এক গুচ্ছো কদম পর্বঃ১৭

0
1355

#এক_গুচ্ছো_কদম
#পর্বঃ১৭
লিখাঃসামিয়া খান

পুকুরের পানিতে একের পর এক ডুব দিয়ে চলেছে মৃদুল।রাত এখন একটা বাজে।এতো রাতে পুকুর পাড়ে ডুব দিতে দেখে আশেপাশের বাড়ির মানুষগুলো উঁকিঝুঁকি করছে।পুকুর পাড়ে সিড়ির মধ্যে আরাম করে বসে আহনাফ সিগারেট খাচ্ছে।পাশে ওর কাঁধে মাথা দিয়ে সৃষ্টি ঘুমিয়ে গিয়েছে।আহনাফ কতো করে বলেছে এতো রাতে ওদের সাথে না আসতে। তাও জিদ করে এসে এখন বিড়ালের মতো ঘুমাচ্ছে।এদিকে মৃদুল ডুব দিয়েই যাচ্ছে।

“দেখ বুড়ি ৫০ টা ডুব দিয়ে ফেলেছি।এবার তো আমাকে উপরে উঠে আসতে দে।”

“চুপ মৃদের বাচ্চা।১০০ টা দেওয়ার আগে যদি উঠার নাম করেছিস তো আবার শুরু থেকে দিতে হবে।দেবদাস হইছো তাইনা?ঠাঁটিয়ে চড় মারা দরকার।”

মৃদুল আর কিছু বললো না চুপচাপ ডুব দিতে লাগলো। সে জানে এই মানুষটার সাথে তর্ক করাটা বৃথা।

মৃদুলের এই করুন অবস্থা দেখে হিমাদ্রি আর চুপ থাকতে পারলো না।আমতা আমতা করে বলতে লাগলো,
“অয়েত্রী আপু অনেক তো হলো এবার তো মৃদুলকে উঠে আসতে দেও।রাত বাড়োটা বাজে।এতো রাতে পানিতে থাকলে অসুস্থ হয়ে যাবে তো।”

হিমাদ্রির এই কথা শুনে কষে একটা ধমক দিলো অয়েত্রী।
“হিম তোর এই প্যানপ্যান অন্য জায়গায় গিয়ে কর।এতো আহ্লাদ করতে হবেনা।একমাস ধরে যে দেবদাস জীবন অতিবাহিত করছে মৃদ তখন আহ্লাদ কই ছিলো?”

কথাগুলো বেশ জোরেই বলেছে অয়েত্রী।অয়েত্রীর এই ধমক শুনে হিমাদ্রির কোলে থাকা মাদিহা কান্না করে দিলো।

মাদিহার কান্না শুনে বেশ বিরক্ত হলো অয়েত্রী।

“তোকে না কতো করে বললাম পুঁচকোকে নিয়ে আসিস না হিম।দে ওকে আমার কাছে দে। এতো রাত হয়েছে তাও ঘুম আসেনি।আমি ঘুম পারিয়ে দিচ্ছি।”

হিমাদ্রী মাদিহাকে অয়েত্রীর কোলে দিতে গেলে মাদিহা চিৎকার দিয়ে হিমাদ্রির গলা হাত দিয়ে পেঁচিয়ে ধরলো।

“থাক আপু আমার কাছে। যাবেনা এখন। কারণ হয়তো তোমাকে দেখে ভয় পেয়েছে।”

“ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক।ওর বাপই ভয় পায় আর ও পাবেনা।”

বেশ কিছুক্ষণ সবাই চুপ থাকলো।পরিবেশে এখন নিরবতা।শুধু মৃদুলের ডুব দেওয়ার শব্দ হচ্ছে।শেষ কয়েকটা ডুব দেওয়ার পর উপরে উঠে আসলো মৃদল।একদম ১০০ টা পূরণ করেছে সে।হাঁপাতে হাঁপাতে একদম হিমাদ্রির পাশে বসে পরলো।হিমাদ্রি মাদিহাকে নিজের এক হাতে রেখে অন্য হাতে শাড়ীর আঁচল দিয়ে মাথা, মুখ মুছে দিচ্ছে।সেদিকে মৃদু হাসি মুখে অয়েত্রী আর আহনাফ তাঁকিয়ে আছে।অয়েত্রী আর আহনাফ একবার নিজেদের মুখ চাওয়াচাওয়ি।

“কীরে মৃদুল তোর অনুভূতি কী?”

ক্লান্ত ভঙিতে মৃদুল জবাব দিলো,
“বুড়ির বাচ্চা।তুই আমাকে দিয়ে একশটা ডুব দেওয়ালি তারপর ছাড়লি তাইনা?”

“কী করবো বল।তুই তো দেবদাস হয়ে গিয়েছিস।শালা বউ গেছে এক মাস।ওরকম মেয়ে চলে গিয়েছে তাতে ভালোই হয়েছে।কই আল্লাহের কাছে শুকরিয়া আদায় করবে তা না।সারাদিন ঘরে পরে থাকে।দাড়ি মুছে একদম বনমানুষ হয়ে গিয়েছে।গোপালের ভূরি বের হয়েছে।ওই তুইতো আবার গাঁজা খাসনা?”

