কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ
পর্ব ২২
___________________
তিন মাস মত হলো কর্নাটকে ফিরেছে আর্য। সেখানে ফেরার পর বেশ কয়েকদিন সম্পূর্ণ আনমনা ছিল। পুরনো মুহূর্ত তাড়িয়ে বেরিয়েছে। তবে নিজের সঙ্গে সংঘাত করে আবার নতুন মুহূর্ত গড়তে গিয়ে পুরনো মুহূর্তগুলো স্মৃতি হয়ে গেছে। প্রথম দিন ফিরে এসে পরিচিত ভূমি সম্পূর্ণ নতুন লাগছিল। কেমন একটা আলাদা পরিবেশ। তবে কোনো কিছু অগোছালো ছিল না। মিনাজ নিজের হাতেই সবকিছু গুছিয়ে রেখেছিল। তবে পূর্বের মত বেশি সময় লাগেনি মানিয়ে নিতে। মিনাজ এবং লক্সমি দুজনে তাকে প্রথম দেখে বড্ড অবাক হয়েছিল। আর্য কখনো ছোট করে চুল কাটে না। সবসময় মাঝারি সাইজের কিংবা একটু বড় থাকতো। তাকে নিয়ে বড্ড ইয়ার্কি-ফাজলামি করতে শুরু করে। গ্রাম্য এক নারীর চোখের লাজুকতা তাকে এত দিন আটকে রেখেছিল। অভিমানী চোখ এড়িয়ে পালিয়ে আসতে পারেনি।প্রেমে পড়ে নিজের মধ্যে অনেক পরিবর্তন লক্ষ করে। নিজেই নিজেকে খুঁজে।খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করে, স্নেহার প্রতি ভীষণ দুর্বল সে। দুর্বলের চাইতে বেশি দুর্বল বোঝাতে যদি কোনো শব্দ থাকে তাহলে ওই শব্দটি প্রযোজ্য। স্কুলের শিক্ষক থেকে আত্মীয়-স্বজন, সবাই ছোটবেলা থেকেই বড় বড় চুল রাখতে বারণ করেছিল। কারোর কথা শুনেনি। অথচ স্নেহার একটা কথায় চুল কেটে ফেলেছে। কারোর প্রতি অতিরিক্ত দুর্বলতা ভালো নয়, সে যতই প্রিয় মানুষ হোক না কেন। তার থেকে কিছুটা হলেও দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে চাইছিল, কিন্তু সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। দুর্বলতা কিছুতে কাটিয়ে উঠতে পারেনি। অবশেষে এই বিষয়টি মাথা থেকে সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলে। দিন হাসিখুশিতে কাটতে শুরু করে। স্কুল-কলেজের পড়াশুনা বিকেলে মিনাজের কিংবা লক্সমির সঙ্গে শহরে ঘুরতে যাওয়া। আরও বেশি মানুষের সঙ্গে মিশতে শুরু করে। এখানকার মানুষ গুলো একে একে আপন হয়ে ওঠে। সন্ধ্যায় পড়াশুনা আবার গভীর রাত পর্যন্ত মধুর কথায় মুগ্ধ হওয়া নিত্য দিনের অভ্যাস হয়ে ওঠে।রামধনুর রং এর মত উজ্জ্বল হয়ে ওঠে স্বপ্নগুলো। বুকে রাশি রাশি মুগ্ধতা নিয়ে দিন অতিবাহিত হতে থাকে। শীত-গ্রীষ্ম পেরিয়ে বর্ষার মাঝামাঝি চলে আসলো। এবারের প্রিয় বর্ষা যে তার জীবনে ঘন কালো অন্ধকার নিয়ে আসবে ভাবতে পারিনি। মিনাজের কোর্স সম্পন্ন হয়েছে। আগামীকাল বিকেলে তার ফ্লাইট। ফিরে যাবে নিজের শহরে। আর ফিরবে না কখনো এই শহরে। সকাল থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে।