একটুখানি পর্ব : ৫১

0
453

একটুখানি
– লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৫১
কূজনকে দেখছে কলরব। ঘুমিয়ে একাকার হয়ে
আছে কূজন। কাঁথা জড়িয়ে আরামসে ঘুমাচ্ছে।
কলরব কূজনের পাশে বসেই কূজনের কপালে হাত
রেখে দেখলো জ্বর আছে কিনা। টেম্পারেচার
নরমাল আছে দেখতে পেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে
দিলো। মনে মনে বলল,
– ভাই আমাকে ক্ষমা করে দিস। কুহু তো কোনো
ট্রফি না যে দিয়ে দিব তোকে। সে একটা মানুষ।
নিজস্ব একটা স্বপ্ন আছে, আছে ভালোবাসা, ঘর
বাঁধার স্বপ্ন। বিশ্বাস কর যদি কুহু আমাকে ভালো না
বাসতো, তোকে ভালোবাসতো তাহলে নিজের
বুকে পাথর চেপে হলেও তোকে আর কুহুকে
এক করে দিতাম। বিশ্বাস কর ভাই যদি এমনো হতো
কুহু আমাদের দুজন থেকে কাউকেই ভালোবাসে
না তাহলেও আমি কুহুকে ভুলে যেতাম। তোকে
কষ্ট দিতে চাই না ভাই। কিন্তু কুহুর মুখের হাসি আমার
কাছে খুব বেশি ইম্পর্টেন্ট। মেয়েটাকে কষ্ট
দিতে পারবো না। তোর মনে আছে কিনা জানি না
নানার বাড়িতে ছোটবেলায় গ্রীষ্মের ছুটিতে
বেড়াতে গিয়ে আমরা ক্রিকেট খেলতাম। তোর
টিম বরাবরি হারতো। তুই হাসি মুখে আমার টিমের
জয়জয়কার করতি। কোনোদিন মন খারাপ করতে
দেখিনি তোকে। কিন্তু আমি ঠিকই জানতাম তোর
খারাপ লাগতো। তাই এক দুইবার নিজ থেকে হেরে
যেতাম। তখন তোর মুখে বিজয়ীর হাসি দেখে
শান্তি লাগতো, খুব বেশি শান্তি লাগতো। আজো তুই
ছোটবেলার মতোই আছিস। এখনো জীবননামক
খেলায় আমার মতন সেলফিশ ভাইটির জন্য হাসিমুখে সব
সহ্য করছিস। বিশ্বাস কর কূজন আমারো কষ্ট হচ্ছে।
তুই এখনো ছোটবেলার মতোই রয়ে গেছিস।
শুদ্ধতম, মহত্তম, নির্মল হৃদয় নিয়ে আজো কল্পনায়
রয়ে গেলি। কিন্তু আমি তো আর ছোটবেলাটির
মতন নেই। বাস্তবতা দেখেছি, বাস্তবতা শিখেছি,
দুদিনের পৃথিবীতে স্বার্থপর হতে শিখেছি। কুহুর
জন্য স্বার্থপর আমি। একমাত্র কুহুর খুশির জন্য। কুহু
তো কোনো খেলনা নয় যে দুই ভাই একে
অপরের জন্য তাকে ত্যাগ করবো। ক্রিকেট নামক
খেলায় আমি ইচ্ছে করে হারতে পারি কারণ এতে
ব্যাটবলের কোনো কষ্ট হবে না। কিন্তু কুহু নামক
ভালোবাসার খেলায় এমন করলে আমাদের
দুজনেরই ভালোবাসার মানুষটা কষ্ট পাবে, আমাদের
কুহু কষ্ট পাবে। তা আমি নিজ চোখে দেখতে
পারবো না। চাঁদের আলোয় কুহুর চোখের এক
ফোঁটা গড়িয়ে পড়া জল দেখেই আমি নীল হয়ে
যাচ্ছিলাম ভাই। আমি নিজের বুকের হাহাকারের দাপটের
সাথে পেরে উঠলেও কুহুর কান্নার দাপট আমাকে
ভেঙে চুরচুর করে দিবে। কুহুর আত্মসম্মান এর
সামনে তোর প্রতি আমার আদর, স্নেহ হেরে
গেল ভাই। ক্ষমা করে দিস। তবে আজ না বুঝলেও
একদিন বুঝবি তিনটি জীবন নষ্ট হওয়া থেকে একজন
কষ্ট পাওয়া ভালো। তোর কষ্টের নাও যে সুখের
তীরে ঠেকবেই কূজন ঠেকবেই।
কথাগুলো মনে মনে বলেই কলরব বিছানা ছেড়ে
দাঁড়িয়ে পড়লো। কূজনের জন্য খুব বেশি কষ্ট
হচ্ছে। কালকেই কূজনকে পাঠিয়ে দিতে হবে।
এখানে থাকলে অনেক বেশি কষ্ট পাবে কূজন।
ছেলেটা এতো কষ্ট সহ্য করেও আজ জানতে
চেয়েছে জ্বরের ঘোরে উল্টাপাল্টা কিছু
বলেনি তো। কলরব ইচ্ছে করেই মুখ খুলেনি।
বুঝতে দেয়নি কিছুই। কলরব চায় না কূজন শুধু শুধু
অস্বস্তিতে পড়ুক।

– সুরভী ভাবি কেমন আছেন?
