কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ পর্ব-২০

0
137

কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ
পর্ব ২০
__________________
কফি হাউসের কিছুটা দূরে একটা মন্দির রয়েছে।মন্দিরের গা ঘেঁষে বেরিয়ে গেছে দীর্ঘ সরু এক রাস্তা। আজ তারা আবার শহরে এসেছে। আর্যকে আজ মুখ ফুটে বলতে হয়নি হাত ধরার জন্য। স্নেহা প্রথম থেকেই আর্যর হাত নিজের হাতে বন্দি করে রেখেছে। সরু রাস্তার দু-দিকে সারি সারি অসংখ্য কৃষ্ণচূড়া গাছ হয়েছে। দু’পাশে এবং মাথার উপর অসংখ্য শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে। তবে শীতকাল হওয়ায় তারা পাতা ঝরিয়ে ন্যাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।বিকেলের শেষ সূর্যরশ্মি শাখা-প্রশাখার ছোট্ট ফাঁক দিয়ে এসে স্নেহার চুলে পড়েছে। সূর্যের আলোয় চুলগুলো ঝকঝক করছে। খুব নমনীয় লাগছে। বড্ড সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। আর্যর চুল স্পর্শ করতে ইচ্ছে করলেও সাহস পেল না। দিগন্তে চাষীরা সোনালী ফসল তুলতে ব্যস্ত। ক্লান্ত মাখা শরীর নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে তারা। প্রত্যেক দিনই এই পথে কত নতুন কত পুরনো যুগলবন্দি হেঁটে বেড়ায়। কল্পনার বেড়াজাল পেরিয়ে যায়।সবকিছুই চাষীরা চোখে বন্দি করে।দিগন্তে কাজ করলেও মাঝে মাঝে তাদের চোখ এই সরু রাস্তায় চলে আসে। পুলকে ভরে ওঠে। একসময় তারাও কোনো গলিতে এভাবে হাতে হাত রেখে ঘুরেছে। হাজারো মুহূর্ত বন্দি করেছে। আর সম্ভব হয় না এমন মুহূর্ত তৈরি করার। অন্যের মুহূর্ত দেখে নিজেই মনে মনে মুহূর্ত তৈরি করে ফেলে। খুশি হয়। ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।
অনেকটা পথ হেঁটে চলে এসেছে দুজন। আরও কিছুদূর হাঁটতে চায়। কাল যখন স্নেহা আর্যকে কিছুটা সময় হাঁটার কথা বলেছিল, তখন আর্য কবিতার ছলে বলেছিল সন্ধ্যায় হাঁটবে। স্নেহা যথেষ্ট বইপ্রেমী। অনেক প্রেমের উপন্যাস পড়েছে। আর্যর দয়ালু মাখা কণ্ঠস্বরে বলা কবিতার আসল অর্থ বুঝতে পেরে যায়। তাই আর্যকে অনেক দূরে নিয়ে যাচ্ছে। ফেরার সময় সন্ধ্যে হয়ে যাবে। আর্যর কথামতো সন্ধ্যায় নতুন করে হাঁটবে। অনেকক্ষণ মৌন থাকার পর আর্য খেয়াল করে দেখল, স্নেহার চোখে জল বিন্দু টিপটিপ করছে। এ চোখের জল কোনো আনন্দের মুহূর্তৈর জন্য নয়। চোখেমুখে করুন ছাপ রয়েছে। কোনো কিছুতে মগ্ন আছে। আর্য তার মোহভঙ্গ করতে চাইল না। অল্প সময়ের পর স্নেহা নিজে থেকে বলল,”জানিস তো, আমি মন থেকে বিশ্বাস করি মানুষ একবার নয় বারবার প্রেমে পড়তে পারে। ঠিক হুমায়ুন স্যারের কথা মত। কিন্তু প্রথম প্রেম যার সঙ্গে হয়, যার চোখ দেখে প্রেমের অর্থ বুঝতে পারি, তাকে কোনোদিন ভোলা যায় না। যদি প্রথম প্রেমটা সত্যি হয়, তাহলে, নতুন করে সবকিছু সৃষ্টি হলেও পুরনো মানুষটা হৃদয়ে কোথাও না কোথাও থেকে যায়। গতকাল রাতে নিজেকে অনেক বুঝিয়েছি। আমার বয়স অল্প। এই বয়সে ভেঙ্গে পড়লে হয় না। নতুন করে আবার সবকিছু শুরু করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কই পারছি?” স্নেহার কণ্ঠস্বর