কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ পর্ব-৫

0
281

কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ
পর্ব ৫
___________________
হেমন্তের পৌঢ়ত্বের পর আসে জড়গ্রস্ত শীতের বার্ধক্য। আবহমান গ্রামবাংলার অন্যান্য সকাল থেকে শীতের সকাল আলাদা। প্রকৃতির পালাবদলে শীত আসে রিক্ততা আর শুষ্কতা নিয়ে। ফসলহীন মাঠ,ঝরা পাতা প্রকৃতি যেন বৈরাগীর বসন পরেছে। শীতের সকাল আসে কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে। কোমল সূর্যরশ্মিতে ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দু গুলো মুক্তোর মত ঝলমল করে।গাছের পাতা থেকে টুপটাপ শিশিরের ঝরে পড়ার শব্দ, আর পাখির কলরব আন্দোলিত করে গ্রামের জীবনকে। কর্মমুখী মানুষ শিশিরভেজা মেঠো পথে পা রাখে। জীবিকার প্রয়োজনে হাড় কাঁপানো শীত পরোয়া করে না ওরা। কুয়াশা ভেদ করে ছুটে চলে যে যার কাজে।কতটা বেলা হলো বোঝার উপায় নেই। বেলা যেন থমকে দাঁড়িয়েছে, কেন না সূর্যের দেখা নেই। কুয়াশা বারবার সূর্যকে আড়াল করছে। শীতের আগমনের সাথে সাথে বনভূমিতে শুরু হয় হাহাকার , মালতীলতা হয় পত্র শূন্য। খেজুর গাছের আগায় ঝুলছে খেজুর রসের ছোট্ট হাঁড়ি। সূর্যের মিটিমিটি আলো দেওয়ার আগে গাছিরা বেরিয়ে পড়ে রস সংগ্রহে। ক্ষেতের পর ক্ষেত থাকে সরষে ফুল। ফুলের উপর উঠে চলা রঙিন প্রজাপতি কিংবা মৌমাছিদের মেলা মন হরণ করে। শীত মানে সরষে ফুলের হলুদ বন্যা। শীতের দাপট থামাতে পারে না পাখির চঞ্চলতা। কৃষকের মতো কৃষক-বধূ গৃহস্থলীর কাজে লিপ্ত হয়। হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় পুকুরের জল স্পর্শ করে বাসন মাজে। গৃহপালিত পশুর জন্যও আছে শীতের পোশাক। ডালি হাতে ফুল তোলার জন্য বের হয়েছে স্নেহা। বাড়ির বাগানে গিয়ে হতাশ হয়। তার আগে কেউ সব ফুল তুলে নিয়েছে। রাগে গন গন করতে থাকে। তাদের বাড়িতে প্রত্যেকদিন পুজো হয়। কিন্তু প্রভাত হওয়ার অনেক আগে গাছ শূন্য করে ফুল তুলে নিয়ে যাওয়া যুক্তিসংগত নয়। মানতে পারে না স্নেহা। সে সম্পূর্ণ নিশ্চিত, এই কাজ আকাশ কিংবা নিলেশ উভয়ের মধ্যে একজন করেছে। এই গ্রামে তারা দুজনই খুব সকালে উঠে ফুল তুলতে বের হয়। গ্রামের প্রত্যেকের বাড়িতে গাছ শূন্য করে ফেলে। উভয় পাল্লা দিয়ে চলে, কে বেশি ফুল সংগ্রহ করতে পারে? শীত, বর্ষা কোনো কিছু তোয়াক্কা করে না। তাদের এই অযৌক্তিক সংগ্রামের জন্য বাড়ির সদস্য পাশাপাশি গ্রামের গৃহবধূদের থেকে বকুনি খায়, কিন্তু থামে না। প্রয়োজনের তুলনায় অতিরুক্ত ফুল তুলে নিয়ে অন্যকে শুন্য হাতে ফিরিয়ে দেওয়া যে দৃষ্টিকটু সেটা তারা বুঝেও বোঝে না। ওমন সময় স্নেহা নিলেশকে দেখতে পায়। কাছে ডাকে। সন্তর্পনে কাছে এসে উপস্থিত হয়।
“অ্যয়, আমাদের সব ফুল তুলে নিয়েছিস কেন?”