– আমি তোর ভাবি হলাম কবে?
– গার্লফ্রেন্ড ছিলি নাকি? মনে পড়ছে না তো।
– এক থাপ্পর দিয়ে তোর আক্কেল দাঁত সহ সব দাঁত
ফেলে দিব।
– তুই জানিস কি করে যে আমার আক্কেল দাঁত
উঠেছে?
– তোর কোন খবরটা জানি না। তুই যে তোর
ফুলটুশীর উপরও রেগে আছিস তাও জানি।
– শালা রঞ্জুটা তোকে সব খবর পাস করে তাই না?
– ঐ রঞ্জু তোর শালা হলো কবে? তুই শালা।
বান্ধবীর জামাইর শালা নিজে আর উল্টা আরো
বান্ধবীর জামাইকে শালা বলে ঝাড়ি মারে। আসছে
আমার মহাপুরুষ কলরব। রঞ্জুকে সম্মান দিয়ে কথা বলবি
তোর দুলাভাই হয়।
– আমি তোদের বদদোয়া দিলাম তোদের বাচ্চা
হবে না। তোদের বাচ্চাকাচ্চা হলেও আমার ঝামেলা
লাগবে। তুই বলবি আমি ওদের মামা। রঞ্জু বলবে চাচা।
কপাল! কপাল! তোরে দুইটা কেন একটা
আরেকটাকে বিয়ে করলি। নাহ্ পেলাম ভাবি নাহ্
পেলাম দুলাভাই। ব্যাচমেটকে বিয়ে করে তোরা
দুজনই আমাদের মতন বন্ধুবান্ধবকে চিপায়
ফেলেছিস।
– আমার কোনো দোষ নেই। ঐ শালা রঞ্জুই
আমাকে ফুসলিয়ে বিয়ে করেছে।
সুরভীর কথা শুনে কলরব হাসতে হাসতে শোয়া
থেকে উঠে বসলো। তারপর বলল,
– কে কাকে ফুসলিয়েছে তা ইবনাত কলরব
ভালোভাবেই জানে।
– কিরে বেশ ফুরফুরে মেজাজের মনে হচ্ছে।
ফুলটুশী কি এমন করলো যে রাগ চলে গেছে?
– ঐ মেয়ে কিছুই করতে পারে না। যা করার আমিই
করিরে দোস্ত।
সুরভী মজা করে বলল,
– কি কি করিস তুই?
– রঞ্জু তোর সাথে যা যা করে সব করি।
– যাহ্ ফাজিল।
– ও আমি কিছু বললে ফাজিল আর উনি ভালো মানুষ।
– হয়েছে এবার বন্ধ করুন আর দয়া করে ছবি পাঠান
তো ফুলটুশীর।
– মোবাইলে তো ছবি নেই। একটা ওয়াশ করা ছবি
আছে।
– ঐটাই তুলে পাঠা। দেখতে হবে আমার কোন
মেয়ে তোর মন কেঁড়েছে? কিসের তৈরী
সে? কতো মেয়ে তোর পিছন পিছন ঘুরলো
পাত্তা দিলি না। এমনকি আমি যদি রঞ্জু হাদারামটাকে পছন্দ
না করতাম তাহলে আমিও তোর পিছন পিছন ঘুরতাম।
সুরভীর কথা শোনে কলরব গগনবিহারী হাসি হাসতে
লাগলো। সুরভী বিরক্ত হয়ে বলল,
– ছাগলের মতন একদম হাসবি না।
কলরব হাসি থামিয়ে বলল,
– শোন আমার ফুলটুশী দেখতে পুরাই ডেজার্ট
মাগাড় ডেঞ্জারাস। সেই রাগ মেয়ের। পান থেকে
চুন খসতেই চোখ দিয়ে আগুন ঝরায়। তবে মজার
কথা হলো আমাকে খুব ভয় পায়। একদম
বোকাসোকা কিছুই বুঝে না। অনেক বেশি
হেল্পফুল। সত্যি বলতে মেয়েটা খুব সাধারণ। তার
মাঝেও কেমন যেন একটা অসাধারণ। কুহুকে প্রথম
যখন দেখি আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতোই
লেগেছে। খুব বেশি সুন্দরী মনে হয়নি। প্রায়
প্রতিদিনই তো কথা হতো। তবে কুহুর যে জিনিসটা
প্রথম থেকে ভালো লাগে সেটা হলো হেল্প
করার মন মানসিকতা। কুহু পুরাই ভালোমানুষ টাইপ। যেমন
ধর গতকাল বিকেলে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। রাস্তায়
একটা কলার খোসা পড়ে ছিল। কুহুর বোন পিহু সেটা
টপকিয়ে চলে যায়। আর ইরিন কথা বলতে বলতে
সেটায় পা দিয়ে পড়ে যেতে নেয়। কুহু ধরে
ফেলে। ইরিন খোসাটাকে পা দিয়ে সরিয়ে চলে
আসে। কিন্তু কুহু খোসাটা হাত দিয়ে তুলে
ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসে। এটাই ওর মাঝের