ভেজা। তার কথা শুনে একটু ভেবে নিল আর্য। এলোমেলো যুক্তিগুলো তাড়াতাড়ি সাজিয়ে বলল,”আমি জানি। তুই এখনো ওই মানুষটাকে ভুলতে পারিসনি। ভোলার দরকারও নেই …।” আর্যর কথায় বাধা দিয়ে তাড়াতাড়ি কাঁদো কাঁদো গলায় স্নেহা বলল,”তুই সব জানিস হনুমান। নিজে তো কয়েকটা বছর কেঁদে ভাসিয়েছিস আর এখন আমাকেও।” স্নেহাকে হঠাৎ করে কাঁদতে দেখে বড্ড অবাক হলো আর্য। হঠাৎ করে ভেঙে পড়লো কেন? মানুষের আনাগোনা কম তবুও বাইরে কাঁদার দৃশ্য ভালো লাগলো না।
“তুই কাঁদছিস কেন? কি হলো তোর?”
“আমি তো কোনোদিন কারোর কিছু ক্ষতি করিনি‌। সবার ভালো চেয়েছি। পরিবারের সাথে তোদের সাথে বড্ড হাসি খুশি ছিলাম। ও নিজে এসে হৃদয় ভরিয়ে দিল আবার নিজে হৃদয় ভেঙ্গে চলে গেল। মানুষ কেন এতটা নিষ্ঠুর হয় বলতো? ওই মানুষটা যদি না আসতো তাহলে আজ তোর আর আমার মধ্যে কোনোরকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকতো না। খুব গভীরভাবে ভালবাসতাম তোকে। তুই যতটা আমাকে ভালোবাসিস আমিও ততটা ভালোবাসতাম।”
“আমরা যাকে সব সময় কাছে পেতে চাই তাকে কখনো পাই না। যদি পাই তাহলেও বিতর্কিত ভাবে।” স্নেহা এতটাই ইমোশনাল হয়ে পড়েছে যে প্রতুত্তর করতে পারল না। আর্যর আরও অনেকটা কাছে এসে শক্ত করে ধরল। দু-চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরিয়ে দিচ্ছে। একবারও উপরের দিকে তাকিয়ে দেখছে না। বুকের ভেতর থেকে গোঙানির শব্দ বেরিয়ে আসছে। বড্ড কাঁদছে সে। তাকে কিভাবে সান্ত্বনা দেবে বুঝে উঠতে পারল না। তাকে কি বলে সান্ত্বনা দেওয়া যায়, ঠিক জানা নেই আর্যর। মিনিট দশেকের পর আর্য বলল,”চোখের জল কি এত সস্তা! শুধু ফেলছিস। চোখের জল মুছে ফেল বলছি..।”
স্নেহা তাও থামল না। সে দাঁড়িয়ে পরল। হাঁটতে শক্তি পাচ্ছে না। আর্য আবার বলল,”এবার তো থাম। এত কষ্ট নিয়ে কি করে বেঁচে আছিস। তোর বাবা-মা তো আছে, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। তাদেরকে সব কিছু বল। দেখবি ভালো লাগবে।”
স্নেহা এবার নিজের আঙ্গুলের ডগা দিয়ে চোখের জল ধীরে ধীরে মুছে ফেলল। একটু আশ্চর্য হলো। ভেবেছিলো, আর্য নিজের হাতে তার চোখের জল মুছে দেবে। তাকে বড় বড় কথা শোনাবে। তেমনটা কিছুই করলো না। স্নেহা বুঝলো, আর্য আর চার-পাঁচটি ছেলের মত ছেলে নয়। কারোর ইমোশনকে কাজে লাগিয়ে কাছে টেনে নেবে।কিংবা ইমোশানকে কাজে লাগিয়ে নিজের স্বার্থের কথা ভাববে। আর্যর কাছে বড় সুযোগ ছিল। স্নেহার চোখের জল মুছে দিতে পারতো। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলতো, আমিতো আছি সবকিছু ঠিক করে দেবো। এগুলো কিছু না করে সে নিজের বাবা-মাকে ভরসা করতে বলল। কারণ,পৃথিবীর প্রথম আপনজন বাবা-মা। আর্যর যে গায়ে ঘেঁষা ছেলে নয় বুঝতে পারল স্নেহা। নতুন করে চিনলো। স্নেহা আর্যর ব্যবহারে মুগ্ধ হলো। একগাল হেসে ফেললো। তাকে কাঁদতে কাঁদতে হাসতে দেখে একটু আশ্চর্য হলো বটে তবে মনে মনে ভীষণ খুশি হলো। মানুষের চোখেমুখে পুলকই বেঁচে থাকার আসল চাবিকাঠি।
“তুই এখনই বাচ্চার মতো ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছিলিস না!আবার এখন দাঁত কেলিয়ে হাসছিস?”
