কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ পর্ব-২৩

0
147

কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ
পর্ব ২৩
________________
সকালে খুব বৃষ্টি হওয়ায় বর্ষাকালেও শীত জাঁকিয়ে ধরেছে। দুপুরের পর থেকে মেঘের আড়ালে সূর্যিমামা উঁকি দিতে শুরু করলো। বিকেলের দিকে আকাশ আরও পরিস্কার হলো। হালকা রোদ বেরোলো। অনেকগুলো দিন হল মিনাজ ফিরে গেছে। রুমের মধ্যে একা বসে থাকতে ভালো লাগলো না। বিকেলে লক্সমিকে ফোন করে বলল একটু ঘুরতে যাওয়ার জন্য। তেমন কোনো বিশেষ কাজ না থাকায় সঙ্গে সঙ্গে রাজি হল। গায়ে জ্যাকেট পরে দুজন বেরিয়ে গেলো খোলা আকাশের নিচে। দীপাবলীর দিন গ্রামের সরু রাস্তায় যেদিকে গিয়েছিল আজও ওই দিকে গেল। কিছুটা যাওয়ার পর তারা পূর্বপরিচিত বাঁকে গেল না। অন্য বাঁকে ঘুরে গেল। সামান্য যাওয়ার পর অসংখ্য ছেলে মেয়ের চিৎকার চেঁচামেচি শোনা গেল। আর্য বুঝতে পারল পাশে কোথাও খেলার মাঠ রয়েছে। কিছুটা হাঁটার পর মাঠের দর্শন পেল। একটা বিশাল খেলার মাঠ। বাচ্চা ছেলে মেয়েরা চেঁচামেচি করে দৌড়াচ্ছে। ইয়ং ছেলেরা ক্রিকেট আর ভলিবলে মগ্ন হয়েছে। বয়স্করা নিজেদের শরীর মেন্টেন করার জন্য হাঁটাহাঁটি করছেন। মাঠের একদম পূর্ব দিকে বড় বড় অনেকগুলো পাথর পড়ে রয়েছে। দেখলেই বোঝা যায় সেখানে পূর্বে ছোট কিংবা বড় টিলা ছিল। মানুষ সেগুলোকে ধ্বংস করেছে। পাথরের উপর কিছু ছেলেমেয়ে বসে মোবাইলে মগ্ন আছে। আবার কেউ খোশগল্পে মেতে আছে।চারপাশে অসংখ্য নাম না জানা গাছ জন্মেছে। চেনা গাছ বলতে শুধু মাত্র জবাফুল আর নারকেল গাছ।হালকা শীতল বাতাস বইছে। কানের গোড়ায় ঠান্ডা বাতাস লাগতেই শরীর শিরশির করে উঠলো। রুমের মধ্যে সব সময় বসে থাকতে হয়। খোলা আকাশের নিচে বসতে মন চাইল না। মাঠের চারদিকে ঘোরার কথা বলল লক্সমিকে। তারপর দুজন পাশাপাশি খুব ধীরগতিতে হাঁটতে রইল। নিঃশব্দে হেঁটে চলল। হাঁটার শব্দ ছাড়া তেমন কোনো শব্দ হলো না। কিছুক্ষণ পর লক্সমি চোখ বাঁকিয়ে আর্যকে দেখল। প্রতি দিনের তুলনায় আজকে একটু বেশি খোশমেজাজে দেখাছে। মুখমন্ডল লাবণ্যে পরিপূর্ণ রয়েছে। এত খুশি থাকার সঠিক কারণ বুঝলো না। প্রশ্ন করল,
“তোমাকে আজ এত খুশি দেখাচ্ছে কেন?রাতে বিশেষ কিছু আছে না কি?” আর্য প্রসন্ন হাসি হেসে বলল,”না না। তেমন কোনো বিশেষ কারণ নেই।”
“তাহলে?”
