এক_বিন্দু_আশা পর্ব ৩ [শেষ পর্ব]

এক_বিন্দু_আশা পর্ব ৩ [শেষ পর্ব]
#লেখক:আর আহমেদ

তিন বছর পর নিজের প্রাক্তন স্বামি শাহাদতকে ড্রেন পরিষ্কার করতে দেখে ভূ মন্ডল কেঁপে উঠলো রুবার। তবে প্রাক্তন বললে ভুল হবে, তাদের তো ডিভোর্সই হয়নি। হাতের দামি ব্যাগটা গড়িয়ে পড়ে যায় তৎক্ষনাৎ। রুবা দাড়াতে পারেনা। প্লাস্টিকের পা নিয়ে হেঁটে চলে ক্রোমশ। আশপাশে দূর্গন্ধ সৃষ্টি হয়েছে। শাহাদাতের শর্টের এক হাত পুরো নোংরা পানিতে ভিজে উঠেছে। নাক ছিটকে আসে রুবার। শাহাদাত নোংরা তুলছিলো। রুবা ডাক দেয়,

-শাহাদাত ভাইয়া?

কথাটা কানের উপশিরা কাঁপাতেই মাথা তুলে তাকায় শাহাদত। মুখ কালো হয়ে গেছে। আগের থেকে হয়ে গেছে অনেক রোগা! কিন্তু শাহাদত রুবাকে দেখে বিষম খেলো। রুবার পুরো শরীরে আধুনিকতার ছোঁয়া। হাতে ব্যান্ডের একটা জ্বলজ্বলে ঘরি, পরনে কাজ করা স্লিকি থ্রি পিছ। আগের থেকে সুন্দর হয়েছে হাজারোগুন। শাহাদতের চিনতে খানিক অসুবিধেয়ই হয়। যখন চিনতে পারে তড়িৎ গতিতে উঠে দাড়ায়। চোখগুলো ছানাবড়া করে তাকিয়ে শাহাদাত। রুবা নির্লিপ্ত কণ্ঠে ভাবনার ছেদ ঘটে শাহাদাতের,

-কেমন আছেন?

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে শাহাদাত। কন্ঠে কষ্ট শাহাদাতের,

-খোঁচা দিচ্ছো?

-তবে এতটুকু কথাতেও খোচা লাগে বলুন,

-তুমি কেমন আছো?

-আলহামদুলিল্লাহ, আপনারা যদি সেদিন আমায় বাড়ি থেকে বের না করে দিতেন তাহলে আমি এতটা ভালো বোধহয় থাকতে পারতাম না। খুব ভালো আছি।

-বিয়ে করেছো?

ঠোঁট একাএকাই প্রাসারিত হয়ে ওঠে রুবার। বলে,

-করেছি, ইয়ে মানে করবো। সামনের সপ্তাহেই আমার বিয়ে। বাই দা ওয়ে, তন্মি আপু কই?

চোখ নামিয়ে নেয় শাহাদত। নামটি শুনতেই বুকে জ্বলে ওঠে দাউদাউ করা আগুন। যন্ত্রনায় কেমন আতড়াতে থাকে।রুবা ফের জিজ্ঞেস করে,

-বলছেন না যে?

-সে নেই।

কন্ঠ ঠান্ডা,শিতল শাহাদতের। কিন্তু বুক তছনছ হয়ে যাচ্ছে তার। রুবা বলে,

-নেই মানে?

