে হচ্ছে সে সবদিক দিয়ে আঁটকে গিয়েছে।
—-
ভোর হওয়ার একটু পরেই স্নিগ্ধা ঘুম থেকে উঠে পড়লো।পাশেই খালি গা’য়ে লিটন শুয়ে আছে।ব্যাগ থেকে একটা জামা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো স্নিগ্ধা।রাতে তারা অনেকটা সময় নিয়ে শারীরিক সম্পর্কে মেতে ছিলো।বিপরীত লিঙ্গের দু’জন মানুষ পাশাপাশি এক বিছানায় শুয়ে থাকলে এইসব হওয়ায় স্বাভাবিক।অত্যন্ত স্নিগ্ধা সেটাই মনে করে।তার কাছে এখন এইসব দুধভাত।তাই বলে যে, সে লিটনের উপর রেগে নেই তা ভাবা ভুল।সে আগের মতোই লিটনের উপর রেগে আছে।শারীরিক সম্পর্ক শারীরিক সম্পর্কের জায়গায় আর রাগ রাগের জায়গায়।স্নিগ্ধা এখনো মনে করে সব কিছু হয়েছে লিটনের জন্য।এতে তার কোনো দোষ নেই।তার কারণ একটাই!লিটন আগে তার কাছে এসেছে সে যায় নি।লিটন এগিয়েছিলো বলেই সেও এগিয়েছে।

লিটন আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে উঠে বসলো।সামনে সদ্য গোসল করে বের হয়ে আসা স্নিগ্ধাকে দেখে মাথায় কেমন একটা নেশা নেশা কাজ করছে।রাতের কথা ভেবে লিটন ঠোঁটে বিশ্রী একটা হাসি ফুটিয়ে তুললো।অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে লিটন যখন নিজেকে আর সংযত করতে পারলো না তখন সে বিছানা ছেড়ে ধীর গতিতে এগিয়ে গেলো স্নিগ্ধার দিকে।স্নিগ্ধাকে পুনরায় নিজের সাথে চেপে ধরে নোংরা খেলায় মেতে উঠলো।স্নিগ্ধাও হাসি মুখে নিজেকে সঁপে দিয়েছে।
__________
সময় বহমান।চোখের পলকেই সময় যেনো দৌড়ে চলে যায়।ঠিক তেমনি দেখতে দেখতে পাঁচ মাস কেটে গিয়েছে।বেলীর এখন নয় মাস চলছে।এই পাঁচ মাসে বেলী আর বুরাগের মধ্যে তৈরি হয়েছে অভিমানের ঘন স্তুপ।বুরাগের মনে এখনো রাগ আর জেদ রয়ে গিয়েছে।তবে,মা’র থেকে প্রতিটা দিন সে বেলীর খবর নিয়েছে।আর,অন্যদিকে বেলী!সে বুরাগকে ফোন করতে গিয়েও ফোন করে নি।সেও,শ্বাশুড়ির কাছ থেকে বুরাগের খোঁজ খবর নিয়েছে।

মৌমির সাথে বুরাগের বন্ধুত্বের সম্পর্ক টা শেষ হয়ে গিয়েছে।মৌমির অবাধ্য চলাফেরা আর বেহায়াপনা আচরণ দেখে বুরাগ বুঝতে পেরেছিলো তার জন্য মৌমির মনে আলাদা কিছু অনুভূতি আছে।তবে,বুরাগ চাইলেও মৌমিকে এইখান থেকে চলে যেতে বলতে পারতো না।আর,এইভাবে তো হুটহাট করে কাউকে চলে যেতে বলা ঠিকও না।সব কিছুই বুরাগ মুখ বুজে সহ্য করে নিচ্ছিলো।তবে,দিনদিন যখন মৌমির অবাধ্যতা ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছিলো তখন একদিন বুরাগ মৌমিকে যা তা বলে অপমান করেছিলো।এমনকি চলে যেতেও বলেছিলো।মৌমি সেদিন লজ্জায় কুঁকড়িয়ে গিয়েছিলো।সেদিনেই সে চলে যায় বুরাগদের বাসা থেকে।তারপর হোটেলে একদিন থেকে চলে যায় আমেরিকায়।

