কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ
পর্ব ১৭
___________________
কর্ণাটক রাজ্যে দুর্গা পুজোর চাইতে দীপাবলি বেশ জমজমাট হয়। কয়েকদিন ধরে সেজে উঠেছে গ্রামের পল্লী থেকে শহর। চারিদিকে রংবেরংগের আলোর স্তম্ভ জ্বলে উঠেছে। বাড়ির উঠোনে,ছাদে এবং ঠাকুরঘরে সারি সারি প্রদীপ জ্বলছে। চতুর্দিকে বারুদের একটি অস্পষ্ট গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। ছোট ছোট শিশুরা আতশবাজি নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। কোলাহল মাখা শহর আজ আরও বেশি কোলাহলে বুঁদ হয়ে উঠেছে। আজ কারোরই এমন কোলাহলের প্রতি সামান্য বিরক্ত কিংবা অস্বস্তি নেই। সবাই হালকা জ্যোৎস্না এবং প্রদীপের স্বর্ণ আলো গায়ে মাখছে। আর্য রুমের মধ্যে বসে জুতোর ফিতে বেঁধে ফেলল। তার মন বড্ডো চঞ্চল এবং পুলকিত। দিন গুলো খুব সুন্দর এবং সাজানো-গোছানো ভাবে কাটছে। কেরালায় বন্যার পর থেকে স্নেহা রোজই কথা বলে। সমস্ত রাগ অভিমান ভুলে গেছে। তার সঙ্গে বিক্রমের সম্পর্কের কথাও নিজের মুখে স্বীকার করেছে। উভয়ের বিচ্ছেদের কথা শুনে মোটেও ভালো লাগেনি আর্যর। স্নেহাকে ভালোবাসতো ঠিকই, তবে মন থেকে চাইতো না তারা আলাদা হয়ে যাক। নিজের সুখের জন্য স্বার্থপর হতে পারে না সে। এখন স্নেহার পুরনো চঞ্চল উসখুস মনকে খুঁজে পায় না। সব সময় কেমন একটা ভরাক্রান্ত থাকে। কথা বলতে বলতে কেঁদে ওঠে। আর্য যতটুকু সম্ভব সান্ত্বনা দেয়। অনেকটা তার এলোমেলো জীবনকে গুছিয়ে দিয়েছে। বিকেল থেকে ফোনে নানা ধরনের গল্প করেছে দুজন। এখনো লাইনে রয়েছে। আর্য পরিপাটি হয়ে সিঁড়ি বেয়ে দুপদাপ করে নিচে নেমে আসলো।শহরের রাস্তায় ধীরে ধীরে পা ফেলে এগিয়ে গেল।
“কি রে! এত চেঁচামেচি কোথা থেকে আসছে? বেরিয়েছিস কোথাও?” মৃদু কণ্ঠে স্নেহা বলল।
“হ্যাঁ, সকালে তোকে বললাম না,সন্ধ্যায় লক্সমির সঙ্গে একটু বেরোবো।”
“মনে থাকে না রে। এখন তাড়াতাড়ি সবকিছু ভুলে যাই। বলতে বলতে বয়স হয়ে গেল তো।”
“হ্যাঁ, বুড়ি হয়ে গেছিস।” হালকা হেসে নিয়ে আবার বলল “তোদের বাড়িতে প্রদীপ জ্বালানো হয়নি? ঠাকুর দেখতে যাবি না?”
“না রে। এবার আর কোথাও যাওয়া হবে না। ঠাম্মি মারা গেছেন তো তাই।” আর্য কথা বলল না। প্রসঙ্গ পাল্টাতে উদ্যত হলো। ঠাম্মির কথা মনে পড়লেই কাঁদতে শুরু করবে স্নেহা। স্নেহাও প্রসঙ্গ পাল্টে গেল। কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলল,”তুই এই রোগাক্রান্ত মেয়েটাকে ভালোবাসিস? যার শরীরে হাজারো রোগ বাসা বেঁধেছে। কতদিন বাঁচবে তাও ঠিক নেই।” হালকা হেসে উঠল স্নেহা। আর্যর বুকের মধ্যে হঠাৎ করে ধুকপুকানি বেড়ে গেল। কাউকে ‘ভালোবাসি’ বলার আগে যখন মানুষটি নিজে থেকে বুঝতে পেরে যায় বিপরীত মানুষটি তাকে ভালোবাসে, তখন অনুভূতিটি হয় সম্পূর্ণ আলাদা। ভাষায় প্রকাশ করার অক্ষমতা চলে আসে। আর্য একটু ন্যাকামী করে বলল,”দূর, আমি কেন কাউকে ভালোবাসতে যাবো।”
“আমার সঙ্গে ঢং করছিস? আমি তো সবকিছু মেনে নিয়েছি।” আর্য আবার একটা ধাক্কা খেল। সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। বুকে কেমন হচ্ছে। সমুদ্রে সাইক্লোন সৃষ্টি হলে সমুদ্র যেমন উথালপাথাল হয়ে ওঠে আর্যর বুকের মধ্যে ঠিক তেমন উথালপাথাল হচ্ছে। তাকে কিছু বলতে না দেখে স্নেহা আবার বলল,”তুই আমায় কি দেখে ভালবাসলি রে? জানিস তো, আমার কানের কাছে কাটা অংশ আমায় কত বিচ্ছিরি দেখায়। যার সঙ্গে দু’বছর সম্পর্কে ছিলাম সেও একবার বলেছিল। জানি না মন থেকে বলেছিল, না ইয়ার্কি করে বলেছিল! তবে বলেছিল তো।” স্নেহার কণ্ঠস্বরে একটা কাঁদো কাঁদো ভাব চলে আসলো। নিজের প্রতি ক্ষোভ উগ্র দিচ্ছে।
“একজন বন্ধুর কাছে আর একজন বন্ধু সব সময় সুন্দর। তুই আমার কাছে বরাবরই সুন্দর। ভগবান সব কিছুই সুন্দর সৃষ্টি করেন। আমরা যাকে ঘেন্না করি তাকেও কিন্তু কেউ একজন ভালোবাসে।”
“আমি এখনো তোর বন্ধু! আচ্ছা ঠিক আছে বন্ধু যা।”
আর্য কোনো উত্তর দিল না। অনেকক্ষণ চুপ থেকে স্নেহা বলল,”কি রে! আর কতক্ষণ হাঁটবি? তোর ওই দিদি এখনো আসেনি!”
