একটুখানি পর্ব : ২৯

0
577

একটুখানি
#লামিয়া_চৌঃ
পর্ব:২৯
কূজন বাড়ি আসার পর থেকেই বাবার সাথে কথা বলতে চাইছে কিন্তু বাবা সে সুযোগ দিচ্ছে না। কূজন ভেবেছিল তার বাবা খুব রাগ দেখাবে,বকাঝকা করবে কিন্তু কিছুই করছে না, শুধু সূক্ষভাবে এড়িয়ে চলছে। বাসায় ফিরেই কূজন বাবার সাথে কথা বলতে চেয়েছিল। হাসনাদ সাহেব ব্যস্ত থাকার অজুহাতে কথা বলেননি। বরং কূজনকে জিজ্ঞাসা করেছেন,
– এতো তাড়াতাড়ি চলে এলে যে? আরো কয়দিন থেকে আসতে।
কূজন বাবাকে উত্তরে কিছুই বলেনি। কি বলার আছে? বাবা যে কষ্ট পেয়ে বলেছে তা কূজন খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে। হাসনাদ সাহেব জাহরার সাথেও কথা বলছেন না। যা কিছু লাগছে নিজে নিজে করছেন। এমনকি যে ঔষধের কথা উনার স্ত্রীকে দিনে হাজারবার মনে করিয়ে দিতে হয়, শুধু মনে করিয়ে দিলেই হয় না হাতে তুলে দিতে হয় সেই ঔষধও আজ নিজে মনে করে খেয়েছেন। কূজন আসার আগ পর্যন্ত কূজনের মা বুঝতেই পারেনি কূজনের বাবা কেনো এমন করছে। কূজন এসে সব বলার পর হাসনাদ সাহেবের সাথে অনেকবার কথা বলতে চেয়েছেন। কিন্তু হাসনাদ সাহেব স্ত্রীকে কথা বলার কোনো সুযোগ দেয়নি। এ কাজে সে কাজে ব্যস্ত বলে এড়িয়ে চলছেন। কূজনের মা সারাদিন চেষ্টার পরও যখন হাসনাদ সাহেব কথা বললেন না তিনি কাঁদতে লাগলেন। কূজন শুধু সব চেয়ে দেখছে কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। মাকে কান্না থামাতে বললেই মা আরো বেশি চোখের পানি ঝরাতে লাগলেন। কূজন কখনোই কারো কান্না সহ্য করতে পারে না। এখনো সহ্য করতে পারছে না। তাই রুমে এসে চুপ করে বসে আছে। ইরিনের আঁকা ওর ছবিটা দেখে আরো মন খারাপ হয়ে যায়। ইরিন বলেছিল যারা খুব প্রিয় তাদের ছবি শুধু ওর ঐ খাতায় আঁকে আর সেটা রেখে দেয়। কূজন সেদিন চেয়েছিল কিন্তু দেয়নি বলেছিল কাউকে দেয় না। কিন্তু আজ দিয়ে দিল কেনো? কূজন কি এই সামান্য ঘটনার জন্য ইরিনের অপ্রিয় কেউ হয়ে গেলো? ভাবতেই মনটা বিষাদে ভরে গেলো। কুহুর চিন্তা এখন মাথায় আনতে চাইছে না তারপরো এতো কিছুর মাঝে কুহুকেও ভুলতে পারেনি। কুহুকে কি ভালোবাসার কথা জানান দেওয়া যেতো না? ডায়েরীটা কুহুকে দিয়ে আসলেও পারতো। এতো ভেবে ভেবে কূজনের প্রচন্ড মাথা ধরেছে। মাথার ব্যথা চোখ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। লাইট নিভিয়ে চুপ করে শুয়ে রইল কূজন। হাসনাদ সাহেব জাহরাকে কখনো কাঁদতে দেখেনি। এমনকি বিয়ের দিনও উনি স্ত্রীর চোখে পানি দেখেননি। হাসি মুখে বাবার আর বড় বোনের কথায় সব মেনে নিয়েছিলেন। হাসনাদ সাহেব তলস্তয় এর বিখ্যাত উপন্যাস পিস এন্ড ওয়ার পড়ছেন। পড়ায় ঠিকভাবে মন দিতে পারছেন না। জাহরা যে শোয়ে শোয়ে কাঁদছে তা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছেন। খুব খারাপ লাগছে সেই যে কূজন হওয়ার সময় জাহরা ভয়ে হাসনাদ সাহেবের হাতে ধরে কেঁদেছিলেন আর কাঁদেননি। মাঝে মাঝে হাসনাদ সাহেব ভেবে পায় না কূজনের মা কি সত্যি কাঁদতে জানে না? তিনি তো শুনেছিলেন নারীর প্রধান অস্ত্রই হলো চোখের জল তাহলে জাহরা কি অস্ত্রবিহীন যোদ্ধা? তাহলে কীভাবে জয় করলো হাসনাদ সাহেবকে? হাসনাদ সাহেব একটু ভাবতেই জবাব পেয়ে গেলেন। সেই একটুকরো হাসিতেই তিনি মনের সব কষ্ট ভুলে গিয়েছিলেন। হাসনাদ সাহেব হাতের বইটা বেডসাইড টেবিলে রেখে ডাকলেন,
– জাহরা কাঁদছো কেনো? এসব কান্নাকাটি তোমাকে যায় না।
কূজনের মা শুয়েছিলেন। চোখ মুছে উঠে বসে বললেন,
– আপা ইরিনকে অনেক মেরেছে।
– ইরিনকে মারলো কেনো? ওর দোষ কোথায়?