অন্যদিকে,করিম এখনো পলাতক।পুলিশ রা তাকে খুঁজতে এখনো সক্ষম হয় নি।তাই,পুলিশ রা ভেবে নিয়েছে এবার প্রকাশ্যে আর খুঁজবে না,আড়ালে খুঁজার চেষ্টা করবে।

আর,স্নিগ্ধা,লিটন আগের মতোই এই শহর ওই শহর ঘুরে বেড়াচ্ছে।তাদের মধ্যকার সম্পর্ক আগের থেকে অনেক টাই তিক্ত হয়ে উঠেছে।পারলে দু’জন দু’জনকে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে নিবে এমন ভাব।
—-
আফিয়া বিছানায় বসে কাঁথার শেষ অংশ টা সেলাই করছিলেন।আর দু’দিন পর উনি বেলীদের বাড়িতে যাবেন।বেলীর ডেলিভারি কয়েকদিন পরেই হওয়ার কথা।নাকের ডগায় চশমা রেখে সুতা গুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন।এমন সময় বুরাগ হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকে মা’র সামনে দাঁড়িয়ে বললো,

–“মা বলো কিসের জন্য ডেকেছিলে?”

আফিয়া সোজাসাপ্টা জবাবে বললেন,

–“বুধবারে তৈরি থেকো বেলীদের বাড়ি যাবো।ডেলিভারির তো সময় হয়ে গিয়েছে।তোমাদের অভিমানের পাল্লা বেশ চলছে।কেউ কারোর সাথে কথা বলছো না অথচ আমার কাছ থেকেই একে অপরের খবর নিচ্ছো।তোমাদের মধ্যকার সমস্যা গুলো মিটিয়ে নাও বুরাগ।এইসময় টা মেয়েরা স্বামীকে খুব করে কাছে পেতে চায়।”

বুরাগ কোনো কিছু না ভেবেই শক্ত গলায় বললো,

–“আমি যাবো না।তুমি যাও।আমার অফিসে অনেক কাজ আছে।”

আফিয়া অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন বুরাগের দিকে।বুরাগের এরূপ কথায় তিনি বাকরুদ্ধ।রাগের তাড়নায় সে তার প্রথম সন্তানকে দেখতে চাইছে না।আফিয়ার ইচ্ছে করছে বুরাগকে গিয়ে একটা চড় মেরে দিতে।কিন্তু,এতো বড় ছেলেকে কি চড় মারা যায় নাকি।কয়েকদিন পর আবার বাবা হবে।তাই আফিয়া ভিতরে রাগ টাকে ধরে রেখে বাহিরে শান্ত কন্ঠে বললেন,

–“ঠিকাছে যেও না তোমার সন্তানকে দেখতে।আমি খোঁজ পাঠিয়ে দিবো তোমাকে কি হয়েছে আর কি হয় নি।”

বুরাগ হতভম্ব হয়ে গিয়েছে।নিজের উপর নিজেরেই খুব রাগ লাগছে।সে তো রাগের বশে এইসব বলেছে,আর এখন মা’র মুখে এইসব কথা শুনে হতভম্ব হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়েই দেখছে না।কিছু বলতে যাবে তার আগেই আফিয়া কিছুটা চেঁচিয়ে বললেন,

–“আমার চোখের সামনে থেকে চলে যাও।বাপের চরিত্র শরীরে এসে ভিড় করছে!অবশ্য করবেই তো বাপের অংশ যে তুমি।তাহলে বাপের মতো না হয়ে কি চাচার মতো হবে।”

বুরাগ গোলগাল চোখে তাকিয়ে রইলো মা’য়ের দিকে।ধমকি গলার আওয়াজে বুরাগ সুড়সুড় করে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো।

বুরাগের যাওয়ার পানে আফিয়া চেয়ে থেকে বেজায় রাগ নিয়ে বিরবির করে বলতে লাগলেন,

–“বাপ ছেলে দুটোই এক।কেউ কারোর থেকে কম না।ঘরের বউ দের একটুতেও শান্তিতে থাকতে দেয় না।পস্তাবে!সময় হলেই সবাই একদিন না একদিন পস্তাবে।”
—-
অফিসে মুখোমুখি হয়ে বসে আছেন আজাদ রহমান আর রাখেশ।রাখেশ ক্ষিপ্ত গলায় বললেন,