“আসলে আমাদের বাড়িতে মন্দির রয়েছে তো। প্রত্যেক বছর জাঁকজমক করে একবার পুজো হয়। আর ওই পুজো আজকে বাড়িতে হচ্ছে। কালকে দুপুরে গ্রামের সবাইকে আমাদের বাড়িতে খাওয়ানো হবে। তারপর বিকালে বস্ত্র দান করা হবে। পুরনো অতীত মনে পড়ছে। বাড়িতে থাকলে খুব আনন্দ হতো। এখন বড়িতে আত্মীয়-স্বজনে ভরপুর হয়ে গেছে।” খুব মনোযোগ দিয়ে কথা শুনল লক্সমি। একটু ভেবে বলল,”তুমি একবার বলেছিলে না তোমরা খুব গরিব মানুষ। আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। তাহলে এসব কি? প্রতিবছর এমন অনুষ্ঠান পরিচালনা করা যথেষ্ট খরচসাপেক্ষ তো।”
“আমি কখনো বলিনি, আমি গরিব । আমাদের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো নয় তা ঠিক। তবে আমরা গরিব নই। নিজেকে গরিব ভাবা তো পাপ। আমাদের যা আছে আমরা তাতেই সন্তুষ্ট। তাছাড়া এই অনুষ্ঠান আমার বাবা এবং কাকু দুজন মিলে করেন। কখনো অসুবিধায় হয় না। আর একজন মানুষের যেটুকু প্রয়োজন ওইটুকু পেয়ে গেলে সে কখনো গরিব হতে পারে না। ধরো, তোমার প্রত্যেকদিন এক টাকা প্রয়োজন। আর তুমি প্রতিদিন এক টাকা পেয়ে যাচ্ছ। তাহলে তুমি কখনো গরীব হতে পারো না। কিন্তু আমার প্রতিদিন দশ টাকা প্রয়োজন। কিন্তু আমি কখনো দশ টাকা পাই না,ছয়-সাত টাকা করে পাই। তাহলে আমি গরিব । গরিব শব্দটি কখনো অর্থের ওপর নির্ভর করে না। গরিব শব্দটি সবসময় মানুষের মন এবং চাহিদার উপর নির্ভর করে।” আর্যর কথা বলা শেষ হওয়ার পরও লক্সমি কোনো জবাব দিল না। মৌন রইল।সে জানে, পুরুষ মানুষের আসল সৌন্দর্য তাদের নম্র ব্যবহার এবং বিচক্ষণতা। আর্যর সহজ সরল ব্যবহার ও শান্তশিষ্ট স্বভাব তাকে খুব কাছে নিয়ে এসেছে। খুব ভালো করে ভাবতে শিখিয়েছে। লক্সমির ভালো লাগলো। এমন বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। মাথা নাড়িয়ে হাসিমুখে বলল,”সত্যি ভাবনার বিষয়। গ্রামের মানুষগুলো একটু বেশি দয়ালু হয় তাই না।”
“আমাদের গ্রাম বাংলায় একটা প্রবাদ আছে,’যার ধন আছে তার মন নেই যার মন আছে তার ধন নেই’…।” আর্য আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই লক্সমি হি হি করে হেসে উঠলো। বলল,”এই কথাটির মানে কি?” আর্য কোনোরকম বিরক্ত হলো না। এতক্ষণে তারা আয়তকার মাঠের একটা বাহু বেরিয়ে এসেছে। খুব শান্ত মাথায় বলল,”বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লক্ষ্য করবে যাদের প্রচুর পরিমানের ধন সম্পদ রয়েছে তারা কাউকে সাহায্য করতে চায় না।কিন্তু যার কাছে দেখবে টাকাপয়সা খুব কম আছে তারাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাহায্য করে। তারা বড্ড উদার হয়।” লক্সমি মাথা নাড়ালো।
“তোমাদের গ্রাম দেখার ইচ্ছে জাগছে। একবার নিয়ে যাবে আমায়? তোমার বাবা-মাকে দেখব। তোমাদের বাড়িতে ঘুমোবো।স্নেহার বাড়ি যাব তাকে দেখবো। বাঙালি খাবার জমিয়ে খাবো। তোমার বাবাকে বলবে পুকুর থেকে মাছ ধরতে। এখানে তো মাছ পাওয়া যায় না।মাঠে ঘুরে বেড়াবো। নিজের সামান্য পরিধি ছাড়া কোথাও যাওয়া হয়নি। খুব ইচ্ছে করে বাইরে ঘুরতে যেতে। নিয়ে যাবে আমায়?”