“আমি তুলিনি!”
“আবার মিথ্যা বলছিস!”
“মা কালীর দিব্যি,আমি তোদের বাড়ির ফুল তুলিনি। আমিতো টিকলির বাড়ির দিকে গিয়েছিলাম। এটা আকাশের কাজ হতে পারে।”
“দুটোই বড় বদমাশ হয়েছিস। তোদের জন্য কিছু থাকবে না।”
এই সময় আকাশকে ডালি ভর্তি ফুল নিয়ে আসতে দেখা গেল। আকাশকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে স্নেহা ডাক দিল। স্নেহাকে দেখতে পেয়ে আর সামনের দিকে এগিয়ে গেল না। দৌড়ে পালিয়ে গেল। স্নেহা চিৎকার করে বারবার ডাকতে থাকলো। রেগে গিয়ে বেশ বকাঝকা করল। কিন্তু, কে শুনে কার কথা।কবিতা দেবী পুকুরপাড়ে বাসনপত্র পরিষ্কার করছিলেন। মেয়ের চেঁচানো গলা শুনে উঠে দাঁড়ালেন। কাছে আসতে বললেন। স্নেহা নিলেশের কাছ থেকে কয়েকটা ফুল নেয়, তাও আবার অনেক জোরজবস্তি করে। তাকে বিদায় জানিয়ে মায়ের কাছে আসে। মায়ের বকুনি শুরু হয়। এত বড় একটা মেয়ে, ওই বাচ্চা ছেলেদের সঙ্গে বাচ্চা হচ্ছিস। বিবেকবোধ এখনো জাগ্রত হয় নি। স্নেহা দাঁড়িয়ে মায়ের সব কথা হজম করছে, কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। পরিষ্কার করা বাসনগুলো তিনি মেয়ের হাতে দিলেন। বাসনগুলো নিয়ে বাড়ির মধ্যে চলে আসে। নির্দিষ্ট জায়গায় বাসন পত্র রাখে। ভাইকে ডেকে তোলে। দুজন ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করে। বাবার জন্য চা বানিয়ে দেয়।বাবা কাজে বেরিয়ে যাওয়ার পর, স্নেহা বই পত্র নিয়ে ছাদে চলে যায়। রোদের মধ্যে মাদুর পাতিয়ে পড়তে বসে। দীর্ঘ সময় ধরে পড়ায় মনোযোগী হতে গিয়েও ব্যর্থ হলো। এই জিনিসটি জোর করে হয় না। বারবার বইয়ের পাতা উল্টাতে থাকে। বিক্রমের কথা মনে পড়ছে। দিন দিন বদলে যাচ্ছে সে। হয়তো, প্রথম থেকে এমনি ছিল। যতই তার সঙ্গে মিশছে ততই তাকে চিনতে পারছে। তার মধ্যে ইগো জিনিসটা খুব বেশি পরিমাণে রয়েছে। যখন তার মনে হয় কেউ তার আত্মসম্মানে আঘাত করছে, তখনই প্রতিবাদ করে ওঠে। তার মুখের উপর উত্তর দিয়ে দেয়। এই গুণ অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু সে বড় ছোট মানে না। গুরুজনের মুখের উপর কথা বলতে কুন্ঠাবোধ করে না। কোনো কিছু পরোয়া নেই।সামান্য কথায় এত রেগে যাওয়া, বড়দের কথা ধৈর্য সহকারে না শুনে মুখের উপর কথা বলা, এই সমস্ত বিষয় একদমই পছন্দ করে না স্নেহা। গত কয়েকদিন আগে সামান্য ব্যাপারে প্রফুল্ল বাবু (প্রাইভেট অংক টিচার) সঙ্গে কলরবে জড়িয়ে যায়। টিউশন ছেড়ে পালিয়ে আসে। সকলেই জানে দোষটি স্যারের। কিন্তু তা বলে এমন রিয়াক্ট করা উচিত নয়। যতই হোক তিনি একজন জন শিক্ষক। তারপর থেকে আর প্রাইভেট পড়তে যায়নি। নিজেতো সরি বলে নি, বরং