কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ পর্ব-৩

0
659

কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ
পর্ব ৩
__________________
রাত্রির কালো পর্দা সরিয়ে একটি রৌদ্রদীপ্ত দিনকে উপহারস্বরুপ শ্যামা ধরিত্রীর হাতে তুলে দেয় যে, সে উষা-তপনের দ্রুতি, অরুণ রমণী। ঊষার আবির্ভাব রাত্রি বিদায় ও দিনের শুভসূচনা সন্ধিক্ষণ। তার পিছনে পিছনে চলে সূর্য দেব আবির্ভাব,আবির্ভূত হন উদয়াচলে। সূচিত হয় প্রভাত। প্রবাদে আছে শব্দ জাগরণের স্নিগ্ধ প্রশান্তি। আছে শুভ্র শুচিতা, আছে অরুণ অরুণের সোনা হাসিতে উজ্জ্বল কর্মচঞ্চল প্রাণের স্নিগ্ধতা। আর্যর গৌর বর্ণ লিকলিকে শরীর থেকে জলের রেখা ঝরে পড়ছে। মাথায় বড়ো বড়ো এলোমেলো চুলে ভর্তি। চুলে জল জমে থাকার দরুন চুল গুলো স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারছে না। তীব্র ঠান্ডা দেহকে কাইল করতে পারেনি। নিত্য দিনের অভ্যাস। আর্য, পুরো নাম আর্য আচার্য। ব্রাহ্মণ ঘরের সন্তান। তেরো বছর বয়সে উপনয়নের পর থেকে অশোক বাবু নিজের কাজ ছেলের হাতে তুলে দিয়েছেন। উপনয়ন কথাটি শুনলে আর্য কেমন একটা গম্ভীর হয়ে ওঠে। তার ব্যবহার আচমকা পরিবর্তন‌ হয়ে যায়। কি অদ্ভুত নিয়ম ব্রাহ্মণ সমাজে! আর চারজন হিন্দু পরিবারের থেকে ব্রাহ্মণ পরিবারের নিয়ম যে আকাশ পাতাল পার্থক্য সেদিন বুঝতে পারে । উপনয়নের দিন থেকে পরপর তিনদিন এক অন্ধকার কক্ষে বন্দি করে রাখা হয়েছিল তাকে। পাশে কেউ ছিল না। চড়ু ছাড়া আর কোনো খাবার দেওয়া হয় নি। ভয় পিয়েছিলে, আঁতকে উঠেছিল, অথচ এই গৌণ বিষয় গুলোকে কেউ গুরুত্ব দেয়নি। নিয়ম পালন করতে বাধ্য। উপনয়ন যাকে চলতি ভাষায় পৈতে বিয়ে বলা হয়। বিয়ের আচার-অনুষ্ঠানের সাথে এই অনুষ্ঠানের অনেকাংশই সাদৃশ্য রয়েছে। এত অল্প বয়সে এমন ধর্মীয় অনুষ্ঠান মোটেও পছন্দ করেনি আর্য। জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপর ধীরে ধীরে বুঝতে শিখেছে সেগুলো ধর্মীয় কুসংস্কার ছাড়া অন্য কিছু নয়। কিন্তু তাঁর বাবার মত একজন মানুষ তাকে ধর্মীয় কুসংস্কার শিখিয়েছে, সেটা বাস্তবে অনুভব করলেও মন থেকে মানতে পারছে না। মন এক কথা বলছে তো -বাস্তব আর এক কথা। কৌতূহলবশত মনের মধ্যে সুপ্ত থাকা সমস্ত প্রশ্ন একদিন বাবার কাছে খোলাসা করে। ঠান্ডা মস্তিষ্কে তিনি ছেলেকে সবকিছু বুঝিয়ে বলেছিলেন,যুগ যুগ ধরে যে প্রণালী পালন হয়ে আসছে সেগুলো কে হঠাৎ করে আবৃত করা সম্ভব নয়। সমস্ত কিছুকে কুসংস্কার বলে পরিহার করাও বোকামি। ধর্মের প্রতি যেমন গোঁড়ামি থাকা অনুচিত, তেমনই ধর্মের প্রতি বিশ্বাস থাকাটাও স্বেচ্ছাচারী। যে মানুষ ফুলকে ভালোবাসতে পারে না, গানকে ভালোবাসতে পারে না, মানুষকে ভালোবাসতে পারে না, সৃষ্টিকর্তাকে ভালোবাসতে পারে না, তারাই কিন্তু পরবর্তী সময়ে উগ্র জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি করে। আজকাল অধিকাংশ মানুষ মূর্তিপূজায় বিশ্বাস করে না। তবুও তারা মূর্তিপূজা করে। কারণ, কিছু কাজের মাধ্যমে তারা মনের শান্তি পায়। জীবনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য মনের শান্তি অত্যন্ত জরুরী। মনের শান্তি থেকে বড়ো কিছু হতে পারে না। তা ছাড়া,ভোরে ঘুম থেকে ওঠা,সকালে শুদ্ধ বায়ুর সংস্পর্শে আসা -শরীরে অনেক উপকার রয়েছে।