“আর বলিস না। এখানকার মেয়েরা সারাদিন সাজুগুজু করতেই থাকে।”
” আচ্ছা ঠিক আছে। আমি রাখছি। পরে কথা হবে আবার। সবাই আতশবাজি জ্বালাচ্ছে।ভাইয়ের মন খারাপ। তার কাছে একটু যাই। সাবধানে থাকবি তুই।” আর্য উত্তর দেওয়ার পর ফোন কেটে দিল। মন পুলকে ভরে উঠেছে। স্নেহার কথা যত মনে পড়ছে তত হারিয়ে যাচ্ছে রোমাঞ্চে। মনের উদ্দীপনা চরমে পৌঁছেছে। আজ এমন এক আনন্দময় দিনে আরও আনন্দময় হয়ে উঠেছে তার জীবন। ভাগ্যের চাকা এমন ঘুরে যাবে কখনো ভাবেনি। তার ঠোঁটের কোণে বারবার হাসি ফুটে উঠছে। মুখ বার বার উজ্জলতায় ছেয়ে যাচ্ছে। আরও কিছুটা হাঁটার পর লক্সমিকে দেখতে পেল। সে ইশারায় তাকে দাঁড়িয়ে যেতে বলল। আর্য চুপিসাড়ে দাঁড়িয়ে গেল। লক্সমি কাছে এসে হাসি বিনিময় করল। আর্য ঠোঁট টিপে লক্সমিকে আপাদমস্তক দেখলো। পরনে লেহেঙ্গা, কোমর বন্ধনী, চুলের বেনীতে রজনীগন্ধার মালা, আজ আবার ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক লাগিয়েছে। শহরের রঙিন রঙিন আলোয় লক্সমিকে ও রঙিন লাগছে। নারী সাজুগুজু করলে যে কোনো পুরুষকে মোহিত করবে, স্বাভাবিক। লক্সমি রূপে মোহিত হয়ে আর্য বলল,”তুমি কি বিয়ে করতে যাবে? বিয়ে করতে গেলেও মেয়েরা এত সাজুগুজু করে না। সামান্য একটু শহর ঘুরে দেখবে তাতেই লেহেঙ্গা পরতে হলো।”
“তোমার কাছে হয়তো অতিরিক্ত লাগছে কিন্তু আমার কাছে সামান্য। আমাদের কালচার। আমরা বাঙালি বলতে বুঝি রসগোল্লা, শাড়ি, ধুতি,পাঞ্জাবি। সাউথ ইন্ডিয়ান বলতে মানুষ বোঝে ধোসা, ইডলি, ঘাগরি জাতীয় পোশাক কিংবা লেহেঙ্গা। আজ এগুলো সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়লেও, এগুলোর প্রাচুর্য সবচেয়ে বেশি নিজ নিজ এলাকায়।”
“তা বলে সব সময় ভারি পোশাক পরে থাকবে! বিরক্ত লাগে না?”