স্যারকে দিয়ে সরি বলিয়েছে। তারপর একটা কবিশ্রেষ্ঠ হাসি দিয়েছিল। সে কিছু একটা জয় করেছে। কিন্তু সে জানলো না, তার এই ব্যবহার তার নিচু মানসিকতার পরিচয় দিচ্ছে। তার অহংকার স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফুটে উঠছে সকলের মাঝে। স্নেহা ভীষণ মনঃক্ষুন্ন হয়। রেগে বাড়ি পালিয়ে আসে। এগুলো মানতে পারে না। আর বিক্রম বিষয়গুলি খুব সহজ ভাবে নেয়, ভাবে এগুলো আত্মসম্মানের মর্যাদা বজায় রাখা। নিজের আত্মসম্মান নিজেকে রক্ষা করতে হবে। ভীষণ বিরক্ত বোধ করছে সে। ফোন তুলে বিক্রমকে কল দেয়।
“হ্যাঁ, বলো।” বিপরীত থেকে পুরুষ কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো। একটা আলাদা ভালোলাগা শুরু হয় স্নেহার মধ্যে। বুকের মধ্যে গুমোট ভাব বাষ্পীভূত হতে শুরু করেছে। পৃথিবীতে বাবার পর দ্বিতীয় কোনো পুরুষ মানুষ, যাকে মন খুলে সমস্ত কথা বলা যায়। না বলা কথা ঠিক বুঝতে পেরে যায়।
“দেখা করবে?”
“এখন না, বিকালে…।”
“এখন ব্যস্ত বুঝি!”
“ঠিক ব্যস্ত নয়, পড়তে বসছি। সামনে পরীক্ষা, তুমিও পড়তে বস।” চুপ করে যায় স্নেহা। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারে বিক্রম ফোন কেটে দিয়েছে।মন বিষাদে ভরে ওঠে। বিক্রম কেমন একটা। ভালোবাসার জন্য মানুষ কত কিছু করে, সমস্ত কিছুর উর্ধে ভালোবাসার মানুষটিকে বেশি প্রায়োরিটি দেয়। কিন্তু বিক্রম ব্যতিক্রম। তার কাছে ইমপোর্টেন্ট মানুষ, সে নিজেই। নিজেকে বেশি তত্ত্বাবধানে মধ্যে রাখে। নিজেকে বেশি আমল দেয়। বিক্রম অকপটে স্বীকারও করেছে তার জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, সে নিজে। স্নেহাকেও বলেছে নিজেকে বেশি গুরুত্ব দিতে। জীবনে নিজের চাইতে ভালো বন্ধু কখনো কেউ হতে পারে না। স্নেহা এ সব বিশ্বাস করে না। নিজের বন্ধু নিজে কি করে সম্ভব? বিক্রম যেন বোকা বোকা কথা বলে। তার জীবনে সবকিছু বিক্রম ময়। বিক্রম ছাড়া একটি পা এগিয়ে চলা অসম্ভব। সে জানে, হয়তো, বিক্রম একটু বদমেজাজী কিন্তু ভয়ঙ্কর প্রেমিক। হয়তো, বিপরীত মানুষের চাইতে নিজেকে বেশি গুরুত্ব দেয়,কিন্তু বিপরীত মানুষটিকে অবহেলা করার মতো স্পর্ধা তার মধ্যে নেই। সে স্নেহাকে অসম্ভব ভালোবাসে। হয়তো, স্নেহার জন্য সবকিছু করতে পারবে না, কিন্তু তার ছোট্ট ছোট্ট খুশি কখনো হারিয়ে যেতে দেবে না। তার কাছ থেকে কখনো সরে যাবে না।

বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে রিম্পি বারবার আর্যকে ডেকে যাচ্ছে। আর্য তার ডাকে সাড়া দিয়েছে। কিন্তু ধৈর্যহীন রিম্পি তাতে সন্তুষ্ট নয়। একটু বিরক্ত হয়ে বাইরে বের হলো। তাকে ভেতরে আসতে বলল। সে আসবে না। আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে, তারপর চলে যাবে। আর্য দ্রুত আবার বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে। সে জানে, রিম্পি কোন প্রকৃতির মেয়ে! অল্প সময়ের মধ্যে তৈরি হতে হবে। না হলে রিম্পি সত্যি সত্যি স্কুলে চলে যাবে। তাকে প্রায় সাত কিলোমিটার রাস্তা একা যেতে হবে। একা যেতে কারই বা ভালো লাগে। কাকিমার বড় মেয়ে রিম্পি, দশম শ্রেণীর ছাত্রী। রিম্পি জন্ম হওয়ার পর, বাবা-মার মুখ কেমন একটা শুকিয়ে যায়। তারা পুত্র সন্তান কামনা করেছিলেন। প্রথমে রিম্পিকে মন থেকে গ্রহণ করতে পারেননি। একটু অবহেলা পায়। নিজের সন্তানকে কতদিন গ্রহণ না করে থাকবেন?একটু একটু করে বড় হতে শুরু করে, চেহারার পরিবর্তন আসে। সুদর্শন হয়ে ওঠে রিম্পি। দোহারা গড়ন বিশিষ্ট রিম্পি একটু শ্যাম বর্ণ বটে, কিন্তু তার চোখ-মুখ, এমন হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী পৃথিবীতে খুব কম সংখ্যক নারী রয়েছে। বর্তমানে আচার্য পরিবারের সবচেয়ে সুদর্শন নারী সে । এ যেন ভগবানের অসীম লীলা, যাকে অবহেলা করবে তার মধ্যে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য থাকবে যা সেই বাড়ির উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে দেবে। রিম্পি শুধু রুপে নয় গুণেও গুণবতী। নম্র ব্যবহার,ভদ্রতা, গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধা, কথা বলার ভঙ্গি তাকে অনন্য করে তুলেছে।তবুও রিম্পি বাবা-মার মধ্যে পুত্রের একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল। সবচেয়ে হাসির ব্যাপার হলো, পুত্র সন্তানের জন্য বিভিন্ন বাবাজির কাছে ঘুরতে থাকেন। ওষুধ সংগ্রহ করেন। ওষুধ নিলে নাকি অবশ্যই পুত্র সন্তান হবে, এমনই কথা দেন একজন বাবাজি। কিন্তু পুত্রসন্তান তো হল না, উল্টে জমজ কন্যা সন্তান হলো। মনের মধ্যে রাগ ক্ষোভ বাড়তে থাকলো। বিশেষ করে ওই বাবাজির ওপর। যাই হোক, এই ঘটনার পর থেকে তাদের মন থেকে কুসংস্কার দূর হয়েছে। এটাই অনেক। মেয়েরা যে ছেলেদের থেকে কোনো অংশে কম নয়,তা বুঝতে পেরেছেন। মেয়েরা সব সময় ভাগের খাতার নয় গুনের খাতায়ও থাকতে পারে।যদি জমজ কন্যাসন্তানের পরিবর্তে ছেলে হতো, তাহলে হয়তো, তারা কখনোই মেয়ের মর্ম বুঝতেন না। তিনজন মেয়েকে নিয়ে অনেক সুখে আছেন। সোনা আর টিয়ার মতো রিম্পিও বেশিরভাগ সময় আর্যদের বাড়িতে কাটায়। রোজ স্কুলে যাওয়ার সময় রিম্পি আর্যকে ডেকে নিয়ে যায়। একসঙ্গে স্কুলে যায়।তবে ছুটির সময় বিভিন্নতা হওয়ায় একসঙ্গে বাড়ি ফেরা হয় না। খুব অল্প সময়ের মধ্যে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে আর্য বেরিয়ে আসে। সদ্য স্নান করায় তাকে বেশি স্নিগ্ধ উজ্জল লাগছে। গায়ে সলিলের ফোঁটা গুলো ভালো করে মুছেনি, জামা ভেজা রয়েছে। চুলের গোড়ায় এখনো সলিল জমে আছে। চুলের গোড়ায় সরিলের ফোঁটা গুলো মুক্তোর মত দেখাচ্ছে।তাকে দেখে রিম্পি হেসে উঠল, কোনোদিন শোধরাবে না দাদা। সব সময় অ-প্রণালীবদ্ধ থাকলো।