আর্য তাকে শেষবারের মতো বাঙালি খাবার রান্না করে খাইয়েছে। সারা বিকেল জুড়ে প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গোছাতে সাহায্য করেছে। পেছনে সব সময় লেগে আছে। রাতে ঘুমাতে গিয়েও পারল না। বারবার এদিক ওদিক পাশ ঘুরালো। অস্বস্তি হচ্ছে। ছটফট করছে। ধৈর্য শক্তি কমে আসছে। বিছানা থেকে উঠে রুমের মধ্যে পায়চারি করল। তাও চোখে ঘুম আসলো না। বিরক্ত হয়ে শেষমেশ দুজনে মাঝ রাতে ছাদে গিয়ে বসলো। গভীর রাত। তবে নিবিড় অন্ধকার নেই। চারিদিকে হালকা আলো ঝলমল করছে। গ্রামের রাত্রির তুলনায় শহরের রাত্রির অনেক বৈসাদৃশ্য। শহরের গভীর রাত নামে অনেক দেরিতে তাও অল্পসময়ের জন্য। রাতের শহরের নান্দনিকতা অনেক বেশি। রাতের নান্দনিকতা ভুলিয়ে দেয় সারা দিনের ক্লান্তি। হাই রোডের উপর দিয়ে বড় বড় ট্রাক ও লরি ছুটে চলে যাচ্ছে দূর-দূরান্তে। মাঝেমধ্যে পুলিশের গাড়ি লক্ষ করা যাচ্ছে। তারা কখনো কখনো গাড়ি থেকে নেমে রাস্তায় পায়চারি করছে। তখনো সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াচ্ছে। ব্যর্থ ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে ঝিমিয়ে যাওয়া চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করছে। এমন মুগ্ধকর পরিবেশও তাদের মনে স্নিগ্ধতা নেই। অধিকাংশ দোকান বন্ধ। টলতে টলতে কিছু জোড়া পা উঠছে ট্যাক্সিতে। গলিতে এখনো জেগে আছে কিছু ক্ষুদার্থ কুকুর। এই শহর সারারাত জাগে,ব্যস্ত থাকে, টাকা উড়ায়, কাঁদে, ব্যথাও পায়। রাতের শহর বড্ড মায়াময়।আকাশে মেঘ আর চাঁদ লুকোচুরি খেলছে। মাঝেমধ্যে অসংখ্য কালো মেঘ জড়ো হয়ে অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে তবু বৃষ্টি পড়ছে না।দূরে আরও দূরে চোখ রাখতে বড় বড় টিলা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। নুড়িপাথরে ভর্তি টিলার ওপর নাম না জানা অসংখ্য গাছ জন্মেছে, বড় হয়েছে। দমকা বাতাসে তারা মাঝে মধ্যে নড়ে উঠছে। নরম জ্যোৎস্নার আলো মাখতে থাকা ছোট ছোট গাছগুলোকে বড্ড সুন্দর দেখাচ্ছে। তাদের ছায়া দিগন্তে লম্বা হয়ে পড়েছে। কি অপূর্ব মোহময় দৃশ্য! মাটি,গাছপালা,মানুষজন সবাই বৃষ্টির প্রতীক্ষায় রয়েছে। বর্ষাকালে তারা বৃষ্টি চায়। শীতল জলে ভিজতে চায়।
আকাশে লক্ষ তারা
ঢেকেছে মেঘের আড়ালে
তারার নরম আলোয়
কত গল্পের আনাগোনা
রাতের মাতাল সমীকরণে
