কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ পর্ব-৮

0
214

কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ
পর্ব ৮
___________________
দক্ষিণ ভারতে কর্ণাটক রাজ্য উল্লেখযোগ্য হওয়ার পেছনে বিশেষ ভূমিকা রয়েছে সেখানকার জলবায়ু। শীতকালে যেমন তীব্র শীত পড়ে না, তেমনি গ্রীষ্মকালে তীব্র গরম দেখা যায় না। নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু বিরাজ করে। যদিও শীতের দাপট একটু বেশি। করমন্ডল উপকূল সংলগ্ন হওয়ায় এখানে কিছু অংশে বছরে দুবার বৃষ্টি হয়। প্লাটফর্মে একটা সরু বেঞ্চের উপর বসে আছেন অশোকবাবু এবং উনার ছেলে। খুব সুস্থভাবে পৌঁছে গেছেন, তবে ভীষণ ক্লান্ত। সকাল থেকে অবিরাম বৃষ্টি হচ্ছে, কমার নাম গন্ধই নেই। বিজয়ওয়াড়া পেরোনোর পর তাদেরকে সোয়েটার পরতে হয়েছে। আষাঢ় মাসে যে সোয়েটার পরতে হবে কখনও ভাবেনি। আসলে, তারা সদ্য গরম ত্যাগ করে শীতের সংস্পর্শে এসেছে, তাই একটু বেশি শীতল অনুভব করছে। বাস্তবে অতটা শীত নেই। ঘণ্টা দেড়েকের পর বৃষ্টি কমল। বৃষ্টি কমার পর আরও তিরিশ মিনিটের মতো প্লাটফর্মে অপেক্ষা করল। পুব আকাশে মেঘ আর হালকা মিষ্টি সূর্যালোক লুকোচুরি খেলতে শুরু করেছে। ভীন রাজ্যে তাদের সামনে প্রথম সূর্য উদয়। ভারী মধুময় লাগছে। সদ্য বৃষ্টি হওয়া সূর্যালোকের মধ্যে একটা জ্বলজ্বলে ভাব রয়েছে। ভেজা পাতার ওপর জ্বলজ্বলে সূর্যালোকের বিচ্ছুরণ হয়ে নতুন একটি রংয়ের সৃষ্টি হয়েছে। বেশ দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য। আর অপেক্ষা করল না। ব্যাগ পত্র নিয়ে হাইরোডের উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগল। হাই রোডের উপর এসে ভীষন অবাক হলো আর্য। গ্রামবাংলায় বৃষ্টি হওয়ার দু-দিন পর কোনো অচেনা লোক সেখানে উপস্থিত হলে অনায়াসে বলে দিতে পারে কয়েকদিন আগে উক্ত স্থানে বৃষ্টি হয়েছে। এখানের পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিছুক্ষণ আগে যে অতিমাত্রায় বৃষ্টি হলো তার লেশমাত্র নেই। এই মুহূর্তে কোনো অচেনা লোক উপস্থিত হলে কিছুতেই বলতে পারবে না কিছুক্ষণ আগে এখানে অঝোরে বৃষ্টি হয়ে গেছে। নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট বাসে উঠে পড়ল তারা। বাসে কিছুক্ষণ বসার পর আর্যর কাছে শ্যাম বর্ণের একটি মেয়ে উপস্থিত হয়ে কর্নাটকা ভাষায় কিছু বলল।কিছু বুঝতে না পেরে মেয়েটিকে হিন্দিতে বলতে বলল আর্য। তাজ্জব বিষয় হলো মেয়েটি হিন্দি ভাষা জানে না। বাসের মধ্যে সমস্ত যাত্রীর চোখ ওই দিকে নিমজ্জিত হলো। বড্ড অস্বস্তিতে পড়েছে আর্য।শহরে প্রথম প্রবেশের মুখে এমন বিব্রতকর অভিজ্ঞতার সাক্ষী না হলে ভালো হতো। তাদের হট্টগোল দেখে খুব দ্রুত কন্ডাক্টর সেখানে আসলো। কন্ডাক্টরকে দেখে চরম বিস্মিত হলেও মনে মনে ভীষণ খুশি হলো আর্য। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করল ড্রাইভারও মহিলা কি না!
