কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ
পর্ব ২৪
_________________
দু-বছর পর,,,
যামিনীর কালো আঁধার ঘুচতে অনেক বাকি। সূর্যি মামা এখনো ঘুমন্ত। হঠাৎ আর্যর নরম ঘুমের ব্যাঘাত ঘটালো দরজার শব্দ। বাহিরে থেকে বারবার দরজায় কেউ টোকা দিচ্ছে আর এক নারী কন্ঠ তার নাম ধরে ডাকছে। গলার স্বর চিনতে অসুবিধা হয়নি। আর্য তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠলো। ঘড়ির কাঁটা ভোর চারটা হতে কিছু সময় বাকি। দরজা খুলে আন্টিকে দেখে অবাক হলো না। ঘুমন্ত মুখে বলল,”কিছু সমস্যা? এত ভোরে ডেকে তুললেন যে?”
“তোমার সঙ্গে কেউ দেখা করতে এসেছে।”
“কে?” ভ্রু কুঁচকে আর্য বলল।
“আগে কখনো দেখিনি। দুটো ছেলে বলল তোমাকে তাড়াতাড়ি ডেকে দিতে। খুব দরকার।” আর্য ভীষণ অবাক হলো। এখানে তাকে কে খোঁজ করতে পারে? পরিচিত অনেকেই রয়েছে। তবে এমন কোনো ঘনিষ্ঠ নেই যে খুব ভোরে তাকে খুঁজবে। বেশি দেরি করলো না। রুমের মধ্যে ফিরে তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে চশমা পরে নিচে নেমে আসলো। বাইরের ল্যাম্পপোস্টের আলোয় চতুর্দিকে আলোকিত হয়ে আছে। নিচে এক জোড়া পরিচিত মুখ দেখে আর্যর চোখ রীতিমতো কেঁপে উঠলো। শরীর-মন মুগ্ধতায় শিহরন বয়ে গেল। এই ভিন রাজ্যে তার প্রথম বন্ধু লিমভো আর দর্শন তার দিকে তাকিয়ে স্লান হাসছে। বেশ পরিপাটি করে সাজানো গোছানো। তাদের হাতে তিন-চারটে বড়ো বড়ো লাগেজ রয়েছে। দর্শন নিজের বড় বড় চুলগুলো কেটে ফেলেছে। দুজনের মাথার চুল এখন সমান। আর কোনো পার্থক্য খুঁজে পেল না আর্য। হালকা হাসলো। কে লিমভো আর কে দর্শন, বুঝতে পারল না। আর্য একগাল হেসে বলল,”তোমরা এখানে! এত সকালে?”
“আজকে আমরা বাড়ি ফিরে যাচ্ছি, আর্য। আর হয়তো আমাদের মধ্যে দেখা হবে না। তাই ভাবলাম যাওয়ার আগে তোমার সঙ্গে অন্তত একবার দেখা করে যাই।” আর্যর হাসিমাখা মুখ মুহূর্তের মধ্যে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। কি নিদারুন এই জীবন। প্রবল উচ্ছাসে সঙ্গে বাহিত জল হঠাৎ করে স্তব্ধ হয়ে গেল। মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলল। আমতা আমতা করে বলল,”এখনই ফ্লাইট আছে বুঝি?”
“হুম, সেজন্যই ভরে ঘুমের ডিস্টার্ব করলাম।”
“এখানে আর কখনো ফিরবে না?”