–“আপনি আমাকে এতোদিন মিথ্যা বলে এসেছেন।আমার মেয়েকে আপনার ছেলের বউ করার স্বপ্ন দেখিয়ে এখন বলছেন আপনার ছেলে বিবাহিত!শুধু বিবাহিত নয় বাচ্চার বাবাও হবে।কতো বড় প্রতারক আপনি।”

আজাদ রহমান এসির মধ্যেও ঘেমে একাকার হয়ে যাচ্ছেন।মুখ ফঁসকে বলে ফেলেছিলেন বুরাগের এই কথা গুলো।আর,কেনোই বা বলে ফেলেছিলেন তাও উনার অজানা।সাদা রুমাল টা দিয়ে কপালের ঘাম টুকু মুছে নিলেন।আমতাআমতা করে বললেন,

–“বুরাগ বিবাহিত হলেও আমি আপনার মেয়ে জয়নব কেই আমার ছেলের বউ করতে চেয়েছিলাম।”

রাখেশ কিছুটা শক্ত গলায় বললেন,

–“আপনি ভাবলেন কি করে এইসব জানার পরও আমি আমার মেয়েকে আপনার ছেলের সাথে বিয়ে দিবো।দেশে কি ছেলের অভাব পড়েছে।আপনাকে বিশ্বাস করাটাই ভুল হয়েছে আমার।প্রতারণা করেছেন আপনি।সরি!মিস্টার রহমান আপনার সাথে আমার সম্পর্ক এখানেই শেষ করতে হবে।আপনি আমার পাওনা গুলো বুঝিয়ে দিবেন যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব।আমি কোনো অযুহাত শুনবো না।”

রাখেশ চলে গেলেই আজাদ রহমান টেবিলের কাঁচে জোরে চাপড় দিয়ে বসলেন।নিজের পা’য়ে নিজেই কুঁড়াল মেরেছেন।ভেবেছিলেন কি আর হয়ে গেলো কি।আজাদ রহমানের মনে হচ্ছে নিজের মুখটাকে নিজেই কুঁচিকুঁচি করে কেটে ফেলতে।এই মুখের জন্যই তো আজকে উনি এতো টাকা লস খেতে চলেছেন।
__
প্রায় চারদিনের মতো কেটে যায় আফিয়া বেলীদের বাড়িতে এসেছেন।বাচ্চার জন্য একগাদা জিনিসপত্র নিয়ে এসেছেন।বেলী প্রথম প্রথম অনেক খুশি হয়েছিলো শ্বাশুড়িকে দেখে।ভেবে নিয়েছিলো,বুরাগও এসেছে।তবে,যখন জানতে পারে বুরাগ আসে নি তখনি বেলীর মুখ বেলুনের মতো চুপসে গিয়েছিলো।চোখের কোণে নোনাজলের বন্যা বয়ে গিয়েছিলো।বুরাগের উপর খুব অভিমান জমেছে বেলীর।যদিও আসে কথা বলবে না সে!মোটেও না।কয়েকমাস যদি কথা না বলে থাকতে পারে তাহলে এখনো থাকতে পারবে।

বাড়ির উঠোনটায় সবাই বসে আছে।শুধুমাত্র রেশমি ছাড়া।রেশমি বাপের বাড়ি আছে।একমাসের মতো হলো সে ছেলে বাবুর জন্ম দিয়েছে।আরো কয়েকটা মাস থেকেই শ্বশুড় বাড়ি চলে আসবে।

বেলী গোলগাল শরীর টা নিয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করছে।শুয়ে থাকতে থাকতে কোমরে কাঁধে মনে হয় জখম হয়ে গিয়েছে।কাল হাসপাতালে যেতে হবে।কিন্তু,মনের ভিতর খুব ভয় ভয় কাজ করছে।যা নিতান্তই বেলীর কাছে অজানা।

