কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ পর্ব-১৬

0
255

কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ
পর্ব ১৬
__________________
টাকা সেন্ড করে দেওয়ার পর নিঝুম হয়ে বসে রইল আর্য। বার দুয়েক কল করল। কিন্তু স্নেহা ফোন তুললো না। সম্ভবত ঘুম থেকে এখনো উঠেনি। নিরাশ হয়ে জানালা দিয়ে প্রবেশ করা সকালের বাঁকা সূর্যরশ্মির দিকে তাকিয়ে রইল। প্রথম যখন কর্নাটকে এসেছিল তখন স্নেহার সঙ্গে পুরনো সম্পর্ক অপরিবর্তিত ছিল। সম্পর্ক আরও গভীর হচ্ছিল। কিন্তু মাসখানেকের মধ্যেই সম্পর্ক বদলে যায়। হঠাৎ করে কেমন হয়ে ওঠে সবকিছু। ফোন করা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয় স্নেহা। বারবার ফোন করতে থাকে আর্য। কিন্তু একবারও তোলেনি। আর্য প্রথমে ভেবেছিলো, মন খারাপ। কোনো কিছু নিয়ে একটু বেশি চিন্তিত রয়েছে। মন খারাপ থাকলে কারোর সাথে কথা বলে না সে। কিংবা বড় কোনো সমস্যার মধ্যে পড়েছে।বিপরীত দিক থেকে সাড়া না পাওয়া সত্ত্বেও সব সময় ফোন করে গেছে। সপ্তাহখানেকের পর ফোন তুললো। ভেবেছিলো সমস্ত ঘটনা খুলে বলবে। স্নেহা তা করেনি। উল্টে সমস্ত দোষ আর্যকে দিয়েছিল। সে খুব খারাপ ভাষায় গালি দিল। আর্যর অবচেতন মন কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না, তার দোষ কোথায়? তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করা! দোষের অন্তত একটা তো কারণ থাকবে। কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছিল না। সে নিশ্চিত, তার মধ্যে কোনো দোষ নেই। কখনো কারোর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেনি। সেখানে স্নেহা তো অনেক কাছের বন্ধু। তার সঙ্গে অপব্যবহার করার দুঃসাহস নেই। বেহায়া মন নয়, আর্যর নরম মন খুব তাড়াতাড়ি স্নেহাকে ক্ষমা করে দেয়। স্নেহাকে চিঠি লিখে। বেশ কয়েকদিন অপেক্ষা করার পরও চিঠির উত্তর পায়নি। সে আবার ফোন করে। তখন স্নেহা তার চরিত্রের নিম্নতার পরিচয় দেয়।কতটা নিচে নামতে পারে, তার দৃষ্টিভঙ্গি কতটা নিচু, আর্যর সামনে একেবারে নতুন রূপে নিজেকে তুলে ধরে। আর্য নিজে থেকে ফোন কেটে দিয়েছিল। এমন খারাপ কথা শোনাও পাপ। কখনো ভাবতে পারেনি তার বাবাকে নিয়ে কেউ কথা শোনাবে। যে মানুষটি তাঁর আদর্শ তার অস্তিত্ব, ওই মানুষটির পুরুষত্ব নিয়ে কেউ প্রশ্ন করবে স্বপ্নেও ভাবেনি সে। দোষ আর্যর ছিল। তাকে গালি দিক সহ্য করে নিতো। কিন্তু সামান্য কথায় বাবা তুলে কথা বলায় মানতে পারেনি আর্য। নিশ্চুপ ভাবে বসে পড়েছিল। চোখ বেয়ে জলের ধারা ঝোরে পড়ে। সারারাত আধো আধো ঘুমে কাটিয়েছে। অস্বস্তি বোধ করেছে। উল্টাপাল্টা অনেক চিন্তা করেছে।
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে,জীবনে আর যাই হয়ে যাক ওই মানুষটির সঙ্গে আর কখনো কথা বলবে না। তার জন্য নিজের বাবাকে অপমানিত হতে হয়েছে। অন্যের কাছে ছোট হয়েছে। তারপর থেকে টানা এক বছর কোনো কথা হয়নি। স্নেহা ও একবারের জন্য খোঁজ করেনি। সেদিন হয়তো রাগ করার কারণ খুঁজে পায়নি আর্য। যদিও রাগ করার মতো কোনো কথা বলেনি সে। বারবার ফোন করে ছিল শুধুমাত্র নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি মিটে নেওয়ার জন্য। সবকিছু আগের মত হওয়ার জন্য। আগের মত কিছু হলো না। ভেবেছিল সবকিছু ভুলে যাবে। কিন্তু তাকে ভুলতেই ভুলে গেল। আর্য একটা ফোনের অপেক্ষায় ছিল। তাকে