“সাইকেল নিবি না?” হাসিমুখে বলল রিম্পি।
“না, তোর সাইকেলে আমাকে বসিয়ে নিয়ে চল। শরীরটা তেমন ভালো নেই। ছুটি হলে একা চলে আসবি না, অপেক্ষা করবি একসঙ্গে ফিরব।”
রিম্পি মাথা নাড়ায়। দুজন সাইকেলে চেপে বসে। স্কুলের উদ্দেশে যাত্রা করে। পেছনে ঠোঁট টিপে চুপচাপ বসে আছে আর্য। কোনো কথা বলছে না। আজ রিম্পির কাছে আর্য সম্পন্ন আনকোরা। দাদাকে এমন চুপচাপ হয়ে বসতে আগে কখনো দেখেনি, বিশেষ করে তার সঙ্গে থাকাকালীন। একটু আশ্চর্য হয় সে। গলা খাঁকরে জিজ্ঞেস করে,”কি হয়েছে তোর?”
কোনো উত্তর নেই। দ্বিতীয় বার একই প্রশ্ন করল। তাও নিশ্চুপ। দাদার মুখ থেকে কথা বের করার জন্য রিম্পি নতুন কৌশল বাঁধলো। সে খুব ভালো করে জানে, দাদাকে কিভাবে ভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় আনা সম্ভব। এক পলক হেসে বলল,”স্নেহার কথা ভাবছিস? খুব ভালবাসিস না তাকে?”
আচমকা এমন প্রশ্নে আর্য চমকে উঠল। মনের কথা রিম্পি কিভাবে বুঝে গেল। দ্রুত নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। স্বাভাবিক হয়ে বলল,” না তো, তাকে ভালোবাসতে যাব কোন দুঃখে? জীবনে প্রথম নারীকে প্রেমিকা হতে হবে,-এমন নয়।”
“আর বলতে হবে না, সবাই জানে কোনটা বন্ধুত্ব আর কোনটা প্রেম।”
আর্য আবার চুপ হয়ে যায়। কালকের রাতের কথা মনে পড়ছে। কাল যখন প্রথম স্নেহার সঙ্গে রাতে বাড়ি ফিরল,মন ভীষন ব্যাকুল ছিল। উত্তেজনায় ছটফট করছিল। একটা নতুন ভালো লাগা ছিল। সে স্নেহাকে ভালোবাসে, চিরন্তন সত্য। উত্তেজনায় বসে বাবাকে সব কিছুই বলে দিয়েছে। কখনো বাবার কাছে কিছু লুকাইনি, তার ভালোবাসাও লুকাতে পারল না। বাবা কখনো তাকে নিরাশ করেননি। ভেবেছিল, কাল একই কাজ করবেন। কিন্তু তিনি করলেন না। তিনি ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে খুব নম্রভাবে জিজ্ঞেস করেছিলেন, জীবন একটা লম্বা রাস্তার মতো। লম্বা রাস্তা হেঁটে শেষ করার নামই জীবন।হাঁটার সময় রাস্তার মাঝখানে ছোট-বড় অনেক পাথর পড়ে থাকবে, সেই পাথরগুলো কুড়িয়ে কি পকেটে কিংবা ব্যাকের মধ্যে ভরে হাঁটা উচিত? হাসি মুখে উত্তর দিয়েছিল, কখনোই নয়। তাতে পকেট ভারী হয়ে যাবে। হাঁটতে অসুবিধা হবে।