একটুখানি পর্ব : ৩৩

0
570

একটুখানি
– লামইয়া চৌঃ
পর্ব:৩৩
কলরব এইবার আবার বিসিএস পরীক্ষা দিবে
তাই জোরসে পড়াশুনা শুরু করেছে। দুপুরে
খাওয়া দাওয়ার পর যে পড়া শুরু করেছে এখনো
পড়ছে। কলরবের মা ছেলের জন্য চা আর বিস্কুট
নিয়ে এসেছেন। পড়ার টেবিলে চায়ের কাপ
আর পিরিচ রেখে ছেলের বিছানায় বসলেন।
কলরব পড়তে পড়তেই বিস্কুট মুখে দিল।
একটুখানি চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই আবার
বইয়ে চোখ বুলাচ্ছে। কলরবের মা বসে বসে
গুনগুন করে গান গাইছে। কলরব আস্তে করে
ববললো,
– মা ডিস্টার্ব হচ্ছে।
কলরবের মা ছেলের কথায় সিরিয়াস হয়ে চুপ
হয়ে গেলেন। কলরব যখন কাপে দ্বিতীয় চুমুক
দিল কলরবের মা ঠিক তখন সিরিয়াস হয়ে
বললো,
– আচ্ছা এই রুমে তো তুই একা থাকিস কূজন
আসলে ভালোই করে। গেস্ট রুমে না থেকে
তোর রুমে থাকে।
কলরব অস্ফুট স্বরে বললো,
– হুম।
কলরবের মা কণ্ঠে বেদনা মিশিয়ে বললেন,
– কূজন চলে গেলেই তোকে আবার একা থাকতে
হবে তারচেয়ে বরং কুহুকে নিয়ে এলে ভালো
হবে।
কলরব অন্যমনস্ক হয়ে অস্ফুট স্বরে জবাব দিল, –
হুম।
হুম বলে নিজেই ভ্যবাচ্যাকা খেয়ে গেল সে।
তারপর ঘুরে তাকালো মায়ের দিকে।
কলরবের মা পা দুলাতে দুলাতে বললেন,
– এক ঢিলে মানুষ দুই পাখি মারে কিন্তু আমি
তিন পাখি মারি।
কলরব অবাক চাহনী নিয়ে মায়ের দিকে
তাকিয়ে আছে।
কলরবের মা ছেলের দিকে তাকিয়ে মুচকি
হেসে বলতে লাগলেন,
– ইরিনের টিচার, আমার কিচেন পার্টনার আর
তোর লাইফ পার্টনার। এই হলো তিন পাখি।
কলরব একটুখানি কেশে বললো,
– মা আমি এখন পড়ছি।
কলরবের মা বিছানা ছেড়ে দরজার দিকে
এগুতে এগুতে বললেন,
– পড় পড় এখনি যা পড়ার পড়ে নে। কুহু এলে
পড়ায় তখন একটুখানিও মন বসবে না।
মা চলে যেতেই কলরব টেবিলের দিকে মুখ
করে বসলো। হাতে থাকা কলমটা দিয়ে পড়ার
বইয়ে যে পৃষ্ঠা খুলা আছে সে পৃষ্ঠায় ছোট
করে লিখলো “আই ডু লাভ ইউ কুহু”
.
কূজন খুশি মনে কলরবদের বাসার কলিংবেল
চাপলো। ইরিন তখন দরজার কাছ দিয়ে হেঁটে
যাচ্ছিল। কলিংবেলের শব্দে ইরিন দরজার
নবে হাত দিল তারপর হঠাৎ করেই তার মনে
পড়লো এখন তো কূজনের আসার কথা। যদি কূজন
হয়ে থাকে? শিউর হওয়ার জন্য দরজার ম্যাজিক
আই এ চোখ রাখল। ইরিন ঠিক ঠিক দেখতে পেল
কূজন দরজার ওপাশে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে।
কূজনকে দেখেই ইরিনের চোখ মুখ কুঁচকে গেল।
দরজা না খুলেই সে চট করে নিজের রুমের
দিকে পা বাড়াল। ঠিক তখনই কলরবের মা
কলরবের রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। কলিংবেল
বাজছে কিন্তু ইরিন দরজা না খুলে রুমে চলে
যাচ্ছে তা দেখে বিরক্ত হলেন কিন্তু মুখে
কিছু বললেন না। এমনিতেও সেদিন মেয়েটাকে
অনেকখানি মেরেছেন। ইরিনকে কিছু না বলে
সাহরা গিয়ে দরজা খুললেন। কূজন খালামণিকে
জড়িয়ে ধরেই বললো,
– থেঙ্ক ইউ খালামণি।
– আগে ভিতরে আয় তো। তোর ভোঁতা বাপের
কথা বলবো তোকে। কীভাবে যে ম্যানেক
করেছি! বেশ বেগ পেতে হয়েছে।
কূজন খালার কথায় হাসলো।
.