“এখানে ফেরার তেমন কোনো কারন তো নেই। তবে বলাও যায় না।” আর্য জবাব দিল না। তারা যে এখানে আর ফিরবে না তা বোঝা যাচ্ছে। শুধু মন খারাপের কথায় এড়াতেই ছোট্ট অজুহাত দিচ্ছে। তবুও কিছু করার নেই। এটাই জীবন। দুজন একে একে আর্য সঙ্গে হ্যান্ডশ্যাক করল। তিনজনের চোখের কোনে জল জমা হয়েছে। তবে কেউ কাঁদলো না। আড়ালে কষ্ট লুকিয়ে মুখে হাসি বজায় রাখল।কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার পর ট্যাক্সি এসে পৌছালো। দুজন ডিকিতে ব্যাগ গুলো তুলে দিল। ট্যাক্সির মধ্যে প্রবেশ করার আগে একজন হাসিমুখে বলল,”ভালো থেকো। নিজের খেয়াল রাখবে।” তার কথা শেষ হতে আর একজন মাথা নাড়িয়ে বোঝাল নিজের খেয়াল রাখতে। তিনজন মৃদু হাসলো। এরপর আস্তে আস্তে শহরের গোলকধাঁধায় ট্যাক্সিটি হারিয়ে গেল।
রুমের মধ্যে ফিরে এসে দরজা বন্ধ করলো। ঘুমাতে আর ইচ্ছে করলো না। আলোও জ্বালালো না। গালে হাত দিয়ে চুপিসাড়ে বসে রইল। একের পরে এক সবাই হারিয়ে যাচ্ছে। যত বড় হচ্ছে তাতে জ্ঞানের পরিধি বাড়ছে;কিন্তু নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পর পর ছোট হয়ে যাচ্ছে। একের পর এক মানুষ নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে।ফিরে যাচ্ছে নিজেদের গন্তব্যে। মনে পড়ল এখানে আসার প্রথম দিন। এই ভিন রাজ্যে প্রথম কাটানোর সঙ্গী তারা। তাদের হাত ধরেই এখানকার অনেক কিছুই জেনেছিল।তাদের সঙ্গে প্রথম কাটানোর রাত্রির অভিজ্ঞতাও উজ্জ্বল হয়ে আছে। কি সুন্দর ছিল সেসব দিন। নতুন নতুন সব কিছু চিনতে ভালো লাগছিল। তাদের স্নেহ এবং ভালোবাসা সম্পূর্ণ খাঁটি ছিল। তবুও তার মানিয়ে নিতে অসুবিধা হয়। মনে হচ্ছিল তারা অসহ্যকর। তখন কখনো মনে হয়নি তাদেরকেও একদিন হারাতে হবে। তাদের জন্য মন খারাপ হবে। জীবনের অংক এত সহজ হবে না। হোস্টেল থেকে চলে আসার পর কলেজে মাঝেমধ্যে দেখা হতো। তারাও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ ভাবে কথা বলতো। তাদের প্রতি সমস্ত অভিযোগ আজ বিলীন হয়ে গেল।প্রমাণ হয়ে গেল সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে ভালোবাসা শ্রেষ্ঠ। আর্য জানে না, ওই দুটো নেপালি ছেলে তাকে কখনো মনে রাখবে কিনা! তবে সে নিশ্চিত,ছেলে দুটোকে কখনো ভুলতে পারবে না। সারাজীবন হৃদয়ে কোথাও না কোথাও থেকে যাবে। প্রথম রাত্রি কখনো মলিন হবে না। তাদের সঙ্গে কাটানো মুহূর্ত খুব বেশি নয়। তবুও আপন।
বেলা বাড়তেই পড়ায় মনোযোগী হয়ে উঠল আর্য। ফাইনাল ইয়ারের শেষ পরীক্ষা আর কয়েকদিন পর।বিশেষ কারণে এবার এক্সাম কিছুটা সময় পিছিয়ে গেছে। তারপর নিজের কোর্সও কমপ্লিট। সেও ফিরে যাবে নিজের গ্রামে। যদিও আরও একবছরের বাধ্যতামূলক ইন্টার্নশিপ রয়েছে। বেশ কয়েক মাস হলো বাইরে বেরোনো হয় না। সারাদিন বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে বসে থাকে। অবসর সময়ে ছাদে গিয়ে বসে। বাড়িতে ফোন করে কথা বলে। লক্সমি মাঝেমধ্যে ফোন করে। তবে তার সঙ্গে আগের মত দেখা হয় না।তার কোর্স কমপ্লিট। এমনকি ইন্টার্নশিপও শেষ। চাকরির খোঁজে ছুটে বেড়াচ্ছে। ইন্টারভিউর পূর্ব প্রস্তুতিও নিচ্ছে।