একটুখানি পর্ব : ৩৪

0
544

একটুখানি
– লামইয়া চৌধুরী
পর্বঃ৩৪
কূজনের ডায়েরি পড়ে পিহু মাথায় হাত দিয়ে
বসে আছে। চেহারায় বিরক্তি আর বিস্ময়ের
দারুণ সংমিশ্রণ। বসে বসে গুনগুন করে “নো
ব্রেইনার” গানটা গাইছে। তার কাছে কূজনকে
তাই মনে হচ্ছে। আজাইরা থেকে গজাইরা গীত
গায় এই ছেলে। নাহ্ গীত আজাইরা না সেটা
বেশ সুন্দরই গায় তবে এই কবিতাগুলো সেই
মাপের দারুণ রকমের ফালতু লাগছে পিহুর
কাছে। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে টেবিলের
উপর পা তুলে রেখেছে পিহু। নিজেকেও এখন
ব্রেইন ছাড়াই মনে হচ্ছে। সে বুঝলো না
কেনো কূজন যে কুহুকে পছন্দ করে? অথচ এসব
ব্যাপারে তো সে নিজেকে ডক্টরেট ভাবতো।
আজ প্রমাণ পেল আসলে এতোটাও বুঝে না
সে। আর বুঝবে কীভাবে? আদৌ কূজনের
কোনো আচরণে কি এমন কিছু ছিল নাকি? এই
সুইট বয় তো সবার সাথে কিউট মার্কা হাসি
ঝুলিয়েই কথা বলে। তারপর ছাদে গেলেও তো
কুহুর দিকে তাকায় না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
খালি প্রকৃতি দেখে। পিহু ভাবছে সবটাই
কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে গেছে। একে তো
কলরব, কূজন দুই ভাই। দুইজনই কুহুকে পছন্দ করে।
তার উপর কুহু আবার কনফিউজড কাকে পছন্দ
করে। পিহু ভাবছে কুহু ডায়েরিটা পড়ার পর কি
সিদ্ধান্ত নিবে। নিশ্চই পটে যাবে। পিহু তো
তার বোনকে চিনে। কবিতার প্রতি দুর্বলতা
তার তুঙ্গে। যাক তাহলে সমস্যার সমাধান হয়ে
যাবে। পিহু ভাবছে কুহু শুধু কাকে পছন্দ করে
সেটা বুঝলেই হল। কলরব,কূজন যাকে ইচ্ছা চুজ
করুক কিন্তু বুঝেশুনে যাতে চুজ করে।কিন্তু আব্বু
যে আবার বিয়ে দেখছে? উফ্ সবদিক দিয়ে
ঝামেলা আর ঝামেলা। আকাশপাতাল ভাবতে
ভাবতেই পিহু ঘড়ির দিকে তাকালো। সন্ধ্যা
ছয়টা বেজে যাচ্ছে। এতক্ষণে তো কুহুর বাসায়
এসে যাওয়ার কথা। আসছে না কেনো? পিহু
কুহুকে কল করতেই রুমের ভিতর কুহুর মোবাইল
বেজে উঠল। পিহু চেয়ারে বসেই মাকে ডাকল।
– কি হল ডাকছিস কেনো?
– আম্মু আপুণি এখনো এলো না আবার
মোবাইলও নিয়ে যায়নি।
– ওহ্ তোর বড় খালার বাসায় গেছে।
পিহু কাঁদো কাঁদো চেহারা করে বললো,
– আমাকে নিয়ে যায়নি কেনো?
– তোর না পরীক্ষা চলছে??
– তো কি হয়েছে এখান থেকে এখানেই তো।
– না যাওয়া লাগবে না পরীক্ষা শেষে যাস
আর কুহু কালকেই এসে পড়বে।
– ঠিক আছে।
মা চলে যেতেই পিহু ডায়েরিটা সযত্নে
আলমারিতে তুলে রেখে দিল। কুহু আসলে
কুহুকে দিতে হবে।