যোগ্য জবাব দিতে হবে। তা হলো না। ভেবেছিলো, স্নেহার কখনো আর্যকে দরকার পড়বে না। তার বন্ধু-বান্ধব টাকার কোনো কিছুরই অভাব নেই। সেখানে আর্য সামান্য এক মানুষ। কিন্তু গ্রাম বাংলায় একটা প্রবাদ রয়েছে ‘জাকু করিবু হীন, তাকু আঁখি মলি মলি চিন’। এখন স্নেহার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আর্যকে। সেদিন বিকেলে ফোনটি স্নেহার ছিল। স্ক্রিনে নাম দেখে বিরক্তর সঙ্গে সঙ্গে বিশাল একটি আগ্রহ বাড়তে থাকে। তার ফোন রিসিভ করেনি। ভালো লাগছিলো না। আরও কয়েকটি দিন কেটে যাওয়ার পরও স্নেহার ফোন আসলো না। গতকাল থেকে স্নেহা আবার বারবার ফোন করে চলেছে। প্রথমের দিকে ধৈর্য ধরে থাকলেও শেষের দিকে ধৈর্য্য হারা হয়ে ওঠে। কিছু একটা হয়েছে। যার জন্য বারবার ফোন করছে সে। ফোন রিসিভ করে। অনেকক্ষণ ধরে তার সঙ্গে কথাও বলে। তার কণ্ঠস্বর ভীষণ ভেজা। ঘন এক বিপদের মধ্যে জীবন কাটছে। দু-হাজার টাকার প্রয়োজন। খুব শীঘ্রই ব্যবস্থা করতে না পারলে একটা বড় ধরনের বিপদ ঘটে যাবে। আর্যর মখমলে মন নাড়াতে খুব বেশি সময় লাগল না। সে সামনে পিছনে কিছু ভাবলো না। স্নেহাকে কথা দিয়ে দিল সকালের মধ্যে টাকা ঠিক পাঠিয়ে দেবে। এতদিন ধৈর্য ধরে স্নেহার একটা ফোনের অপেক্ষা ছিল, যোগ্য জবাব ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। তা মুহুর্তের মধ্যে উবে গেল। সবকিছু ভুলে গেল। জীবনের নতুন কোনো ঘটনা কিংবা কোনো মুহূর্ত তৈরি হওয়ার আগে অনেক ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়। তাড়াতাড়ি করে কোনো সিদ্ধান্ত নেয় না। নরম মস্তিষ্কে ধীরেসুস্থে বিচার করে দেখে, কোনো কাজ কিংবা মানুষটি সঠিক কি না!তার কথার মধ্যে কোন চটচটে ব্যাপার আছে কি না! কিন্তু স্নেহার ক্ষেত্রে বরাবরই দুর্বল সে। স্নেহা কখনো মিথ্যা কথা বলতে পারে না। তার প্রতিটি কথা সত্য। একবারের জন্য জানতে চাইল না, তার কিসের জন্য টাকার প্রয়োজন? তার বাবার কথা অনেক শোনেছে ।মেয়ের প্রতি তিনি কতটা ধৈর্যশীল এবং স্নেহশীল তা অজানা নয়। মেয়ের বিপদের সময় অবশ্যই পাশে থাকবেন। মনের মধ্যে কোনোরূপ খটকা জমতে দিল না। জীবনে অনেক কিছু ঘটনা থাকে যেগুলো পরিবারের সঙ্গে কিছুতেই শেয়ার করা সম্ভব হয়ে উঠে না।
অশোক বাবু গরীব হতে পারেন তবে কখনো সন্তানদের চোখে অভাব বুঝতে দেননি। যতটুকু প্রয়োজন তার চাইতে সব সময় বেশি দিয়েছেন। ভালোবাসা হোক কিংবা টাকা পয়সা কোনো কিছুতে কার্পণ্য করেননি। আর্য বাইরে রয়েছে। অনেক কিছুই প্রয়োজন তার। কি করছে না করছে ঠিক মতো দেখতে পান না। সময় মত টাকা পয়সা পাঠিয়ে দেন। কিন্তু বাবার একটা টাকাও খরচ করার প্রয়োজন হয় না তার। অযথা বাইরে বেরোনো কিংবা নতুন পোশাক আশাকের প্রতি ইন্টারেস্ট খুবই কম। রান্নার জন্য কারেন্টের একটা ইন্ডাকশন এনে রেখেছে। মাঝেমধ্যে তাতে রান্না করে ফেলে আর্য আর মিনাজ। খরচ বলতে এইটুকুই। টাকা খরচের তুলনায় জমার খাতায় বেশি। স্নেহাকে টাকা দিতে অসুবিধা হলো না। অনেকক্ষণ ধরে আর্যকে চুপচাপ স্থির হয়ে বসে থাকতে দেখে খটকা লাগল মিনাজের মনে।