-তুমি চলে আসার এক মাস যেতেই আব্বু আসুস্হ হয়ে যায়। দিনরাত শুধু এটুকুনিই বলতো আমার রুবা ভালো নেই, কেউ ভালো থাকবে না। কেউ না। এভাবে দিনদিন অসুস্থতা বাড়তে লাগলো। সয্যাসায়ী হয়ে উঠলো আব্বু। সাথেসাথে বেড়ে গেলো তন্মির সাহস। সে রাত করে ফেরা, পার্টি করা সব করতে লাগলো। পরপর দুদীন বাইরে কাটিয়ে আসতো। না চাইতেও সহ্য করতাম। এটাই আমার ভুল ছিলো। একদিন ও বাড়িতেই পার্টি এরেন্জ করলো। হাজারো বারনের পরেও। সেদিন বাড়িতে আনা হলো এলকোহল, নামীদামি মদ! জোড়ে চালানো হলো ডিস্কো। অসুস্থ বাবা আতড়াতে আতড়াতে থাকলো। বারবার বলতে লাগলো,
-বন্ধ করো এসব। আমার সইছে না। বন্ধ করো!
আব্বুর অসুস্থতার খুব বড় সুযোগ নিলো তন্মি। সেদিন আব্বুকে জুস দেওয়ার নাম করে সাথে মেশালো এলকোহল। তন্মি সুযোগ বুঝে প্রপার্টি পেপারে সাইন করিয়ে নিলো, আমাদের চক্ষুড়ালে। পরদিন সকালে কোথথেকে একটা ছেলে আসলো। তন্মি তখন সোফায় বসে সাথে আব্বুও ছিলো। ছেলেটিকে দেখেই সে সটাং জড়িয়ে ধরলো। রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে তন্মিকে জোড়ে একটা চড় বসিয়ে দিলাম। তার বিপরীতে ফের দুটো গালে পড়লো। ওই ছেলেটি নাকি তন্মির স্বামী। শুনেই আব্বু বুকে হাত গুজলেন। অবস্থা খুব খরাপ হতে নিলেই হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো আব্বুকে। সাথেসাথে আমাদের সরঞ্জাম সমূহও। লয়ার এনে আমাদের বাড়ি ছাড়া করলো তন্মি। আব্বু এখনো হসপিটালে। বলেছে হাজার পঞ্চাশ টাকা দিলে তবেই…
আমাদের কাছে টাকা নেই। কি করবো কি না করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। যখন তোমাদের কথা মনে পড়ে তখন ছুটে গেলাম সেখানে, কিন্তু ভাগ্য তবুও আমার সাথে নেই, ছিলোনা। আমাদের থেকেও করুন অবস্থা তোমার বাপ মায়ের। শুনলাম, সবুজ কোথাথেকে বিয়ে করে এসেছে। বউটি ভালো না। কয়েকদিনের মাথাতেই তাদের বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছে সবুজ! ছেলের কাছে চরম আঘাত পেয়ে তিনি নিশ্চুপ হয়ে গেছে!

আর বলতে পারলো না শাহাদত। ছোট বাচ্চাদের মতো কাঁদতে লাগলো হেঁচকি তুলে। রুবা থমকে দাড়িয়ে। কথাগুলো তার হৃদয় ছন্নবিচ্ছিন্ন করছিলো। রুবা সামলায় নিজেকে। কন্ঠতে শীতিলতা এনে বলে,

-কোথায় চাচ্চু? আর বৃদ্ধাশ্রম?

-হসপিটাল তুহিনে। মেঘমালা বৃদ্ধাশ্রম।

-আমি একবার যেতে চাই।

-কোথায়?

-হাসপাতালে। নিয়ে যাবেন?

-এখন আমি..

বলেই মাথা নিচু করে নেয় শাহাদত। রুবা ঠিক আছে বলে রিকশা ধরে। চলে যায় তুহিন হাসপাতাল!