“আচ্ছা, নিয়ে যাব। তবে এখন না। আমাকে আরও অনেক বড় হতে হবে তারপর। আসলে.. কি বলতে চাইছি নিশ্চয়ই বুঝেতে পারছো?” শেষের কথাগুলো আমতা আমতা করে বলল আর্য। লক্সমি হাসিমুখে মাথা নাড়ালো। তার হাসি আশ্বস্ত করল আর্যকে।
“জানো, আমাদের গ্রাম শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসে বর্ণিত গ্রামের মতো সুন্দর। একবার গেলে আর আসতে ইচ্ছে করবে না।”
“শরৎচন্দ্র টা আবার কে?”
“সে কি! তুমি শরৎচন্দ্র কে চেনো না? বিভূতিভূষণ,বঙ্কিমচন্দ্র এদের নাম শোনোনি?”
“না।” আর্য কপালে হাত চাপড়ালো। একটু ঈর্ষা প্রকাশ করে বলল,”তোমার জীবনে অনেক কিছু অপূর্ণতা রয়েছে দেখছি। রবীন্দ্রনাথকে চেনো তো, না তাঁকেও চেনো না!”
“ওঁকে চিনি। তিনি তো আমাদের ন্যাশনাল অ্যানথেমের রচয়িতা।”
“ও রক্ষে করলে আমায়। ভাবছিলাম তাঁকেও হয়তো চেনো না।” লক্সমি রেগে আর্যর পিঠে চাটি মারলো। বলল,”মজা হচ্ছে? আমি কি বাঙালি যে বাঙালি রাইটারদের নাম জানবো?”
“জেনে নিতে হবে।এই দুটো বছরে আমি তোমাদের ভাষা শিখে গেলাম আর তুমি একটাও বাংলা ভাষা শিখলে না।” লক্সমি এবার লজ্জা পেলো। মনে হল, আর্য নিজের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে তাকে ছোট করছে। চুপ হয়ে হাঁটতে রইল। আর্য নিজেও ব্যাপারটি বুঝতে পেরে খারাপ লাগলো। জল এ দিকে গড়িয়ে যাবে ভাবতে পারিনি। তাড়াতাড়ি বলল,”রাগ করছো কেন? আমি তো শুধু মাত্র মজা করছিলাম? এত সিরিয়াসলি নিয়ে নেবে বুঝতে পারিনি।আর কথাগুলো যে অন্যভাবে ভাবা যায় তাও বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারলে কখনও বলতাম না।” আর্যর বরাবরের মতো খুব সহজ সরল ব্যবহার এবং কঠিন সত্য যা নিজের কিংবা বিপরীত মানুষের জন্য বিপদজনক, তাও বলতে কার্পণ্য করে না। বড্ড খুশি হলো লক্সমি।
“জানি মজা করছো। শরতচনদ (শরৎচন্দ্র) নভেল এ বর্ণিত আর কি কি আছে তোমাদের গ্রামে?” শরৎচন্দ্রের উচ্চারণ শুনে আর্য না হেসে পারলো না। খিলখিল করে হাসতে রইল। তার সামনে হাত জোড় করে বলল,”দয়া করে আর এমন উচ্চারণ করবে না। নিজের নাম এমনভাবে শুনলে তিনি এক্ষুনি স্বর্গ থেকে ফিরে এসে তোমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবে।” এবার লক্সমি আরও রেগে গেলো। রাগে গনগন করতে রইল। তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ঠান্ডা