“তোর মতো নাকি! একবার কষ্ট পেলে ওই কষ্টকে সারা জীবন বয়ে বেড়াবো।”
“তোর মতো ভ্যা ভ্যা করে কাঁদি তো না?”
“আমি জানি, কে কাঁদে আর কে কাঁদে না।”
“হুশশশ, চলতো।”
দুজনের দিকে দুজন তাকিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করল। স্নেহার পরবর্তী ব্যবহারে আর্য বড্ড চমৎকৃত হলো। কিছুক্ষণের আগে কেঁদে ভাসিয়ে দেওয়ার মানুষটি এখন হেসে উড়ে বেড়াচ্ছে। অচেনা কোনো মানুষ দেখলে বুঝতে পারবে না তার বুকের মধ্যে কতটা হাহাকার রয়েছে। অপ্রাপ্তির বেদনা পুড়িয়ে মারছে।হৃদয় কতটা পোড়া আর রক্তাক্ত। অল্প হাঁটার পর স্নেহা বলল,”এই দেখ না..। কতগুলো বছর হলো তোর সঙ্গে পরিচিত, অথচ তোর হবিটাই জানা হয়নি। তোর হবি কি রে?”
“চাঁদ দেখা, জ্যোৎস্নার আলো মাখা।”
“সে কি রে? এগুলো আবার হবি হয় নাকি?”
“হ্যাঁ হয়।” স্নেহা নিরুত্তর রইল। আর্য গভীর ভাবনায় ডুবে গেছে বুঝতে পারল। তার ভাবনায় নিজেকে কল্পনা করতে ভালো লাগলো। স্নেহা একটু চালাকি করে দয়া মাখা কন্ঠে বলল,”তুই আমার একটা কুৎসিত রূপের কল্পনা কর তো?”
“না।”
“কেন?”
“কুৎসিত কেন আমি তোর স্বাভাবিক রূপও কল্পনা করতে পারবো না। যদি আমার কল্পনার মধ্যে তোর সৌন্দর্যের ঘাটতি পড়ে যায়, তাহলে?” আর্যর কথা শুনে স্নেহার সারা শরীর হঠাৎ শিরশিরিয়ে উঠলো। একরাশ স্তব্ধতা নেমে আসলো। একমুঠো মন খারাপের গল্প মুহূর্তে ভালো হয়ে গেল। আর্যর ছোট ছোট চোখের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হতে চাইল। ভালোবাসা মানে শুধু সৌন্দর্য নয়, ভালোবাসা মানে সম্মান,শ্রদ্ধা আর বিশ্বাস। আজ আর্যকে দেখে তা বুঝতে পারছে। তার কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞাটা একটু জটিল আরেকটু সহজ। ঠিক কতটা জটিল আর কতটা সহজ বলা সম্ভব নয়। স্নেহা তার চোখের দিকে সংজ্ঞাহীন ভাবে তাকিয়ে আবার বলল,”তোকে বিয়ে করার পর আমি কতটুকু স্বাধীনতা পাবো?”