“বেশি বোকছো। মনে হচ্ছে লেহেঙ্গা আমি পরে নেই তুমি পরে আছো।” দুজনেই হালকা হেসে উঠলো। হাসি থামতে কিছুটা সময় লাগলো। চোখে চোখ পড়তেই মুখে হাত চেপে আবার হেসে উঠলো।
ইতিমধ্যে দুজন হাই রোড থেকে নেমে একটা সরু রাস্তায় পৌঁছেছে। সরু রাস্তায় হাঁটছে। কোথায় যাচ্ছে জানে না আর্য। বেশ কয়েক দিন আগে লক্সমি বলেছিল দীপাবলীর দিন একটা ভালো জায়গায় ঘুরে দেখাবে। আর্য রাজি হয়ে গেছিল। আরও কিছুটা হাঁটার পর সে বুঝতে পারল, তারা গ্রামের দিকে যাচ্ছে। পশ্চিমবাংলার মত এখানকার গ্রামগুলো অতটা অনুন্নত নয়। পাকা রাস্তা। আশেপাশে সমস্ত ছোট-বড় বাড়িগুলো ও পাকা। দীপাবলীর রাত হওয়ায় গ্রামের পুরনো আবেগ ময় নীরবতা নেই। শহরের মতো চারিদিকে কোলাহলে পরিপূর্ণ রয়েছে। আর্য একটু অন্যমনস্ক হয়ে পরলো। মিনিট পাঁচেক পর খেয়াল করে দেখলো লক্সমি অনেকটা পথ এগিয়ে গেছে। দৌড়ে তার কাছে পৌঁছাল। বলল,”আমায় কি গ্রাম দেখাতে নিয়ে যাচ্ছ? আমিতো গ্রামের ছেলে।”
“পৌঁছে গেছি। এবার বুঝতে পারবে।” লক্সমির হাতে থাকা ব্যাগ আর্যকে দিল। আর্য হাতে ব্যাগ ধরে লক্সমিকে লক্ষ করল। সে রাস্তা থেকে ক্ষেতের জমিতে নেমে পড়ল। তার দেখাদেখি আর্যও নামল। প্রথম দিন বাসে আসার সময় এমন ক্ষেতের জমি দেখেছিল। তখন ঠিক বুঝতে পারছিল না, নারকেল গাছ গুলোর মাঝখানে কী কী সবজি গাছ রয়েছে? এখন নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছে। বাঁধাকপি আর ফুলকপির গাছ আছে। আর্য এখনো বুঝতে পারলো না, সন্ধ্যার সময় ক্ষেতের জমিতে গিয়ে কি করবে? মশার কামড় খেতে নিয়ে যাচ্ছে! বড্ড কৌতুহলী হয়ে পরলো। লক্সমিকে অনুসরণ করল। লেহঙ্গা পরে ক্ষেতের জমির মধ্যে হাঁটতে একটু অসুবিধা হচ্ছে। তাই তাকে ব্যাগ ধরিয়ে দিয়েছে। দুই হাতে হালকা লেহেঙ্গা তুলে খুব সন্তর্পনে এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে তাকে কিছুটা বাংলা সিনেমার নায়িকার মত দেখাচ্ছে। নায়ক বিপদে আছে আর নায়িকা পা থেকে হালকা শাড়ি তুলে দৌড়ে যাচ্ছে।প্রত্যেক ক্ষেতের জমিতে টিপটিপ করে বেশ কয়েকটি আলো জ্বলেছে। আজ জমির পাশের কুঠিতে প্রদীপ ও জ্বলেছে। সারিবদ্ধ ভাবে মোমবাতি বসানো হয়েছে। এক কুঠিবাড়ির সামনে এক ভদ্রলোক আড়ষ্টভাবে হাই তুলছেন। তার মেদবহুল শরীরের সঙ্গে অমানানসই পোশাক দেখে হালকা হেসে উঠলো আর্য। একটি নির্জন জায়গায় দুজন নারী পুরুষকে দেখে মোটেও অবাক হলেন না তিনি। একটা জোরে হাঁক ছেড়ে বললেন,”লক্সমি মা নি কি রে!”
“হ্যাঁ, প্রদীপ জ্বালাতে যাচ্ছি।”
“সাবধানে যাস মা।” আর্য ভীষন অবাক হলো। এই নির্জন জায়গায় প্রদীপ জ্বালাতে যাচ্ছে। মনের মধ্যে কৌতুহল আরও জেঁকে বসলো। কোনোরুপ প্রশ্ন করল না। একটু ধৈর্য ধরলে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে। আরও কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর উক্ত স্থানে পৌঁছে গেল। একটা বিশাল ক্ষেতের জমি। তবে এখানে নারকেল গাছ কিংবা কলাগাছ কোনোটাই নেই। চারিদিকে ফাঁকা ভুতুড়ে এলাকা। দেখলে বোঝা যায়, বহু বছর ধরে এখানে কোনো চাষবাস হয়নি। আগাছা গুলো অনেক বড় হয়ে গেছে। বেশ জোরালো বাতাস বইছে। অচেনা মানুষ মুহূর্তের মধ্যে ভয় পেয়ে যাবে। আর্য এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে দেখল পাশের ক্ষেতের জমিগুলোর মালিক রয়েছে। চারিদিকে অনেক বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বলছে। ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আরও কিছুটা এগিয়ে যেতে দেখল একটা ছোটো খড়ের কুঠিবাড়ি। পূর্বের গুলোর মত অত সাজানো-গোছানো নয়। অনেক পুরনো। ভেঙ্গে পড়েছে। বহু অংশে খড় পচে গেছে। আবার কোথাও কোথাও খড়ের লেশমাত্র নেই। লক্সমি সেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। পেছনে পেছনে আর্যও। ভেতরে একটা পুরনো খাট এবং মাটির কলসি পড়ে আছে। আর্যর এমন দৃশ্য দেখতে বেশ ভালো লাগলো। দেখে বোঝা যাচ্ছে এই ঘরে এক সময় মানুষের আনাগোনা ছিল। অনেকগুলো রাত এখানে কেউ কাটিয়েছে। লক্সমি আর্যর কাছ থেকে ব্যাগ নিয়ে নিল। ব্যাগ থেকে অনেকগুলো প্রদীপ এবং মোমবাতি বার করলো। তারপর,ওই গুলোকে সারিবদ্ধ ভাবে বসিয়ে জ্বালালো। মাথা ঠুকে প্রণাম করলো। লক্সমির দেখাদেখি আর্যও প্রণাম করলো। দীপাবলীর সন্ধ্যায় এমন এক ললিত দৃশ্যের মুখোমুখি হবে স্বপ্নেও ভাবেনি। সবকিছু সিনেমার মতো লাগছে। শরীরের সমস্ত অন্ধকার দূরে কোথাও সরে গিয়ে স্বর্ণ আলোয় ভরে গেছে। খুশির আলোয় ভাসছে। অল্প সময়ের পর দুইজন বাইরে বেরিয়ে আসলো। পাশাপাশি দাঁড়ালো। দূরে মৃদু বাতাসে সন্ধ্যামালতী দুলছে। আগাছাগুলো বাতাসে আঘাত পেয়ে সাঁইসাঁই শব্দ করে উঠছে। চারিদিকে এক নাগাড়ে ঝিঁঝিঁপোকা ডেকে চলেছে। মানুষের উপস্থিতিতে কয়েকটা শিয়াল দৌড়ে নিরাপদ জায়গায় চলে গেল। মাত্র হাতে গোনা তিনটে নারকেল গাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে।আগাছা ভর্তি হয়ে যাওয়ায় বহু বছর আগে কাটা নারকেল গাছের গোড়া গুলো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে কাছে দাঁড়ালে একটু একটু বোঝা যাচ্ছে। আর্য ঠিক বুঝতে পারল, এত সৌন্দর্যের মধ্যে কোথাও একটা মন খারাপের গল্প লুকিয়ে রয়েছে। তাইতো আজ এত সুন্দর প্রাণবন্ত জায়গায় প্রাণহীন হয়ে আছে। নিশ্চুপ নিরব পরিবেশ। হালকা অন্ধকার আর হালকা আলোয় মুড়ে রয়েছে এক মুঠো অভিমান। কারোর ধূসর চোখের জল লুকিয়ে রয়েছে। এমন খুশির মুহূর্তে লক্সমিকে প্রশ্ন করে অস্বস্তির মধ্যে ফেলতে চাইল না। অনেক প্রশ্ন নিজের মধ্যে সুপ্ত রাখল। কিছুক্ষণ মৌন হয়ে রইল। আর্য মৌনতা ভেঙে বলল,”এই ক্ষেতের জমি তোমাদের। তাই না!”
“হুম, কি করে বুঝলে?” লক্সমি আর্যর দিকে তাকালো।
“আমি চাষির ছেলে। আমার এমন বহু অভিজ্ঞতা রয়েছে।” লক্সমি হালকা হাসলো। তারপর ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে একটা ভাঙ্গা বাঁশ দিয়ে বাঁধানো বেঞ্চের উপর বসল। পাশে আর্যও বসলো। সেখানেও আগাছায় পরিপূর্ণ। সাপের ভয় রয়েছে। তাই জুতো খুলে পা মুড়ে বসলো। লক্সমি তার পুরনো হাসি ঠোঁটে ফুটিয়ে বলল,”জানো, এই জমিতে আমার অনেক স্মৃতি রয়েছে। ছোটবেলায় এই জায়গায় কত খেলেছি, দৌড়েছি, মারামারি করেছি তার কোনো ঠিক নেই। ওই যে ছোট্ট কুটির দেখছো ওইখানে রাতের বেলায় আমার বাবা থাকতো। কিন্তু মা বাবাকে এমন নির্জন জায়গায় একা থাকতে দিত না। মাঝেমধ্যে মাও চলে আসতো। আবার অনেক সময় গভীর রাতে বাবা এখান থেকে পালিয়ে যেত। বাবা আর মা একে অপরকে না হলে চলতো না। খুব ভালোবাসতো দুজন দুজনকে। আমারও ভালোবাসায় কখনো অভাব পড়েনি। আজও সমানভাবে ভালোবাসা পেয়ে যাচ্ছি। আমি প্রত্যেক বছর এখানে এসে প্রদীপ জ্বালাই। রাতে জায়গাটিকে যতটা সুন্দর দেখাচ্ছে দিনে কিন্তু অতটা সুন্দর দেখায় না। আমার একটু ভূতের ভয় রয়েছে। রাতে আসতে ভয় পাই। রাতে আমার সঙ্গে কেউ আসতেও চায় না। অথচ আমার বাবা এখানে রাতের পর রাত একা কাটিয়েছে। আসলে, কোনো বাবাই কোনো কিছু ভয় পায় না। প্রতি বছর দীপাবলীর দিন আমি বিকালে এসে এখানে প্রদীপ জ্বালিয়ে দিই।রাতে আশা সম্ভব হয় না। এবার তোমার সঙ্গে পরিচয় হয়। বুঝেছিলাম তুমি ব্রাহ্মণ ভয় পাবে না। তাই তোমাকে নিয়ে চলে আসলাম। না জানিয়ে তোমাকে নিয়ে এসেছি কিছু মনে কর না।” লক্সমি থামল। আর্য কোনো উত্তর করলো না। বড্ড আশ্চর্য হলো। এখানকার মানুষরাও ব্রাহ্মণকে আলাদা চোখে দেখে। তারা ভয় পেতে পারে অথচ ব্রাহ্মণ ভয় পেতে পারে না। এ কেমন কথা? তারাও আর চারজন মানুষের মতো সাধারণ। তাদের মধ্যে কোনো অলৌকিক ক্ষমতা নেই। আর্যকে কিছু বলতে না দেখে লক্সমি আবার বলল,”জানো,আমি এখানে কত নারকেল ডাব চুরি করে খেয়েছি, তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। চুরি করার প্রয়োজন পরতো না তবুও চুরি করতাম। ছোটবেলায় বাড়ির খাবার জিনিস চুরি করলে কেমন একটা আনন্দ হতো। তুমি কখনো চুরি করেছো?”