অয়েত্রীর কথায় অসহায় ভঙীতে মৃদল বললো,
“তুই একথা আমাকে বলতে পারলি বুড়ি?”

“বলবো না তো কী করবো।তোর আগে এই বনমানুষ থেকে মানুষ বানাতে হবে।আর এই গোপালের ভূড়িকে মন্ত্রীমশাইের চিকনা পেট করতে হবে।তাই নারে আহনাফ? ”

“একদম।আমি তোর সাথে আছি বুড়ি।”

“আমি তো জানি সেটা।আর এইযে হিমের বাচ্চা তুই যদি মৃদুলের প্রতি দরদ দেখাতে যাস তাহলে আমি কাঁচা ডিম দুধের সাথে মিশিয়ে খাওয়াবো।”

“কিন্তু আপু মৃদের কষ্ট হবে তো।”

“চুপ।পুরুষ মানুষের আবার কষ্ট। পুরুষ থেকে সুপুরুষ হতে হলে এরকম কষ্ট সহ্য করতে হয়।এখন চল বাড়ীতে চল।রাত প্রায় একটা বাজে।”

সকলে উঠে বাড়ীর দিকে রওনা দিলেও আহনাফ সৃষ্টিকে নিয়ে সেই ভঙিতেই বসে রইলো।অয়েত্রী কিছুদূর এগিয়ে আবার ফিরে এসে ভ্রূ কুঁচকিয়ে আহনাফের সামনে এসে দাড়ালো।

“কীরে বুড়ি।”

“তুই কী এখানেই থাকবি?”

“না রে কিন্তু ঘুমিয়েছে মেয়েটা। এখন কীভাবে ডাকি।”

“পাগল তুই। পোয়াতি মানুষ এতো রাতে আমি এখানে নিয়ে আসতাম না কিন্তু
মেয়েটা সখ করলো তাই নিয়ে আসলাম।আর রাখা যাবেনা চল এখান থেকে।”

“হুম চল।কী ব্যাপার তুই আবার আমার পাশে বসছিস কেনো? ”

আহনাফের পাশে বসতে বসতে অয়েত্রী জবাব দিলো,

“দাড়া একটু বসে যাই।তোর সাথে একটু কথা বলি।”

“কী কথা?”

“মৃদের এখন অনেকটা মেন্টালি সাপোর্ট প্রয়োজন।কারণ আমি ওকে দেখেই বুঝতে পেরেছি কতোটা আঘাত পাইছে।”

“জানিরে। তার জন্যই তো চাচাকে তাড়াতাড়ি বললাম তোকে নিয়ে আসতে।একমাত্র তুই এখন মৃদকে সামলাতে পারবি।”

“চিন্তা করিস না।যে পর্যন্ত মৃদ স্বাভাবিক নয় হয় সে পর্যন্ত আমি আছি এখানে।আমাদের মৃদটা না অনেক বড় বোকা। হিমের মতো এতো সুন্দর একটা মেয়ে থাকতে ও রোদসীর মতো জঘন্যের পিছনে গেলো।”

“এভরিথিং হ্যাপেন্ডস ফর এ রিজন।কেনো কীভাবে এতো কিছু হলো আমরা তা বলতে পারবো না।”

“সেটা ঠিক। এখন চল বাড়ীতে চল।”

“হুম।সৃষ্টি, সৃষ্টি উঠো বাড়ীতে যাবো।”

আহনাফের নরম স্বরে সৃষ্টি মিটমিট করে চোখ খুললো।কিন্তু ঘুম ভাঙেনি।ঘুম ঘুম কণ্ঠে বলে উঠলো সৃষ্টি,
“আমাকে কোলে নেন।”

সৃষ্টির এইকথা শুনে আহনাফ হতভাগ হয়ে গেলো আর অয়েত্রী হেঁসে ফেললো।

“দেখ আহনাফ।সৃষ্টি এখনো অনেক ছোট। এতো অল্প বয়সে অনেক কিছু সহ্য করেছে মেয়েটা।এখন চাইলে তুই ওকে আগলে রাখতে পারিস।”

“রাখবো রে বুড়ি।ওর এখনো পুরো জীবন পরে আছে।দুর্জয় মারা গিয়েছে ছয় মাস।তাই দুর্জয়ের আমানত হিসেবে ওকেও সামলে রাখবো আর বাবুদেরও।”

“তোকে আমি এ বিষয়ে এপ্রিশিয়েট করি।আর হ্যাঁ কোলে নিতে পারিস।আমি কিছু মনে করবো না।কিন্তু পারবি তো?নয় মাস খেয়াল করে নিয়ে যেতে হবে।”

“আমি জিম করি বুঝেছিস।”

“চল এখন।আমি লাইট ধরে দিচ্ছি।”
,
,
,
তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করে জায়নামাজটা ঠিক জায়গায় রেখে বিছানার দিকে এগিয়ে চললো মৃদের বাবা।বিছানায় উঠে মাথার টুপিটা শিয়রে রেখে দিলো।
“কী হলো গিন্নি এখনো ঘুমাওনি?”