“কি ব্যাপার! কলেজ যাবে না?” মিনাজের কথায় হুঁশ ফিরলো। তার দিকে তাকিয়ে হাসি বিনিময় করল। মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল। চেয়ার থেকে উঠে পড়ে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিল। এমন সময় মিনাজ তাকে একটি একশো টাকার নোট ধরিয়ে দিল। তার বিনিময় দশটি দশ টাকার নোট চাইলো। আর্য হাসিমুখে গ্রহণ এবং বিনিময় করল।সে জানে এই টাকা কি হবে। বর্তমানে আর্যর ও খুচরো টাকার খুব প্রয়োজন। বেশ কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। মিনাজ ছাতা নিলেও আর্য ছাতা নিল না। তার ছাতার প্রয়োজন হয় না। বাড়ির সামনেই বাস স্ট্যান্ড।বাস থেকে নামলেই কলেজ। ছাতার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু মিনাজের কলেজ সামান্য দূরে। বাসে নয় হেঁটে হেঁটে যাতায়াত করতে হয়। ছাতা খোলার প্রয়োজন হলো না। অনেক দিনের পর হালকা রোদ বেরিয়েছে। বাড়ির সামনে বের হতেই ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের একটা দল এসে জুটল। একটা ছোটো কৌটো দুজনের দিকে বাড়িয়ে দিল। উভয়ই কৌটোর মধ্যে দশ টাকা করে ফেলল। প্রসন্ন হাসি বিনিময় করে এগিয়ে গেল। কিছুটা যাওয়ার পর মিনাজ হাত নাড়িয়ে আর্যকে বিদায় জানালো। তারপর নিজের কলেজের উদ্দেশ্যে চলল। আর্য বাসের মধ্যে উঠে পড়ে জানালার পাশে বসলো। জানালার বাইরের দিকে তাকাতেই কয়েক দিনের পরিচিত সেই সোনালী মুহূর্তগুলো ফুটে উঠছে। দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য।কয়েকদিন ধরে অবিরাম বর্ষণে পার্শ্ববর্তী রাজ্য কেরালায় ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। এই বন্যা শুধুমাত্র কেরালা কিংবা ভারতবর্ষ নয় সারা বিশ্বের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। প্রকৃতি কতটা কঠিন রূপ ধারণ করতে পারে তা সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছে। কেরালার মানুষ স্বাধীনতার পূর্বেও এমন বন্যার সম্মুখীন হয়নি। বর্তমানে টিভির পর্দায় চোখ রাখলে একজন স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের বুক নাড়িয়ে তুলবে। বন্যাতে কয়েক লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে। কত বড় বড় বিল্ডিং মুহূর্তের মধ্যে ভেঙ্গে চুরমার করে দিচ্ছে। স্বজনহারা ভিটেমাটি হারার হাহাকার চারিদিকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। কেরালা সমুদ্রতীরবর্তী এবং নিচু এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় জল খুব দ্রুত চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় নয়, কেরালায় প্রায় অধিকাংশ এলাকায় জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। পুরো প্রশাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সকলের কাছে সাহায্যের আর্জি জানিয়েছেন। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছে সারা দেশবাসী। শিশু,শ্রমিক, কৃষক থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা সবাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। বিভিন্ন স্কুল এবং সমাজ সেবক সংস্থাগুলি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। তারা রাস্তায় ঘুরে ঘুরে সাধারণ মানুষের কাছে সাহায্য চাইছে। কেউ পাঁচ টাকা আবার কেউ দশ টাকা করে দিচ্ছে। আবার অনেকে উদারতার পরিচয় দিচ্ছে। সমস্ত টাকা তারা তুলে দিচ্ছে কেরালার সরকারের হাতে। এমন মুহূর্ত গুলো বড্ড সুন্দর। মানুষের বিপদে যদি মানুষ না থাকে, তাহলে তারা কেমন মানুষ! বেশ কয়েকদিন ধরে স্কুলে যাওয়া এবং আসার সময় এমন দৃশ্যর সাক্ষী হচ্ছে বারবার। নিজে থেকেও সাহায্য করেছে। বড় রেস্টুরেন্টে একশো টাকা খেয়ে যতটা না তৃপ্তি পিয়েছে, পাঁচ টাকা সাহায্য করে তার চাইতে বেশি তৃপ্তি পেয়েছে আর্য।