হারাতে বসেছে হৃদয়ের কত প্লাবন।।
আর্য মিটিমিটি চোখে দেখল মিনাজকে। সে পকেটের মধ্যে হাত ভরে ক্ষনিকের জন্য নিস্তব্ধে থাকা বৃহৎ শহরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কৃত্তিম এবং অকৃত্তিম আলোয় ভাসছে তার শরীর। আর্য গুটি গুটি পায়ে উঠে গেল। তার পাশে দাঁড়ালো। মিনাজ চোখ ফিরে দেখল কিন্তু কেউই হাসি বিনিময় করল না। রাতের অন্ধকারে হৃদয়ের হাসি আজ ছাই হয়ে গেছে। মিনাজের পাশে দাঁড়াতে তার শরীরের ঘ্রাণ অনুভব করল আর্য। কি মিষ্টি ঘ্রাণ। কিন্তু অদ্ভুত একটা বিষয় রয়েছে! আর্য এই দু-বছরে মিনাজকে কখনো স্নান করতে দেখেনি। মাসে খুব বেশি হলে একবার কিংবা দুবার। কোনো মানুষকে দীর্ঘদিন স্নান করতে না দেখলে যেকোনো মানুষের মনে বিভ্রান্ত সৃষ্টি হবে, স্বাভাবিক। আর্য বিভ্রান্ত হয়েছিল। তবে জিজ্ঞেস করা সাহস হয়নি। তার ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়তো অনুচিত। কিন্তু কৌতুহল বেশিদিন চেপে রাখতেও পারেনি। একদিন সবকিছু জানতে চেয়েছিল। সেদিন মিনাজ মিষ্টি মুখে সবকিছুই ছোট ভাইয়ের সঙ্গে শেয়ার করে। প্রায় সময় বরফে ঢেকে থাকা শহরে তাদের বাড়ি। শীত প্রবলভাবে থাকে। স্নান করা কখনো প্রয়োজন হয় না। এখানে এসেও সেই অভ্যাস ছাড়তে পারেনি। চেষ্টা করেও স্নানকে নিত্য দিনের প্রয়োজনীয়তা বানাতে পারেনি। উল্টে শরীরের জ্বরের প্রবণতা বাড়িয়ে ফেলেছে। তবে এই ক্লান্ত উষ্ণ জায়গায় স্নান না করে কি থাকা যায়? ভেজা কাপড়ে শরীর মুছতে দেখা গেছে। ওই সব পুরনো কিছু বিরক্ত কিংবা আনন্দময় দিনগুলো আর কিছু মুহূর্ত মনে পড়তেই বুকটা হাহাকার করে ওঠলো। ওর চোখের দিকে কিছুতে তাকাতে পারছে না। কিছুক্ষণ পর মিনাজ আর্যর দিকে তাকিয়ে বলল,”চল ঘুমিয়ে পড়ি। ভোর হতে আর বেশি বাকি নেই।”
“আজ আর ঘুম আসবে না। আজ শেষ রাত। একটু গল্প করে না হয় কাটিয়ে ফেলি।” মিনাজ নিরুত্তর রইল। কথা বলতে ইচ্ছে করলেও শক্তি পেলো না। কত গুলো রাত এই ছাদে বসে কাটিয়েছে। কত মন খারাপের গল্প, কত আনন্দের মুহূর্ত রয়েছে, তা এক মাএ ছাদের ইট সিমেন্ট গুলোই জানে। ঈদের রাতে বসে দুজন চাঁদ দেখেছে। দীপাবলিতে গভীর রাত পর্যন্ত বসে আকাশে ওড়া ফানুস দেখেছে। আজ সেই সব দিনগুলো মলিন হতে চলেছে। ফিরবে না আর এমন মুহূর্ত। আর্যর চোখের কোণে জল টিপটিপ করে উঠলো। আঙ্গুলের ডগা দিয়ে চোখের জল মুছে বলল,”তুমি খুব খারাপ। তোমায় যদি সত্যিই চিনতাম জানতাম, তাহলে কখনো এতটা ভালবাসতাম না।”
“আমার উপরে এত অভিমান!”