“হুম,করছি তো। আমি অনেকবার চুরি করে স্নেহাকে দেখেছি।” হঠাৎ করে আর্য কল্পনার মধ্যে ডুবে পরল। লাক্সমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে খিল খিল করে হেসে উঠল। কী সব কথা বলছে? চুরি করে কাউকে দেখা যায় নাকি!চুরি করে আবার কিভাবে দেখবে? আর্য প্রসন্ন হাসি হেসে বলল,”আমি স্নেহাকে সামনে থেকে অনেকবার দেখেছি। সামনাসামনি বসে গল্প করেছি। কিন্তু বেশিরভাগ সময় চুরি করে দেখতাম।যখন তোমার সামনে কেউ থাকবে তখন স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করবে সে। যতই পরিচিত হোক না কেন সে একটু ভেবেচিন্তে কথা বলবে। কিন্তু সে যখন একা থাকবে তখন এগুলোর কোনো কিছুই করবে না। আসল রূপ ফুটে উঠবে। সাজানো-গোছানো নয় আমি তার প্রকৃত রূপকে ভালোবেসেছি। স্কুলে কিংবা টিউশনে প্রায় সময় স্নেহা আমার পাশে বসতো। আমি কখনো তাকে দেখতাম না। আমিতো লুকিয়ে লুকিয়ে চুরি করে দেখতাম। লুকিয়ে লুকিয়ে একা চোখ মারতাম। তার বইয়ের যে পাতা ছেঁড়া থাকতো আমি ইচ্ছে করে আমার বইয়ের সেই পাতা ছিঁড়ে ফেলতাম।তার যে বইয়ের কভার দেওয়া থাকতো না আমিও সেই বই কভার দিতাম না। আমি তাকে সম্পূর্ণ অনুসরণ করতাম। এখন যে করি না, তা কিন্তু নয়। তার উজ্জ্বল মুখশ্রী,কানের কাছে কাটা অংশ, ঘাড়ের কাছে তিল, ঢিপঢিপ করতে থাকা ছোট্ট দুটো চোখ, ঠোঁটে পাগল করা হাসি, খুব সহজ সরল ব্যবহার আমাকে বারবার মোহিত করে। আমি উষ্ণতায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠি। তাকে সামনে থেকে দেখলে অদ্ভুত রহস্যময় রঙ্গে রঙ্গিন হয়ে ওঠে আমার হৃদয়।” অপলক চোখে লক্সমি আর্যর মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনলো। কথা গুলোর মধ্যে কত মাধুর্যতা এবং গভীর ভালোবাসা রয়েছে।আর্যকে একবার দেখলে মনে হয় খুব আনরোমান্টিক আবার কোনো এক বিশেষ মুহূর্তে দেখে মনে হয় খুব রোমান্টিক। আসলে সে কেমন? -তা সাধারণ মানুষ বলতে পারবে না। তার চরিত্রের সঠিক উন্মোচন হয়তো একজন কবিই করতে পারবে। লক্সমি আবার হাসল। লক্ষ্য করল আর্য বড্ড অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে। কোমল স্বরে বলল,”আচ্ছা, আর্য, তোমার কাছে ভালবাসার মানে কি?”
