#এমনও_প্রেম_হয়
#ইয়ানা_রহমান
#পর্ব:-৩২
লিলি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনলো। জিয়ান ওকে বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু মনে করে না শুনে কেঁদে ফেললো।
ঘরের ভিতর আর ঢুকলো না। নিশ্চুপ এসেছিলো নিশ্চুপ করেই চলে গেলো।
কাউকে বুঝতে দিলো না যে ও সব শুনেছে।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনে জিয়ানরা সবাই ঘুরতে গেলো। পিকনিক করলো। স্মিথ গিটার বাজিয়ে গান শোনালো। সবাই মিউজিক গেম খেললো।
ওরা সবাই ছোট একটা পাহাড়ে উঠে অনেক সেলফি তুললো। পাহাড় থেকে নেমে আসার সময় লিলি পা ফসকে পড়ে গিয়ে ডান হাতে খুব ব্যাথা পেলো। হসপিটালে নিলে এক্সরে করে জানা গেলো হাত ভেঙ্গে গেছে।
হাতে প্লাস্টার করে সোল্ডার ব্যাগ ঝুলিয়ে, মেডিসিন নিয়ে বাসায় নিয়ে এলো।
.
খুব নিষ্ঠার সাথে জিয়ান ওর সেবা করতে থাকলো। জিয়ান মানুষটাই এমন, সবার বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেখানে লিলিয়ানতো ওর বেস্ট ফ্রেন্ড।
ওর সব বন্ধুরা লিলিকে হাসি খুশি রাখার চেষ্টা করেছে। স্টিভ রান্না করে মুখে তুলে খাইয়েছে। স্টিভ রাতে লিলির বাসায় থেকেছে, কখন কি লাগে এই ভেবে। লিলির আর স্টিভের মাঝে বেশ ভাব হয়েছে।
.
.
.
এদিকে লিয়ারা চেন্নাই থেকে দেশে ফিরে এলো।
সবার মাথায় ঘুরছে শুধু একই কথা, লিভার যেটুকু ভালো আছে তা দুই মাসের মধ্যে নষ্ট হয়ে যাবে।
কে হবে ডোনার?
বাবা ডাইবেটিক পেশেন্ট। তার লিভার চলবে না। আর মায়ের হাই ব্লাড প্রেসার। এটাও চলবে না।
বোন একজন, তার বিয়ে হয় গেছে, সে এখন আমেরিকা থাকে। নতুন বিয়ে হয়েছে, ওর শশুর বাড়িতে এই কথা কিছুতেই মেনে নিবে না। এটাও বাদ।
এক ভাই উচ্ছাস, ওর সাথে রক্তের গ্রুপের মিল নেই।
বাকি রইলো আয়ুশ। ওতো শিশু বাচ্চা, এতো বড় মেজর অপারেশনে ওকে জড়ানো যাবে না। আঠারো বছরের একজন না হলে হবে না।
ডোনার কোনভাবেই জোগাড় হলো না।
.
যে সব নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন ডাক্তারেরা সেই মতই চলছে উদয়। ওষুধ আর প্রোটিন নিয়ম মাফিক খাচ্ছে। তবুও অবস্থার কোন উন্নতি নেই। দিনে দিনে শরীরে পানি জমে অনেক মোটা হয়ে গেছে। পা ফুলে ভারী হয়েছে। পায়ের নিচে দুইটা বালিশ রেখে পা উচু করে ঘুমায়।
মাথায় কিছু গোটা হয়ে ভরে গেলো। সেগুলিতে খুব ব্যাথা হয়। সেলুনে নিয়ে মাথার চুল ফেলে ন্যাড়া করে নিয়ে এলাম।
শরীরেও গোটা আছে দুই চারটা। দাড়ির গোড়ায় ও গোটা। চুলের সাথে দাড়িও ফেলে দিলো।
এই গোটা গুলি একটু খুটলেই রক্ত পড়তে থাকে সহজে রক্ত পরা বন্ধ হয় না।
সেভ করলে দাড়ির গোড়া থেকে রক্তপাত শুরু হয় সেটা সহজে বন্ধ হয় না। সেভ না করেও থাকতে পারে না দাড়ির গোড়ায় গোটা হওয়াতে খুব চুলকায়। দাতের মাড়ির পাশ দিয়ে রক্ত এসে মুখ ভরে যায়।
মাঝে মাঝে শ্বাস কষ্ট হয়, তখন ইনহেলারের সাহায্যে কিছুটা শ্বাসকষ্ট কমে। এভাবেই চলে গেলো কয়েক মাস।
অবস্থা আরো খারাপ হলো, মাঝে মাঝে কাউকেই চিনতে পারে না। তখন ভাত খাওয়া বোঝেনা, গোসল করা বোঝেনা। টয়লেট বোঝেনা।
শুধুই চিৎকার করে, ঘুমায় না, বাড়ি ভরে হেঁটে বেড়ায়।
.