করার চেষ্টা করলো। কিছুক্ষণ পর ঠাণ্ডা হল। তবুও গম্ভীর কণ্ঠে বলল,”আমি যা জানতে চাইছিলাম তা বল?” আর্য ভাবতে রইল, উপন্যাসে বর্ণিত মত তাদের গ্রামে আর কী কী রয়েছে? বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পর মনে পড়ল। স্নেহার বাড়ি কিছুটা হলেও উপন্যাসের মতো হবে। তাদের বাড়ির পেছনে পুকুর তার চারদিকে গাছপালা তারই ইঙ্গিত দেয়। এবং বাড়ির পাশে রেললাইন কিংবা রুমের মধ্যে নানা ধরনের হাতের কাজ। জানালা দিয়ে ট্রেন দেখা একটু হলেও উপন্যাসের মত। এবং মুহূর্তের জন্য স্নেহার সেই অগোছালো ভাবে শাড়ি পরা শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে কোনো এক নারীই হবে। আর্য সেদিনের ঘটনাটি বেশ বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলল। শোনার পরে লক্সমি মুখ ভেংচি কেটে বলল,”সে কি! তুমি স্নেহার রুম পর্যন্ত চলে গেছিলে? আবার কোলে মাথা রেখেছো?” আর্য তাড়াতাড়ি লক্সমির মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলল,”আমি কিছু করিনি। শুধু কোলে মাথা রেখেছি।” হা হা করে হাসলো লক্সমি। আর্য তার হাসিতে যোগ দিলো না।তাও লক্সমি হাসি লুকিয়ে রাখতে পারল না। মুখে হাত চেপে হাসতে রইল। হাসি মাখা কন্ঠে বলল,”আমি কখন বললাম তুমি কিছু করেছো?”
“তুমি না প্রচুর খারাপ। কথার প্যাচে আমাকে ফেলতে চাইছো।”
“আমি তো মজা করে বললাম। তুমি যে তেমনটা নয় তা আমি জানি। তখন মুহূর্তটা সত্যি আলাদা ছিল তাই না! অনুভূতিপ্রবণ হয়ে পড়েছিলে?” আর্য নিরুত্তর।সেই কথা আবার মনে পড়লো। বুক কেমন করে উঠলো। সত্যি! সে দিন কত সুখ পেয়েছে কাউকে বলে বোঝাতে পারবে না। তার লাবণ্যময় কোলে যখন মাথা রেখে ছিল তখন বুকটা শিরশির করছিল। কি দারুন মুহুর্ত! হঠাৎ আযানের শব্দ তাদের কানে ভেসে আসলো। আরও কিছুটা হাঁটার পর লক্ষ করল, মাঠে মানুষজনের আনাগোনা নিমিষে কমে গেছে। হঠাৎ করে কি হলো বুঝতে পারল না। আর্য লাক্সমিকে বলল,”মানুষগুলো হঠাৎ করে পালিয়ে গেল কেন?”
“আযান শোনা গেল না! তাই।” আর্য মাথা নাড়ালো। লক্সমি আবার বলল,”চলো আমরাও ফিরে যাই।”
“এই তো এলে। এখনি চলে যাবে?”
“কয়েকটা পোশাক কিনতাম। চল না।”
“এতগুলো তো পোশাক রয়েছে। যখনই ঘুরতে বের হও আলাদা আলাদা পোশাক পরো। আর কত পোশাক চাই? আবার কী সব পোশাক? ধ্যাত!”