দেখা করতে সময় পায় না। দীর্ঘ সময় পড়ার পর ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনের লক্সমির নাম। অবাক হলো না বরং ভালো লাগলো। কালকে রাতে লক্সমিকে ফোন করে বলেছিল তার কিছু নোটস এবং পুরনো বই লাগবে।সে কোনো কিছুর কারন জানতে চায়নি। জবাব দিয়েছিল, সকালে যথা সময়ে তাকে পৌঁছে দেবে। এই মেয়েটির প্রতি অনেক ঋণী সে। না চাইতে অনেক সাহায্য পেয়েছে। সব সময় পাশে থেকেছে। মেয়েটিকে কখনো ভেঙে পড়তে কিংবা কষ্ট পেতে দেখা যায়নি। সব সময় মুখে লম্বা স্মাইল থাকে। এত খুশি কী করে থাকে কে জানে। ধুপ ধাপ করে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নেমে আসলো আর্য। বিল্ডিং এর পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে লক্সমি। আর্যকে দেখামাত্র ছোট্ট হাসি বিনিময় করে স্কুটার থেকে বই গুলো বের করল। তার হাতে বই ধরিয়ে দেওয়ার আগেই আর্য বলল,”ভেতরে এসো। বাইরে দাঁড়াতে হবে না।” লক্সমি অবাক হলো। এর আগে বহুবার এই জায়গায় দেখা করেছে। কিন্তু আর্য কখনো তাকে ভেতরে ডাকেনি। আজ হঠাৎ? কৌতুহল জাগলো। সামনে থেকে না না বললেও মনের মধ্যে ভেতরে যাওয়ার বাসনা ত্যাগ করতে পারল না। স্কুটার এক সাইডে রেখে সিঁড়ি বেয়ে উপরে আসলো। আর্য রুমে প্রবেশ করল। একটা টুল দিল বসার জন্য। টুলের উপর বসে কোনো কিছু না ভেবে সরাসরি জিজ্ঞেস করল,”তুমি তো আমাকে কখনো ভেতরে নিয়ে আসো না। আজকে কি মনে করে ভেতরে নিয়ে আসলে?”
“আগে রুমের মধ্যে আমি একা থাকতাম না। মিনাজ থাকতো। রুম দুজনের ছিল।”
“কিন্তু সে তো দুবছর হলো চলে গেছে। তারপরও তো ভেতরে আসতে বলনি।” আর্য মৃদু হাসলো। তার বেডের উপর বসে বই গোছাতে গোছাতে বলল,”এটাতো আমার নিজের বাড়ি নয়। ভাড়াটে বাড়ি। কিছু গাইডলাইনস মানতে হয়। গাইডলাইনস না মারলে সতর্ক করে। বেশ কয়েকবার সতর্ক করার পরও না মানলে তখন রুম ছাড়তে হবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত আমাকে একবারও সতর্ক করার সাহস হয়নি।কারন, আমি খুব নিষ্ঠার সঙ্গে সমস্ত গাইডলাইনস পালন করেছি। তাই আমাকে কিছু বলবে না। আর বললেও একবার ভুলের জন্য নিশ্চয়ই আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে না। আর এই বাড়িতে আমিও মাত্র দুই মাস থাকবো। তাই ভুলের পরিমাণ বাড়লেও অসুবিধা নেই।”
“তার মানে তুমি সুযোগের সৎ ব্যবহার করছো?”
“বলতে গেলে বিষয়টি তেমন।” দুজনে হেসে উঠলো। আর্যর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সত্তার পরিচয় পেল লক্সমি। সে খুব ধীরে সুস্থে সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করে। আর্যর বলা পূর্ব বাক্যটি আবার একবার মনে করে বুঝলো কিছু একটা মিস করেছে। তাড়াতাড়ি বলল,”তুমি দুমাসের পর চলে যাবে মানে? ইন্টার্নশিপ কে করবে?”
“আমি করব। তবে ঘরটা ছেড়ে দিতে হবে। মাত্র চার বছরের এগ্রিমেন্ট ছিল।” লক্সমি চুপ করল। আর্যকে আবার একটা ঝামেলার মধ্যে পড়তে হবে। এ ঘর ছেড়ে দিলে তাকে আবার একটা ঘর খুঁজতে হবে।টুল দোলাতে দোলাতে বলল,” মিনাজের পর আর কেউ আসেনি?”
