একটুখানি পর্ব : ৩০

0
569

একটুখানি
#লামিয়া_চৌঃ
পর্ব:৩০
হাসনাদ সাহেব কলরবদের বাসার সামনে গাড়িতে বসে আছেন। গাড়ির জানালার কাঁচের মধ্য দিয়ে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছেন। অনেক্ষণ হলো তিনি একই ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন। ড্রাইভার শামসুর ডাকে হুশ ফিরলো। ড্রাইভার শামসু বিনয়ের স্বরে বললেন,
– স্যার আমি কি আফনারে ভুল ঠিকানায় নিয়া আইছি?
হাসনাদ সাহেব আচমকা বলে ফেললেন,
– ভুল ঠিকানারে সামসু বড্ড বড় ভুল ঠিকানা।
পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলেন হাসনাদ সাহেব। তারপর এমন একটা ভাব করলেন যেন মশকারা করেছেন। ইয়ার্কির সুরে বললেন,
– সোনার হরিণের খোঁজ করতে তো মানুষ বনে যায় আমি লোকালয় এসেছি তাই মজা করে বললাম।
শামসু এই পরিবারটাকে খুব ভালোবাসে। যতো দেখে ততো মুগ্ধ হয়। সুন্দর করে নরম স্বরে কথা বলা যেন এদের বংশের পরম্পরা। ওরা ইয়ার্কি ঠাট্টাও করে নরম স্বরে, কেমন যেন একটা ভদ্রতা মেশানো থাকে। হাসনাদ সাহেব গাড়ি থেকে নেমে কলরবদের বাড়ির গেইটে ঢুকলেন। ঢুকার আগে নেইমপ্লেট পড়লেন “সালাউদ্দিন ভিলা”। হাসনাদ সাহেব বুঝে নিলেন এই বাড়িটায় ইরিনরা ভাড়া থাকে। তিনি যতোদূর জানেন ইফতেখার সাহেবের বাবার নাম ইলিয়াস আহম্মেদ। আর দাদার নাম ইদ্রিস আহম্মেদ। সালাউদ্দিন নামের কেউ নেই উনার। তাই বাড়িটায় যে তারা ভাড়াটে হাসনাদ সাহেব শিউর। তিনি সিঁড়ি দিয়ে ধীর পায়ে উঠলেন। তারপর তিনতলার ডান দিকের ফ্ল্যাটটায় কলিংবেল চাপলেন। একটুখানি দাঁড়াতেও হলো না হাসনাদ সাহেবকে। প্রায় সাথে সাথে একজন দরজা খুলে দিলো। হাসনাদ সাহেব দেখলেন উনার সামনে পুরো ছয় ফুটের এক যুবক দাঁড়িয়ে। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, দেহের গড়ন মাঝারী। মেদবহুলও নয় কৃশকায়ও নয়। চোখ দুটিতে বুদ্ধির ঝিলিক। হাসনাদ সাহেব আনদাজ করে নিয়েছেন যুবকটি কলরব, ইরিনের ভাই। কলরব শান্ত কণ্ঠে হাসনাদ সাহেবকে সালাম দিলো। হাসনাদ সাহেব সালামের উত্তর দিলেন। তারপর কিছুটা কেশে বললেন,
– আমি কূজনের বাবা।
কলরব মনে করলো সে ভুল শুনেছে তাই একমিনিট সময় নিলো ভাবার জন্য। একটুখানি ভেবেই হিসাব কষে ফেলেছে সে। তারপর দ্বিধা না করে আন্তরিক ভঙ্গিতে হেসে বললো,
– আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল! আসুন ভিতরে আসুন।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। তোমার বাবা মা বাসায় আছেন?
– জ্বি আঙ্কেল। আপনি বাইরে দাঁড়িয়ে কেনো? ভিতরে আসুন।
হাসনাদ সাহেব একটু ইতস্তত: করে বললেন,
– ইরিন আছে?
কলরব ঠোঁটে ঈষৎ হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,
– জ্বি আঙ্কেল আছে। আপনি আগে ভিতরে আসুন প্লিজ।
হাসনাদ সাহেব কলরবের পিছন পিছন ভিতরে ঢুকলেন।উনাকে বসতে বলে কলরব গেলো তার মাকে ডাকতে। মায়ের ঘরে ঢুকেই কলরব বিস্ময়ের সাথে বললো,
– মা আঙ্কেল এসেছেন!
কলরবের মা বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসেছিলেন। পা দুলাতে দুলাতে বললেন,
– কোন আঙ্কেল?
– কূজনের বাবা।
কলরবের মা ছেলের কথা শুনে পা দোলানো বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথা ঢেকে বললেন,
– খবরদার ইরিন যেন ওর ঘর থেকে না বের হয়।
কলরব কিছু একটা বলতে যাবে তখন মা বললো,
– কোনো কথা শুনতে চাই না। তোর বাবা আছে??