“আমার কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞাটা খুব ছোট। যাকে ভালবাসবে তাকে তার শেষ বসন্ত পর্যন্ত ভালবাসতে হবে। ভালোবাসা না পেলেও ভালবাসতে হবে। মন থেকে ভালবাসতে হবে।” তার কথা শোনে লক্সমি নিজেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। তার কথার মধ্যে প্রচুর পরিমাণে আবেগ রয়েছে। তার বাক্যগুলো কোনো এক সচেতন মানুষকে হঠাৎ করে প্রেমের স্রোতে ভাসিয়ে দিতে সক্ষম। পড়ন্ত বিকেলে কোনো এক প্রেমিক যেন তার প্রেমিকাকে গল্প শোনাচ্ছে। গল্পের লাইনগুলো অজস্র আবেগে মাখা। যেন আবেগ দিয়ে গল্পের লাইনগুলো লেখা হয়েছে। আর্য এবার বিপন্ন মুখে বলল,”আমার কাছ থেকে সবকিছু জেনে নিচ্ছ। নিজে তো কিছু বলছো না। বড্ড স্বার্থপর তুমি।” লক্সমি জবাব না দিয়ে শুধু হাসলো। একে অপরের দিকে তাকালো। কোনো কারন ছাড়াই লক্সমি লজ্জা পেতে শুরু করলো। কেমন একটা লাগছে তার। মুখ সরিয়ে দূরের ফাঁকা ময়দানের দিকে তাকিয়ে রইল। তার অবচেতন মন কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছে।
“তোমার কাছে ভালবাসার মানে কি?” আর্য বলল। হঠাৎ আর্যর এমন প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল লক্সমি। একটু ভেবেচিন্তে তার ভাবনা গুলো সাজালো।ঢোক গিলে বলল,”তোমার আর আমার চিন্তার মধ্যে অনেক পার্থক্য।তোমার ভালোবাসার সংজ্ঞা আমার ভালোবাসার সংজ্ঞার মধ্যে প্রচুর বৈসাদৃশ্য রয়েছে। আমার কাছে ভালোবাসা মানে শুধু মন পাওয়া নয়। আমার সব কিছু প্রয়োজন। মন যৌবন শরীর সবকিছু ছাড়া ভালোবাসা অসম্পূর্ণ।আমি যাকে ভালোবাসবো তার কাছ থেকেও এই তিনটে জিনিস চাইবো। কোনো একটির অতৃপ্ততায় আমি আমার ভালোবাসা পূর্ণ করতে পারবো না…..।” লক্সমির কথার সুতো ছিঁড়ে গেল সামনে আলো স্তম্ভ মতো কিছু একটা পড়ে যাওয়ায়। একটু ইতঃস্তত বোধ করলো। এই সময় কে কি ফেলতে পারে? লক্সমি তাকে শান্ত হতে বলল। উত্তেজিত হওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। আকাশের দিকে তাকাতে বললো। লক্সমির কথামতো আর্য আকাশের দিকে তাকিয়ে অবাক হলো। অসংখ্য ফানুস আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। তার মধ্যেই একটা পড়ে গেছে। দীপাবলী মানে ফানুস, ফানুস মানে দীপাবলি। দীপাবলির রাতে আকাশে ফানুস উঠবে না, -তা কি হয়? আর্য বেঞ্চ থেকে নেমে পড়লো। পকেটের মধ্যে হাত ভরে শূন্য আকাশের দিকে তাকালো। অমাবস্যা রাত হলেও আকাশে মিটমিট করা তারা এবং ফানুসের হালকা আলোয় উবে গেছে ঘন অন্ধকার। আলোকময় ধারা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। চারিদিকে বেশ শান্ত নির্জন পরিবেশ। হালকা শীতল বাতাস গায়ে লাগছে। আজ জ্যোৎস্নার আলো গায়ে মাখতে সুন্দর লাগছে। আর্য মৃদু কণ্ঠে বলল,”আমি যদি গ্রামে থাকতাম তাহলে অনেক মজা করতাম। প্রতিবছর বাবা ছয়টা ফানুস নিয়ে আসতো। আমরা ছয় ভাই-বোন একসঙ্গে ফানুস উড়িয়ে দিতাম।”
“তুমি না বলে ছিলে তোমার তিন ভাইবোন। এখন ছয়জন কি করে হলো?”