“এসেছিল দুজন। তবে কিছু দিনের জন্য। পাশের ইউনিভার্সিটিতে ওদের পরীক্ষা পড়েছিল। তাই একজন এক মাসের মত এসে ছিল। দ্বিতীয়জনও তেমন ছিল। পরীক্ষার পর ফিরে গেছে।”
“তাহলে লং টাইমের জন্য এখনো পর্যন্ত কেউ সিফট হয়নি। দিব্যি একা আছো।” আর্য মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। লক্সমির অস্বস্তি হলো। বেশিক্ষণ স্থির হয়ে বসে থাকতে ভালো লাগলো না। যতই হোক এটা ভাড়াবাড়ি। আর্য একা থাকে। বেশিক্ষণ থাকতে মন চাইল না। মনের মধ্যে রুমের চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখার ইচ্ছে জাগলেও, তা সুপ্ত রাখল। স্থির চোখে শুধু বেডের দিকে তাকিয়ে রইল। রুমের মধ্যে একটি মাত্র পুরুষ মানুষ থাকে। রুমের মধ্যে গোছানো এবং অগোছানো যাই থাকুক না কেন সেগুলো তাকিয়ে উল্লাস করার দুঃসাহস তার নেই। সে তার চরিত্রের নিম্নতার পরিচয় দিতে চায় না। কিছু সময়ের পর বলল,”তোমার সঙ্গে স্নেহার কথা হয়?” চমকানোর মতো কোনো কথা নয় তবুও একটু অবাক হল আর্য। অসময়ে তার নাম উচ্চারণ করার কারণ কি? মনে বিষন্নতা এবং স্নিগ্ধতা দুটোই জমা হলো। তার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল,”মাঝেমধ্যে কথা হয়।”
“দিনে কবার?” আর্য খুব হাসলো। হাসতে হাসতে বলল,”দিনে নয়, এই দু বছরে মাত্র পাঁচ বার ফোন করেছে।” তাদের সম্পর্ক যে দু’বছর আগে ভেঙ্গে গেছে তা জানতো লক্সমি। তখন সে আর্যকে সান্ত্বনা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু উল্টে আর্য তাকে সান্ত্বনা দেয়। আর্যকে কষ্ট পেতেও দেখা যায়নি। তার দৃঢ় বিশ্বাস, স্নেহা কখনো কাউকে বিয়ে করতে পারে না। তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবে না। তার কিছু একটা হয়েছে যার জন্য দূরে সরে গেছে। মনে অনেক সংকোচন জমেছে। সেই সংকোচন গুলো একদিন বিলীন করতে পারলে ঠিক ফিরে আসবে। তারই অপেক্ষায় আছে আর্য। তাকেই ফিরতে হবে। লক্সমির মধ্যে কেমন একটা জেদ বসে গেছে। তার কথায় লজ্জা পেলেও বলল,”এই পাঁচ বারের মধ্যে কি কথা বলেছো?”
“এই…. কেমন আছি? পড়াশোনা কেমন চলছে? বাবা মা কেমন আছে? এইটুকুই!”
“তুমি জানতে চাও নি, হঠাৎ করে মন পরিবর্তন করল কেন? ছেড়ে চলে গেল কেন?”
“সে তো কোনোদিন আমার সঙ্গে ছিল না। তাহলে ছেড়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ কি করে উঠতে পারে? আমার চোখে প্রেমিকা আর বন্ধু এক। আমার মনে হয় প্রেমিকা হতে গেলে আগে বন্ধু হতে হবে। কিন্তু তার চোখে প্রেমিকা আর বন্ধু সম্পূর্ণ আলাদা। লাস্ট যখন আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল তখনো সে আমাকে বন্ধু ভেবেছিল। আমরা একে অপরের অনুভূতি বুঝতে পেরেছিলাম। বিয়ে করবো বলেও স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু তাজ্জব ব্যাপার কি জানো, আমি কখনো তাকে সামনাসামনি বলিনি,তাকে ভালোবাসি। আর সেও কখনো আমাকে বলেনি, সে আমায় ভালোবাসে। তাছাড়া,এই পাঁচবার যে কথা হয়েছে এর মধ্যে আমাকে নিজের মত করে কথা বলার সুযোগ দেয়নি। ওই বিষয়টি যখনই এসেছে সে তখন এড়িয়ে গেছে।” আর্য চুপ করে গেল। লক্সমি কোনো জবাব দিল না। কিছুক্ষণ শান্ত থেকে বলল,”বুঝতে পারি না তোমাদের কথা