কলরব বিরক্তি মেশানো কণ্ঠে জবাবা দিলো,
– না বাবা এখনও স্কুল থেকে ফিরেনি।
সাহরা খাতুন ছেলের সঙ্গে কথা বলে আর সময় নষ্ট করলেন না। সোজা রান্নাঘরে যেয়ে দশ মিনিটে ট্রে তে নাস্তা সাজালেন। তারপর কলরবকে ডেকে বললেন ড্রয়িংরুমে ট্রেতে রাখা নাস্তাগুলো নিয়ে যেতে। হাসনাদ সাহেব তখন চমৎকার করে সাজানো ড্রয়িংরুমটা মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন। এর আগেও দুইবার এসেছেন কিন্তু এতো করে খুঁটিয়ে দেখেননি। আজ কেনো দেখছেন তাহলে? আজ কি কেনো এই রুমে এতো চাঞ্চল্য খুঁজে পাচ্ছেন? হাসনাদ সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর হুট করেই মনে হলো চিরচেনা সেই বহু আকাঙ্খিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছেন। যে কণ্ঠে তিনি বহু বছর আগে একবার মুগ্ধ হয়েছিলেন। তারপর আচমকাই হাসনাদ সাহেবের চোখের সামনে জাহরার ভুবনভুলানো সেই হাসিমাখা মুখশ্রী ভেসে উঠলো। হাসনাদ সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন সাথে নিজেকে ধন্য মনে করলেন জাহরার মতো এতো ভালো জীবনসাথী ভাগ্যে জুটেছে বলে। কলরবকে নাস্তার ট্রে হাতে আসতে দেখে হাসনাদ সাহেবের কপালে ভাঁজ পড়লো। কলরব সেন্টার টেবিলে ট্রে রাখতেই কলরবের মা কলরবের পিছন পিছন ভিতরে এসে বললেন,
– আসসালামু আলাইকুম।
হাসনাদ সাহেব বেশ সাবলীলভাবে সালামের উত্তর দিয়ে বললেন,
– ইফতেখার সাহেব বাসায় আছেন?
– না এখনও স্কুল থেকে ফিরেনি।
কলরবের মা কলরবকে ইশারায় হাসনাদ সাহেবকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিতে বললেন। কলরব হাসনাদ সাহেবের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিলেন। হাসনাদ সাহেব কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
– চা কি ইরিন বানিয়েছে?
কলরবের মা ভাবলেশহীনভাবে জবাব দিলেন,
– না।
হাসনাদ সাহেবের মুখখানা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। তিনি করুণ মুখ করে বললেন,
– ইরিনকে একটুখানি ডেকে দেওয়া যাবে? ওর সাথে দেখা করতে এসেছি।
সাহরা বেশ সাবলীলভাবে বললেন,
– না দেখা করতে দেয়া যাবে না।
হাসনাদ সাহেব প্রথমে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। কলরবও যেন একদম স্তম্ভিত হয়ে গেছে। হাসনাদ সাহেব নিজেকে সামলে নিয়ে চায়ের কাপটা টেবিলে নামিয়ে রাখলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে শান্তস্বরে বললেন,
– কেনো জানতে পারি কি?
– অবশ্যই জানতে পারেন। আপনি যেমন আপনার বউ বাচ্চা কার সঙ্গে দেখা করবে আর কার সঙ্গে দেখা করবে না তা নিয়ন্ত্রণ করেন তেমনি আমিও আমার সন্তান বা স্বামী কার সঙ্গে দেখা করবে সে বিষয়ে এখতিয়ার রাখি।
হাসনাদ সাহেবের ঠোঁট কাঁপতে লাগলো, মাথার রগ টনটন করতে লাগলো। মনে হচ্ছে এখনই ছিঁড়ে যাবে। তারপরও যতোটুকু সম্ভব নিজের রাগ সংবরণ করে তিনি বললেন,
– আপনি শুধু শুধু ইরিনকে মারলেন কেনো? বাচ্চা একটা মে..
হাসনাদ সাহেবের কথা শেষ না হতেই সাহরা বললেন,
– বাচ্চা মেয়েটা আমার আমি তাকে কি করবো না করবো সেটা আমার ব্যাপার।
– দেখুন আপনি এভাবে শুধু শুধু পারিবারিক ঝামেলার মাঝে ইরিনকে না আনলেই পারতেন।
– আপনিও এতো আগের একটুখানি ঘটনায় এতো বছর ধরে রিএক্ট না করলেও পারতেন।
হাসনাদ সাহেব এবার বেশ উঁচু স্বরে বললেন,
– আপনার কাছে এটা একটুখানি মনে হয়????
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here