“তুমি মেডিকেল স্টুডেন্ট, ফ্যাশন ডিজাইনার নও। মেয়েদের পোশাক নিয়ে এত গবেষনা করতে হবে না। চলো তো। বেশি বকো না।”
প্রায় এক ঘন্টার পর লক্সমি উপর থেকে নিচে আসলো। তার হাতে একটা ব্যাগ রয়েছে। মুখে লাবণ্যময় হাসি।
“চলো। বাড়ি ফেরা যাক।”
“এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলে? আরও কিছু কেনো।” আর্যর তাচ্ছিল্য করে বলা কথা ধরে ফেলল লক্সমি।
“কোথায় বেশি সময় গেল? ঘন্টাখানেক তো হয়েছে।”
“তাই তো বলছি। এটা কোনো সময় নাকি!বাবা কেন মা আর দিদির সঙ্গে শপিং এ যেত না আজকে বুঝতে পারলাম।”
“তুমিতো ফ্যাশন ডিজাইনার। সবকিছুই জানবে।”
” হুশ,চলো তো।” ফেরার পথে সূর্যি মামা ডুবে গেছে। সরু রাস্তায় অন্ধকার নেমেছে। একে অপরকে ঠিক দেখতে পেল না। হাই রোডে আসার পর খুব ভালো করে দেখল দুজন দুজনকে। লক্সমি দেখল আর্য হাতে একটা ব্যাগ রয়েছে, যা আসার সময় ছিল না। কৌতুহল বাড়লো। নিশ্চয়ই শপিং এর ফাঁকে কেউ দেখা করেছে না হয় সে নিজেই কিছু কিনেছে।
” ব্যাগে কি আছে?” আর্য নিজের হাতের দিকে তাকালো। উত্তর দেওয়ার আগেই ব্যাগ ছাড়িয়ে নিল লক্সমি। কি আছে দেখল। ছেট ছেট কালারের বয়স্ক মানুষদের একটা জামা। আগ্রহের সঙ্গে বলল,”তুমি বুড়োদের পোশাক পরবে? এ গুলোতো বড়দের জন্য।”
“এটা আমি আমার জন্য কিনিনি। বাবার জন্য কিনেছি।”
“নিজের জন্য কিনতে পারতে কিছু।”
“আমার অনেক পোশাক রয়েছে। এই মুহূর্তে নতুন পোশাকের প্রয়োজন নেই। এখানকার পোশাক আমি সব সময় পরছি। আমার বাবাও এখানকার পোশাক পরুক। তাছাড়া কি জানো? আমি যদি কোনো পোশাক কিনে পরি তাহলে আনন্দটা ক্ষণিকের জন্য থাকবে। কিন্তু বাবাকে যদি কিছু কিনে দিই তাহলে আনন্দটা সারা জীবন থেকে যাবে। বাবা-মাও চায় তাঁর ছেলে-মেয়ে কিছু কিনে দিক। একটা জামা পেলে বাবা কত খুশি হবে জানেন?”