মাঝরাত!বুরাগ এপাশ ওপাশ করেও কিছুতেই ঘুমোতে পারছে না।মনের ভিতর টায় খুব অস্থিরতা কাজ করছে।সব অস্থিরতা শুধু বেলীকে নিয়েই।এমনকি বেলীকে নিয়ে ভয়ও হচ্ছে বুরাগের।এতো অস্থিরতা নিয়েই বুরাগ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।তড়িঘড়ি করে আলমারির কাছে গিয়ে ট্রাউজার আর টি-শার্ট পাল্টে রেডি হয়ে গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।গন্তব্য হলো আশাকুঞ্জ নিবাস।বুরাগের শুধু মনে হচ্ছে সে আর একদন্ডও বেলীকে ছাড়া থাকতে পারবে না।তাই,এই মাঝরাতেই বেলীকে দেখার জন্য গাড়ি নিয়ে ছুটলো আশাকুঞ্জ নিবাসে।

জাবেদা আর আফিয়ার মাঝখানে শুয়ে আছে বেলী।আজকে তার অসম্ভব রকমের কষ্ট হচ্ছে।এই শ্বাস নিতে কষ্ট হয় তো এই কথা বলতে কষ্ট হয়।আচমকাই পেটে তীব্র ব্যথা অনুভব করায় বেলী একটু নড়েচড়ে উঠলো।প্রথমে তেমন একটা পাত্তা দেয় নি।কারণ,প্রায় সময় এই এইরকম হতো।আর,যখন বেবি কিক মারতো তখনো এইরকম একটা ব্যথা অনুভব হতো।তাই বেলী নিজেকে আশ্বস্ত করেছে একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু,ব্যথা যখন তীব্র থেকে তীব্রতর হওয়া শুরু করে তখন বেলী ভয় পেয়ে যায়।পাশ ফিরে জাবেদা বা আফিয়া কে ডাকার সুযোগ টাও পাচ্ছে না।ব্যথার তাড়নায় বেলী বিছানার চাদর টা খাঁমচে মেরে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো।বেলীর কান্নার আওয়াজ পেয়ে জাবেদা আর আফিয়া দু’জনেই ঘুম থেকে একপ্রকার হুড়মুড়িয়ে উঠলেন।বেলীকে এইভাবে কান্না করতে দেখে তাঁরাও ভয় পেয়ে যান।জাবেদা বুঝে নিয়েছেন আসল সময় ঘনিয়ে এসেছে।কিন্তু,এখন এই রাতে হাসপাতালে নেওয়া একেবারেই অসম্ভব।তাই তিনি ছুটলেন রোকসানাদের বাড়ির দিকে।রোকসানার দাদি এইসব ব্যাপারে খুবই দক্ষ।

সব কিছু ব্যবস্থা করতে করতে অনেক টাই দেরি হয়ে গিয়েছে।বেলী শুধু ব্যথায় ছটফট করছে।ভোরের আলো ফুটতে শুরু করে দিয়েছে।জাবেদা ভিতরে আছেন বেলীর সাথে আর বাহিরে উঠোনে আফিয়া,সুমনা পায়চারী করছেন।আফিয়ার খুবই চিন্তা হচ্ছে।শুধু মনে মনে এই দোয়া করছেন যেনো বেলী আর বাচ্চা দু’জনেই সুস্থ থাকে।

বুরাগ তার একটু পরেই চলে আসে।বুরাগের গাড়ি দেখে আফিয়া কিছুটা চমকে উঠলেন।বুরাগকে এইখানে একদমই আশা করেন নি।তবে,বুরাগকে এইখানে দেখে বেশ খুশিই হয়েছেন।বুরাগ তো জানতো না বেলীর আজকে ব্যথা উঠেছে।কিন্তু,আসল সময়েই বুরাগ এসে হাজির।মনের টান হয়তোবা এটাকেই বলে।

বুরাগ উঠোনে মা’কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে যায়।উত্তেজিত হয়ে সেদিকেই এগিয়ে গেলো।কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

–“মা তুমি এইখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো।”