সামান্য সাহায্য বহু মানুষের এক বেলা আহারে ব্যবস্থা হয়ে যাচ্ছে। ভারতবর্ষের প্রথম সারির ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি হলো সাউথ ইন্ডাস্ট্রি। কিন্তু খুব কম সংখ্যক সেলিব্রেটিকে দেখা গেল সাধারণ মানুষের বিপদে এগিয়ে আসতে। অথচ তারা সেলিব্রেটি হয়েছে এই সাধারণ মানুষ গুলোর জন্য। সেলিব্রিটিদের চাইতে সাধারণ মানুষ গুলোর সাহায্যে করার প্রবণতা চোখে পড়ার মতো।অনেক সংস্থা এবং স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা বাস থামিয়ে মানুষদের কাছে সাহায্যের আর্জি জানাচ্ছে। কেউ সাহায্য করছে আবার কেউ বিরক্ত হচ্ছে। আবার কেউ মুখের উপর বলে দিচ্ছে বন্যার কারণে ওই রাজ্যের যত না ক্ষতি হয়েছে তার চাইতে বেশি সাহায্য করা হচ্ছে। কিন্তু তারা বোঝার চেষ্টা করছে না, একটা রাজ্য সম্পূর্ণ ভেঙে পড়লে ওই রাজ্যকে পূর্বের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে কত পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়। তবে আর্যর খুব ভালো লাগলো। এমন দৃশ্য একটা দেশের জন্য খুবই মঙ্গলময়।
কলেজে পৌছে আবার একবার অবাক হলো আর্য।সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী উৎশৃংখল ভাবে বাইরে ঘোরাফেরা করছে। কৌতুহল বাড়লো। রুমের মধ্যে ব্যাগ রেখে চটপট মাঠের মধ্যে চলে আসলো। প্রথমে চোখ পরল ইয়াসমিন আর আরিফুলের ওপর। আর্যকে দেখামাত্র হাসি বিনিময় করল তারা। আর্যর ভালো লাগলো না। দ্রুত তাদের থেকে আড়াল হয়ে গেল। তাদের ব্যবহার তাকে মনঃক্ষুণ্ণ করেছে, এমন নয়। ইয়াসমিন আর আরিফুল দুজনেই বাঙালি এবং বাড়ি এক জায়গায়। তাদের বাড়ির লোক মাঝেমধ্যে তাদের সঙ্গে দেখা করতে আসে। কখনো ইয়াসমিনের বাড়ির লোকজন আবার কখনো আরিফুলের বাড়ির লোকজন। দেখা করতে আসলেই তাঁরা একগাদা বাঙালি খাবার দিয়ে যান। ইয়াসমিন এবং আরিফুল আর এক বাঙালি ভাইকে রেখে বাঙালি খাবার খেতে পারে না। নিজেদের খাবারের অনেকাংশই আর্যকে দিয়ে দেয়। আর্য না বললেও শোনে না। প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর তারা বাড়ি ফিরে যায়। বাড়ি থেকে আসার সময় অনেক বাঙালি খাবার নিয়ে আসে। আর্য বারণ করা সত্ত্বেও অনেক খাবার দেয়। বারবার তাদের কাছ থেকে খাবার নিতে ভালো লাগে না আর্যর। তাদের ফ্যামিলির সদস্য সংখ্যা অনেক বেশি, খুব সহজে আসা যাওয়া করতে পারে। আর্য পরিবারের ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। বারবার তাদের কাছ থেকে কিছু নিয়ে নিচ্ছে কিন্তু নিজে কিছু দিতে পারছে না। মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি হয়। তাই তাদেরকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে। ইয়াসমিন আর আরিফুলের শকুন দৃষ্টি তাকে আড়াল হতে দিল না। ঠিক খুঁজে বার করল।
“এত ফাঁকা মাঠের মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে রাখা সহজ নয় ভাই। এভাবে পালিয়ে বেড়াচ্ছ কেন?” হাসিমুখে বলল আরিফুল। হঠাৎ কোনো একটা বস্তু দ্বারা আঘাত পেলে মুখের আকৃতি যেমন হয়,আর্যর মুখটি ঠিক তেমন হলো। নিজের বোকামির কথা বুঝতে পেরে হেসে উঠলো। সত্যিই, এই ফাঁকা মাঠের মধ্যে নিজেকে কিভাবে লুকানো সম্ভব? আর কতদিনই বা লুকিয়ে বেড়াবে?