বার্তা। তোমার আর আমার ভাবনা যে অনেক পার্থক্য তা আগে বুঝতে পেরেছি। তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে বেশি মাথা ঘামাতেও চাই না। তবে একটা কথা আমি পরিস্কার বুঝতে পারছি, মেয়েটা তোমার জন্য পারফেক্ট নয়। তুমি আমাকে যা যা বলেছো তা যদি সত্য হয়, তাহলে মেয়েটা অনেকাংশে দায়ী।” লক্সমি আরও কিছু বলতে চাইলেও বলতে পারল না। সে বুঝতে পারলো আর্যর এমন কথা শুনতে ভালো লাগছে না। স্নেহার নামে নেগেটিভ কিছু শুনতে খারাপ লাগছে। বাড়ি ফেরার জন্য উদ্যত হল। নিচে পৌঁছেও দিল। রুমে ফিরে আবার চুপ হয়ে গেল। লক্সমির শেষ কথাগুলো তাকে ভীষণভাবে ভাবিয়ে তুললো। সত্যি কি তাই? স্কুলে প্রথম বন্ধুত্ব-টা স্নেহাই শুরু করেছিল। আর্য যখন বারবার জিজ্ঞেস করেছিল তার কোনো প্রেমিক আছে কি না! সে সবসময় ‘না’ বলেছে। যখন সবকিছু জানতে পারল, তখনো আর্যকে কিছু বলেনি। স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পর যখন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেল, তখন স্নেহা নিজেই উতলা হয়ে উঠেছিল। আর্যকে খুঁজে বের করে। আবার নিজেই তার কাছ থেকে সরে এসেছে। আবার পরে নিজেই ফিরে গেছে। এরপর আর্যকে গ্রামে ডাকলো। দুজন মিলে অজস্র স্বপ্ন দেখলো।তারপর আবার নিজে চলে গেল। এতকিছুর পরও আর্যর একবারও মনে হলো না স্নেহা কোনো অংশে দায়ী। স্নেহার একটা দোষ খুঁজে পেল না।এটাই কি ভালোবাসা? বিপরীত মানুষটার প্রতি অনেক অভিযোগ থাকলেও মন থেকে ওই অভিযোগ স্বীকার করা যায় না। বিপরীত মানুষটির উপর কোনোরূপ দোষ না চাপিয়ে সমস্ত দোষ নিজের ঘাড়ে চাপিয়ে নেওয়ার নাম কি ভালোবাসা?
ফাইনাল ইয়ারের এক্সাম শেষ হওয়ার পরও তাকে ঘর ছাড়তে হয়নি। এক বছরের ইন্টার্নশিপও শেষ হয়ে গেছে। এর মধ্যে একবার ঘরে গিয়েছিলো। ঘরের চতুর্দিক ঘুরে বুঝতে পেরেছিল, দারিদ্রতা তাদেরকে ঘিরে ধরেছে। বর্তমানে মেডিক্যালে খরচ যথেষ্ট ব্যয় বহুল। একজন মাঠে খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে খরচ জোগানো সহজ নয়। তার উপর রয়েছে প্রাইভেট কলেজ। যাদের আসল উদ্দেশ্য টাকা রোজগার করা। ইতোমধ্যে, অশোক বাবু নিজের এক বিঘা জল জমি বিক্রি করে দিয়েছেন। অনেক ধার-দেনা হয়ে গেছে। ছেলের পেছনে টাকা যোগানোর সক্ষমতা ধীরে ধীরে ক্ষীন হয়ে আসছিল। আর্য স্বপ্ন দেখছিল ডক্টর শেষ হওয়ার পর ‘এম.ডি’ করবে। এর জন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন। বাবাকে বলা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিল না। বলতে বলতে তার বয়স তেইশ পেরিয়ে গেছে। একটা রোজগারের সন্ধান চাই। বাবার বয়স হচ্ছে। সেবার তিন দিনের বেশি বাড়িতে থাকতে পারেনি। কর্নাটকে ফিরে আসে। চাকরি খুঁজতে শুরু করে। দেশে বিপুল পরিমাণে মেডিক্যাল স্টুডেন্টের চাহিদা থাকায় আর্যকে চাকরি বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হয়নি।প্রথম কয়েকটা পরীক্ষায় সুযোগ করে উঠতে না পারলেও, পরবর্তী সময়ে তার তীক্ষ্ণ উপস্থিত বুদ্ধি, প্রথাগত শিক্ষা, কোনো কাজের প্রতি একাগ্রতা ও ধৈর্য এবং উজ্জ্বল মার্কশিট একটা কাজের সন্ধান করে দেয়। মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে নিযুক্ত হয়।