সবচেয়ে বড় স্পেশালিটি। মানুষ হিসেবে সেরা
মানুষটাকেই আমি ভালোবেসেছি সুরভী। কুহু যখন
বেড়াতে যায় ওর ফুফির বাড়িতে তখন আমি পুরাই অস্হির
হয়ে পড়েছিলাম। কেমন যেন পাগল পাগল লাগতো
নিজেকে। তখন প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম
কুহুকে ভালোবাসি। এরপর থেকে ওকে খুব বেশি
খেয়াল করে দেখেছি। দেখি ওর সবটাই কেমন
যেন সৌন্দর্য্যে ঘেরা।
– বাব্বাহ্ আমাদের ইবনাত কলরব তো পুরা হাবুডাবু
খাচ্ছে, নাহ্ প্রেমে পুরা ডুবে গেছে।
– ঐ শেষ হয়নি এখনো বাকি আছে। আমার কুহু
অনেক সুন্দর করে কথা বলে। কথা বলার সময়
কেমন যেন অভিধানের কঠিন কঠিন শব্দগুলো
ব্যবহার করে। খুব বেশি শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলে।
আবৃতিতে সবার থেকে এগিয়ে। মোটকথা কুহুর
মাঝে প্রথম দেখায় বা এমনিতে কিছু পাবি না। কিন্তু
একবার যখন ওকে বুঝতে চেষ্টা করবি অসাধারণ
রকমের মুগ্ধ হবি। ধীরে ধীরে এই মেয়ে
সবাইকে নেশাগ্রস্ত বানিয়ে ফেলে। এমনিতে
তোর মনে হবে আমি শুধু শুধু কুহুর জন্য পাগল কিন্তু
তুই যখন কুহুর সাথে মিশবি নিজেও ওর ভক্ত হয়ে যাবি।
খুব খুব মিষ্টি একটা মেয়ে। বিশেষভাবে ওর রাগটা যা
মিষ্টি বলার বাইরে। ফুলটুশী যখন যখন রেগে যায়
আমি তখন তখন নতুন করে ওর প্রেমে পড়ি।
– মিস্টার ডার্ক হেন্ডসাম আপনি এতো বিশ্লেষণ
করেন? রঞ্জুর সাথে সংসার করি কিন্তু আদৌ তাকে যদি
কেউ জিজ্ঞাসা করে আমি কেমন সে বলতে
পারে না। শুধু বলে অনেক সুন্দর। কিন্তু তুই কি সুন্দর
করে বলিস। তোর কথা শোনেই আমি অলরেডি
মুগ্ধ হয়ে গেছি কুহুর প্রতি।
– সত্যি বলছি মিলিয়ে নিস। আমি আগে ভাবতাম আমিই
বোধহয় সাফারার এখন দেখি আমি একা না। কুহুকে
অনেকেই পছন্দ করে।
কথাটা বলেই কলরবের কূজনের জন্য প্রচন্ড মন
খারাপ হয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুরভীকে
বলল,
– সুরভী পরে কথা বলছি। মাত্র ঘুম থেকে উঠেছি।
– বাই রঞ্জুর শালা।
– তুই পারিস বটে।

কূজন ইরিনের দিকে কাগজ বাড়িয়ে দিতেই ইরিন বলল,
– কি এটা?
– দেখো সোনার হরিণ।
ইরিন কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলো ওর আঁকা
কূজনের পেইন্টিং। সে হেসে বলল,
– থেঙ্ক ইউ ভাইয়া।
– সোনার হরিণ মোস্ট ওয়েলকাম কিন্তু তুমি কি
আমাকে আর আগের মতন পছন্দ করো না?
– কেনো করবো না?
– কারণ তুমি বলেছিলে তুমি যাদের ভালোবাসো
ওদের পেইন্টিংগুলো তুমি ওদের দাও না। তাহলে
আমাকে দিয়ে দিলে কেনো?
ইরিন অপরাধীর মতন হেসে বলল,
– আসলে ভাইয়া তোমার উপর খুব রেগেছিলাম তাই।
– রাগ ভাঙার পরও ফিরিয়ে নিতে চাওনি।
– আসলে চাচ্ছিলাম কিন্তু কেমন যেন খারাপ
লাগছিলো। শুধু শুধু আঙ্কেলের জন্য আমি
তোমাকে ভুল বুঝলাম।
কূজন হেসে বলল,
– ইটস্ ওকে সোনার হরিণ।
ইরিন হেসে বলল,
– তোমাকে একটা জিনিস দেখাই?
– দেখি দেখাও।
ইরিন নিজের ড্রয়িং খাতাটা খুলে কূজনের সামনে
রেখে বলল,
– দেখো।
কূজন দেখলো ইরিন সেইম আরেকটা পেইন্টিং
বানিয়েছে। কূজন হেসে বলল,
– তুমি অনেক লক্ষী সোনার হরিণ।
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here