“কাকু-কাকিমার তিনটে মেয়ে রয়েছে না! বাবা তাদের জন্য ও আনতো। আবার কাকুও ছয়টা ফানুস কিনে আনতো। তোমাদের দীপাবলি একদিন হয়। আমাদের তো দুদিন, প্রথমদিন কালীপুজো তারপর দিন দীপাবলি।একদিন বাবার দেওয়া ফানুস আর একদিন কাকুর দেওয়া ফানুস…। কত সুন্দর ছিল ওই সব দিন।”
শীত আসতে আর বেশি দিন বাকি নেই। এখানে গভীরভাবে শীত অনুভব করার অবকাশও নেই। সারা বছর তাপমাত্রা তেমন একটা হেরফের হয় না। আজ কলেজে বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এর জন্য কয়েকদিন ধরে ভালো মতো ক্লাস হয়নি। গত বছর অসুস্থ থাকায় অনুষ্ঠানের সঙ্গে তেমন একটা পরিচিত নয় আর্য। এবার অনুষ্ঠান নিয়ে অতিরিক্ত একটা কৌতুহল জেগে বসেছে। এখানকার তেমন একটা অনুষ্ঠান দেখা হয়নি। সবকিছুর মত অনুষ্ঠানেও নিশ্চয়ই ভিন্নতা রয়েছে। সন্ধের সময় একা কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। অনেক আগে লক্সমি কলেজে পৌছে গেছে। অনুষ্ঠান পরিচালনা করবে সে, তা জানার পর থেকেই আর্যর মনের উজ্জ্বলতা বেড়ে যায়। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা আছে এই অনুষ্ঠানের জন্য। কলেজে পৌছে দারুন একটা ঝটকা খেলো। একটাও মেয়েকে দেখা গেল না যে জামা পরেছে। সবাই শাড়ি নয়তো লেহেঙ্গা পরেছে। সমস্ত ছেলরাও একটা দৃষ্টিনন্দন পোশাক পরে আছে। তারা কেউই স্যুট প্যান্ট পরেনি। সবাই ধুতি আর শার্ট পরেছে। তবে বাঙালিরা যেভাবে ধুতি পরে, বিশেষ করে ব্রাহ্মণরা, ওইভাবে নয়। বাঙালি যেভাবে লুঙ্গি পরে কখনো গুছিয়ে আবার কখনো পুরোটা ছেড়ে দিয়ে, সবাই ওই ভাবে পরেছে। এমন দৃশ্য যে কোনো মানুষকে বড্ড আশ্চর্য করে তুলবে। এখানকার রুচি এবং শখ শৌখিনতা চরমে রয়েছে, তা বোঝা যায়। মানুষগুলোর নিজেদেরকে প্রচুর সময় দেয়। নিজেদের জন্য অনেক ভাবে। ছেলে হোক মেয়ে সাজুগুজু করতে সবাই পছন্দ করে।
দর্শকের একদম পেছনে সিমেন্টে বাধা একটা বেঞ্চের উপর বসলো আর্য। সেখানে বসা মাত্রই আরিফুল এসে উপস্থিত হলো। সেও আজ ধুতি আর শার্ট পরেছে।
“কি ব্যাপার, তুমিও ধুতি পরেছ?”
“সবাই পরেছে তাই আমিও পরে নিলাম। এখানকার কালচারটাই এমন। বিয়েবাড়ির হোক বা কোনো বিশেষ অনুষ্ঠান সব সময় এরা ধুতি পরবে।সবাই পরেছে নিজেকে কেমন একটা ব্যতিক্রম ব্যতিক্রম লাগলো।।”
“এখানকার কালচার বড্ড সুন্দর তাই না! মানুষগুলোর মধ্যে একতা রয়েছে। আমাদের বাঙালির মতো পেছনে টানার স্বভাব নেই। একটা অনুষ্ঠানে এসেছে দেখো সবাই এক পোশাক পরেছে। সবাই নিজেদের সংস্কৃতি ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। আর আমরা তো নিজেদের সংস্কৃতি ঐতিহ্য ধরে রাখতে লজ্জাবোধ করি।”
“একদম। একতার অভাবে আজ আমরা বড্ড অসহায়।”
আরিফুল পাশে এসে বসল। তারপর জোরে একটা হাই তুলল।তার চোখ মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে বেশ কয়েকটা রাত ঘুমোয়নি। যদিও হোস্টেলে বিষয়টির মধ্যে কোনো নতুনত্ব নেই। বিকেলের শেষ সূর্যরশ্মি তাদের সামনে এসে পড়েছে। সূর্য রশ্মির মধ্যে একটা জ্বলজ্বলে ভাব আছে।আরিফুল নাড়াচাড়া করতেই সূর্যরশ্মি আর্যর চোখে এসে লাগছে। তাই থাকে স্থির হয়ে বসতে বলল।অল্প সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠান শুরু হল। সন্ধ্যা হতে সামান্য বাকি।প্রথমের দিকে অনুষ্ঠান একটু ভালো লাগলেও পরে একদম ভালো লাগলো না। পুরোটাই কর্নাটকের ভাষায় হচ্ছে। বুঝতে বড্ড সমস্যা হচ্ছে। লক্সমি খুব সুন্দরভাবে পরিচালনা করছে তার সঙ্গে আরও একটি মেয়ে রয়েছে। দুজনেই দুর্দান্ত করছে।সন্ধ্যা হওয়ার পর আর্য খেয়াল করলো আরিফুল ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আর্য মতো তারও অনুষ্ঠান পছন্দ হচ্ছে না। পছন্দ না হওয়ার তেমন কোনো বিশেষ কারণ নেই । আসলে, ভাষাগত সমস্যা ঘন হয়ে রয়েছে। স্টেজে দাঁড়িয়ে বন্ধু-বান্ধবীদের করা গান আবৃত্তি বক্তব্য ঠিকমত বুঝতে পারছে না। আর্য একটু বিরক্ত হয়ে শেষমেষ স্নেহাকে ফোন করল। তার সঙ্গে খোশগল্পে জড়িয়ে পড়ল। অনেকক্ষণ গল্প করার পর স্নেহা বলল,”তুই একবার চলে আয় গ্রামে। কতদিন সামনাসামনি বসে গল্প করিনি। বলতে বলতে দু’টো বছর হয়ে গেল।”
“যাব তো।”
“কবে? বাড়ি ছেড়ে দুটো বছর বাইরে পড়ে আছিস। একবার এসে ঘুরে যাস। বাবা-মাকে সামনে থেকে দেখলে ভালো লাগবে, আবার কাকু-কাকিমাও তোকে দেখলে তাঁদের ভালো লাগবে।”
“সবকিছু বুঝি। কিন্তু সম্ভব হয় না। কলেজ খুব বেশি হলে পনেরো দিন ছুটি দেয়। আমার যেতে আসবেই তো ছয় দিন লেগে যায়।”
“তাও চলে আয়। বাবা-মার কাছে পাঁচ দিন থাকলেও অনেক।”
“সামনে ক্রিসমাসে অনেকগুলো ছুটি থাকবে। ওই সময় গিয়ে ঘুরে আসব।”
“সত্যি তো?”