“অভিমান নয়। তুমি সত্যিই খারাপ। ছেড়ে চলে যাওয়াটা কি ভীষণ দরকার?” মৃদু হাসল মিনাজ।বলল,”তুই বড্ড ছেলে মানুষ।বাচ্চার মত কথা বলছিস। আমি আমার বাড়িতে ফিরব না? চার বছর বাবা মার সঙ্গে দেখা হয়নি। ঠিক মত কথা হয়নি। হাতে গোনা মাত্র দশ বারো বার কথা হয়েছে।ওরা কেমন আছে জানি না। আমাকে ফিরতে হবে। আমি বড় হয়ে গেছি, এবার নিজের বাবা-মার দায়িত্ব নিতে হবে। সমস্ত বন্ধন ছেড়ে আমাকে ফিরতেই হবে।” আর্য জবাব দিল না। কিছু ভালো লাগছে না। তার এক বন্ধুকে ছাড়তে কষ্ট হচ্ছে। তাহলে, মিনাজের না কতটা কষ্ট হচ্ছে? সে তো শুধু আর্যকে নয়। আর্যর মত অনেক বন্ধুকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। তাদের সাথেও দেখা হবে না। তার কষ্ট সামান্য হলেও বেশি।
“তোমার কষ্ট হচ্ছে না সবাইকে ছেড়ে যেতে? মনে পড়বে না এই দিনগুলো?” নরম কন্ঠে বলল আর্য।
“অবশ্যই মনে পড়বে। পিছুটান থাকলেও কষ্ট হচ্ছে না। কারণ আমি আমার পিতা-মাতার কাছে ফিরছি। নিজের পৈত্রিকভূমিতে ফিরছি। সেখানে কষ্ট কিসের? বরং আমার হৃদয় আনন্দে ফুরফুরে করে বেড়াচ্ছে। তুইও একদিন এই শহর থেকে চলে যাবি। সেদিন বুঝতে পারবি আজকে আমার মনে ঠিক কি চলছে।” আর্য স্প্রিংয়ের মতো ছিটকে উঠলো। সত্যি তো, তাকেও একদিন এই শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে। চাইলেও এই শহরে ফেরা হবে না। চেনা রাস্তাগুলোর উপরে কেউ পা মাড়িয়ে হেঁটে যাবে। চেনা রুম কেউ নিজের মতো করে গুছিয়ে নেবে। আরও কিছুটা সময় মৌন থাকার পর মিনাজ বলল,
“তুই আমার ছোটবেলার ঝাল-মুড়ির ভাগীদার না,
তুই আমার বৃষ্টি ভিজে স্কুলে যাওয়ার সঙ্গীও না,
তুই আমার স্কুল পালানোর বন্ধুও না,
তুই আমার হেরে যাওয়ার সঙ্গীও না।”
মিনাজ একটু থেমে আবার বলল,”তবুও কত আপন! কত স্মৃতির অংশীদার আমরা দুজন।” আর্য নিজেকে আর সামলাতে পারল না। কষ্টে বুক চিন চিন করে উঠছে। মিনাজকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। মিনাজ তার পিঠে হাত চাপড়ে বলল,”control yourself, brother”. তাকে সান্ত্বনা দিল। চোখের জল মুছে দিল। ইট সিমেন্ট দিয়ে প্রাচীরের মতো করা উচু অংশে দুজন বসলো। মিনাজ বলল,”দুটো গল্প বলবো, শুনবি?”
“হুম,শুনবো।”
“একটা সম্পূর্ণ অচেনা ছেলে মেয়ে কোনো এক বিশেষ কারণে এক হলো। তাদের মধ্যে স্নিগ্ধতা, মুগ্ধতা, অনুভূতি, ভালোলাগা-খারাপলাগা সবকিছু নতুন। তারা সারারাত এক রুমে রইল। একটা বিছানা দুজন শেয়ার করলো। একজনের খাবার দুইজন ভাগ করে খেলো। দুজন পাশাপাশি বসে চাঁদ দেখলো।জ্যোৎস্নার আলো মেখে গল্প করল। একে অপরকে সঠিক চেনার চেষ্টা করল।”