আমাকে এক মুহূর্তের জন্য সরতে দেয় না।
সারাক্ষণ ওর কাছেই বসে থাকি। আয়ুশের দেখাশোনা, যত্ন নেয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছি। মা যেটুকু পারে করে।
.
আমি উদয়কে বললাম, আপনি যদি আমাকে এভাবে ধরে রাখেন তবে আয়ুশকে দেখবে কে? ওতো এখনও অনেক ছোট। ওকি মা ছাড়া থাকতে পারে?
.
উদয় বললো, আমি জানি না, তুমি আমার কাছ থেকে সরবে না। একদম সরবে না।
.
আপনি কেন এমন করছেন, আমি তো বাড়িতেই আছি।
.
উদয় চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললো, তুমি চলে গেলে যদি আজরাইল আসে, তখন আমি কি করবো? তখন আমাকে কে বাঁচাবে? আমার যে খুব ভয় করে। মনে হয় তুমি কাছে থাকলে কেউ আমার কিছু করতে পারবে না।
.
এইগুলি দেখে শুনে আর সহ্য হয় না। বুক চিরে কান্না বেরিয়ে আসে। কান্না ছাড়া আর আমার কিছুই করার নেই।
.
কয়েকদিন ধরে পেটে ব্যাথা বলতে লাগলো। আর খুব অস্থির অস্থির করতে লাগলো। শোয় বসে হাটে সবটাতেই একটা সটফট ভাব।
.
ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম।
ডাক্তার বললেন পেটে পানি এসেছে, তাই পেট ব্যাথা আর অস্থিরতা। পেট থেকে পানি বের করতে হবে।
.
আমি, বাবা আর উচ্ছাস ভাই, ওকে নিয়ে হসপিটালে ভর্তি করলাম। পেটের পানি ফেললে যদি একটু শান্তি পায়।
.
পেট থেকে পানি ফেলার আগে আলট্রাসনোগ্রাম করতে হয়।
তাই ওর আলট্রাসনোগ্রাম করা হলো। রিপোর্ট সহ উদয়কে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে পেতে সিরিঞ্জ পুশ করে পানি ফেলা হবে।
ওটির ভিতর কারো ঢুকা এলাউড না।বাবাকে থামানো গেলো না। বাবা জোর করে ভিতরে গেলো উদয়ের সাথে।
.
কিছুক্ষণ পর দেখি উদয়কে স্ট্রেচারে করে দ্রুত কোথাও নিয়ে যাচ্ছে। উদয়ের চোখ দুটি কেমন করে আছে। চোখ খোলা কিন্তু একটু বেশি ওপর দিকে তাকানো। যেনো চোখ উল্টে আছে।
.
পিছনে বাবা চিৎকার করে কাদছে আর দৌড়াচ্ছে।
আমি আর উচ্ছাস ভাইয়া হতভম্বের মত দাড়িয়ে আছি। কি হচ্ছে কিছুই বুঝলাম না। আমরাও তাদের পিছনে ছুটলাম।
.
উদয়কে আই সি ইউ তে নিয়ে সাথে সাথে লাইফ সাপোর্ট দেয়া হলো।
কিন্তু কোন লাভ হলো না। সিরিঞ্জ পুশ করার সাথে সাথেই স্ট্রোক করেছে।
.
সব কষ্টের অবসান ঘটিয়ে আমাকে একা করে উদয় চলে গেলো অন্য দুনিয়ায়।
আমি পাথর হয়ে দাড়িয়ে রইলাম কাদতেও ভুলে গেছি। তার বিশ্বাস ছিলো আমি সাথে থাকলে তাকে কেউ নিতে পারবে না।আমি সর্বক্ষণ সাথে থেকেও তাকে ধরে রাখতে পারিনি।
.
উচ্ছাস ভাইয়া কাদতে কাদতে আমার আব্বু আম্মু সহ সবাইকে ফোন করে জানালো।
ফোন পেয়ে আমার আব্বু আম্মু অন্যান্য সব আত্মীয় স্বজনরা একে একে হসপিটালে এসে ভিড় জমাতে থাকলো।
.
আই সি ইউ থেকে বের করে একটা ট্রলি বেডে শুইয়ে রাখা হয়েছে উদয়কে।
.
আমি কাছে গিয়ে উদয়কে চাদর সরিয়ে উদয়কে জড়িয়ে ধরলাম। শরীরটা তুলতুলে নরম আর সামান্য উষ্ণ।
আমি চিৎকার করে ডাক্তারকে ডাকতে থাকলাম।
আমার চিৎকার শুনে ডক্টর নার্স দৌড়ে এলো। কি হয়েছে বলুন তো!
ডক্টর দেখেন আমার স্বামী বেচেঁ আছে, শরীর এখনো নরম তুলতুলে। আর গা টা ও গরম। ছুঁয়ে দেখেন।
.