তাই পাথরগুলোকে রাস্তার একপাশে সরিয়ে দেওয়া উত্তম। ছেলের মুখে এমন উত্তর শুনে অশোকবাবু খুব খুশি হয়েছিলেন। তিনি হাসিমুখে আবার বলেছিলেন, বয়সন্ধিকালে প্রেম আসলে পকেট ভারী করার মত। পকেট ভারী থাকলে আমাদের হাঁটার স্পিড অনেক কমে যায়। নির্দিষ্ট সময় নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পারবো না।। ভারী পকেট মানুষকে স্থির হয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়, ক্লান্ত করে দেয়। এগিয়ে যাওয়ার শক্তি টুকু হারিয়ে ফেলি। জীবন অনেকটা এমন। অল্প বয়সে অহেতুক বিষয়গুলো নিয়ে যদি নিজেকে ভারী করে ফেলি, তাহলে জীবনের নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছাতে অনেক সময় লেগে যাবে। বাবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে ছিল। বাবার বলা কথাগুলোর সত্যতা বিচার করে দেখেছে। তিনি সঠিক। কিন্তু স্নেহাকে ভোলাও সম্ভব নয়। পৃথিবীর কোনো এক নারী, যার সঙ্গে দীর্ঘক্ষন ধরে কথা বলতে ভালো লাগে। পাশাপাশি বসতে ভালো লাগে। তার নরম হাতের স্পর্শ ভালো লাগে। তার শুকনো ঠোঁটের হাসি পাগল করে তোলে। তাকে সারা জীবন কাছে পেতে চায় সে।

একে অপরের হাত যুগলবন্দি হয়েছে। শহরের এই গোলকধাঁধায় শীতের আমেজ একটু কম। চারিদিকে আলোর ঝলকানি। নানা রকমের আলো দিয়ে সজ্জিত হয়েছে ‘পিঠে পুলির’ মেলা। ছোট্ট ভালোবাসার শহরে বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন মেলার সমাগম দেখা যায়। বইমেলা, বস্ত্র মেলা, বৈশাখী মেলা থেকে শুরু করে পিঠে পুলির মেলা। অনেকগুলো মেলার সন্ধিক্ষণ ঘটায় এই শহর। তাই তো সবার কাছে খুব প্রিয়। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে। তৈরি হয় অপূর্ব মেলবন্ধন।মেলায় যেমন বৃদ্ধ বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্করা থাকেন, থাকে বন্ধু বান্ধবী, অভাব ঘটে না প্রেমিক প্রেমিকারও। প্রেম করার একটা সূক্ষ্ম নিরাপদ জায়গায় মেলা। ভালোবাসা মানে মুহূর্ত তৈরি করা। মুহূর্ত সাময়িক হলেও তার রেশ থাকে আজীবন। নতুন মুহূর্ত তৈরি করতে ব্যস্ত স্নেহা আর বিক্রম। তারা সেই বিকেল থেকে মেলায় পা বাড়িয়েছে। গোধূলি গড়িয়ে রাত হতে যায়, ফেরার নামগন্ধ টুকু নেই। দীর্ঘ সময় একে অপরের কাছে থাকলেও তাদের ভাব প্রকাশের বিনিময় খুবই অল্প। বাড়িতে থাকার সময় একে অপরে সাক্ষাৎ এর যে আকুল ইচ্ছা থাকে, মিলিত হওয়ার পর তা বিলীন হয়ে যায়। এক মুহূর্ত কথা না হলে মনে হয় কতগুলো দিন কথা হয় নি, অথচ কাছাকাছি থাকলে তারা কথা হারিয়ে ফেলে। কি বলবে খুঁজে পায় না। এমনটা কেন হয় জানে না। হয়তো এটাই তাদের ভালোবাসা। অনেকক্ষণ মেলার মধ্যে ঘোরার পর তারা একটা উঁচু জায়গার উপর পাশাপাশি