বাবাকে জানানোর পর পুরো পরিবারই আনন্দে কেঁদে ফেলে। দৃঢ়তা সঙ্গে স্বপ্ন দেখলে এবং পরিশ্রম করলে স্বপ্ন একদিন পূরণ হবেই; সে চাষির ছেলে হোক কিংবা কোনো ধনী পরিবারের ছেলে হোক। পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না। আর্য এইটুকুতে থেমে থাকতে চাইলো না। আরও কিছু করতে চাইল। নিজে ইনকাম করতে পারায় টাকার সমস্যা কিছুটা হলেও দূর হয়। কোনো কিছু না ভেবে বাবাকে জানিয়ে ‘এম.ডি’ তে ভর্তি হয়ে যায়। শুরু করে জীবনের আর এক নতুন অধ্যায়। তারপর বেশ কয়েকটি বড় বড় চাকরির পরীক্ষা সুযোগ পেলেও সবগুলো নাকচ করতে বাধ্য হয়। একদিকে পড়াশুনা অন্যদিকে বড় ধরনের চাকরি মাথার মধ্যে চাপাতে চাইছিল না। মাথায় অতিরিক্ত চাপ বাড়াতে চায় না। তাতে দু-কুল হারাতে হবে। বর্তমানের জন্য ছোটখাটো চাকরিই যথেষ্ট। পুরনো বাড়িও ছাড়তে হয়নি। আরও চার বছরের জন্য এগ্রিমেন্ট নিয়ে নেয়। তারপর আরও দুটো বছর কেটে যায়। দিনগুলো সোনালীর মত অতিবাহিত হতে রইল…..
এক সকালে কাজে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল আর্য তখনই ফোন বেজে ওঠে। স্ক্রিনে নাম দেখে চমকে ওঠে। বিক্রম ফোন করেছে। এতগুলো বছর পর বিক্রমের ফোন? বাকরুদ্ধ হলেও ফোন তুললো না। প্রথম যখন কর্নাটকে এসেছিল তখন স্নেহার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রমও কম কথা শোনায়নি। তার অশ্লীল ভাষা গুলো আজও আর্যকে কষ্ট দেয়। কোনো দোষ না করে অনেক কথা শুনেছিল। সেই সময় তার নাম্বারটা সেভ করে রেখে দিয়েছিল। আর এখনো থেকে গেছে। সেদিন কিছু বলেনি। আজ যোগ্য জবাব দেওয়ার সময় এসেছে। আর্য ফোন তুললো না। জবাব দেওয়ারও প্রয়োজন মনে করল না। কিন্তু বারবার ফোন বাজতে থাকায় একটু অস্বস্তির মধ্যে পড়ল। ফোন ধরা উচিত। হয়তো কোনো প্রয়োজন রয়েছে! আর্য ফোন ধরতে দ্বিতীয়বারের মতো অবাক হলো। বিক্রমের ফোনে রিম্পির কণ্ঠস্বর। কিছুই বুঝতে পারলো না। হঠাৎ করে সমস্ত কথা হারিয়ে ফেলল। এমনটা কি করে হলো? ঠান্ডা মস্তিষ্কে সবকিছু চিন্তা করল। ধীরে ধীরে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে উঠল। সপ্তাহখানেক আগে রিম্পির বিয়ে হয়ে গেছে বাবার মুখে শুনেছিল। রিম্পি নিজেও ডেকেছিলো বিয়েতে কিন্তু ব্যস্ততার কারণে যেতে পারিনি। তবে আর্য বিয়েতে একদমই মন ছিল না। রিম্পির বয়স একুশ-বাইশ হলেও, আর্যর চোখে বালিকা সে। তাছাড়া রিম্পি কোনো কাজ করে না। বিয়ের পর অন্য কোনো মানুষের উপর নির্ভর করুক সে চাইছিল না। কিন্তু কাকামশাই কোনো কথা শোনেননি। রিম্পির পর আরও দুটো মেয়ে রয়েছে। অনেক দায় নাকি তাঁর ঘাড়ে চেপে বসেছে। নিজের মেয়ে অধিকার সামান্য হলেও তাঁর বেশি। অশোক বাবু ভাইকে অনেক বুঝিয়েছিলেন কিন্তু শোনেননি। শেষমেষ বিয়েও হয়ে যায়। আর্য এ ও জানতে পেরেছিল, রিম্পির বিয়ে লাভ ম্যারেজ নয় অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। সবকিছুই চোখের সামনে ভেসে উঠলো। কিছু বুঝতে বাকি রইল না। আর্যর কথা বলার ধরণ দেখে এবং মাঝেমধ্যে আঁতকে উঠতে দেখে রিম্পি কিছু একটা সন্দেহ করল। বলল,”তুই কি বিক্রম কে চিনিস? মনে হচ্ছে তুই এই নাম্বারের সঙ্গে পরিচিত?”