ইরিন বিরক্তি মেশানো স্বরে বললো,
– ভাইয়া তুমি আবার এসেছ কেনো?
কূজন হেসে বললো,
– তোমার বিয়ে খেতে এসেছি।
ইরিন ওর বড় বড় চোখগুলো আরো বড় করে
কটমটিয়ে তাকালো।
কূজন ভয় পেয়ে যাওয়ার মতো অঙ্গভঙ্গি করে
বললো,
– সোনার হরিণ তুমি যে বড় হয়ে গেছ তা
বুঝাতে তোমার টানা টানা হরিণী চোখগুলো
দিয়ে আমাকে কি ভয় দেখাতেই হবে?
ইরিন চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
– যাও এখান থেকে..
– না যাব না।
– হুহ্ যেও না থেকো আমিই চলে যাব
শ্বশুড়বাড়ি।
– কোথায় জঙ্গলে? হা হা হা।
– এই শুনো একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবে না।
– কেনো তোমার জেরেফ তো জঙ্গলে
জঙ্গলেই ঘুরে আর তুমিও তো সোনার হরিণ বনে
থাকাই তো তোমার কাজ। এতো আমাদের
সৌভাগ্য তুমি আমাদের লোকালয়ে থাকছো।
– এই তুমি কি বলতে চাচ্ছো ভাইয়া? তুমি কি
চিড়িয়াখানায় এসেছো নাকি? আমাকে কি…
– আরে বাবা থামো না। আমাকে বলতে দাও..
– না বলতে হবে না। শুনো জেরেফ তো
অভিশপ্ত তাই লোকালয় থেকে দূরে থাকে।
– আরে বাবা এইজন্যই তো বললাম তুমি কি
জেরেফের কাছে চলে যাবে?
ইরিন চোখ ছোট করে বললো,
– ভাইয়া তুমি জেরেফকে চিনো কীভাবে?
– আমিও ফেইরিটেল দেখতাম আগে। মাঝে
মাঝে এখনো দেখি।
– সত্যি? তেমার পছন্দের ক্যারেকটার কে?
– জেরেফ।
ইরিন খুশি হয়ে কূজনকে চিমটি কেটে বললো,
– আমারো। জানো ভাইয়া এজন্যই তোমাকে
আমার এতো ভালো লাগে। কলরব ভাইয়া তো
খেলা ছাড়া আর কিছুই দেখে না।
ইরিন কূজনের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে
পড়লো। কূজন খুব ভালো শ্রোতা তাই মনোযোগ
দিয়ে ইরিনের কথা শুনে যাচ্ছে। রাতের
খাবার খেতে সাহরা ওদের ডেকে নিতে
এলো। এসেই দেখলেন ইরিন আর কূজন গল্প
করছেন। এটা দেখে উনার মন খুশিতে ভরে
উঠলো। একটু ভাব নিয়ে বললেন,
– দুই ভাই বোনের গল্প আর কতো চলবে?
– উফ্ মা যাও তো এখন ডিস্টার্ব করো না।
– পরে কথা বলিয়েন আম্মাজান। এখন খাবেন
চলুন।
– তুমি আমাকে আম্মাজান বলবে না। আমাকে
তুমি মেরেছো।
সাহরা অনায়াসে বলে দিলেন,
– ঠিক আছে তাহলে খালাম্মা ডাকবো।
তিনজনই হেসে ফেললো তারপর এগুলো
ডাইনিং এর দিকে।
ইফতেখার সাহেব আর কলরব বসে ওদের জন্য
অপেক্ষা করছে। ইফতেখার সাহেবের হাত
নিশপিশ করছে পত্রিকার জন্য। কিন্তু উনার
মাষ্টারনীর কড়া নিষেধ খাবার খাওয়ার সময়
অন্তত যেন এটা বাদ দেয়। সাহরা প্লেটে
খাবার সার্ভ করতে করতে ইফতেখার
সাহেবকে ইশারায় কিছু বললেন। ইফতেখার
সাহেব একটুখানি কেশে বললেন,
– কলরব!
– হুম বাবা বলো।
– তোর জন্য মেয়ে দেখেছি আমি।
কলরবের সামনে প্লেট আর পাশে কারেন্ট
অ্যাফেয়ার্স খোলা। সে চোখ বোলাচ্ছে
পাতায়। তাই অন্যমনস্কভাবেই বললো,
– ভালো কথা।
ইরিন ভাইয়ের এমন আচরণ দেখে মজা করে
বললো,
– ছি! ছি! ভাইয়া তুমি বিয়ে করার জন্য এতো
পাগল হয়ে গেছ????
ইরিনের কথায় সবাই হেসে ফেললো। কলরব
হাসির শব্দে ওদের দিকে তাকালো। কূজন
বললো,
– ইশ্ ভাই আমি যদি তোমার মতো এত ভালো
স্টুডেন্ট হতাম!
ইরিন ইয়ার্কি করে বললো,
– তাহলে আঙ্কেলকে বলতে ভালো করেছো
আমার জন্য মেয়ে দেখেছো। হা হা হা।
কলরব এবার বুঝতে পারলো সবাই কেনো
হাসছে। তার বাবা বলেছিল কিছু একটা বলবে
কিন্তু খেয়াল করেনি কি বলেছে। কলরব
নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
– আমি তখন পড়ায় মগ্ন ছিলাম।
সাহরা বললেন,
– এত পড়ে কি হবে? শেষে বিয়েই তো করতে
হবে।
কলরবের মায়ের কথা শুনে কলরবের হার্ট বিট
বেড়ে গেল। ভিতরে ভিতরে সে মাইকেল
জ্যাক্সেনের সবকটা স্টেপ নেচে ফেলছে।
ইফতেখার সাহেব ওদের থামিয়ে বললেন,
– আহা আমাকে কথা বলতে দাও তো। মেয়ের
বাড়ি একটুখানি দূরে। খুলনার ওদিকে। বাবা
মায়ের একমাত্র মেয়ে।
এতটুকু শুনেই কলরব ভিতরে ভিতরে ঘেমে
যাচ্ছে। চেহারায় স্পষ্ট বিষাদের ছাপ ফুটে
উঠেছে। তার বাবা মেয়ে সম্পর্কে আরো
অনেক কিছুই বলে যাচ্ছেন কিন্তু কোনো
কথাই তার কানে যাচ্ছে না। সে ভেবেছিল
হয়তো কুহুর কথা বলছে। কলরব কাতর দৃষ্টিতে
মায়ের দিকে তাকালো। কলরবের মা
নির্বিকার। কলরব যে বাবাকে না করবে
সেটুকুও পারছে না। সব কথা যেন গলায় এসে
আটকে যাচ্ছে। এবার সত্যি সত্যি সে ঘামতে
শুরু করলো। সামনে থাকা গ্লাসটা নিয়ে এক
চুমুকেই সবটুকু পানি শেষ করে বললো,
– বাবা আমি এখন বিয়ে করবো না, সামনে
পরীক্ষা।
কলরবের কথায় ইফতেখার সাহেবের কথায় ছেদ
পড়লো। তিনি থমকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
– কুহু হলেও না?
সাহরা, ইরিন আর ইফতেখার সাহেব একসাথে
তাল মিলিয়ে হাসতে লাগলেন। কলরব দারুণ
চমকে গেল আর কূজনের পৃথিবী যেন থমকে
গেল।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here