“হ্যাঁ রে বাবা। বলেছি মানে ঠিক যাব।”
অনুষ্ঠান শেষ হতে প্রায় রাত নটা বেজে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই জায়গা ফাঁকা হয়ে গেল। চলতে থাকা অনুষ্ঠান হাহাকারে ভরে উঠলো। আশ্চর্য ব্যাপার! কয়েক ঘণ্টার আগে এখানে লোকে-লোকারণ্য ছিল। অথচ এখন ফাঁকা ময়দান। খাঁ খাঁ বিরাজ করছে। শিক্ষক শিক্ষিকাসহ উপস্থিত সবাই দ্রুত চলে গেলেন। আর্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল লক্সমির জন্য। তার কোনো তাড়া নেই। লক্সমিকে একা ফেলে যেতে মন চাইল না। আর আসতে একটু দেরি হবে বুঝতে পারলো। কিছুক্ষণ পর আসলো সে।সময় প্রায় সাড়ে নটা। আর্য তার কাছে গিয়ে বলল,”খুব সুন্দর হয়েছে। দারুন ভাবে পরিচালনা করেছে। জানতাম না তো তুমি পরিচালনা করতে পারো।”
“থ্যাঙ্ক ইউ। আমার সঙ্গে যাবে না বাসে!” বলে হেসে উঠল।
“তোমার সঙ্গেই যাব।” দুজনে হালকা হেসে উঠলো। তারপর স্কুটারের উঠে বসলো। মেধাহালি মসৃণ রাস্তায় গাড়ি হালকা ছুটে চলল। রাতের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। অসংখ্য পুলিশ গাড়ি রাস্তায় নেমেছে। প্রায় দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। উভয়ই এখানকার নিয়মের সম্পর্কে খুবই পরিচিত। এখানে রাতের নিয়ম বড্ড কড়া। রাত দশটার পর এখানে উচ্চস্বরে চিৎকার কিংবা হালকা বক্স বাজানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।এমনকি রাত বারোটার পর বার্থডে অনুষ্ঠানে কেক কাটলেও সেই আওয়াজ রুমের বাইরে কিছুতেই বের হবে না। এই আইন অমান্য করলে মোটা অংকের টাকা জরিমানা দিতে হবে।দশটার মধ্যে সমস্ত অপ্রয়োজনীয়’ দোকানপাট বন্ধ করে ফেলতে হয়। সারি সারি পুলিশ শহরের অলিতে গলিতে প্রবেশ করে যায়। কোনোরূপ অকৃতিকর ঘটনা ঘটতে দেয় না। কেউ বিপদে পড়লে তাকে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পুলিশের। কোনো বাক্য ব্যয় ছাড়াই এগিয়ে গেল তারা। আর্যকে বাড়ির সামনে ছেড়ে দিয়ে লক্সমি বেরিয়ে গেল। আর্য কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে নিঝুম হয়ে যাওয়া শহরকে দেখলো। রাতের নিস্তব্ধতায় শহরটিকে দেখতে বড্ড ভালো লাগছে। লক্ষ করল, তাদের গলিতেও পুলিশের গাড়ি ডুকছে। সে ভাবতে লাগলো এমন নিয়ম ভালো না খারাপ। ভাবতে গিয়ে আবিষ্কার করল এই নিয়ম খারাপ না আবার অতটা ভালোও নয়। মাঝখানে গিয়ে থেমে গেল। কাউকে বেশি এগিয়ে রাখল না। এমন সময় বিদ্যুত চলে গেল। চারিদিকে নিস্তব্ধতা তীব্র হয়ে উঠল। এই শহর আরও সুন্দর হয়ে উঠল। রাতের অন্ধকারে শহরটিকে দেখতে বড্ড সুন্দর দেখাচ্ছে। গ্রামবাংলায় যেমন কারেন্ট পৌঁছলে সুন্দর দেখায়, তেমনি শহরে কারেন্ট চলে গেলে অন্ধকারে শহরটিকে দেখতে বড্ড সুন্দর লাগে। দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতি হঠাৎ করে উপস্থিত হলে সুন্দর তো দেখাবে। আজ শহরটিকে নিজের প্রেমিকা মনে হচ্ছে।
পর্ব ১৮ আসছে।।