“তুই তো পরাধীন নয় যে স্বাধীনতার প্রশ্ন উঠবে।” মনের মত উত্তর পেলো স্নেহা।কয়েক বছর আগে বলা কারোর কথার সঙ্গে আর্যর কথা মিলিয়ে দেখল। তবে বেশি সময় দিতে পারল না নিজের ভাবনায়।
আঁকাবাঁকা সরু রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তারা একসময় অনেক দূরে চলে এসেছে। স্নেহার মন আর এগিয়ে যেতে সায় দিল না। এখান থেকে হেঁটে ফিরতে অনেকটা সময় লেগে যাবে। তারপর আবার বাড়ি ফিরবে। আর্যকে সবকিছু পরিষ্কার করে বলল। আর্য মুহূর্তের মধ্যে ফিরতে রাজি হলো। স্নেহা এবার দেখেশুনে পা ফেললো। হঠাৎ করে এমনটা কেন হলো বুঝতে পারল না। দেখেশুনে পা ফেলার হেতু বুঝলো না।
“দেখেশুনে পা ফেলছিস কেন? বাচ্চা নাকি!”
“কালকে তুই কী বলেছিলিস বলতো?”
“কী বলেছিলাম?”
“নিজে বলে নিজেই ভুলে গেলি! ঠিক আছে,মনে করিয়ে দিচ্ছি।” আর্যর কাঁধে হাত চাপড়ায়। আকাশের দিকে তাকাতে বলে। তার কথামতো আকাশের দিকে তাকালো। বলল,”আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখ পাখিরা বাসায় ফিরছে। একটু মনোযোগ দিয়ে শোন পাশের বাড়ি গুলোর থেকে শঙ্খধ্বনি ভেসে আসছে।আকাশের দিকে আবার ভালো করে তাকিয়ে দেখ একটিমাত্র সন্ধ্যাতারা উঠেছে। আর এই সময় কৃষক বধু বাড়ি ফিরে তার ছোট্ট শিশুকে দুগ্ধ পান করাচ্ছে। কালকে যখন তোকে বললাম আর একটু হাঁটবো চল, তখন তুই বেশ কবির মতো কবিতা বলে একটা সময় বলে দিলে। কি ভেবেছিলি আমি বুঝতে পারবো না! কালকে রাতে তোর প্রতিটা কথায় যুক্তি দিয়ে সাজিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম তুই কোনো এক সন্ধ্যায় আমার হাত ধরে হাঁটতে চাই ছিলিস।” স্নেহার কথা শুনে ভালো লাগলো আর্যর। চোখের কোণা জলে ভিজে গেল। কল্পনায় এলোমেলো শব্দ গুলোকে সাজিয়ে একটা কবিতা বানিয়ে ফেলেছিল। ওই কবিতাটিকে স্নেহা এত সিরিয়াস ভাবে নিবে ভাবতে পারেনি। স্নেহা কবিতার মধ্যে লুকিয়ে থাকা সঠিক সময় বের করতে পেরেছে। তবে সম্পূর্ণ সঠিক সময় বার করতে পারেনি। আর্য কোনো এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যার কথা বলেছিল, শীতের সন্ধ্যা নয়। তবে স্নেহার এই সামান্য খুঁজে বেড়ানো কিংবা ভাবনায় মুগ্ধ হয়েছে। জীবনে সব সময় বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই অল্পতে খুশি থাকতে হয়। অতিরিক্ত কোনো কিছুই মানুষকে লোভী করে তুলে। মানুষ শুধুমাত্র টাকা-পয়সা কিংবা ধনসম্পত্তির প্রতি লোভী হয় না, ভালোবাসার প্রতিও লোভী। এই লোভ ধনসম্পত্তির চাইতেও বড় ভয়ঙ্কর।