মিনাজ ঢোক গিলে আবার বলল,”এটা হল প্রথম গল্প।আর দ্বিতীয় গল্পে এত দূর পর্যন্ত অনুরূপ ঘটলো কিন্তু তারপর তারা একে অপরের প্রতি মুগ্ধ হয়ে যৌন লালসায় লালিত হয়ে যৌন সম্পর্কে চলে গেল। আবার কেউ মুগ্ধতার বুঁদ কাটিয়ে তুলতে না পেরে, মুহূর্তকে অনেক দীর্ঘ করতে চাইলো। পূর্বের দুটো গল্প একে অপরের প্রতি মুগ্ধ হওয়া পর্যন্ত ঠিক রয়েছে।কিন্তু পরবর্তীতে ওই মুহূর্তগুলোকে কেন্দ্র করে যদি যৌন লালসা কিংবা মুহূর্তগুলোকে দীর্ঘ করতে চায়, তাহলে পূর্ব মুহূর্তর সার্থকতা শূন্য। মুহূর্ত সবসময় অল্পের জন্য হয় দীর্ঘের জন্য নয়। দীর্ঘ মুহূর্তে অনেক ভুলভাল লুকিয়ে থাকে। অনেক লালসা থাকে। যেগুলো আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। কিন্তু মুহূর্তের মুহূর্ত সুন্দরের পরিপূর্ণ থাকে। সেগুলো আমাদের মনের শান্তি যোগায়। ওই ছেলে মেয়ে যদি সকাল পর্যন্ত গল্প করে কাটাতো, তাহলে সেই মুহূর্ত সারা জীবন অমর হয়ে থাকতো। কোথাও না কোথাও একে অপরের প্রতি সারা জীবন ভালোবাসা থেকে যেত। কোনো দিন দেখা না হলেও মনে মনে অনেক ভালোবাসা থাকতো। কিন্তু ওই যে অবৈধ ভাবে যৌন সম্পর্কে করলো।ওই সম্পর্ক তাদের সারাটা জীবন তাড়িয়ে বেড়াবে। ওই মুহূর্তকে কল্পনা করে কখনো মনের সুখ পাবে না। এই যে তোর আর আমার মুহূর্ত খুব সামান্য। এই মুহূর্তগুলো সারা জীবন থেকে যাবে। কোনোদিন আমাদের আর দেখা হবে না। তবুও থেকে যাবে। কারণ এই মুহুর্তের মধ্যে কোনোরূপ স্বার্থ ছিল না। সাগরের জল বাঁধ পর্যন্ত পৌছলেই সুন্দর, আর বাঁধ পেরোলে ভয়ানক।”
বিকেলের গুড়িগুড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করে এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেল। পৌঁছনোর পরই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। ঘন্টা দেড়েক ধরে বৃষ্টির রেশ বজায় থাকে। বৃষ্টি কমার পর ফিরে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করে। সবকিছু ঠিকঠাক করে গুছিয়ে নেয়। বিদায়ের সন্ধিক্ষণ দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে পড়ে। অপেক্ষা আর কয়েকটা মিনিটের। ব্যাগ পত্র নিয়ে প্রবেশের মুখে শেষবার ঘুরে দেখল মিনাজ, স্থির চোখে দাঁড়িয়ে আছে আর্য। তখনো গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। তার চোখ ভেজা। মিনাজ মাথা নাড়িয়ে তাকে কাঁদতে বারণ করল। মুখে লাবণ্যময় হাসি ফুটিয়ে তুললো। তারপর হাত নাড়িয়ে একটু একটু করে বিদায় নিল। আর্যর বুক হঠাৎ করে কেমন হতে শুরু করল। সাইক্লোনের ঘূর্ণি বাতাস যেন হৃদয়ের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। কে এই মিনাজ? তার সাথে তো রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই। ধর্ম,বর্ণ, রাজ্য, পেশা সবকিছুই আলাদা। তবুও কেন তার জন্য মন কাঁদছে? কেন এত তার মন উতলা? এর উত্তর আর্য নিজেও খুঁজে পেলো না। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিকে তোয়াক্কা না করে কিছুক্ষণ পর উড়ে গেল ফ্লাইট। কাছে বসে ফ্লাইটের উড়ে যাওয়া লক্ষ করল আর্য। বেশ অনেকক্ষণ একাকী এয়ারপোর্টে বসে রইল।
