এক_বিন্দু_আশা পর্ব ১

-তুমি এখানে কি করছো? এখন থেকে এটা আমার আর তন্মির ঘর। বেরোও এখান থেকে রুবা।

কথাটি কর্নকুহরে আসতেই পেছনে ফেরে রুবা।কন্ঠস্বর অনুযায়ী তাকাতেই সে স্তম্ভিত! নিজের স্বামীর পাশে বধু বেশে দাড়িয়ে এক সুন্দরী নারী। বিয়ের একমাসের হতেই দ্বিতীয় বিয়ে করে ঘরে আনলো শাহাদাত হোসেন বদরুদ্দোজা। রুবা অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে। আজ চোখেমুখে লেপ্টে আছে হাসি শাহাদাতের। আর চকচকে দাত দেখিয়ে পাশে হাসছে রুবার সতিন,তন্মি! বুক চিনচিন করে ওঠে রুবার। পুকুরের মতন পানি টইটই করছে চোখে রুবার। শাহাদাত রুবার সামনেই হাত ধরে তন্মির। রুবা শুকনো ঠোক গিলে আসার পথ করে দেয়। আজ একমাস পর শাহাদাত হাসছে, মনের মত বউ পেয়ে তার চোখে মুখে লেগে আছে মিষ্টি হাসি। রুবা জানতো এমনি কিছু হবে। হবে নাই বা কেন, একজন পঙ্গু মেয়েকে নিয়ে তো আর সংসার করা যায় না! চোখ বুজে দরজার দিকে তাকায় রুবা। অশ্রু ঝড়ছে চোখ দিয়ে। নিজেকে সামলানোর ব্যার্থ চেষ্টা করে। সে কেন কাঁদছে? একমাসে তো শাহাদাত তাকে ছোয়নি! স্পর্শও করেনি। তাহলে কেন কাঁদছে রুবা। চোখ মুছে নেয় রুবা।

তন্মিকে খাটে বসিয়ে শাহাদাত রুবাকে দেখে রেগে যায়। মেয়েটা এখনো দাড়িয়ে কি করছে? ছ্যাচড়া মেয়ে একটা! দীরঘ একটা মাস যে কিভাবে শাহাদাত কাটিয়েছে তা শুধু সেই জানে! কিছুটা কঠিন স্বরে বলে ওঠে শাহাদাত,

-ওখানে দাড়িয়ে আছো যে? ঘর থেকে বিদেয় হও। আজ এটলিস্ট তোমার সাথে কথা বলে আমি আমার মুডটা নষ্ট করতে চাইনা। তাই এক কথায়,বেরোও ঘর থেকে ফাস্ট!

এক পা থরথর করে কেঁপে ওঠে রুবার। ছোটবেলায় এক ট্রাকের সাথে এক্সিডেন্ট হওয়ায় এক পা বিশ্রি ভাবে ক্ষত হয় রুবার। যার কারনে সে এখন ঠিকঠাক হাটতেও পারেনা। এটাই তার অক্ষমতা। শাহাদাত হোসেন বদরুদ্দোজার পাশে তাকে মানায় না। মানায় তন্মির মতনই কোন সুন্দরীকে।
কথাগুলো কাটার মতো ফোটে রুবার গায়ে। নিজেকে সামনে পেছনে ফেরে রুবা। শাহাদাতকে জিজ্ঞেস করে,

-কোথায় থাকবো আমি?

শাহাদাত চেয়াল খিচে তাকায় রুবার দিকে। কড়া স্বরে বলে,

-জাহান্নামে যাও। বাট এখন ঘর থেকে বেরোও প্লিজ!

গলায় দলা পাকিয়ে আসে রুবার। সে কোথায় থাকবে? সে কল্পনাও করতে পারেনি শাহাদত এত দ্রুত বিয়ে করবে। রুবা আটকালো গলায় কিছু বলতে চায়। হাত দেখিয়ে থামিয়ে দেয় শাহাদাত। বলে,

-এখন এক্সকিউজ দিও না প্লিজ! কোথায় যাবে আমি কি জানি? বাট এখন যাও এখান থেকে,প্লিজ!