পৃথিবীর সবচেয়ে উর্বর ব্যক্তিরা খুব ভোরে বিছানা ত্যাগ করতেন এবং স্নান করতেন। সারাটা দিন কেমন যাবে সকালই বলে দেয়। আর্য, বাবার প্রথমের অভ্রান্ত যুক্তি সেদিন কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। এত দিন বাবার সমস্ত কথা যুক্তিপূর্ণ মনে হলেও, সেদিন বাবার কথাগুলোকে যুক্তিহীন মনে হয়েছে। কিছু জিনিস যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে বলে, সে গুলো বয়ে বেড়াতে হবে; সেটা নিতান্ত অর্থহীন। সৃষ্টিকর্তা চোখ দিয়েছেন, বুদ্ধি দিয়েছেন, হাত-পা দিয়েছেন -সবকিছু নিজের চোখে দেখে নিজেকে বিবেচনার জন্য । অন্যের কথায় নিজেকে বিচলিত করলে চলবে না। তবে বাবার অবাধ্য হয়নি সে। ব্রাহ্মণ পরিবারের যে সমস্ত নিয়ম ঐতিহ্য,সংস্কৃতি রয়েছে সবগুলো পালন করে আসছে। তেরো বছর বয়স থেকে রোজ সকালে স্নান করে পুজোয় বসে। প্রথম প্রথম এই জিনিসের প্রতি কোনো কৌতূহল ছিল না। তারপর এক সময় বিষয়টির প্রতি ভালোবাসা আসলো। বিশ্বাস জেগে উঠল। এত শান্ত নিরব জায়গায় তার থাকতে বেশ ভালোই লাগে। সকালের অলসতা আপনা আপনি দূর হয়ে যায়। এত ঠান্ডায় স্নান করতে দ্বিধাবোধ করে না।যার প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস রয়েছে, তার জন্য অনেক কঠিন কাজ সহজ হয়ে যায়। মন্দিরে প্রবেশ করে খুব নিখুঁতভাবে সংস্কৃতে মন্ত্র পাঠ করে পূজা-অর্চনা শুরু করল আর্য। এইটুকু বয়সে অনেক সংস্কৃত মন্ত্র নিজের আয়ত্তে এনেছে। কোনো সাধারণ মানুষ সহজে বিশ্বাস করে না, আর্য সমস্ত পূজা-অর্চনা জানে। বই না দেখে অনাহাসে মন্ত্র পাঠ করতে পারে। অনেক গ্রাম বাসীর দাবি, আর্য ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। তার রক্তে ব্রাহ্মণের রক্ত বইছে।তাই সহজে সেগুলো রপ্ত করতে পেরেছে। কিন্তু গ্রামবাসীর কথা মানতে চান না অশোকবাবু। আমাদের সমাজে অনেক ব্রাহ্মণ পরিবার রয়েছে। সমস্ত পরিবারের ছেলেরা; কিন্তু পূজা অর্চনা পারে না। তারাও ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। তাহলে, তারা কেন সহজে মন্ত্র পাঠ রপ্ত করতে পারেনি? পরিশ্রম ছাড়া এই জগতে সবকিছুই অসম্ভব। সে আজ যা কিছু পেয়েছে সবই পরিশ্রমের কারণে। ছোটবেলা থেকে বাবার পাসে বসেছে। বাবার সমস্ত কথা শুনেছে। কখনো অবাধ্য হয়নি। বাবার প্রতিটা কথা মনোযোগ সহকারে শুনে সেগুলোকে নিজের জীবনে প্রয়োগ করেছে। মিনিট কুড়ির মধ্যে তার পূজা অর্চনা শেষ হয়। সাদা ধবধবে ধুতি, গায়ে উত্তরি পড়ে মন্দিরের বাইরে