“লুকাবো কেন? কি হচ্ছে দেখছিলাম?” আর্য কিছুতেই নিজের মনের সংকোচন তাদের মধ্যে প্রকাশ করতে চাইল না। সফলও হল। তারা কলেজের হোস্টেলে থাকে। পরের দিন কলেজে কি হবে তারা আগের দিন রাতেই জানতে পেরে যায়। আর্যকে তারা সব কিছু বলল। বিভিন্ন সমাজসেবক সংস্থা এবং স্কুল ও কলেজ গুলো যেভাবে পার্শ্ববর্তী ঘরবাড়ি কিংবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে সাহায্য চাইছে, তাদের কলেজেও তিন দিন ধরে এমন প্রোগ্রাম আয়োজন করেছে। আজ দ্বিতীয় দিন। তারা এক্ষুনি বেরিয়ে যাবে। কাউকে জোর করা হচ্ছে না। যার ইচ্ছা যাবে। আর্য তাদের সঙ্গে যেতে রাজি হল। হই হুল্লোর করে বেরিয়ে পড়ল। ভীষণ অবাক হয় ইয়াসমিন আর আরিফুলকে দেখে। তারা তো এদেশের নাগরিক নয়। মাত্র চার বছরের অতিথি । তারপর ফিরে যাবে নিজেদের দেশে। কোনো স্বার্থ ছাড়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের অংশগ্রহণ আর্যর মনকে খুশিতে দুলিয়ে দিল। কিছু কিছু মানুষ বড্ড উদাসীন হয়। তারা কখনও জাতি দেশ ধর্ম মানে না। এক মানুষ দুমুঠো অন্নের জন্য হাহাকার করছে। আর সে মানুষ হয়ে চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। আর্য মুখ ঘুরে দেখল, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটা ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছে। কোনো শিক্ষিকা তাদের সঙ্গে থাকবে না। তারা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট একটা পোশাক এবং ব্যানার দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব শেষ করে ফেলেছেন। এবার সব কাজ ছাত্র-ছাত্রীদের। বেশ কয়েকজন ছাত্র ছাত্রী মনোক্ষুন্ন হলো। তারা যেতে রাজি হলো না। আবার শূন্য কৌটো নিয়ে অন্যের কাছে সাহায্য চাইতে চায় না। বড্ড অবাক হলো আর্য! এমন পরিস্থিতিতে সকলকে স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ করার কথা। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ দায়িত্ব আর কর্তব্য পালন করছে। সব জায়গায় দায়িত্ব ও কর্তব্যকে মেলে ধরা শোভনীয় নয়। শূন্য কৌটো কেউ নিতে না চাওয়ায় আর্য দুর্দান্ত এক আইডিয়া দিল। তারাও দেশের নাগরিক। নিজেদেরও সাহায্য করা উচিত।অন্য কে কিছু বলার আগে নিজেকে প্রথম ওই কাজটি করে দেখানো উচিত। আর্য তাই করল। এবং সকলকে সেখানে কিছু না কিছু সাহায্য করতে বলল। সবাই মহা খুশি হয়ে সাহায্য করল। তারপর আনন্দের সহিত এগিয়ে গেল। কিছুটা যাওয়ার পর আর্যর চোখ পড়ল লক্সমির ওপর। এমন একটা সমাজ সেবক মূলক কাজে লক্সমি অংশগ্রহণ করেছে না। কেমন একটা দৃষ্টিকটু লাগছে। সে তাদেরকে এগিয়ে যেতে বলে লক্সমির কাছে ছুটে আসলো। কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,”কি ব্যাপার! তুমি যাবে না?”