“তুই তো আমার ছোটবেলার বন্ধু। বেস্ট ফ্রেন্ড। আমার মনে হয় না বিয়ের পর একে অপরকে স্বামী স্ত্রী বলে মনে করবো। সম্পর্কটা সারা জীবন ‘তুই’ ‘তে’ ‘তা’ তে রয়ে যাবে। কখনো দেখা যাবে তোর বাবা-মার সামনে তোকে ‘কুত্তা’ ‘হনুমান’ বলে গালি দিচ্ছি। আবার কখনো রেগে গিয়ে তাদের সামনে তোকে পিটিয়ে দিয়েছি। তখন দুজনের অবস্থা কেমন হবে ভাব!” স্নেহার ছেলেমানুষি কথা শুনে হা হা করে হেসে উঠলো আর্য সঙ্গে নিজেও হাসলো। অনেকক্ষণ ধরে হাসতে রইল। কিছুটা থামার পর আর্য স্নেহার চোখের দিকে সুহাসের সহিত তাকিয়ে বলল,”আমিও বিয়ের পরে তোকে ধরে মারব দাঁড়া।”
“কি! বউ কি মারার জিনিস? বউ আদর করার জিনিস। আদর করবি।”
“চিন্তা করিস না।মিছিমিছি মারবো। মারার পর আবার আদর করে দেবো।”
“কেন? এমনি আদর করা যায় না? মেরে আদর করতে হবে? তোকে কি সাধে বলি উল্টাসিধা মানুষ।” তার চোখে-মুখে স্নিগ্ধতায় ভরপুর।শীতের সকালে দূর্বা ঘাসের উপর শিশির পড়লে যতটা সুন্দর পবিত্র স্নিগ্ধ লাগে, এই মুহূর্তগুলো ঠিক ততটা সুন্দর পবিত্র লাগলো। আর্য কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগে ফোন বেজে উঠল। লক্সমি ফোন করেছে। মিনিট দুয়েক তার সঙ্গে কথা বললো। এই কিছুটা মুহূর্তে বড্ড বিরক্ত হয়েছে স্নেহা। মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো,”কে ছিল রে ফোনে?”
“লক্সমি।”
“তুই অন্য মেয়ে সঙ্গে কথা বলছিলিস? তার দিকে তাকাস?”
“আরে না না। ও আমার চেয়ে বড়। আমি তাকে দিদির চোখে দেখি। তোকে তো তার সম্বন্ধে সব কিছু বলেছি। একটা কথাও লুকোইনি।” আর্য নিজেকে সঠিক প্রমাণ করার জন্য উঠে পড়ে লাগলো। তার এই অস্থিরতা দেখে খুব হাসলো স্নেহা।
“এত অস্থির হচ্ছিস কেন? আমি তো মজা করছিলাম। আমি তোকে চিনি, তুই কেমন? এতগুলো বছর ধরে তোকে যতটা না চিনতাম, এই দুটো দিনে কিছু মুহূর্তে তোকে ভালো করে চিনে গেছি। নতুন করে চেনার প্রয়োজন নেই। আর কি জানিস তো, মেয়েরা যে ছেলেকে নিজের করতে চায়, তাকে অন্য কারোর সঙ্গে দেখতে পারে না।”
“না, তুই আমায় সম্পূর্ণ চিনতে পারিসনি। একটা মানুষ একটা পৃথিবীর সমান।এক জীবনে যেমন পুরো পৃথিবীকে চেনা সম্ভব হয় না। তেমন এক জীবনে একটি মানুষকে সম্পূর্ণ চেনা অসম্ভব।” স্নেহা এবার মাথায় হাত চাপড়ে বলল,”আবার শুরু করলি বুড়োদের মত কথা-বার্তা। সব সময় বিজ্ঞের মত কথা বলতে হবে? কিছুক্ষণ আগে তো বেশ মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছিলিস, ওইভাবে আর বলা যায় না?” স্নেহা থামলো। চোখে চোখ পড়তেই অট্টহাসি হেসে উঠল।হাত গুলো একে অপরের মধ্যে বন্দি করে নিজেদের গন্তব্যে হেঁটে চলল।