বেরিয়ে আসলো। হাতে প্লেট ভর্তি প্রসাদ। টিয়া আর রুপাকে দেখে এক পলক হেসে উঠল। তারা প্রায় প্রত্যেক দিনে পুজোর ঘন্টি শব্দ শুনে মন্দিরের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে যায়। আর্যর কাকিমার জমজ মেয়ে টিয়া আর রুপা। বয়স প্রায় ছয় বছরের কাছাকাছি। তারা নিজের মায়ের থেকে বেশির ভাগ সময় আর্যর কাছেই থাকে। সেও মেয়ে দুটোকে খুব ভালোবাসে। দুটো গালে হামি দিল। তারপর আর্য বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করল। বাবাকে প্রনাম করে একটা নতুন দিন শুরু করল। এটাই তার নিত্যদিনের রুটিন। এরপর টিউশন থাকলে টিউশন চলে যাও, না হলে পড়তে বসে যায়। সমস্ত অলসতা দূর হয়ে গেছে। মনের মধ্যে শুধু শান্তি আর শান্তি। বেশ আরাম লাগছে। মন্দিরে প্রবেশ করলে নিজের মন এত শান্ত হয়ে যায় কেন, তার উত্তর এখনো খুঁজে বার করতে পারিনি। বাবার বলা পুরনো কথাগুলো মনে পড়ছে। তেরো বছর বয়সে,বাবার সেই কথা গুলোর উপর যেমন নির্ভরযোগ্য হতে পারেনি, তেমনি সেই কথাগুলোকে বিসর্জনও দিতে পারেনি।

স্কুলের ছুটির ঘন্টা প্রায় দশ মিনিট হলো পড়ে গেছে। তবুও স্নেহার দেখা নেই। স্কুলের বাইরে একটা ছোট সিমেন্টের বেঞ্চের উপর বসে আছে আর্য। অপেক্ষায় আছে স্নেহার। এক সঙ্গে দুজন ক্লাস শেষ করেছে। একজন কতক্ষণ থেকে এসে বসে আছে আর একজন স্কুল থেকে বেরিয়ে আসছে না। স্নেহার সঙ্গে দেখা না করে একা বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। রাগ করবে। বন্ধুত্বর মানে হলো, একে অপরের প্রতি বিশ্বাস অগাধ ভালোবাসা। সমস্ত কিছুর বিনিময় বন্ধুর পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। অপেক্ষা করা। সব কিছু কথা একে অন্যের সাথে শেয়ার করা। স্নেহা বন্ধুত্বের সমস্ত বৈশিষ্ট্য পালন করে। কিন্তু আর্য যদি স্নেহার জন্য সামান্য অপেক্ষা করতে না পারে। তাহলে সে বন্ধুত্ব তো একতরফা হয়ে যায়। বিশ্বাস মুছে যায়। তেমনটা হোক কখনো চায় না। যতক্ষণ লাগুক সে অপেক্ষায় থাকবে। মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করার পর আর্য স্নেহার দেখা পেল। আর্যকে দেখে দূর থেকে খিলখিল করে হাসছে স্নেহা। আর্য একটা প্রসন্ন হাসি দিয়ে দূরে তাকিয়ে থাকলো নির্মল চোখে। এই একটি পোশাকে স্নেহাকে বড্ড সুন্দর দেখায়। মায়াবী লাগে। স্কুলের বেশিরভাগ মেয়ের কাছে তাদের শাড়ির রঙ বড্ড বিরক্ত কর। মোটেও পছন্দ হয়নি। অথচ আর্য এই শাড়িতে স্নেহাকে দেখতে ভীষণ পছন্দ করে। সাদা শাড়ি গ্রে পাহার, বড়ো বড়ো চুল সুন্দর করে গোছানো। কানের কাছে কাটা দাগ। ঘাড়ের কাছে কালো তিল। রোগা-পাতলা মুখখানার মাঝখানে ছোট্ট দুটো জ্যোতিহীন চোখ বারবার মহিত করে আর্যকে। স্নেহা আর্যর কাছে আসলো। তার হাতে দুটো ক্যাডবেরি দিল। আর্য হাত মুঠো করে ধরলো।
“স্কুল ফাঁকা হয়ে গেছে। একটা স্টুডেন্ট নেই। আর তুই এতক্ষণ স্কুলের মধ্যে কি করছিলি?”