কোনো রকম করে রুমে ফিরে আসলো। বড্ড একা লাগছে। সারাটা বিকেল হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে কাটিয়ে ফেললো। চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। অসংখ্য কালো দাগ রয়েছে। চোখ দুটো ভেতরের দিকে গলে গেছে। গতরাতে একবারের জন্য চোখ বন্ধ করেনি। সকালে একটু ঘুমিয়ে ছিল, তবে বেশিক্ষণ নয়। নতুন জামা-প্যান্ট এখনো বদলানো হয়নি। আরও কিছুটা সময় পর পশ্চিমাকাশ লাল আভায় ভরিয়ে সূর্যি মামা বিদায় নিল। আর্য তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে সন্ধ্যার প্রদীপ জ্বালালো। অহেতুক কারোর ফেরার অপেক্ষা করলো! আজ আর কেউ সন্ধ্যায় নামাজ পড়ে রুমের মধ্যে আসলো না। কেউ বলল না, আর্য তুমি মুড়ি মাখাও আমি জিলিপি নিয়ে আসছি, তারপর ছাদে চাঁদ দেখতে দেখতে দুজন খাবো।কেউ বলল না, ছাদে যখন যাচ্ছ তখন আমার শুকনো জামা প্যান্টগুলো তুলে নিয়ে আসবে। কেউ বলল না, ইশ্ রুমটা নোংরা হয়েছে একটু ঝাঁট দিয়ে দে তো।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলো। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি প্রবলভাবে ঝাঁপিয়ে পরলো। মুষলধারে চতুর্দিকে বৃষ্টি হচ্ছে। থমথমে পরিবেশ। প্রবল বজ্রপাত হচ্ছে। কিছুক্ষণ বিদ্যুৎ চলে গিয়ে আবার ফিরে আসলো। আন্টি এসে তাকে খাবার দিয়ে গেছেন। মেঝেতে খাবার থালা পড়ে রয়েছে। খেতে একদম ইচ্ছে নেই। শুকনো ভাত,সাম্বার,মাঞ্চুরিয়ান পড়ে রয়েছে। থালার চারিদিকে দু-চারটা মাছি ভনভন করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের তাড়াতে শক্তি পেলো না আর্য। রুমের মধ্যে চারিদিকে বিচ্ছিরি ভাবে অসংখ্য জিনিসপত্র এলোমেলোভাবে পড়ে রয়েছে। কেউ যে এই রুম থেকে বিদায় নিয়েছে তা স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে। এতক্ষণে মিনাজ থাকলে কখনো অগোছালো থাকতো না। সবকিছু গুছিয়ে ফেলতো। অগোছালো তার বড্ড অপছন্দ। মুখ লুকিয়ে বসে থাকত না। একে অপরের সাথে গল্প করতো।পুরনো দিনের কথা মনে করলো। কি সুন্দর ছিল অতীত। প্রথম এই ঘরে আসা.. মিনাজকে সহজে বিশ্বাস না করা.. ধীরে ধীরে বিশ্বাস করা.. সবকিছু সঙ্গে আপোষ করে নেওয়া। এরপর দীর্ঘ সময় সুখ-দুঃখের সঙ্গী হয়েছে। শরীর অসুস্থ হলে দাদার মতো সেবা করেছে। ওষুধ কিনে দিয়েছে। ভেঙ্গে পড়ার মুহূর্তে শক্ত পাথর হয়ে পাশে বসেছে। উৎসাহিত করেছে। রাতে আলো নিভিয়ে ঘুমহীন চোখে সুখ-দুঃখের গল্প করেছে। হাত ধরে শহরে ঘুরেছে। একসঙ্গে হাবিজাবি কত রান্না করেছে। আবার সেগুলো মুখে রুচি না আসলেও খেয়েছে। অথচ কেউ কাউকে কখনো দোষারোপ করেনি।কত দুষ্টুমি করেছে।