ডক্টর লিয়ার জোরাজুরিতে আবার স্টেথোস্কোপ দিয়ে পরীক্ষা করে দেখলো, টর্চ দিয়ে চোখ দেখলো। তারপর বললো,
সরি উনি বেচেঁ নেই। ওনার শরীরে অনেক পানি জমা হয়েছে। তাই শরীর নরম। আর বডি টেম্পারেচার বলতে যা বোঝাচ্ছেন সেটা আপনার মনের ভুল।
.
সাদা কাপড়ে জড়ানো বারান্দায় রাখা মানুষটার আজ শেষ বিদায়। আত্মীয় স্বজন, পারাপ্রতিবেশি, বন্ধু বান্ধব আজ শোকে কাতর। সবার চোখই অশ্রুসজল।
.
বাড়ির আনাচে কানাচে উপচে পরা লোকজন। সবাই শেষ বিদায় দিতে এসেছে উদয়কে।
পিছনের স্মৃতিগুলি নিয়ে সবাই আলাপ আলোচনা,
আফসোস করছে। আগে যারা উদয়কে নিয়ে সমালোচনা করতো তারাও আজ ওর গুণগান করছে।
.
কেউ কেউ বলছে এই বউটার এখন কি হবে? বাচ্চাটাও খুবই ছোট। খুব অভাগী, পোরা কপালী মেয়েটা। স্বামীকে ধরে রাখতে পারলো না।
অল্প বয়সেই স্বামীকে হারিয়ে বিধবা হয়ে গেলো। কতই বা বয়স বউটার !!
.
এই নিথর দেহটা বেঁচে থাকা অবস্থায় রোগে ভুগে ভুগে মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করতে করতে কতবার যে মৃত্যুবরণ করেছে।
চলে যাবার আগে তীব্র ব্যাথা নিয়ে ছট্ফট্ করেছে। আজ দেহটা পড়ে আছে নাড়াচাড়া দিলেও আর নড়বে না। জেগে উঠবে না।
অথচ কতো রাত ছিল ভালোবাসায় রঙিন। কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নে পরিপূর্ণ। জীবনটা ছিলো সুখ স্বপ্নে বিভোর।
.
মোমবাতি যেমন পোড়ে কিন্তু ধোয়া হয় না, ঠিক তেমনি আমিও কাদছি কিন্তু চোখে অশ্রু ঝরছে না।
.
কষ্টের মেঘ জমেছে আজ হৃদয়ের আকাশে। নিঃসঙ্গতার কালো মেঘ আজ আকরে ধরেছে আমায়। আমার একাকীত্ব শূন্য জীবনের ভার আমি কেমন করে বইবো।
আমি একা, বড় একা, আমার আপন কেউ নেই।
.
আল্লাহ কাউকে সম্পদ দিয়ে পরীক্ষা করেন,
কাউকে দারিদ্রতা দিয়ে পরীক্ষা করেন,
কাউকে সুস্বাস্থ্য দিয়ে পরীক্ষা করেন, আবার কাউকে অসুস্থতা দিয়ে পরীক্ষা করেন।
সফল তারাই যারা আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে আল্লাহকে ভয় করে।
.
সাজিয়ে গুছিয়ে উদয়কে মহাযাত্রার জন্য রেডি করলো সবাই। আমাকে শেষ দেখার জন্য ওর কাছে নিয়ে গেলো। ওর এই নতুন সাজ আমাকে ভেঙে খান খান করে দিলো। আমি সহ্য করতে পারলাম না। চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরলাম। জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।
.
চার দিন আজ উদয় ঘরে নেই। ঘরটা ফাঁকা পড়ে আছে। এখন আর কেউ জোর করে কাছে বসিয়ে রাখে না। হাত ধরে থাকে না।
আজ ওর কুলখানি। আমার পরনে সাদা থান শাড়ি উঠলো।
গায়ে কোন গয়না নেই , এমনকি নাকের ফুলটাও খুলে নিয়েছে।
.
বিশ বছর বয়সেই স্বামীকে হারিয়ে বিধবা হলাম।
এতো কষ্ট আমি কোথায় রাখবো।
আজ কেন জানি খুব কান্না পাচ্ছে, শূন্যতা, অপূর্ণতা, নির্ভরতা নাকি নিঃসঙ্গতার জন্য আমি জানি না। শুধু বুঝতে পারছি বুকের ভিতর কোথাও যেনো লুকানো জায়গা থেকে একদল অভিমান কান্না হয়ে দু চোখ ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
আজ আপনি কাছে নেই বলে শূন্যতা তার ইচ্ছামত নিষ্ঠুরতার খেলা দেখাচ্ছে।
উদয় আপনি কতদূরে বলেন তো ….! আমি আপনার কাছে যেতে চাই।
আমি আপনার বুকে মুখ লুকাতে চাই। আমাকে একা করে দিয়ে আপনি কোথায় চলে গেলেন। এমনতো কথা ছিলো না।
(বানানের ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন)
(চলবে)