স্নেহা স্কুল ব্যাগ থেকে চাবি বের করে সাইকেলের লক খুললো। সাইকেলের উপর চেপে বসে। সাইকেলের প্যাডেল গড়ালো। তার দেখাদেখি আর্যও সাইকেল চালানো শুরু করলো। আবেগময় মন নিয়ে কৃষ্ণচূড়া ঘেরা রাস্তার মধ্যেখান দিয়ে চলতে শুরু করলো।
“কি রে! উত্তর দিচ্ছিস না কেন?”
“তোর জন্য ক্যাডবেরি আনতে গেছিলাম। কিন্তু আন্টি দেরি করেদিল। কি করব বল?”
আর্য লক্ষ করল স্নেহা কথা এড়িয়ে যাচ্ছে। এটা ঠিক, স্নেহা প্রত্যেকদিন আর্যকে ক্যাডবেরি কিনে দেয়। কিন্তু একটা ক্যাডবেরি এত সময় নষ্ট করতে পারে না। কিছুক্ষণ নিরবতা। শুধুমাত্র সাইকেলের প্যাটেলের শব্দ কানে বাজছে। বড্ড আনমনা লাগছে স্নেহাকে। চঞ্চল প্রকৃতির মেয়েকে শান্ত দেখতে মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। সব সময় হাসিখুশি থাকা মেয়েটি চুপ হয়ে গেল কেন?
“তোকে এত তন্ময় দেখাচ্ছে কেন?” স্নেহা আর্যর দিকে মুখ ফিরিয়ে ফিক করে হেসে উঠলো।
“আজকাল দেখছি সাহিত্যিকের মত নতুন নতুন শব্দ ব্যবহার করছিস। সাহিত্যিক হওয়ার ইচ্ছা আছে?”