শাহাদাত বিমুঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। প্লাস্টিকের পা লাগিয়েছে। আগের সেই গাইয়া রুবা এখন একজন বিস্রস্ত মডেলার হওয়ার যোগ্যতা রাখে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাজে মন দেয় শাহাদত।

রিকশা থেকে নেমে রুবা বাস ধরে। বাসে তেমন ভির নেই। ভির জমেছে রুবার হৃদয়ে। ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। আজ এতদিন পর এইরুপে সমস্তটা সামনে আসবে রুবার কল্পনাতিত। সে স্তব্ধ,নীরব,শব্দহীন পুরো বাস কেঁদে চলে। মোড়ে এসে থামে বাস। রুবা নেমে পড়ে। কয়েকপা এগোলেই সামনে তুহিন হাসপাতাল। রুবা চট করে ডুকে পড়ে। কিন্তু রুম নাম্বর তো জানাই হয়নি। বর্ননা দিয়ে রিসিপশন থেকে শুনে রুবা চলে যায়। তৃতীয় তলার চৌষট্টি নাম্বর রুমে যেতেই ডুকরে কেঁদে ওঠে রুবা।

-চাচী!

কারো ডাক পেতেই পেছনে তাকান ইলিমা রহমান। রুবাকে দেখেই তিনি উঠে দাড়ান। সম্পূর্ণ আচেনা একটি মেয়ে দাড়িয়ে সামনে। রুবা দৌড়ে এসে ইলিমার বুকে মাথা গুজে। এতক্ষণে অল্পেকটু প্রশান্তি পেলো রুবা। ইলিমা মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করেন,

-কেমন আছিস?

-খুব খারাপ। তোমরা আমায় একবারও জানাও নি কেন?

-তোকেতো হাজারো খুজেও পাওয়া গেলো না রে।

-আমি চলে এসেছি! আর যাব না বিশ্বাস করো।

-বউ হয়ে থাকবি?

রুবা সটাং সরে যায়। আগামি সপ্তাহে তার বিয়ে। সে নাকোচ মাথা দুলায়। খুব কাছ থেকে ঘুমন্ত ইরফানকে দেখেই ছুট দেয় রিসিপশনের দিকে। সমস্ত খরচা মিটিয়ে চিকিৎসা চালু করতে বলে রুবা। ডক্টর চিকিৎসা শুরু করে। অপলক ভাবে তাকিয়ে ইলিমা। মেয়েটা কি হতে কি হয়েছে! এত টাকাই বা পেলো কই? তিন বছরে কি হয়েছে মেয়েটার সাথে?

—–

সেদিন রুবা বাড়ি থেকে বের হয়ে হাটতে থাকে নির্জন রাস্তা দিয়ে। চোখ বাধ ভেঙে পানি ঝাড়াচ্ছিলো তখন। একজন বৃদ্ধা মহিলা সাথে সাক্ষাৎ রুবার। রুবাকে দেখে তার নিজের মেয়ের কথা মনে পড়ে যায়।তার দুজন ছেলে মেয়েই বিদেশে।তিনি রুবাকে জিজ্ঞেস করলেন,

-কে তুমি মা?

উত্তরে সবটা বললো রুবা। মহিলার মায়া হলো। তিনি আশ্বাস দিয়ে যেতে বললেন তার সাথে। বাড়ি গিয়ে মহিলা জানালো তার ছেলেমেয়ের কথা। রাস্তায় জ্যাম ছিলো বলেই এত রাত হলো বাড়ি ফিরতে। সেদিন থেকে ওখানেই থাকতে লাগলো রুবা। মহিলা কলেজে ভর্তি করিয়ে দিলেন। রুবা টিউশনি করাতে লাগলো। ব্যাস্ত রুবার একবিন্দু বসার আর টাইম নেই। এইচ এস সি দেয়ার পর মোটামুটি একটা চাকরি পায় রুবা। মহিলার ছেলে বিদেশ থেকে এসেই রুবাকে দেখে তার ভালো লাগে। সে যেনো চোখে হারায় রুবাকে। মহিলা সমস্তটা টের পেয়ে রুবাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন।রুবা রাজি হয়। আদিত্য আর রুবার সামনের সপ্তাহেই বিয়ে। কিন্তু গত মাসে মহিলা হার্ট এট্যাকে মারা যায়। আদিত্যর বোন এখনো বিদেশে। বিয়ের সময় আসবে বলেছে।
______
-আমি এখন আসি? সবতো মিটমাট। আবারো আসবো তোমাদের নিতে। কেমন?

