একটুখানি
—- লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৩৫
কূজনের প্রচণ্ড মাথা ব্যথা করছে। মাথা
ব্যাথা চোখ পর্যন্ত নেমে এসেছে। দুই হাতে
মাথা চেপে ধরে বসে আছে। অসহ্যরকমের
ব্যাথায় ছেয়ে যাচ্ছে সারা শরীর। হয়তো
ব্যাথাটা হৃদয় থেকে উৎপন্ন তাই। মাথা
ব্যাথাটা খাবার টেবিলেই শুরু হয়েছে। কুহুর
নাম শোনা মাত্রই কূজনের মাথা ঝিমঝিম
করতে লাগলো। কুহুর সাথে কলরব ভাইয়ের
বিয়ে??? মানতে কষ্ট হচ্ছে বেশ। মাথা ব্যাথা
আরো বেড়েই চলেছে। ওয়াশরুমে যেয়ে
চোখে মুখে পানির ছিটা দিয়ে ফিরে এসে
শুয়ে আছে সে। এখনো বিশ্বাস করতে পারছে
না সে যে কুহু আর কলরব। বহু কষ্টে ভদ্রতা
দেখিয়ে এতক্ষণ ডাইনিং টেবিলে বসে ছিল
সে। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর আর যখন নিজের
মনের সাথে পেরে উঠছিল না তখন টেবিল
ছেড়ে উঠে এসেছে। এখন সে কি করবে?
কেনো সে এখানে আসতে গেল? এখানে না
আসলে হয়তো কখনো কুহুকে খুঁজে পেতো না।
এটা কি বাবাকে দেওয়া কষ্টের ফল?? বাবার
অবাধ্য হয়ে এখানে এসেছিলাম তাই কি???
বাবার কষ্টটা বুঝতে পারিনি তাই আল্লাহ কি
আমাকেও একি কষ্টের মধ্যে ফেললেন? বুকের
মধ্যে একটা চাপা আর্তনাদ শুনতে পেল সে।
পাশ ফিরে শুতেই দরজা খোলার শব্দ হল। কূজন
তাকিয়ে দেখলো কলরব রুমে এসেছে। মোবাইল
চার্জে দিয়ে বেড়িয়ে গেল রুম থেকে। কলরব
বেরিয়ে পড়তেই কূজন উঠে লাইট অফ করে
মেঝেতেই বসে পড়লো। মাথাটা কেমন ফাঁকা
ফাঁকা লাগছে। চোখ বন্ধ করতেই কুহুলে
দেখলো আর বাবা বলে চাপা একটা আর্তনাদ
করে উঠলো। আজ কেনো যেন বাবার কষ্টটা খুব
করে বুঝতে চাইছে সে। বাবা কি সত্যিই
ভালো আছে? নাকি মায়ের সাথে শুধু মানিয়ে
নিয়েছে?? এখনো কি খালামণিকে ভুলতে
পেরেছে? আচ্ছা সেদিন তো বাবা এই
বাসায় এসেছিল। খালামণিকে দেখে নিশ্চই
বাবার বুকেও ব্যাথা হয়েছে। যেমনটা এখন
আমার হচ্ছে।
আচ্ছা ভালোবাসা কি কখনো মলিন হয়ে যায়?
নাকি অন্য কারো আবডালে ঢাকা পড়ে যায়?
কুহুর সাথে কলরবের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর
কূজনের কি কুহুর প্রতি ভালোবাসাটা থাকবে?
নাকি নিঃশেষ হয়ে যাবে। কূজন যদি কুহুকে
ভুলতে না পারে তাহলে কি হবে??? সে কি
মরে যাবে?? নাকি ধুঁকে ধুঁকে মরবে?? আর
ভাবতে পারছে না সে। যন্ত্রণায় পেরে উঠছে
না নিজের সাথে। কোনোরকমে উঠে
বিছানায় উপুর হয়ে গা এলিয়ে দিল কূজন।
.