“ইচ্ছা তো অনেক কিছুতে আছে। সব ইচ্ছে কি পুরণ হয়?” সাইকেলে বসে নিজের অলসতা ভাঙ্গার চেষ্টা করল আর্য। “আবার শুরু করলি। জ্ঞানী জ্ঞানী কথা ছাড়া কি তোর কাছে আর কোন কথা থাকে না!” স্নেহা মাথার চুল ঠিক করতে লাগল। আরো কিছুটা সময় এ ভাবে কাটল। অর্ধেকের বেশি রাস্তা তারা পেরিয়ে এসেছে। এবার দুজনের গন্তব্য আলাদা। তাদের বাড়ি কাছাকাছি নয়। প্রায় পাঁচ কিলোমিটারের ব্যবধান। নির্দিষ্ট মোড়ে এসে স্নেহা হাত নাড়িয়ে আর্যকে বিদায় জানায়। মোড় ঘুরে দাঁড়িয়ে পড়ে আর্য। স্নেহার চলে যাওয়ার দিকে চোখ রাখে। স্নেহা যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের মোড় সম্পূর্ণ না ঘুরছে, ততক্ষণ পর্যন্ত চোখ স্থির রাখল। স্নেহা এই বিষয়টি সম্বন্ধে অভ্যস্ত। সে জানে, আর্য দাঁড়িয়ে থাকবে। মোড় ঘোরার আগে, সেও একবার চোখ ফিরিয়ে আর্যকে দেখলো। আর্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। হয়তো, বিষয়টি অত্যন্ত সহজ-সরল। কিন্তু তার ভালো লাগে। এরমধ্যে তৃপ্ততা খুঁজে পায়। মনকে শান্ত রাখতে পারে। মোড় পেরিয়ে দীর্ঘ ফাঁকা রাস্তায় একা যেতে হবে স্নেহাকে। শীতকাল, তাই সাড়ে চারটা সময় আকাশ অনেক অন্ধকার হয়ে এসেছে। সূয্যিমামা পশ্চিম দিগন্তে বিদায় নেওয়ার জন্য প্রস্তুত। মাঝেমধ্যে দমকা শীতল হাওয়া তাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। তার বদ্ধকর জীবন ভালো লাগে না। সে মুক্তি চায়। স্বাধীনতা চায়। এত শাসন পছন্দ করে না। চার দেওয়ালে বন্দী থাকতে ইচ্ছে করে না। আর চারটে সাধারণ মেয়ের মত, তার বেড়ে ওঠা হয়নি। একঘেয়েমি একাকীত্বতা নিয়ে বড় হয়েছে। সারাদিন বইয়ের মধ্যে মুখ লুকিয়ে রাখতে হয়েছে। নিজের পছন্দ-অপছন্দকে সব সময় বিসর্জন দিতে হয়েছে। বাবা-মার হুকুম চিরকাল মানতে হয়েছে। তার চাইতে প্রায় চার-পাঁচ বছরের ছোট নিলেশ, আকাশ আর টিকলি কত ভালূ বন্ধু। তাদের সাথে কাটানো কয়েকটি মুহূর্ত ছাড়া, আর তেমন কোনো ভালো মুহূর্ত নেই। সব ফ্যাকাশে। তারপর স্কুলে পড়াকালীন পরিচিত হয় আর্যর সাথে। এমন শান্তশিষ্ট নিরীহ ছেলে তার জীবনে প্রথম দেখা। তবে মনের জোর অসীম। সব সময় নতুন কিছু সৃষ্টির চেষ্টা করে। কোনো বাঁধা মানতে চায় না। এলোমেলো ছেলেটি তার স্কুল জীবনে প্রথম ছেলে বন্ধু। তার সাথে গল্প করতে কথা বলতে খুব ভালো লাগে। কত সুন্দর বাক্য সাজিয়ে কথা বলে। যা সচরাচর একজন শিক্ষিত ভদ্র মানুষ বলতে পারে না। এত কম সময়ে কি করে বাক্যগুলোকে সুন্দরভাবে সাজায়, তা জানে না স্নেহা। দু-চোখ বন্ধ করে আর্যকে বিশ্বাস করতে পারে। তার কথা মনে পড়লে মনে দোলা দিয়ে ওঠে। আলাদা একটা আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে। মাঝে মাঝে মনে করে, সে অনেক ভাগ্যবতী। জীবনে এমন একটি ভালো বন্ধু পেয়েছে। যাকে কখনো হারাতে চায় না। আর্য প্রথম তার জীবনে মুক্ত স্বাধীনতার চেতনা জাগিয়েছে। তাই তার প্রতি ভালোবাসা নিবিড়। কিন্তু সে কখনো বুঝতে পারেনি, আর্য নিজেই একটি বন্দি খাঁচার পাখি।