“বুঝলাম। কিন্তু, শুধু বাবার জন্য কিনলে কেন? মা বোন তো রয়েছে। তাদের জন্যও কিনতে পারতে।”
“আমিতো ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। টাকা তেমন বেশি ছিল না। পরেরবার নিশ্চয়ই কিনব।” আর্যর কথাগুলো ভালো লাগলো লক্সমির। এইটুকু বয়সে সে নিজের কথা না ভেবে পরিবারের কথা ভাবে। খুব কম মানুষ পারে এমনটা হতে। আজকাল তো বেশিরভাগ মানুষ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। নিজের ভালো-মন্দই বোঝে। সেখানে আর্য সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। সবার ঊর্ধ্বে। এমন সন্তান গর্ভে ধারণ করাও সার্থক। অনেকক্ষণ ধরে মৌন রইল। মৌনতা কাটিয়ে লক্সমি বলল,”তুমি একটু বেশি তোমার বাবাকে ভালোবাসো তাই না।”
“কি জানি! ভালোবাসা বেশি খারাপ বুঝি না। তবে বাবা-মা বাবা-মাই হয়। তাদের অন্য কোনো নাম থাকতে পারে না। জানো, আমার বাবা একসময় প্রচুর পান খেতেন।ছোটবেলা বাবাকে একবার বলেছিলাম আমায়ও একটা পান বানিয়ে দিতে। বাবা আমায় পান দেননি। তিনি এক টুকরো সুপারি দিয়ে বলেছিলেন, এগুলোই ছোটরা খায়। আর পান বড়দের জন্য। আমি মাথা নাড়লেও বুঝতে পেরেছিলাম বাবা আমার কাছ থেকে কিছু লুকিয়েছে। একদিন চুরি করে পান খাই। বাবার কাছে ধরাও পড়ে যাই। কিন্তু কিছু বলেননি। বাবা বুঝতে পেরেছিলেন আজ পান খাচ্ছি কাল পানের সঙ্গে মেশানো নেশা জাতীয় বস্তু খাবো। কারণ ওই জিনিসটার প্রতি আমার ভীষন আগ্রহ ছিল। তারপর বাবা কি করেছিলেন জানেন?”
লক্সমি অধীর আগ্রহে সঙ্গে বলল,”কি করেছিলেন?” আর্য তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,”বাবা পান এবং পানের সমস্ত সরঞ্জাম নিয়ে পুকুরে ফেলে দিয়েছিলেন। বাবা এবং মা দুজন মিলে সারা দিন কম করে দশ থেকে বারোটা পান খেতেন। কিন্তু তারপর থেকে একটাও খাননি। মা খুব রাগ করেছিল কিন্তু মেনেও নিয়েছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ছেলেমেয়েদেরকে শুধু বললে হবে না। তারা সব সময় বড়দেরকে অনুসরণ করে। ছোটদের সামনে আমরা যে কাজ করি ওই কাজ তারা কখনো ভালো কিংবা খারাপ দেখে না। তারা ওই কাজটি করতে চায়। একটা বাচ্চা ছেলেকে রোজ বই পড়তে না বলে তার সামনে বই খুলে তুমি পড়ো। দেখবে সে নিজে থেকেই একদিন বই পড়ছে।” আর্য কিছুক্ষণ থেমে আবার বলল,”জানো, আমাদের শাক সবজি বাজারে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা গাড়ি ভীষণ প্রয়োজন ছিল। বাবার স্কুটারে প্রতি ঝোঁকও ছিল ভীষন। টাকা গুছিয়ে ছিলেন কিনবেন বলে।যেদিন কেনার কথা তার আগের দিন রাতে বোন বলেছিল, সে ক্যারাটে শিখবে। যা মেয়েদের আত্মরক্ষার জন্য বর্তমান সমাজে ভীষণ প্রয়োজন। বাবা তার পরের দিন আর স্কুটার আনতে যায়নি। বোনকে নিয়ে গিয়ে আগে ক্যারাটেতে ভর্তি করায়। বাবাদের মত ত্যাগ স্বীকার কেউ কখনো করতে পারবে না। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, আমাদের সমাজে বেশিরভাগ বাবার শেষ ঠিকানা হয় বৃদ্ধাশ্রম নয়তো ফুটপাত। এত ত্যাগের পরও কিছু পায় না।”

ঘরের মধ্যে আলো জ্বালিয়ে চুপচাপ বসেছিল আর্য। বইয়ের মধ্যে মন বসাতে না পেরে বই গুছিয়ে রেখে দিয়েছে। স্নেহার ফোনের জন্য অপেক্ষা করছে। এরই ফাঁকে অনেক পুরনো স্মৃতিময় জিনিস নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখলো। পায়চারি করলো। মিনাজের জিনিসগুলো একটা জায়গায় গুছিয়ে রেখেছে। অব্যবহৃত হয়ে পড়ে আছে। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর স্নেহার ফোন আসলো। ফোন ধরেই বুঝতে পারল কোনো কারনে কষ্ট পেয়েছে সে। তার কণ্ঠস্বর ভারাক্রান্ত।
“কি রে! তোর আবার কি হলো? মা বকেছে?”