পিহু বসে আছে কূজনের ডায়েরি হাতে নিয়ে।
ডায়েরিটা যদি কূজনের না তো তাহলে সে খুব
ইন্টারেস্ট নিয়ে ডায়েরিটা পড়তো। কিন্তু
কূজনের ডায়েরির প্রতি পিহুর কোনো
ইন্টারেস্টই নেই। কারণ সে নিশ্চিত কূজন এটায়
কবিতা দিয়ে ভরে রেখেছে। পিহু ডায়েরিটা
হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখছে। কালো
রঙের বেশ সুন্দর একটা ডায়েরী। দেখেই
বোঝা যাচ্ছে ডায়েরিটা বেশ দামি। হাজার
বারোশো টাকা তো হবেই। পিহু ডায়েরিটা
পড়বে না পড়বে না বলেও খুললো। প্রথম
পাতায় দেখলো অনেক সুন্দর করে কূজন নিজের
নাম ঠিকানা লিখে রেখেছে। পিহু কূজনের
হাতের লিখা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। এত সুন্দর
করে লিখা যে মনে হচ্ছে প্রিন্ট করা। পিহুর
‘ক’ লিখাটা খুব বিশ্রী হয় তাই সে কূজনের
মতো করে নিজের খাতায় ‘ক’ লিখলো। কূজনের
মত এত সুন্দর না হলেও খারাপ হয়নি। পিহু শুধু
হাতের লিখার জন্য পরের পাতা উল্টে
দেখলো।
সেখানে সুন্দর করে কূজন লিখে রেখেছে,
“যখন তোমার দুচোখ দিয়ে ঝর্নাধারা বয়
তখন আমার অন্তরেতে রক্তক্ষরণ হয়।
চোখে যখন ভাসে তোমার বিষাদমাখা মুখ
আমার তখন সন্ধ্যে নামে, দু:খে ফাটে বুক।
আমি কি কখনো পাবো সেই অধিকার
ভালোবাসার পরশ দিয়ে অশ্রু মোছার??”
.
পিহু এই কবিতা পড়ে মুখ বাকালো। তারপর
বিড়বিড় করে বললো অন্তরে আবার রক্তক্ষরণ
কীভাবে হয়??
কবিতার নীচেই ছোট করে লিখা,
*একটুখানি চোখের দেখায়,সময়গুলো থমকে
দাঁড়ায়★
কুহু… আমার বিশাল আকাশে ভাবনার একটা
সুখ তারা তুমি…
কুহু… অপেহ্মার চাতক পাখির ন্যায় আমার
চোখ জুড়ানোর পলক তুমি…
কুহু…আমার অপেহ্মার অবসানের এক পশলা
হাসি তুমি….
কুহু…তুুমিই আমার প্রেয়সী…
“ভালবাসি”
পিহুর চোখ কপালে উঠলো। পিহু ভেবেছিল কুহু
কবিতা পছন্দ করে তাই বোধহয় কূজন
ডায়েরিতে লিখা সব কবিতা কুহুকে পড়ার
জন্য দিয়েছে। কিন্তু এই ঘটনা দেখে পিহু
একটার পর একটা কবিতা পড়তে লাগলো।
# অন্তরবাসিনি
অন্তরবাসিনি, প্রথম যেদিন দেখেছিলাম
তোমায়
অপূর্ব প্রকৃতির মধ্যে প্রকৃত রুপ পাশের
জানালায়।
খোলা চুল উড়ছিল বাতাসে।
উড়ছে এলো চুল ,নাকি উড়ছে আমার মন?
বুঝিনি সেদিন হৃদয়ের আয়নাখানি
এঁকেছে তোমার ছবি মায়াবী ও চোখ খানি,
জোড়া ভ্রু জুগোল, কাজল চোখ হরিণী।
ওহে অন্তরবাসিনি সেই তো প্রথম দর্শন।
হারিয়েছি কখন বুঝতেই পারিনি
আমার অবুঝ শান্ত সরল মনখানি।
কি জাদু দিয়ে করেছো হরণ
জানিনা তার কোনো বিবরণ।
শুধু জানি আমার অবুঝ হৃদয়ই নয়
এঁকেছে সে ছবি আমার দুই নয়নখানি।
শয়নে, স্বপনে, নিভৃতে, নির্জন জাগরণে
চোখ বুজলেই ভেসে ওঠে মায়াবী মুখখানি
ওহে অন্তরবাসিনি।
হৃদয়ের মাঝে কুহু কুহু সুরে গেয়ে যায় গান
খানি।
মনের জানালা খুলে বসে আছি আশায় আশায়
সেই প্রথম দর্শন পাই যদি একটুখানি।
সমগ্র জিবন কাটিয়ে দিতে চাই, হাতে রেখে
হাত
চোখে রেখে চোখ, চেয়ে থাকতে পারি
অপলক।
ওগো অন্তরবাসিনি তোমার মনে কি আছে
জানিনা,
আমি ভাবি আমার শুধুই তুমিময় ভাবনা
শুধু তুমি তুমি করে কাটে আমার দিনরাত।
নিজের অজান্তেই ভালবেসেছি তোমার
অশ্রুখানি!