“ধুর ভালো লাগে না। গিয়ে কি লাভ বলো তো?” মুখ তুলে বললো লক্সমি।
“তুমি এই কথা বলছো?”
“আমি এমন কথা বলছি মানে কারণ অবশ্যই রয়েছে। কালকে আমি গেছিলাম। কলেজে একজনও টিচার যায়নি। কিন্তু এখন কলেজের ওয়েবসাইট আর অফিশিয়াল ফেইসবুক পেজ খুলে দেখো, সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকারা কৌটো হাতে দাঁড়িয়ে সাহায্য চাইছেন, -এমন ছবি পোস্ট করেছেন। ওই ছবির মধ্যে কোনো ছাত্রছাত্রী নেই।তারা নাকি প্রচুর পরিমাণে অর্থ সাহায্য করছেন। কিন্তু কারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাহায্য চাইলো? সবাই কিন্তু সাহায্য করেননি মুখের উপর কথা শোনিয়ে দিয়েছেন। আমরা কথা শোনলাম আর সম্মান পেল তারা।” আর্য অবাক হলো। আবার হাসিও পেল। ঘটনার মধ্যে কোনো নতুনত্ব নেই। শুধু স্কুল কিংবা কলেজ নয়, প্রায় জায়গায় এমনই হয়। তাছাড়া এখানে সম্মান পাওয়ার মতো কোনো কাজ নেই। মানুষকে সাহায্য করার পেছনে যদি আসল উদ্দেশ্য সম্মান পাওয়া হয়ে থাকে, তাহলে সাহায্য করা আর না করা দুটোই সমান। কিছু মানুষ সবসময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। তারা কোনো কিছু না করে প্রাপ্যটুকু পেতে চায়। এই গৌণ বিষয়ে লক্সমি মন খারাপ করেছে ভেবেই খারাপ লাগলো আর্যর। তবে মনের কোণে একটি চতুর বুদ্ধি নেচে উঠল। কাজে লাগালে জব্বর হবে। তার আইডিয়াটি লক্সমিকে শোনালো। লক্সমি বড্ড খুশি হলেও মনের মধ্যে একটা সংকোচন থেকে গেল। বলল,”টিচাররা সাহায্য করেছেন। দ্বিতীয়বার করতে যাবেন কেন?”
“আমরাও তো রাস্তাঘাটে বার তিনেক একবার সাহায্য করেছি। হয়তো,আরও দু-চার দিন ধরে সাহায্য করতে হবে।আর টিচাররা দ্বিতীয়বার করলে অসুবিধা কোথায়? তাছাড়া, তারা বলেছেন সাহায্য করেছেন। কিন্তু আদৌ কি করেছেন? আমার সন্দেহ রয়েছে!” আর্যর কথায় সম্মতি জানাল সে। আজকে আর পথে নামা হলো না সবাই স্টাফ রুমের উদ্দেশ্যে চলল। কৌটো গুলো টিচারদের দিকে বাড়িয়ে তাদেরকেই প্রথমে সাহায্য করতে বলা হলো। তাঁরা বড্ড অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেলেন।কখনো ভাবেনি তাঁদের ছোঁড়া তীর তাদের দিকেই ফিরে আসবে। কোনো টিচার মুখের উপর না বলতে পারল না। প্রত্যেক টিচারের মধ্যে সংকোচন আর রাগ তৈরি হলো কিন্তু প্রকাশ করার সাহস পেলেন না। এতে নিজেদের নিচু মানসিকতার পরিচয় সকলে পেয়ে যাবে। স্টাফ রুম থেকে বেরিয়ে এসে লাইব্রেরীর মধ্যে প্রবেশ করল। উনাকে সাহায্যের কথা বলতেই উনি দারুন ভাবে মুখের ভঙ্গি বদলালেন। তারপর পকেট থেকে দুটো পাঁচশ টাকার নোট বার করলেন। সবাই ভীষণ অবাক হলো। মানুষটি বড্ড ভালো। কিন্তু তিনি দুটো পাঁচশ টাকার নোট ভালোভাবে দেখে আবার পকেটের মধ্যে ভরে দিলেন। তারপর জামার পকেট থেকে কুড়ি টাকার নোট বের করে কৌটোর মধ্যে ফেললেন। এমন মজার ঘটনায় সবাই হৈ হুল্লোর করে হেসে উঠলো। তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, এটা লাইব্রেরী। এখনে শান্ত থাকা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু উনার কথা কেউ শোনলো না। সবাই উনার অবাঞ্ছিত ব্যবহারে হাসাহাসি করতে রইল। একজন মুখের উপর বলেই দিল, আপনার থেকে আমি অনেক বেশি টাকা সাহায্য করেছি।