“তোকে কয়েকটা কথা বলছি মন দিয়ে শোন।”
“আচ্ছা।”
“তুই আর আমাকে কখনো ফোন করিস না। আমার ভালো লাগছে না।”
“আচ্ছা।”
“মনে থাকবে তো?”
“আচ্ছা।” স্নেহা বুঝলো,তার সিরিয়াস কথাবার্তা আর্য মজা করে নিচ্ছে। খপ করে রেগে গেল। রাগান্বিত কণ্ঠস্বরে জোরে চিৎকার করে বলল,”বাঁদরের মত লাফাচ্ছিস কেন? আমার কথা কানে যাচ্ছে না? সব সময় ফাইজলামি না!” এবার আর্য নরম হলো। বাঁদর শব্দটি শুনে কষ্ট পায়নি। তবে শব্দটি বলার ধরনের মাধ্যমে একটা ঘৃণা রয়েছে। তাড়াতাড়ি জবাব দিল,”আচ্ছা, আর ফোন করবো না। কিন্তু একটা কারণ তো থাকবে। কারণটা বল?”
“তুই তো আমার ব্যাপারে সব কিছুই জানিস। আমি একজনকে ভালোবাসি। তাকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসতে পারবো না। তোকে দ্বিতীয় দিন বলেছিলাম, তোর প্রতি আমার কোনো ফিলিংস নেই। এখনো ফিলিংস আসেনি। কি করে সম্ভব এই সম্পর্কটা বজায় রাখা?” আর্য শক্ত পাথরের মত স্থির হয়ে গেল। উত্তর দেওয়ার মতো কোনো জবাব রইল না। তাহলে এতদিন সবকিছুই অভিনয় ছিল? তা কি করে হতে পারে? স্নেহা কক্ষনো এমনটা হতে পারে না। চুপ করে গেল। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়লো।
“কিরে কিছু বলছিস না যে?” আর্য তাও নিরুত্তর রইল। বেশ দীর্ঘ সময় ধরে নীরবতা। স্নেহা আবার বলল,”আমার ওপর রাগ করছিস? ভুল বুঝিস না আমায়। একটু বোঝার চেষ্টা কর।” আর্যরও মন খারাপের সঙ্গে সঙ্গে রাগ হল। মুহূর্তের অভিমান জমে পাহাড় হল। চোখের জল মুছে স্পষ্ট ভাবে বলল,”আমি আমার অনুভূতি গুলো নিয়ে ভালো থাকবো। কারোর প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই।”
“সত্যি তো। কাঁদবি না তো? আর ফোন করবি না তো?”
“না, আমি আমার সীমাবদ্ধতা জানি। কোথায় থামতে হবে তাও জানি। নিজেকে দোষ দিস না।”
বিপরীত থেকে কোনো উত্তর আসলো না। প্রায় দু’ঘণ্টা একইভাবে কানের কাছে ফোন ধরে রইলো। কিন্তু কেউ কথা বললো না। কেউ লাইনও কাটলো না। নির্দিষ্ট সময় লাইন একা একা কেটে গেল। ঠিকরে উঠল আর্য। স্নেহা বারবার কেন এমন করে? হঠাৎ হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নেয়। হঠাৎই কালবৈশাখীর মত আসে আবার হঠাৎ পালিয়ে যায়। এত তাড়াতাড়ি কি করে সিদ্ধান্ত নেয়? তাকে কথা দিলেও নিজেকে সামলাতে পারল না। বেশ কয়েকবার ফোন করলো কিন্তু ধরলো না। আর্যর চোখ থেকে হু হু করে জল গড়িয়ে পরলো।

পর্ব ২৪ আসছে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here