বসলো। রঙিন আলোয় তাদের সাদামাটা পোশাকও রঙিন হয়ে গেছে। আকাশের মিটমিট করা তারাগুলো ফ্যাকাশে লাগছে। চারিদিকে কলরবে পূর্ণতা পেয়েছে। এই মেলার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র যে বিনোদন তা কিন্তু নয়, অনেক মানুষের কিছুদিনের রোজগারের সন্ধানও বটে। ভাপা পিঠা, নকশী পিঠা , পানতোয়া , পাটিসাপটা, ফুলঝুরি, বিবিখানা , দুধপুলি , বকুল পিঠা , ঝিনুক পিঠা , লবঙ্গ লতিকা , চিতই পিঠার গন্ধ চারিদিকে মকমক করছে। নামে পিঠে পুলির মেলা হলেও নানান ধরনের পিঠের দোকানের পাশাপাশি রয়েছে চা-কফি, আইসক্রিম,মেয়েদের সাজ সজ্জার জিনিসপত্র, বাচ্চাদের খেলনার দোকান,এমনকি নাগরদোলাও রয়েছে। তারাও সামান্য রোজগারের সন্ধানে বেরিয়েছে।
“চলো আরেকটু ঘুরি? বেশি রাত পর্যন্ত থাকতে পারবো না।” স্নেহার কণ্ঠস্বরের মধ্যে একটা পরিচিত মায়া এসেছে। যা সর্বদা বিক্রমের সাথে কথোপকথনে চলে আসে।
“বসো একটু।”
“এ ভাবে বসতে ভালো লাগছে না। নিশ্চুপ ভাবে বসে থাকতে ভালো লাগে বুঝি?”
“হ্যাঁ, এ ভাবে বসে থাকতে ভালো লাগছে। অনেকগুলো বছর এ ভাবে বসে থাকলেও অসুবিধা নেই। আমার খুব সুন্দর লাগছে।”
বিক্রমের স্পর্শে মুগ্ধ হয় স্নেহা। কোনো কথা না বলে তার কাঁধে মাথা এলিয়ে দিল। চুপচাপ দীর্ঘক্ষণ ধরে বসে থাকল। কোন কথা নেই। মাঝেমধ্যে দুটো চোখ পরস্পর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হেসে ওঠে, তারপর আবার নিশ্চুপ হয়ে যায়। লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে।
“তুমি এখানে একটু অপেক্ষা করো আমি দ্রুত ফিরছি।” বিক্রম দ্রুত উঁচু জায়গা থেকে নেমে মেলার মধ্যে হারিয়ে গেল। স্নেহা বাধা দিয়েছিল, তাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সে শুনল না। দ্রুত ফিরবে বলে বেরিয়ে যায়। বেশি সময় লাগল না। বিক্রম কথা রেখেছে। তাড়াতাড়ি হাতে কিছু একটা নিয়ে ফিরলো। স্নেহার কৌতুহল বাড়তে থাকে। সে জানতে চাইল তার মধ্যে কি আছে। বিক্রম খবরের কাগজে মোড়া অংশটি খুলে বার করল। একগুচ্ছ লাল রঙের চুড়ি। স্নেহাকে চুড়ি পরিয়ে দেওয়ার জন্য হাতটি ধরল। স্নেহা খপ করে হাত টেনে নেয়,”আমার এগুলো ভালো লাগে না। আমাকে কখনো দেখেছো চুড়ি কিংবা পায়ে পায়েল পরতে! প্রত্যেক মেয়ের এগুলো ভালো লাগে মানে আমারও যে ভালো লাগবে তা তো নয়।” বিক্রম মুখে শব্দ করল না। নিঃশব্দে চুড়িগুলো আবার খবরের কাগজে মুড়ে ফেলল। চুড়িগুলো রেখে দিতে দেখে সে বললো,”কি হলো? রেখে দিচ্ছ কেন? আমায় দেবে না।”
“না।”
“আমি নেব না এমনটা তো বলিনি। আমি শুধু বলেছি আমার এগুলো ভালো লাগে না।”
“যা ভালো লাগে না তা কাছে রেখে লাভ কি?”