বিক্রম চলে যাওয়ার পর থেকে স্নেহার মধ্যে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। পূর্বের অবস্থায় থেকে গেছে। নতুন করে কিছু শুরু করতে পারেনি। এক বছর পেরিয়ে গেলেও স্মৃতি হত্যা করতে পারেনি। স্মৃতি আজও কুরে-কুরে মারছে। নতুন করে স্বপ্ন দেখার দুঃসাহস হারিয়ে ফেলেছে। সব সময় হট মেজাজে এবং খিটখিটে থাকে। কারোর কথা শোনে না। কাউকে তোয়াক্কা পর্যন্ত করে না। সারাদিন রুমের মধ্যে চুপচাপ একা বসে থাকে। বাইরে ট্রেনের ছুটে চলা নিজের চোখের ক্যামেরায় বন্দী করে।সোশ্যাল সামাজিক সমস্ত কিছু থেকে অনেক দূরে রয়েছে সে। নিজের জীবনের প্রতি এক প্রকার ঘেন্না আর বিরক্ত চলে এসেছে। আপন-মনে আসন বুনে চলেছে সে। এক বছরে উন্নতি বলতে শুধু এটুকুই। অনেকগুলো হাতের কাজ শিখেছে। নিজের একাকিত্বের সঙ্গী করে নিয়েছে। তার সামনে তার প্রিয় বান্ধবী আদ্বিতিয়া দাঁড়িয়ে রয়েছে অথচ সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। তাকে সামান্য বসতে পর্যন্ত বলছে না। বড্ড বিরক্ত মুখে আদ্বিতিয়া বলল,”গতকাল সন্ধ্যা থেকে ফোন করে যাচ্ছি, আবার একটা সন্ধ্যা হতে যায়, ফোন তুলছিস না কেন?”
“ভালো লাগেনি তাই তুলিনি।”
“তাই বলে আমার ফোন তুলবি না!”
“ভালো না লাগলে আমি আমার বাবার ফোন পর্যন্ত তুলি না।” স্নেহার কথাগুলো কাঁটার মতো বিঁধলেও সবকিছু সহ্য করলো আদ্বিতিয়া।
“আচ্ছা সবকিছু বাদ দিলাম। আমি তোর বাড়িতে এসেছি আমায় অন্তত একটু বসতে বল।”
“সামনেই তো খাট পড়ে রয়েছে বসে পড়বি। তুই কি আমার বাড়িতে প্রথম এলি যে কিছু জানিস না।”
“তুই এমনটা হয়ে যাচ্ছিস কেন রে? কারোর কথা শোনছিস না। সবার মুখের উপর কথা বলে যাচ্ছিস। বাবা-মার উপর মেজাজ দেখাচ্ছিস।”
“মেজাজ দেখাবো না তো কি করব! আমি আমার মত থাকতে চাই। থাকতে দিচ্ছে না কেন?”
“তুই তোর মত থাকবি ভালো কথা। কিন্তু সকাল ন’টার সময় ঘুম থেকে উঠবি। দুপুর দুটোর সময় স্নান করতে যাবি। দুপুরের খাবার বিকেলে খাবি। একদিনও কলেজে যাবি না। বাবা মা কিছু বলবে না বুঝি?” স্নেহা চুপ করে গেল। অদ্বিতীয়া তার পাশে বসেই আসন ছাড়িয়ে নিল। স্নেহা অনেক জোরজবস্তি করে ফিরিয়ে আনতে চাইল কিন্তু ব্যর্থ হলো। তাকে শান্ত হয়ে চুপচাপ বসতে বলল। একটা পা মুড়ে আর একটা পায়ের হাঁটুতে থুতনি রেখে অদ্ভুতভাবে বসল স্নেহা। অদ্বিতীয়া আবার বলল,”এমন করিস না তুই। আমার ভালো লাগে না। একটা ছেলের জন্য নিজের জীবন এভাবে নষ্ট করছিস কেন?”