“না তো। আমি কি করে চিনবো?” আর্য পরিচয় গোপন করলো। পুরনো মুহূর্ত তুলে এনে কাউকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলতে চাইলো না।
“বিক্রমের সঙ্গে কথা বলবি?”
“হুম দে।” বিক্রমের সঙ্গে আর্য অনেক সময় ধরে কথা বলল। কিন্তু বিক্রম কিছুতেই বুঝতে পারল না, এই মানুষটি সেই মানুষ।যাকে এক সময় কোনো কারণ ছাড়া অশ্লীল ভাষায় গালি দিয়েছিল। কিন্তু ওই মানুষটা তাকে কিছু বলেনি। আজও বলল না। জামাই হিসেবে যতটুকু ভালোবাসা প্রাপ্য তার চাইতে অনেক বেশি ভালোবাসা পেলো। লাইন কেটে দেওয়ার পর হাসি খুশিতে হৃদয় ভরে উঠলো আর্যর। মাতাল হৃদয়ে প্লাবন বয়ে গেল। সে জানে, স্নেহার একমাত্র পিছুটান বিক্রম। এই মানুষটির প্রতি ভীষণ দুর্বল। এর জন্য অনেক কিছুই করতে পারে। এবার আর কোনো পিছুটান থাকবে না। বিক্রমের বিয়ে হয়ে গেছে। স্নেহাকে বিয়ে করতে আর কোনো সমস্যা হবে না। এতগুলো বছর কোনোরকম যোগাযোগ না থাকলেও আর্য ঠিক অপেক্ষা করে আছে স্নেহার। একদিন ফিরে আসবেই। আচার্য পরিবারের একমাত্র ছেলের ধুমধাম করে বিয়ে হবে। সবাই মিলে আনন্দ করবে। সকল আত্মীয়-স্বজন উপস্থিত থাকবে। সবাইকে সাক্ষী রেখে সবার আশীর্বাদ নিয়ে বিয়ে করবে। কিন্তু আর্যর সেই স্বপ্ন পূরণ হলো না। একসময় দীপক বাবু স্নেহার বিয়ের কথা তুললেন। স্নেহার পছন্দের মানুষ আছে কিনা জানতে চাইলেন। কিন্তু স্নেহা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয় তার জীবনে কোনো পছন্দের মানুষ নেই। বাবা-মার পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। দীপক বাবু আর্যর কথা তুলেছিলেন। কারণ, তিনি জানতেন স্নেহার সবচেয়ে ভালো বন্ধু আর্য। স্কুল জীবন থেকে একে অপরের পাশে আছে। একটা গুড ফ্রেন্ডশিপ একটা গুড রিলেশনশিপ হতে পারে। কিন্তু স্নেহা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয়, আর্য তার ভালো বন্ধু। বিয়ে করে তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক নষ্ট করতে চায় না। দীপক বাবু আর কিছু বলেননি। মেয়ের কথায় রাজি হয়ে যান। শেষমেষ উৎপলের দুটি হাতে বাঁধা পড়ে স্নেহার দুটি হাত।
পর্ব ২৫ আসছে
বিঃদ্রঃ এখানেই অতীতের সমাপ্ত। আর কোনো অতীত নেই। পরবর্তীতে,গল্পের প্রথম অংশে স্নেহার বিয়ে হয়েছিল তার পরবর্তী কাহিনী থাকবে।