– ইরিন কূজনকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে তাই।
– কেনো?
– আপনি নাকি কূজন আর ওর মাঝে অন্যকিছু আছে ভেবেছিলেন।
– হুম প্রথমে ভেবেছিলাম আমি তো আর জানতাম না। ভেবেছিলাম ইরিনকে পছন্দ করে দেখেই ওর বাসায় এতোদিন ধরে থাকছে।কলরব আর ইরিন যে তোমার আপা ছেলেমেয়ে তা তো জানা ছিল না।
– ইরিনের কান্নাকাটিতেই কূজনকে সেখানে পাঠিয়েছিলাম।
– ঠিকাছে এখন ঘুমাও।
– ইরিনকে আপা অনেক মেরেছে। আপার রাগ উঠে গেলে ছেলেমেয়েকে অনেক মারে।
– তুমি কার কাছ থেকে জেনেছো?
– দুলাভাই বলেছেন।
– ইফতেখার সাহেব ফিরাতে পারলেন না?
– দুলাভাইকে দোকানে পাঠিয়ে তারপর ইরিনকে মেরেছে। কলরবও অফিসে ছিল।
– আচ্ছা তুমি চিন্তা করো না আমি কাল যেয়ে সব ঠিকঠাক করে দিব।
কূজনের মা অবাক হয়ে বললেন,
– কি করবেন?
– তেমন কিছুই না। তুমি টেনশন করো না। আমার উপর বিশ্বাস আছে না?
– আছে।
– তাহলে ঘুমাও।
..
কলরবকে অনেকক্ষণ ধরে খাওয়ার জন্য কলরবের মা ডাকছেন। কলরব দরজা দিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। মায়ের উপর খুব রাগ হচ্ছে। ইরিনকে এভাবে মারতে পারলো কীভাবে? এতটুকুনি মেয়েকে মারতে মারতে বেত পর্যন্ত ভেঙে ফেলেছে। মাকে কিছু বলতেও পারছে না আবার সইতেও পারছে না তাই রাগ দেখিয়ে না খেয়ে বসে আছে। ইরিন অবশ্য ভয়ে খেয়ে ফেলেছে। ইরিনের বাবা ইরিনকে খাইয়ে বাসা থেকে বের হয়ে চলে গেছে। আজ বোধহয় আর বাসায় ফিরবেন না। স্ত্রীর সাথে মনোমালিন্য হলেই তিনি মসজিদে রাত কাটান। আজও মসজিদে যেয়ে তাই জানান দিচ্ছেন। কলরবের মা কলরবকে ডেকেও যখন রুম থেকে বের করতে পারলেন না তখন বললেন,
– কূজন তোর ভাই না? এই ভর দুপুরে হঠাৎ করে ছেলেটাকে তোর বোন বের হয়ে যেতে বললো কীভাবে ?
কলরবের মেজাজও খারাপ হয়ে গেলো। বিরক্ত স্বরে মাকে বললো,
– মা যাও তো কানের কাছে প্যানপ্যান করবে না।
– তুই খেতে আয়।
– আমি বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি।
– মিথ্যে বলতে হবে না।
– মা ভালো লাগছে না।
– কূজনের ভালো লেগেছিল?
শান্তশিষ্ট ছেলেটার সাথে কি ব্যবহারটাই না করলো।
– ইরিন ছোট মানুষ মা। আঙ্কেল ওভাবে বলায় খারাপ লেগেছিল, ঘাবড়ে গিয়েছিল মেয়েটা। তাই হয়তো বলেছে।
– ঐদিকে ছেলেটা বোধহয় বাপের কাছে গালমন্দ শুনছে।
– মা কূজনের সাথে আমার কথা হয়েছে। আঙ্কেল কিছুই বলেনি।
– যাক বাঁচলাম এখন খেতে আয়।
– মা বললাম না ক্ষিধে নেই।
কলরবের মা কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,
– কলরব বাবা চলে আয়। মাকে এতো কষ্ট দিস না। মা তাহলে মরে যাব।
কলরবের হাসি পেলো। ওর মা যে কীভাবে এক মিনিটেই চোখ থেকে হাজার টাঙ্কি পানি ঝরিয়ে ড্রামা করতে পারে তা খুব ভালেভাবেই জানে। কলরব মনে মনে বললো,
– ড্রামা কুইন একটা।
তারপর ডুবে গেলো কুহুর ভাবনায়। ভাবতে লাগলো বিয়ের পর কলরব যখন ঝগড়া হলে রাগ করে বসে থাকবে তখন কুহু কি ওর রাগ ভাঙাবে? নাকি ওকে কুহুর রাগ ভাঙাতে হবে? নাহ্ কলরব রাগ ভাঙাবে না। এভাবেই দরজা দিয়ে বসে থাকবে। কুহু তখন ওর জন্যে নিজ হাতে মজার মজার খাবার রান্না করে রাগ ভাঙাবে। ইরিনের কাছে শুনেছিল কুহু নাকি অনেক ভালো রাঁধতে জানে। মায়ের ডাকে কলরবের ভাবনায় ছেদ পড়লো। হাসিমুখে দরজা খুলে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– ড্রামা কুইন চলো আগে ইরিনকে আদর করবে তারপর আমি খাব।
কলরবের মা মুখ বাকিয়ে বললেন,
– চলুন নবাবজাদীর কাছে যাই।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here