রাতে দরজায় টোকা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধড়ফড় করে বিছানা থেকে উঠে পড়ল আর্য। তার বাবা ফিরেছেন। মা দরজা খুলবে না জানে। তিনি ভীষণ কুঁড়ে। বিছানায় গা এলিয়ে দিলে,সেখান থেকে উঠতে চান না। তারপর সময়টা যদি হয় শীতকাল….। আর্য দরজা খুলে দেখলো বাবা থর থর করে কাঁপছে। বাইরে শীতের ভয়াবহতা আন্দাজ করতে পারল। অশোক বাবু বাড়িতে প্রবেশ করে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন,” উফ!বাইরে কি শীত!তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দে।”
“একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলে অসুবিধা কোথায়? শীত পড়েছে জানো না! এত রাত পর্যন্ত কে জেগে থাকবে বলতো। তারপর আবার ঠান্ডা লেগে গায়ে জ্বর উঠাবে।” দরজা বন্ধ করতে করতে আর্য কথাগুলো বলল। অল্প বয়সী ছেলের কাছ থেকে এত আদর যত্ন ভালোবাসা শাসন পেয়ে মুগ্ধ আশোক বাবু। সেই ছোটবেলা থেকে অশোকবাবু বাবাকে হারিয়েছেন। এখন ছেলের মধ্যে নিজের বাবাকে খুঁজে পান। তিনি তেমন একটা শাসন, ভালোবাসা, আদর, যত্ন পাননি। এই বয়সে এসে আদর,যন্ত, শাসন পেতে বেশ ভালোই লাগছে। নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করেন। তার পরিবারে এমন একটা সন্তান জন্ম নিয়েছে, অল্প বয়সে দায়িত্ব নিতে শিখে গেছে। সব সময় নিজেকে নিয়ে নয়,পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কথাও গভীরভাবে ভাবে । আর্য সবার চোখে ভালো হয়ে ওঠার পেছনে যে মানুষটি ছায়ার মতো আড়ালে রয়েছেন, তিনি অশোক আচার্য। একটি শিশু যখন ভূমিষ্ঠ হয়, তখন বলা যায় না ,সে কেমন হবে? সে প্রথম তার পরিবারের শিক্ষা গ্রহণ করে। তার বাবা-মা দেখানো পথে এগিয়ে চলে। তারপর একটা নির্দিষ্ট সময়ে বাবা-মা সন্তানকে একা ছেড়ে দেয়। কারণ, জীবনের বেশিরভাগ পথটা একা এগিয়ে যেতে হয়। জীবনের সঙ্গে লড়াই নিজেকে করতে হবে। তবেই তো জীবনের মানে বোঝা যায়। জীবনে চলার পথে শারীরিক-মানসিক অনেক যন্ত্রনার আগমন ঘটে। লোভ-লালসা, হিংসা, প্রতি হিংসা, বিদ্বেষ জন্ম নেয়। কিছু মানুষ বাবা-মার দেওয়া শিক্ষা ভুলে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। আবার কিছু মানুষ সব কিছুর বিনিময় বাবা মার দেওয়া শিক্ষাকে স্বতন্ত্র করে রাখে।যারা বাবা মার দেওয়া শিক্ষাকে মন থেকে গ্রহণ করে, সব সময় তাদের আদর্শ মেনে চলে। তারা কখনো খারাপ কাজ করতে পারে না। কারণ, কোনো বাবা-মা চায় না তার সন্তান সমাজের চোখে খারাপ হোক। বাবা-মা সবসময় সন্তানকে ভালো শিক্ষাই দেয়। অশোক বাবু জানেন না, তার ছেলে ভবিষ্যতে কি করবে? বড় হয়ে এইভাবে বাবা মাকে ভালোবাসবে -না দূরে ঠেলে দেবে। সেটা নির্ভর করছে সম্পূর্ণ আর্যর উপর। মানুষের মন বড় চঞ্চল। বদলাতে এক সেকেন্ডেরও প্রয়োজন হয় না।
আর্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করল না, সে মেঝেতে আসন পেতে দিল। লবণ কৌটো, লঙ্কা, জলের মগ , আসনের কাছে এনে রাখলো। সমস্ত গোছানো শেষ। বাবাকে তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে বলল। নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখনই পেছন থেকে বাবা ডাকলেন। অবাক হওয়ার মতো কোনো কারণ নেই। কাছে আসলো। তিনি ব্যাগ থেকে দাবা খেলার সরঞ্জাম বার করে, ছেলের হাতে দিলেন। এটা তোর জন্য। বাড়িতে প্রায় সময় একা থাকিস। মাঝেমধ্যে খেলবি ভালো লাগবে। কেমন হয়েছে?