“আমি কখনো কারোর জন্য নিজের জীবন নষ্ট করিনি। আর যদি ভাবিস ওই ছেলের কথা ভেবে আমি এমনটা হয়ে যাচ্ছিস তাহলে ভুল। ওর সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি রয়েছে। সেগুলোর টানাপোড়ন থেকে বের হতে অনেক সময় লাগবে। কারোর জন্য আমি নিজেকে বন্দি করে রেখেছি তা নয়। আমার এমনটা ভালো লাগছে তাই করছি।”
“পাগলামো করিস না। একটু বোঝ। সামনে পরীক্ষা আছে,পরীক্ষা দিবি না ?”
“পরীক্ষা! কটা সাবজেক্ট আছে জানি না। পরীক্ষা কি করে দেব?” তাচ্ছিল্য করে বলল স্নেহা।
“তোর মনে আছে তুই এক সময় স্কুলে ফার্স্ট ছিলিস। কত নামডাক ছিল।”
“সেগুলো তো অতীত। অতীত মনে করে লাভ কি?” অদ্বিতীয়া এবার চুপ করে গেল। বুঝিয়ে লাভ নেই। নিজের জীবনের প্রতি বড্ড উদাসীন হয়ে উঠেছে। এর থেকে কিভাবে মুক্ত পাবে সে? জীবনের একটা কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে অনেক বুঝিয়ে ছিল, বেশি আবেগ ভালো নয়। শোনেনি। নিজে হাতে আজ নিজের জীবন নষ্ট করছে। অদ্বিতীয়া প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,”আর্যর সাথে তোর কথা হয়?” অবাক চোখে তাকাল স্নেহা। আর্যকে কখনো পছন্দ করতো না আদ্বিতিয়া। তার ভেতরে নাকি প্রচুর বারুদ রয়েছে।শুধু দেশলাই কাঠি মারার জন্য একটা উপযুক্ত লোকের প্রয়োজন।হঠাৎ তার কথা জিজ্ঞেস করছে! খটকা লাগলো।
“কথা হয়তো। এক বছরের মতো কথা বলিনি। এই কদিন হলো কথা হচ্ছে। জানিস, ছেলেটা ভীষণ বোকা।”
“বোকা নয়, ওটা তার পারিবারিক শিক্ষা। অতিরিক্ত সহজ সরল। আমরা সব সময় নিজেকে ভালো প্রেজেন্ট করার চেষ্টা করি। আপ্রাণ চেষ্টা করে যাই সৎ হওয়ার। কিন্তু পেরে উঠি না। আর আর্য তা করতে পেরেছে। সে কোনো কিছুর বিনিময় অসৎ পথ বেছে নেয়নি।”
“নারে, একটু তো বোকা আছে। এই ধর না.. তোকে আমি এখনই খুব খারাপ ভাষায় গালি দিলাম। দুজনের মধ্যে ঝগড়া হলো। কয়েক বছর পর আমরা এক হয়ে গেলাম। যতই এক হয়ে যাই না কেন ওই ঝগড়ার জন্য একে অপরের প্রতি একটা অদৃশ্য ঈর্ষা ঘেন্না থেকে যাবে। স্বীকার না করলেও মনের আনাচে কানাচে ঠিক থেকে যাবে। কিন্তু আর্যর মধ্যে থাকে না। সবকিছু দ্রুত ভুলে সহজ সরল হয়ে যায়। জীবনে এত সহজ সরল মানুষ আমি কখনো দেখিনি।”
“বাদ দে অন্যের কথা। নিজের কথা একটু ভাব। সবাই তোকে এখন এক কথা বলবে। আমি ওই গুলো বলে তোকে বিব্রত করতে চাই না। একটু ভেবে দেখ, এক বছরের মধ্যে নিজের কত রোগ বাঁধিয়েছিস। আর কতদিন এভাবে চলবে।নিজে কষ্ট পাচ্ছিস সঙ্গে সঙ্গে ভাই বাবা-মা সবাইকে কষ্ট দিচ্ছিস। তোর এই অবস্থা থেকে কেউ বের করতে পারবে না। পারলে তুই পারবি। নিজেই নিজেকে বোঝা।”

পর্ব ১৭ আসছে
গভীর প্রেম আসছে পরবর্তী পর্বগুলোতে।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here