কলরব ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। পূর্ণিমা নেই।
অবশ্য পূর্ণিমা আমাবস্যা এসব নিয়ে কলরবের
মাথা ব্যাথাও নেই।
কখনো ছিলও না আর আজ তো একদমই নেই। যার
হৃদয় ক্ষণে ক্ষণে জোছনাবিলাস করে, যার
চোখের পলকে কুহুর নামে জোছনা ঝরে, যে
নিজে কুহু নামক চাঁদনী রাতের রাজা তার এসব
পূর্ণিমা, আমাবস্যা এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে
লাভ কি? হাতে কফির মগ। একটুখানি করে চুমুক
দিচ্ছি আর কুহুর কথা ভাবছে সে। কোথায়
ভেবেছিল রাত জেগে পড়বে আর এখন করছেটা
কি??? কলরব মনে মনে হাসলো। মা আসলে
ঠিকই বলেছিল। কুহু আসলে পড়াশুনা শেষ। যাক
গোল্লায় যাক পড়াশুনা। কুহুকে পেলে জীবনে
আর কিছু লাগবে না তার। হঠাৎ করে কফি
খাওয়া থামিয়ে কলরব কফির মগটার দিকে
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ভাবছে কফিটা
যদি কুহুর হাতের হতো তাহলে কেমন হতো??
বিয়ের পর কুহুকে নিয়ে কলরব প্রতি রাতে
ছাদে দাঁড়িয়ে কফি খাবে, কুহুর হাতের
বানানো কফি। এই মগটাতেই দুজন শেয়ার করে
কফি খাবে। কুহু প্রথমে কফির মগে চুমুক দিবে
তারপর কলরব এই মগে কফি খাবে। আচ্ছা কুহু
যদি রাতে ছাদে আসতে ভয় পায় তাহলে
কীভাবে এই স্বপ্ন পূরণ হবে??? কুহুকে জোর
করে ছাদে নিয়ে আসবে। দরকার হলে
পাঁজাকোলে করে নিয়ে আসবে। পাঁজাকোলা
করার কথা মনে হতেই ইরিনের বলা সেদিনের
কথাটা মনে পড়লো কলরবের। আসলেই
পাশাপাশি বাড়ি। বরযাত্রীরা মজা পাবে
না। তবে কলরবের বেশ মজা হবে। ইরিন আর
তার মা যেই পাবলিক সত্যি সত্যি তাহলে কুহু
এ বাসায় কোলে করে নিয়ে আসতে হবে। কুহু
লজ্জায় মরেই যাবে। নিজে নিজে এগুলো
ভাবছে আর পাগলের মতো হাসছে সে। হঠাৎ
রবীন্দ্রনাথের কয়েকটা লাইন মনে পড়লো তার।
“যেমন আছ তেমনি এসো, আর কোরো না সাজ।
বেণী নাহয় এলিয়ে রবে, সিঁথি নাহয় বাঁকা
হবে,
নাই-বা হল পত্রলেখায় সকল কারুকাজ।
আঁচল যদি শিথিল থাকে নাইকো তাহে লাজ।
যেমন আছ তেমনি এসো, আর করো না সাজ।”
কলরব যদিও এসব কবিতা পড়ে না তবে তার
ব্রেইন খুব শার্প। ভার্সিটিতে একবার একটা
নাটক হয়েছিল। নাটকটায় নায়ক সেজেছিল
রঞ্জু। বেশ ভালো অভিনয় করে। সে নাটকের
দৃশ্যে নায়ক তার নায়িকাকে এই লাইনগুলো
বলছিল। বন্ধু রঞ্জুর কথা রাখতে নাটকটা
দেখতে গিয়েছিল। কলরবের আবার যেকোনো
জিনিস একবার শুনলেই মনে থাকে, ভুলে যায়
না কখনো। তাই এতদিন পরও লাইনগুলো মনে
আছে তার। কলরব ঠিক করে ফেললো ফুলশয্যার
রাতে কুহুকে এই লাইনগুলো বলবে সে।
.