গতকালের রাতের মত আজও চোখে ঘুম বাঁধলো না স্নেহার। পেছন থেকে অনেক ভাবনা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। উসখুস মন নিয়ে ঘরে বারবার পায়চারি করছে। চোখ বন্ধ করতে কিছুতেই ঘুম আসছে না। নানা ধরনের ভাবনা মাথায় এক প্রকার যন্ত্রণা নিয়ে এসেছে। এলোমেলো ভাবনাগুলো মনের ওপর মুদ্রিত হয়ে আছে। সেগুলো সাজালো। বেশ কয়েক বছর আগে বিক্রমকে জিজ্ঞেস করেছিল বিয়ে করলে সে কতটুকু স্বাধীনতা পাবে? বলেছিল, যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই। স্নেহা আবার প্রশ্ন করেছিল, তার একটা কুৎসিত রূপের কল্পনা করতে? বিক্রম বলেছিল, সে কেন কুৎসিত হতে যাবে? আজ একই প্রশ্ন আর্যকে করেছে। আর্য প্রথম প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে, স্নেহা পরাধীন নয় যে স্বাধীনতার প্রশ্ন উঠবে। এবং দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলেছে তাকে কল্পনা করার সাহস নেই। কারণ, তার কল্পনায় সৌন্দর্যের অভাব পড়তে পারে। দুজনের ভাবনায় কি আদৌ কোনো পার্থক্য রয়েছে? -না দুজনের ভাবনাই এক? বিক্রমের কাছে ভালোবাসার অর্থ ছিল মুক্ত আর নিয়ন্ত্রণ দুটোই। অন্যকে নয় নিজেকে ভালোবাসো।নিজেকে ভালো রাখো। এইগুলো সে অন্যকে দিয়ে করাতে পছন্দ করত কিন্তু নিজে নয়। আর আর্যর কাছে ভালোবাসার অর্থ সম্পূর্ণ মুক্ত। শুধু নিজে নয় চারপাশের মানুষ জনকে নিয়ে ভালো থাকো। এগুলো অন্যকে নয় সে নিজে করতে চেয়েছে। আসলে, দুজনের ভাবনার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। একজন,কাছের মানুষকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছে আর একজন কাছের মানুষকে নিজের মত করে থাকতে দিয়ে বাঁচতে চেয়েছে। দুজনের চিন্তা ধারায় সামান্য হেরফের হলেও দুজনের ভালোবাসা সম্পূর্ণ খাঁটি। দার্জিলিঙে বেড়াতে গেলে, ঝরনা,প্রচুর গাছপালা, পশুপাখি, নদী, বড় বড় পাথর দেখতে পাওয়া যাবে। শীতল আবহাওয়া থাকবে। রাজস্থানে বেড়াতে গিয়ে, বড় বড় গাছ, নদী, শীতল আবহাওয়া খুঁজলে পাওয়া যাবে না। কারন, ওটা রাজস্থান। এখানে বালি,ছোট ছোট কাঁটা জঙ্গল জাতীয় গাছ এবং উট ছাড়া তেমন কোনো পশুপাখি পাওয়া যাবে না। আবার দার্জিলিঙে গিয়ে রাজস্থানের ভূ-প্রাকৃতিক খুঁজলে পাওয়া যাবে না। দুটো জায়গার মধ্যে বহু পার্থক্য থাকলেও একটা মিল রয়েছে। উভয় জায়গায় ভ্রমণ করলে মনের তৃপ্ত পূরণ হয়। মন আনন্দে ভরে উঠে। মনে শান্তি যোগায়। তেমনই, আর্যর মধ্যে বিক্রমের চিন্তা ধারা কিংবা বিক্রমের মধ্যে আর্যর চিন্তা ধারা খুঁজলে কখনো পাওয়া যাবে না। কারন দুটো মানুষ আলাদা। দুজনের মধ্যে শুধু একটা মিল রয়েছে, দুজনের ভালোবাসা সত্য। ওই ভালোবাসা কাছের মানুষটিকে সুখী করবে। একজনের মধ্যে অন্যজনকে খোঁজা বোকামি। ভালোবাসা পেটের খিদের মত। বিস্কুট খেলে পেটে ভরবে আবার ফল খেলেও পেট ভরবে। নিজের মতো করে যুক্তি সাজিয়ে ভীষণ খুশি হলো স্নেহা। মনের সংকোচন দূর করলো। বর্তমানে যে মানুষটার সঙ্গে আছে ওই মানুষটির মধ্যে পূর্বের মানুষটিকে খোঁজা বোকামি। প্রত্যেক মানুষের নিজস্বতা রয়েছে। ওই নিজস্বতাকে নিয়ে বাঁচতে হয়।