আফিয়া ছেলেকে কিছু বলতে যাবেন তার আগেই ঘরের ভিতর থেকে বেলীর চিৎকার শুনে বুরাগ কিছুটা আঁতকে উঠে।ভয়ার্ত গলায় আবারও আফিয়াকে বললো,

–“এইটা তো বেলীর গলা মা!তুমি বাহিরে দাঁড়িয়ে আছো কেন?চলো ওর কাছে যাবো।”

আফিয়া বুরাগকে আটকে দিয়ে বললেন,

–“বুরাগ এখন যাওয়া যাবে না।দোয়া করো,বাচ্চাটা যেনো ভালোভাবে পৃথিবীর আলো দেখতে পারে।আর,বেলী যেনো সুস্থ থাকে।”

বুরাগ প্রথমে চমকে উঠলো।পরক্ষণেই রাগান্বিত হয়ে বললো,

–“তার মানে বেলীর ডেলিভারি হচ্ছে।অথচ ডাক্তার ছাড়া।কেনো হাসপাতালে নেওয়ার সুযোগ পাও নি তোমরা?এখন যদি কিছু হয়ে যায়।তখন কি হবে।আমি এইজন্য বলেছিলাম আমার কাছে থাকতে।বেলী আর বাচ্চা টার যদি কোনো ক্ষতি হয় তাহলে আমি বেলীকে কোনোদিনও ক্ষমা করবো না।সাথে তোমাকেও না।”

আফিয়া বুরাগের নিকট আসতে নিলেই বুরাগ দূরে সরে যায়।তার খুব ভয় হচ্ছে।সে কাউকে হারাতে পারবে না।আর এদিকে,বেলীর চিৎকার ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছে।বেলীর চিৎকার শুনেই বুরাগ বাচ্চাদের মতো মুখে হাত গুজে কেঁদে দেয়।আফিয়া দূর থেকে বুরাগকে খেয়াল করছেন।বুরাগকে কান্না করতে দেখে আফিয়া বুরাগের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন,

–“আমার কথা টা একবার শোনো বুরাগ।”

–“আমি তোমার কথা শুনতে চাই না মা।আমি একটু একা থাকতে দাও।”

এরিমধ্যে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পেয়ে আফিয়া আর বুরাগ দু’জনেই স্তব্ধ হয়ে যায়।আফিয়া খুশিতে কেঁদে দিলেন।বুরাগ কিছুক্ষণ ভালো করে কান্নার আওয়াজ টা শুনে নিলো।ঠোঁটে আপনাআপনিই মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠেছে।হাঁটুগেঁড়ে আফিয়ার সামনে বসে আফিয়ার কোমর গুজে মুখ লুকিয়ে নিঃশব্দে কাঁদছে।খুশিতে কাঁদছে!বাবা হওয়ার খুশিতে।

সদ্য জন্ম নেওয়া সাদা ধবধবে মেয়ে বাচ্চাটিকে প্রথম জাবেদাই কোলে নিলেন।বেলী চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।তার উপর দিয়ে অনেকটা দখল গিয়েছে।
জাবেদা নিষ্পলক চেয়ে আছেন বাচ্চাটির দিকে।মনভরে দেখছেন বাচ্চাটিকে।কিছুক্ষণ পর বেলী পিটপিট করে চোখ খুলে তাকালো জাবেদার দিকে।ক্লান্ত গলায় ‘আম্মা’ বলতেই জাবেদা নিজেকে আর আটকে ধরে রাখতে পারলেন না।বাচ্চাটিকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে ক্রন্দনরত গলায় বললেন,

–“বেলী!এ তো আমার শিউলি।ঠিক এইভাবেই শিউলি আমার কোলজুড়ে এসেছিলো।কিন্তু,আমি আগলে রাখতে পারি নি আমার শিউলিকে।আমাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গিয়েছে।”

বেলীও কান্না করছে।দূর্বল হাত দুটো এগিয়ে দিলো জাবেদার দিকে।এমতাবস্থায় বললো,

–“আম্মা!এই শিউলিকে আমি আর তুমি মিলে আগলে রাখবো।এমনকি ওর নাম হবে শিউলি!তোমার আর আমার শিউলি।”

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here