“ভালো।” আপনা আপনি মুখ থেকে কণ্ঠস্বর বেরিয়ে আসলো। সে সম্পূর্ণ হতভম্ব। শরীর কেঁপে উঠল। আর অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। হাসতে না চাইলেও বাবার সামনে একটু হেসে নিজের রুমে চলে আসলো। আলো নিভিয়ে দিল। দাবা খেলার সরঞ্জাম টেবিলের উপর রেখে চুপচাপ বসে পড়ল। মনে অনেক প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। বাবার কাছ থেকে প্রথম উপহার পেল, এমনটা নয়। কিন্তু বাবার দেওয়া উপহার গুলো বড্ড অদ্ভুত রকমের। তার অপছন্দের জিনিস গুলো সব সময় উপহার দেয়। তার জীবনের সবচাইতে অপছন্দ এবং একটা বিচ্ছিরি জিনিস দাবা। জোর করে বসালেও পাঁচ মিনিটের বেশি খেলে না। সেটা অশোক বাবু খুব ভালো করে জানেন। কি আশ্চর্য! তিনি সেটাই উপহার দিলেন। এর আগে তিনি একটা বই উপহার দিয়েছিলেন। যে বইয়ের মধ্যে একটা অক্ষরও লেখা নেই। সেটাকে কি আদৌ বই বলা সম্ভব? -সেটা তো খাতার মধ্যে পড়ে। কিন্তু তার গঠন কাঠামো সম্পূর্ণ বই। অদ্ভুত বিষয় হলো, তিনি এমন একটা ভুতুড়ে বই কোথা থেকে পেলেন? সেগুলো আবার উপহার! বাবার এমন পাগলামো অন্যের কাছে হাসির খোরাক হয়ে দাঁড়াবে, সে বিষয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিত। কিন্তু বিষয়টি মোটেও হাসির নয়। সমস্ত প্রশ্ন গুলিয়ে যাচ্ছে। তিনি বয়স্ক মানুষ। প্রচুর বই পড়েছেন। অভিজ্ঞতা অনেক। জীবনের মানে সামান্য হলেও বোঝেন। অন্ধকারের মধ্যে আর্য বাবার দেওয়া উপহার গুলো হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করল। এগুলো উপহার নয়। জীবনের গোলকধাঁধার সূত্র। জীবন কিছুটা অংকের মতো।অনেক সময় অংক করার ক্ষেত্রে কোনো বড় শব্দ না লিখে একটা ছোট্ট চিহ্ন ব্যবহার করে উক্ত শব্দটিকে বোঝানো হয়। ক্ষুদ্র জীবনটাকে ভাষায় বর্ণনা করা সহজ নয়, আবার কঠিনও নয়। কয়েকটি বাক্যের মাধ্যমে একটাই জীবন বর্ণনা করাও সম্ভব। চোখের সামনে কিছু মানুষ রয়েছে,যাদেরকে কিছু বাক্য শোনালে তাদের জীবনে অনেক অতীত মনে পড়ে যায়। মনে করেন এই বাক্যের মধ্যে তাদের জীবন পুরোপুরি লুকিয়ে আছে। অংকের একটি সঠিক চিহ্ন যেমন একটি সঠিক শব্দকে চিনিয়ে দেয়, তেমন কিছু সঠিক বাক্য পুরো জীবনটাইকে বুঝিয়ে দেয়। হয়তো, এই উপহার গুলোর মাধ্যমে অশোক বাবু জীবনের বড় কিছু বর্ণনা করতে চাইছেন। উপহার গুলোর মূল্য কম হলেও, ভেতরে পরীধি বিশাল।

পর্ব ৪ আসছে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here