মেঝেতে থাকা ব্যাগের দিকে খোড়াতে খোড়াতে হেটে চলে রুবা। ব্যাগ একহাতে নিয়ে একবার পুরো রুমে চোখ বোলায়। এ ঘর তাকে কেন মায়ায় জড়ালো? কেন বুক ফেটে কান্না আসছে রুবার? হাতের ব্যাগটা নিয়েও কত ঝগড়া! শাহাদাত তাকে কিছুতেই তার আলমারি ব্যাবহার করতে দিবে না। তাই রুবা ব্যাগে রাখতো তার সব। সে আর দাড়াতে পারেনা। বুক ফেটে কান্না আসছে রুবার। চোখে জ্বলজ্বল করছে নোনা জল। আর দাড়াতে পারে না রুবা। দ্রুত খোড়াতে খোড়াতে বেড়িয়ে যায়। ঘরের বাইরে পা রাখতেই দরজা ধপাস করে লাগানোর শব্দ কানে আসে। ফুপিয়ে ওঠে রুবা। দরজার পাশে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাড়ায়। হাত আলগা হয়ে মেঝেতে পড়ে যায় হাতের ব্যাগ। মুখ ভিজে ওঠে রুবার।

,,ফ্লাসব্যাক,,

-পরশু তোমার বিয়ে রুবা।

বসার ঘরে বাবার মুখে এমন কথা শুনে চমকে উঠলাম। বুকের কোথাও যেন ঝিলিক দিয়ে উঠলো। কালকেই পাত্রপক্ষ রিজেক্ট করেছে আমায়। এটা নিয়ে প্রায় আঠাশবার! রিজেক্ট করার কারন, আমার পায়ের সমস্যা। একজন চাকুরিজীবী ছেলের তো আর ল্যংরা বউ পাশে মানায় না।
উনারা কি আমায় বিয়েতে রাজি হয়েছে? আমার অজ্ঞতা জেনেও? কিন্তু আমায় দেখার পর থেকেই তো এক কথায় না করে চলে গেলো। ভ্রুযুগল কুঁচকে এলো আমার। অকপট জিজ্ঞেস করলাম,

-তারমানে? বিয়ে ঠিক হয়েছে কবে? কার সাথে? আর পরশু মানে?

হঠাৎ মা বসা থেকে উঠে চলে গেলেন ওখান থেকে। একপলক তাকিয়ে আবারো আব্বুর দিকে দৃষ্টি ছুড়লাম। আব্বুর মুখটা কেমন খুশিখুশি। তবে একটু আগে সে কেমন বিষন্ন ছিলো। বিয়ের কোন কথাই ওঠেনি! চাচ্চু আসার পর থেকে আব্বু হাসিখুশি। আব্বু কোন উত্তর দিলো না। আমি সোফা থেকে উঠে আস্তে আস্তে আব্বুর পাশে দাড়ালাম। বললাম,

-চুপ করে আছো কেন? কার সাথে বিয়ে? কে রাজি হলো?

-অত জেনে তুই কি করবি? কে বলেছিলো অন্যের জন্য পা এগিয়ে দিতে? আজ যে তোর বিয়েটা হবে, এটাতেই শুকরিয়া কর। আর ডিসিশন ফাইনাল, বিয়ে তোর পরশুই হবে।

চিৎকার দিকে কথাগুলো বলে চলে গেলেন আব্বু। এমন কেন করেন? চোখ ভিজে উঠলো। আব্বু প্রায়ই এসব বলেন। সারাক্ষণ নিজের বড় ছেলেকে নিয়ে থাকেন। ক্লাস টেনের পর আমার আর পড়াশোনাটা করা হয়নি, হয়নি বলতে করাননি আব্বু! রেজাল্ট আমার সবসময় ভালো এসেছে। ক্লাস এইটে আমি ক্লাসের টপ ছিলাম। আর ভাই ফেলটু! প্রত্যেক ক্লাসে ভাই ফেল করতো। টাকার জোড়ে প্রতি ক্লাস পার হতো ভাই। তবুও ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে পড়াশোনা করিয়েছেন নির্দিধায় বাবা। যত টাকা ভাই চেয়েছে পাঠিয়েছে! এক পা কাঁপতে থাকলো। পা বিদ্ধস্থ হওয়ার পর থেকে ডান পা কেমন কাঁপে আমার। কাছের মানুষ খোটা দিলে তা যেন দ্বিগুণ হয়!

খোঁড়াতে খোড়াতে ঘরে গেলাম। বিছানায় বসবার আগেই কলিজা ছিড়ে আসতে লাগলো। সে রাতে ঘর থেকে বেরোলাম না। মাও ডাকেনি একটিবারও। সকালে আব্বু কড়া গলায় দরজার ওপাড় থেকে বললেন,

-সং সেজে আছিস থাক! কিন্তু খবারটা খেয়ে নিবি। বিয়ের আগে যেন অসুস্থ কথাটা না শুনি!