একটা দীর্ঘস্বাস ফেলে হুমায়রা জবাব দিলো,,

“না গো ব্যবসায়ী ঘুম আসছে না।”

“ঘুমের ঔষধ খাওনি?তাড়াতাড়ি ঘুমাও শরীর ভালো না তোমার।”

“আমার ছেলেদের জীবনটা এমন ক্যান?বিজয় কখনো বাবা হতে পারবে না।মৃদের তালাক হয়ে গেলো।দুর্জয়রা মরে গেলো।এগুলো কেনো হলো বলতে পারবে ব্যবসায়ী?”

“জানিনা।সব তো আল্লাহের ইচ্ছায় হয়।এটাও তাই হয়েছে।”

“তুমি কেনো হিমের সাথে দুর্জয়ের বিয়ে ঠিক করলে?”

“সে কী গিন্নি তুমিই তো বলেছিলে হিমকে তুমি ছেলের বউ বানাতে চাও।”

“বলেছিলাম তা মদুলের জন্য, দুর্জয়ের জন্য না”।

” তাহলে হয়তো আমার ভুল হয়েছে। এখন ঘুমাও।সবকিছু উপরওয়ালার উপর রাখো।দেখবে সে নিরাশ করবেনা।”
,
,
,
বাথরুমের আয়নায় নিজেকে গভীর মনোযোগ দিয়ে অবলোকন করে যাচ্ছে মৃদুল।নিজের মুটিয়ে যাওয়া শরীর দেখে নিজেরেই যেনো কীরকম ঘেন্না লাগছে।তাড়াতাড়ি করে একটা টিশার্ট গায়ে জরিয়ে বেড়িয়ে পরলো মৃদুল।এবং মনে মনে একটা কঠিন সিদ্বান্ত নিলো।

বাইরে এসে মৃদুল দেখতে পেলো হিমাদ্রি মাদিহাকে ঘুম পাড়াচ্ছে।এবং পাশে কফি রাখা।হয়তো শীত লাগবে তাই।রোদসী চলে গিয়েছে একমাসের বেশী।সেদিন থেকে মৃদুল আর মাদিহার সবকিছু হিমাদ্রিই করে।মৃদুলের বুকটা হঠাৎ ভরে উঠলো মাদিহাকে ঘুম পাড়ানোর দৃশ্য দেখে।

মাদিহাকে ঘুম পাড়িয়ে উঠতে যাবে তখন হিমাদ্রি দেখতে পেলো মৃদুল দাড়িয়ে আছে মুখে এক চিলতে হাঁসি নিয়ে।মৃদুলকে এভাবে হাঁসতে দেখে ভ্রু কুঁচকে হিমাদ্রি জিজ্ঞেস করলো,

“এমনভাবে হাঁসছো কেনো মৃদ?”

“এমনি তেমন কিছুনা।”

“ওহ আচ্ছা।এইযে নেও তোমার কফি।আর এতো রাতে সেভ কেনো করতে গেলো?”

কফি হাতে নিয়ে তাতে একটা চুমুক দিয়ে মৃদুল বললো,
“এখন সেভ না করলে কালকে সকালে অয়েত্রী আমাকে কোঁদাল দিয়ে সেভ করিয়ে দিতো।”

“তা বলতে।”

“হুম।”

কফিটা শেষ করে মৃদুল গিয়ে মাদিহার পাশে শুয়ে পরলো।মাথাটা হাল্কা উঠিয়ে মাদিহার গালে একটা চুমো দিয়ে ওকে নিজের কাছে টেনো নিলো মৃদুল।

“আমি চলে যাই মৃদল?”

“হুম যা।কিন্তু তার আগে আমার মাথায় একটু হাঁত বুলিয়ে দে তো।এখন তো আর কেও তোকে বাজে কথা বলবে না আমাকে নিয়ে সে মানুষটাই নাই।”

হিমাদ্রি কোন দ্বীরুক্তি না করে মৃদুলের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করলো।

“মৃদ আমি জানি এতোকিছু ভুলে যাওয়া কোনদিনও সম্ভব না।কিন্তু চেষ্টা তো করতে পারো তুমি।”

“আমি করবো চেষ্টা হিম।আমি আর ওর জন্য কাঁদবো না কষ্ট পাবো না।”

“দোয়া রইলো।তুমি যেনো নিজের ভালো বুঝতে পারো।”

“হুম।”

হিমাদ্রির হাত বুলিয়ে দেওয়াতে বেশ আরামবোধ হলো মৃদুলের।আরামে চোখ বুঁজে আসছে তার।জীবনের প্রথমবার কেনো যেনো মৃদুলের ভিতরে এক আলাদা অনুভূতি হলো হিমের জন্য।

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here