ইলিমা কিছু না বুঝেই মাথা দোলায়। রুবা বেড়িয়ে আসে হাসপাতাল থেকে। ট্যাক্সিতে করে রওনা হয় মেঘমালায়।

বিরাট সাইনবোর্ডে লেখা মেঘমালা বৃদ্ধাশ্রম। ভিতরে গিয়েই অফিসরুমে পারি দেয় রুবা। নিজের পরিচয় দিয়ে সমস্তটা বলে। একজন নিয়ে যায় তাকে। কিন্তু সামনে আসতেই রুবা ভুমিকম্প অনুভব করে। ছেড়া শাড়ি পড়ে নিজের মাকে দেখে চিৎকার দিকে ডেকে ওঠে,

-মাআআআ!

রুবার মাও চকিত দৃষ্টিতে তাকান। কান্নায় ফেটে পড়েন আশিকুর রহমান। মেয়ের দিকে তাকানোর ক্ষমতা নেই তার। রুবা মায়ের পায়ের কাছে বসে। মেঝেতে দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আশিকুর।

-কেমন আছো আব্বু? আম্মু তুমি?

আশিকুর হু হু করে কেদে ওঠেন।চোখ বেয়ে নামে নোনা জল। তিনি আটকানো গলায় বললেন,

-আমায় পারলে ক্ষমা করে দিস মা। ক্ষমা করে দিস!

-এভাবে বলোনা বাবা। পারলে তোমরা আমায় ক্ষমা করে দিও, এতদিনে তোমাদের খোজ নেইনি!

আশিকুর মেয়ের দিকে অবাক চোখে তাকান। কোথাও তার গর্ব হচ্ছে।

কেটে গেছে এক সপ্তাহ্…

দোতলা পুরো আলোয় ছকমক করছে। সমস্ত রকমের আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে পুরে বাড়ি। শাহাদত সকালে বেড়িয়ে গেছে আসেনি এখোনো। আজ রুবার বিয়ে। ধুমধাম করে করা হচ্ছে সমস্ত কাজ। আদিত্য নিজে হাতে সব করছে। রুবা সেদিনই তার চাচা চাচী আর মা বাবাকে এখানে নিয়ে আসে। তারা বিয়ের কাজে কোনরকম ত্রুটি রাখছেন না। শাহাদত এখানে আসার পর থেকে রুবার সাথে অনেকবার কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু বলতে পারেনি। এরিয়েছে রুবা নিজেই। আদিত্যোর বোন পরশু এসেছে। কাল শাহাদতের সাথে ডিভোর্স হয়ে গেছে রুবার।আর সকাল থেকেই সে হাওয়া!

কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজি উপস্থিত। রুবাকে অপ্সরার মতো সাজানো হয়েছে। লাল টকটকে লেহেঙ্গা আর লাল ওড়নায় অসম্ভব সুন্দর লাগছে। কাজি দোয়া পড়ছেন আর আদিত্য হ্যাবলার মতন তাকিয়ে হবু বউয়ের দিকে। চোখই সরাচ্ছে না। কবুল বলতে বললেই,
কবুল
কবুল
কবুল!
শুরু তাদের সংসার।
____

শাহাদত একলা ব্রীজে বসে। মনটা কেমন লাগছে। পাষবিক খারাপ লাগা কাজ করছে তার। এক ধ্যানে তাকিয়ে টলটলে পানির দিকে।

-এইযে মিস্টার, এখানে কি করেন?

কথাটি কারনকুহরে আসতেই ফিরে দেখে শাহাদত। আদিত্যের বোন দাড়িয়ে হাসিমুখে। হাতে ছিলো লাল রক্তজবা!

________________-সমাপ্ত-_________________

আমার লেখা সব গল্পের মধ্যে এটিই ছিলো বড় করে লেখা এন্ডিং। কেমন লাগলো বলতে ভুলবেন না। হ্যাপি রিডিং🥰

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here