ফুপিয়ে উঠে কাঁদলাম অনেক্ষন। আমার খাওয়া দরকার যাতে বিয়েটা ঠিকঠাক হয়। আমার কেমন লাগছে এটা জানবার প্রয়োজন মনে করলে না বাবা? এতটাই নিঃস্ব!

মা দুপুরের খানিক আগে নাস্তা দিয়ে গেলেন। সবটা খেলাম। মাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। ভাইয়ের গলা ঘর থেকে আসতে লাগলো। হয়তো বাড়ি সাজানো হচ্ছে। দুপুর পেড়িয়ে রাত আর রাত পেড়িয়ে সকাল। ঘরেই থাকলাম পুরোটা সময়। দুপুর প্রায় তিনটের দিকে বাবা ঘরে আসলেন। হাতে কিছু গয়নার প্যাক আর একটা নীল রঙা বেনারসি দিয়ে বললেন,

-শোন রুবা,যেসব দিয়ে গেলাম সেজে নিবি। তোর মা ব্যাস্ত। শিলা মেয়েটাকে বলে এসেছি। সে তোকে সাজাবে। কাউকে জানানো হয়নি এ বিয়েতে। তবুও খরচের খাতায় পঞ্চাশ হাজার টাকা অলরেডি উঠে গেছে। রেডি হয়ে তৈরি থাকিস।

বুক ছন্ন বিছিন্ন হয়ে যাচ্ছিলো আমার। চুপ রইলাম। আমিই যখন এ বাড়ির বোঝা তখন বিয়েতে অমতের আর কোন প্রশ্নই আসেনা।

পুরো মুখ ঘোমটায় ডেকে সাজ সম্পূর্ণ করালো শিলাপু। কিছুক্ষন পর আমার ঘরেই কাজিসহ কয়েকজন প্রবেশ করলো। ঘোমটার আড়ালে ঠাওর করলাম মাত্র! মিনিট দশেকের মধ্যেই বিয়ে সম্পূর্ণ!

কিন্তু তারপর আমায় হতে হলো আরও এক আশ্চর্য ঘটনার সম্মুখীন। বাসররাতে স্বামী হিসেবে শাহাদত ভাইয়াকে দেখে শিউরে উঠলাম! বুক হাপড়ের মতো ওঠানামা করতে লাগলো। চোখে জমলো একবিন্দু শিশির। উনি বাঁকা চোখে তাকিয়ে আমার দিকে। তিনিও সবার মতো আমায় অপছন্দ করেন আনেক আগেথেকে। আমাদের বাড়িতে গেলে আমায় সামনে দেখলেই উনি উঠে অন্যকোথাও চলে যান। সেখানে তাকে দেখে থমকে গেলাম। উনি আমায় বিয়ে কেন করলেন? এই প্রশ্নটা খুড়ে খেতে লাগলো। হতাসের সুরে বললো শাহাদাত ভাইয়া,

-শোন রুবা, আমি এ বিয়েতে রাজি নই। শুধু মায়ের কারনেই করেছি এ বিয়ে। সেসব বাদ দে,এখন বিছানা থেকে নামতো, বেশ নাটক হয়েছে। এখন আমি একটু ঘুমোবো।

পাথরের ন্যায় বসে রইলাম। উনি এক হাত ধরে ছিটকে নামিয়ে দিলেন। টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলাম মেঝেতে। পায়ের রগ টনটন করতে লাগলো।

,,বর্তমান,,

মেঝেতে ঠেস দিয়ে বসে পড়লাম দরজার পাশেই। মুখ ভিজে উঠেছে কান্নায়। গলা শুকিয়ে আসছে ক্রোমোশ। সেদিন থেকে এই এক মাস কেটেছে বাঁধভাঙা যন্ত্রনায়! এটাই হয়তো ভাগ্যে ছিলো আমার। চোখদুটো বুজে আসতেই দরজা খোলার আওয়াজ কানে আসে। কেউ আমায় টেনে তুললো। সামনে তাকাতেই ঠাস ঠাস করে চড় পড়লো আমার গালে!

-এখানে বসে শব্দ করে কাঁদা হচ্ছে? তোকেনা বেড়িয়ে যেতে বললাম। সিনক্রিয়েট করতে চাইছিস না?

#চলবে…..
এক_বিন্দু_আশা পর্ব ১
#লেখকঃ আর আহমেদ

শুরুটা কমন হলেও গল্পের প্লট ভিন্ন ধাঁচের হবে। কেমন লাগলো প্রথম পর্ব? সবাই বললে পরের পর্ব শিগগিরী আসবে। হ্যাপি রিডিং।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here