দুপুরে কাজ থেকে বাড়ি ফিরলেন অশোকবাবু।কাদামাখা দেহ নিয়ে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলেন না। বাইরে ধুলোর মধ্যে বসে পড়লেন। হালকা নরম রোদ গায়ে এসে পড়ল। শীতের মধ্যে রোদ মাখতে ভালোই লাগে। পাশে স্ত্রী,লতা আর রিম্পি বসে গল্প করছে। তাদের গল্পের মূল চরিত্র আর্য। তার বিয়ে নিয়ে কথা চলছে। বিয়েতে কে কোন শাড়ি পরবে? কেমন ভাবে সাজবে? এই নিয়ে আলোচনা করছে তিনজন। আচার্য পরিবারের একমাত্র পুত্র সন্তান আর্য। তার বিয়ে ধুমধাম করে হবে। অনেক নামিদামি মানুষ আসবে। সাধারণ মানুষ পেট ভরে খাবার খাবে। পাঁচ পিসি,তিন মাসি,দিদি, মামার বাড়ি, কাকু কাকিমার বাড়ি, কাকুর শ্বশুরবাড়ি, অশোক বাবুর নিজস্ব বন্ধু, আর্যর নিজস্ব বন্ধু-বান্ধবী, কত আত্মীয়-স্বজন! একটা বিচিত্র পরিবেশের সমারোহ হবে। তারা কল্পনার মাত্রার অতিরিক্ত চলে গেছে। অশোকবাবু তাদের কথা শুনে না হেসে পারলেন না। ছেলে এখনও বড় হয়ে ওঠেনি। সে ভবিষ্যতে কেমন হবে তা সবার অজানা। তবুও তাকে নিয়ে কত মানুষ স্বপ্ন দেখছে। তাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইছে। গ্রামের মানুষগুলো বড় অদ্ভুত। স্বপ্ন গুলো খুব ছোট হয় তবে বড্ড রহস্যময়। বেশিরভাগ সময় তাদের স্বপ্নগুলো স্বপ্নই থেকে যায়। অশোক বাবু তাদের কল্পনায় বাধা দিলেন না। মানুষ স্বপ্নের মধ্যে সুখ খুঁজে পায়। এমন সুখ নিয়ে বেঁচে থাকুক তারা। বেঁচে থাকুক পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষ। অশোক বাবু ছেলেকে ডাকলেন মাথায় তেল মাখিয়ে দেওয়ার জন্য। বাবার কথা শোনা মাত্র সিসি ভর্তি তেল নিয়ে হাজির হলো। বাবার মাথায় তেল মাখাতে মাখাতে লক্ষ করল, বাবা বড্ড অযত্ন হয়ে পড়েছেন। হাতে পায়ের নখ গুলো অযত্ন ভাবে বেড়ে চলেছে। অনেকদিন ধরে কাটা হয়নি। চুল-দাড়িতেও ময়লা জমেছে। আর্য বাবাকে স্নান করতে যেতে দিল না। নেইলকাটার এনে সযত্নে বাবার নখ গুলো কেটে দিল। ছেলের স্নেহ যত্ন ভালোবাসা পেয়ে বড্ড মুগ্ধ হলো অশোকবাবু। ছেলের দিকে তাকাতে পারলেন না। সামান্য অহেতুক কারণে চোখের কোণায় জল চিকচিক করে উঠলো। তিনি দ্রুত স্থান ত্যাগ করলেন। এত ভালোবাসা কি আদৌ টিকবে? হারিয়ে যাবে না তো কোনো গভীর অন্ধকারে!

পর্ব ২১ আসছে
বিঃদ্রঃ অনেকের একটা কমন অভিযোগ রয়েছে, একটা পর্ব থেকে নতুন পর্ব দিতে অনেক সময় লেগে যায়। তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, আমি এখন একজন ছাত্র। নিয়মিত স্টাডি করতে হয়। বাইরে একা থাকি রান্না বাদে সমস্ত কাজ নিজেকেই করতে হয়। সামান্য চাপ বেশি। নিয়মিত লেখা সম্ভব হয়ে ওঠে না। আশা করি বুঝবেন। যাদের ধৈর্য শক্তি কম, তারা উপন্যাস শেষ হলে একসঙ্গে পড়তে পারেন। ধন্যবাদ।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here