ওহে অন্তরবাসিনি
ভালবেসে আমায় গ্রহণ কোরো একটুখানি।।।
.
# বাতায়নবর্তিনী
“ওগো বাতায়নবর্তিনী,
শোন একটুখানি।
তোমার ঐ হাসিমুখ
এনেছে আমার স্বপ্নসুখ।
থাকি যখন আধোঘুমে
পরী হয়ে আসো নেমে,
থাকো তুমি বসে
জানালার পাশে।
আমার সকল গানের সুরে
আমার পুরো হৃদয় জুড়ে
আছে শুধু তোমার হাসি।
আমি তোমায় ভালোবাসি।”
.
পিহু একেকটা কবিতা পড়ছে আর একেকবার
সপ্তম আকাশ থেকে পড়ে কোমায় যাচ্ছে।
ডায়েরিটা বন্ধ করে ঘড়িতে সময় দেখে নিল
সে। কুহু কোচিং এ গেছে। আসতে আরো আধা
ঘন্টা বাকি। তারপর ডায়েরি খুলে আবার
পড়তে শুরু করলো।
হয়তো সেদিন চেয়েছিলাম বলতে
কিন্তু পারিনি বলতে তোমায়
আজ বলবো ভাবছি
হয়তো আজো পারবোনা বলতে
ভলোবাসি ভালোবাসি
কি আছে এই চার অক্ষরের মাঝে?
আজও কেনো পারিনি বলতে
তুমি কি বুঝেছিলে সেদিন?
নাকি আজও বোঝোনি
হৃদয়ের গহীনে থাকা
আমার মনের কথা
ভালেবাসি তোমায় ভালোবাসি।।।।
Love u kuhu…
.
প্রথম যেদিন দখলে নিয়েছিলে জানালার
পাশের সিটটা,
হয়তো সেদিনি হরণ করেছিলে এ হৃদয় টা।
ছাদে দাঁড়িয়ে একটুখানি তোমার দেখায়,
মন যে ভরেনা,
সারটি জীবন তোমায় দেখতে চাই।
একটুখানি ধরবে কি আমার হাত?
রইবেকি চিরোকাল আমার পাশে?
ভালবেসে পরম আবেশে রাখতে চাই,
তোমায় আমারি চারিপাশে।
.
প্রিয় ”কুহু”,
আছো আমাতে মিশে, জানিনা কি হবে, এ
জীবনের শেষে…..
রাখবো তোমায় এ বুকে ধরে,
কখনো যাব না তোমায় ছেড়ে।
.
“তুমি হরণ করেছো মোরে মায়াজালে।
এলোমেলো করে দিয়েছো আমার সুরকে।
আমি সুর তুলেছি তোমার জন্য গিটারে।
হারিয়েছি তোমার মায়াবী চোখে।”
.
আমি ডুবতে চাই * তোমার চোখের
সাগরে*জড়াতে চাই তোমায় *আমার
ভালবাসার চাদরে *আমি হাটতেঁ চাই তোমার
সাথে *শুরু থেকে পথের শেষে*হঠাৎ থমকে
গিয়ে বলতে চাই্ধন্য তোমায় ভালবেসে*
পিহু কবিতা পড়তে পড়তে হাপিয়ে গেছে। এত
কবিতা মনে হয় সে সারাজীবনেও পড়ে নাই।
ডায়েরি প্রায় শেষের দিকে। পাঠ্যবইয়ের
কবিতার বাইরে জীবনে বোধহয় এই প্রথম পিহু
কারো কবিতা পড়ছে। যদিও বোরিং লাগছে
তার কাছে তাও সে বাকি পৃষ্ঠাগুলোও পড়লো।
যখন দেখলো শেষের পাতায় আছে তখন
খুশিতে জোরে জোরেই পড়লো,
তুমি দূরে বহুদূরে,
কখনো কি পারবো না ছুঁতে তোমাকে?
আমি ছুটে চলেছি এক মরীচিকার পিছনে,
ধুধু মরুভূমির প্রান্তরে।
কখনো কি পারবো না ছুঁতে তোমাকে?
ছুটতে ছুটতে আজ আমি ক্লান্ত..
ভেবো ননা থেমে যাব।তোমারি প্রতীক্ষায়
আজ আমি পরিশ্রান্ত!
অভিমানী মন আআজো তোমার অপেক্ষাতে।
আমার মন কখনো কি পারবে না ছুঁয়ে দদিতে
তোমাকে?
অভিমানী মন আজো তোমারি অপেক্ষাতে।”
এতবড় বোরিং ডায়েরিটা পড়ে শেষ করে
পিহুর মনে হচ্ছে সে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ
থামিয়েছে।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here