বিক্রমের মধ্যে একটা খারাপ লাগা শুরু হয়েছে। চুড়ি নিয়ে নিলে তেমন কোনো অসুবিধা হতো না। দুজন মানুষ এক। দু’জনেরই উচিত একে অন্যের জন্য নিজেদের কিছু ভালোলাগা বর্জন করা। খারাপকে মেনে নেওয়া। স্নেহা তা করতে পারল না। বিক্রম আবার নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে, নিজে তো কখনো স্নেহার জন্য নিজের ভালোলাগাকে বর্জন দেয়নি।তাহলে স্নেহা যদি অপরাধী হয় তাহলে সে নিজেও সমান অপরাধী। কিন্তু অন্যের প্রতি অপরাধবোধ যে ভাবে খুব সহজে চলে আসলো, নিজের প্রতি তা আসলো না।
“আই এম সরি! আমাকে চুড়ি গুলো দাও।”
“না, জোর করে আদায় করে কোনো কিছুতে সুখ হয় না। আমি বলছি মানে তোমাকে নিতে হবে, এমনটা নয়। ভেতর থেকে যেটাই আসবে সেটাই করবে।” বিক্রমের কণ্ঠস্বরে অভিমান স্পষ্ট। রাগ হয় স্নেহার। যে জিনিস ভালো লাগে না তা অকপটে স্বীকার করতে অসুবিধা কোথায়? এই জিনিসটা এতকাল বিক্রম তাকে শিখিয়েছে। কিন্তু আজ নিজেই অস্বীকার করছে। অন্যের ভুলগুলো খুব সহজে চোখে পড়ে কিন্তু নিজের ভুলগুলো নয়। আবার কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণের নীরবতা মন খারাপের গল্প মুছে দিল, তারা আবার চলতে শুরু করলো……
গন্ধহীন কৃষ্ণচূড়ায় ঘেরা রাস্তায়
দেখা হল উদ্দেশ্যহীন এক সন্ধ্যাতে।
তার ঠোঁটে মখমলে হাসি
আমার দুটো চোখ ভরে গেল লজুকতায়।
সে কাছে আসলো, আরো কাছে
মুছে গেল মন খারাপের গল্প
ভিজলো শহর উষ্ণ আলিঙ্গনে।
নেই কোনো যৌন লালসা, শুধুই আছে নিখুঁত ভালোবাসা।
চুমুটা হলো হামি, স্পর্শটা ভীষণ দামি।
আমার নরম হাত বন্দি হল বলিষ্ঠ হাতে।
তারপর হেঁটে চললাম, আর এক উদ্দেশ্যহীন গন্তব্যে।

পর্ব ৬ আসছে।
বিঃদ্রঃ পাঠক বন্ধুদের কাছে আজকে একটি প্রশ্ন থাকলো আশাকরি যথাযথ উত্তর দেবেন(একান্ত নিজস্ব মন্তব্য)। গল্পের শুরুতে দেখানো হয়েছিল স্নেহার বিয়ে হয়ে গেছে। এখন বলুন, বিয়ের পাত্র কে ছিল?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here