হাসনাদ সাহেব সকাল সকাল ফেণীর উদ্দেশ্যে
রওনা হলেন। ইরিনের সাথে দেখা করবে তাই
মনটা বেশ ফুরফুরে। ইরিনকে দেখলেই মনে হয়
ইশ্ আমারো যদি এমন একটা মেয়ে থাকতো।
বাসাটা কেমন খালি খালি লাগে। মেয়েরা
নাকি ঘর পরিপূর্ণ করে রাখে। হাসনাদ সাহেব
আসার সময় ভুলে ইরিনের জন্য কেনা গিফ্টটা
ফেলে রেখে আসছিলেন। কিন্তু গাড়িতে
বসতেই মনে পড়ে যায়। গাড়ি থেকে নেমে
নিজে যেয়ে উপর থেকে গিফ্টা নিয়ে আসেন
তিনি। কত শখ করে কিনেছেন এই গিফ্ট। কিন্তু
সোনার হরিণ তো তা ফিরিয়েই দিল। আজকে
জোর করে গিফ্টটা দিয়ে আসবেন। না রাখতে
চাইলে বকা দিবেন তারপরো দিবেন। সারা
রাস্তায় এসব ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেলেন
কলরবদের গলিতে। গাড়ি থেকে নেমেই
কলরবদের বিল্ডিং এ পা বাড়ান তারপর আবার
কলরবদের বাসায় না যেয়ে কুহুদের বিল্ডিং
এর দিকে যান। কূজন থেকে ঠিকানা জেনে
নিয়েছেন তবে কোন তলা আর কোন ফ্ল্যাট
তা জানেন না। তবে কুহুর নাম বললেই বের করে
ফেলতে পারবেন। সোনার হরিণের সাথে তো
দেখা করাই যাবে কিন্তু আগে কূজনের জন্য
কুহুর বাবার বাসায় যাবেন তিনি। নিজের
প্রিন্সের প্রিন্সেসকে খুঁজে পেতে হবে।
কূজনকে বেশ বড়সড় ধরনের একটা সারপ্রাইজ
দিবেন ভেবে রেখেছেন। বিয়ের কথা ফাইনাল
করে কূজনকে জানালে কূজন পুরোই থতমত
খেয়ে যাবে। যেমনটা ছোটবেলায় ওকে একটা
ময়না পাখি এনে দেওয়ায় খুশি হয়েছিল ঠিক
তেমনটাই হবে নিশ্চই। ধ্যাত সে খুশি আর এই
খুশি এক হলো নাকি??? ঐ খুশি এই পাওয়ার
তুলনায় নগণ্য। কুহুদের বিল্ডিং এ যেয়ে
নীচতলার ডানদিকের ফ্ল্যাটে কলিংবেল
চাপলেন। একটু পর একজন বয়স্ক লোক এসে
দরজা খুলতেই হাসনাদ সাহেব কুহুর বাসা কিনা
জানতে চাইলেন। বয়স্ক লোকটি বললেন না
কুহুদের বাসা উপরের তলায়, ডান দিকের
ফ্ল্যাট। হাসনাদ সাহেব ধন্যবাদ জানিয়ে
সিঁড়ি বেয়ে উপর উঠলেন। তারপর কলিংবেল
চেপে দাঁড়িয়ে রইলেন। আরেকবার চাপতে
যাবেন ঠিক তখনই দরজা খুলা হলো। হাসনাদ
সাহেব দেখলেন বেশ সুন্দর একটা মেয়ে
দাঁড়িয়ে আছে। তিনি ভেবেছিলেন সালাম
দিবে নিশ্চই কিন্তু মেয়েটা জিজ্ঞাসা
করলো,
– কাকে চাইছেন?
– এটা কি কুহুদের বাসা??
– জ্বি।
– তুমিই কি কুহু?
– না আমার আপু কুহু।
– ওহ্ তোমার বাবা আর আপু বাসায় আছে?
পিহুর কাছে কেমন যেন মনে হচ্ছে ব্যাপারটা।
কুহু যে বাসায় নেই তা বললো শুধু বললো,
– জ্বি ভিতরে আসুন। আমি আব্বুকে ডেকে
দিচ্ছি।
চলবে….