আর্য খাট থেকে উঠে গিয়ে মোবাইল তুলল। ছয় ঘণ্টার মধ্যে কাশ্মীরে পৌঁছে যাওয়ার কথা। নির্দিষ্ট সময় অনেক আগে অতিক্রম হয়ে গেছে। বেশ কয়েকবার ফোন করলো। কিন্তু একবারের জন্যও বাজলো না। মনে পরল পুরনো আর এক কথা,মিনাজ যেখানে থাকে সেখানে সব সময় নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকে। বন্দুকের নলের সামনে তাদের জীবন। চাইলেও আর যোগাযোগ করা সম্ভব নয়।তার নরম কণ্ঠস্বর আর কখনো শুনতে পাবে না। অতিথি পাখির মত জীবনে এসেছিল আবার চলে গেছে। আর কখনো ফিরবে না। যে এতদিন পর্যন্ত প্রতিদিনের ভালোবাসার সঙ্গী ছিল। যার সঙ্গে কিছু মুহূর্ত না থাকলে শরীরে গরম হালকা পাক খেতো -আজ থেকে ওই মানুষটি কেমন থাকবে?কি করবে? কিছুই জানতে পারবে না। হয়তো, কোনোদিন বন্দুকের নলে পাখি উড়ে যাবে না ফেরার দেশে। তবুও কিছু জানতে পারবে না। এখন নিশ্চয়ই সে পরিবারের সঙ্গে রয়েছে। কত আনন্দের মুহূর্ত গল্প করছে। নিশ্চয়ই তার বাবা-মাকেও আর্যর কথা বলছে। তারাও ইচ্ছা প্রকাশ করবে আর্যর সঙ্গে কথা বলার। কিন্তু সম্ভব হবে না। মনে মনে দোয়া করবেন।হাসি আড্ডাতে ভরে গেছে তাদের পরিবার। হাসি খুশির মধ্যে মনে পড়বে কি এখানকার সুখের কথা? মনে পড়বে কি দূরে কোথাও তার এক অচেনা ভাই রয়েছে? অবশ্যই পড়বে। তবে ধীরে ধীরে সেগুলো কালো মেঘের মতো ঝরে পড়বে। একটু একটু করে মুহূর্তগুলো ভুলে যাবে। হয়তো, কোনো এক বর্ষার দুপুরে কিংবা রাতে শরীর উষ্ণতায় ভরে উঠবে পুরনো মুহূর্তগুলো স্মরণ করে। যেগুলো নিষ্ঠার সঙ্গে স্মৃতিতে বন্দি করেছিল। মিনাজের সঙ্গে চাইলেও আর কথা বলা সম্ভব নয়,তা ভেবে একনাগাড়ে কেঁদে গেলো।রাত বাড়তে রইল।আলো নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। চোখ একবারের জন্যও বন্ধ হলো না। ক্লান্ত শরীর তবুও ঘুম আসছে না। স্নেহার সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বলতে পারল না। তাঁকে সান্ত্বনা দিল তবুও শুনল না। স্নেহা বেশি জোর করেনি। তাকে কিছুক্ষণ একা থাকতে দেওয়া উচিত। তার মনও ভেঙ্গে পড়ে। আর্য কেমন ছেলে অজানা নয়। ছেড়ে চলে যাওয়া মানুষকে ভীষণ ভয় পায় আর্য। বুকের শূন্যতায় মানতে পারে না। তাইতো খুব কম মানুষের সঙ্গে নিজেকে মেলে ধরে। বন্ধুত্বের পরিধি ক্ষুদ্র।পাশের খাট আজ ফাঁকা। তার প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় অনেক জিনিসই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। যেগুলো একদিন তার খুব প্রিয় ছিল। কিন্তু সমস্ত জিনিস ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই ফেলে দিয়ে গেছে। কারেন্টের ইন্ডাকশন থেকে শুরু করে দাড়ি কামানোর ট্রিমার আরও কত কি দুইজন সমান ভাবে টাকা দিয়ে কিনেছিলাম। কিন্তু মিনাজ একটাও নিয়ে যায়নি। টাকার ভাগও চায়নি। সবকিছু আর্যকে দিয়ে নিশ্চুপে চলে গেছে। হয়তো,তার বিছানা বেশি দিন খালি থাকবে না। আবার কোনো নতুন সঙ্গী জুটবে। আবার পূর্ণ হবে। পূর্ণতা অপূর্ণতা নিয়েই জীবন। মানুষের মাথার উপর যত বড়ই ছাদ থাকুক না কেন, মানুষ বরাবরই যাযাবর। আজ এখানে তো কাল ওখানে…..
শূন্যতায় বুক জ্বলে,খোঁজে পুরনো মানুষ।
যামিনী-অযামিনীর খেলায় কুঞ্জে হারায়া যায়
প্রিয় মানুষ।
পর্ব ২৩ আসছে