মনের আমোদ বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারলো না। কন্ডাক্টারের কথায় লজ্জিত হলো। মুখ নিচু করে অন্য সিটে চলে আসলো। বাসে মহিলা কন্ডাক্টর রয়েছে, অথচ নারী পুরুষের জন্য আলাদা আলাদা সিটের বিভাগ রয়েছে। সামনের সিটগুলো মহিলাদের আর পেছনের সিটগুলো পুরুষদের।তারা যেখানে বসে ছিল সেটা নারীদের বসার জায়গা । এতদিন শোনে এসেছে মহিলা কম্পার্টমেন্ট শুধুমাত্র ট্রেনে রয়েছে। আজ প্রথম বাসে তেমন একটা অভিজ্ঞতার সাক্ষী থাকলো। ভারতবর্ষে এমন কুরুচিকর নিয়ম আর কোথাও আছে কিনা আর্যর জানা নেই। তবে তাদের সেই ছোট্ট শহর আর গ্রামে এমন নিয়ম নেই। সেখানে নারী-পুরুষ সবাইকে সমান চোখে দেখা হয়।আরও কিছুক্ষণ বাসে বসে থাকার পর আর্য লক্ষ্য করলো নারীদের সিট গুলো সম্পূর্ণ ভর্তি হয়ে গেছে। তারপর যে সমস্ত নারীরা উঠছে তারা নিঃসংকোচন ভাবে পুরুষদের সিটে এসে বসে যাচ্ছে। মৃদু হাসল সে। আমাদের সমাজে যাদের একটু বেশি সুযোগ দেওয়া হয়, তারা ভাবতে শুরু করে,তারা সমাজে উচ্চবর্গীয় মানুষ কিংবা তাদেরকে সবাই সম্মান আর শ্রদ্ধাবোধ করছে। তাদের হাবভাব একটু আলাদা হয়। কিন্তু বাস্তবটা এমন নয়।একজনকে সুযোগ না দিয়ে অন্যজনকে সুযোগ দেওয়ার অর্থ হলো সে অপয়া দুর্বল, সেখান থেকে মুক্ত করার জন্য তাকে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এই গৌণ বিষয়টি এখানকার মেয়েরা এখনো কেন বুঝতে পারেনি তা জানা নেই।
বাস নিজস্ব গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। একসময় শহর ছেড়ে গ্রামের রাস্তা ধরল। জানালা দিয়ে হালকা শীতল বাতাস বয়ে আসছে। জাঁকালো শীত অনুভব করলেও জানালা বন্ধ করল না আর্য। বাইরের দৃশ্য বেশ মনোমুগ্ধকর । কয়েক মুহূর্তের জন্য ম্লান হয়ে যাওয়া মন ফুরফুরে হয়ে উঠছে। পশ্চিমবাংলায় বেশিরভাগ জমিগুলোতে ধান চাষ হয়ে থাকে। সেখানে দুচোখ মিলে দেখলে সোনালী ফসল দেখতে পাওয়া যায়। নীলসমুদ্র যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। চাষেও এখানে অনেক প্রভেদ রয়েছে। এখানে বিঘার পর বিঘা চাষের জমি দেখা যাচ্ছে, সেই জমির উপর ধান কিংবা গম গাছ নেই। রয়েছে নারকেল আর কলাগাছ। নারকেল আর কলা গাছের বাগান যে বিঘার পর বিঘা জমিতে হতে পারে, তা এতদিন কল্পনার মধ্যে ছিল না। যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে শুধু নারকেল গাছ এবং কলা গাছ। তবে পশ্চিমবাংলার মত এখানকার নারকেল আর কলা গাছ গুলো খুব বড় নয়, মাঝারি সাইজের। বাগানের মধ্যিখানে কোথাও কোথাও ছোট্ট কুটির রয়েছে। কিছু কুটির সামনে এখনও আলো মিটমিট করছে। সম্ভবত মালিক সেখানে পাহারা দেন রাতে। আবার কেউ নারকেল আর কলাগাছ থেকে ঝরে পড়া পাতাগুলো কেটে পরিষ্কার করছে। এখানেও বোঝা যাচ্ছে না কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়েছে। লালমাটি বৃষ্টির সমস্ত জল শুষে নিয়েছে। আর্য পাস ঘুরে দেখলো বাবা ঘুমিয়ে পড়েছেন। বাবাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখতে ভালো লাগলো না। আবার ডাকতেও ইচ্ছে করছে না। ঘুমিয়ে থাকলে তিনি এমন ললিত দৃশ্য মিস করবেন। বাবাকে ডেকে তুললো। আশোক বাবু ঘুম জড়ানো চোখে হাত দিয়ে চোখ দলতে লাগলেন। জানালার বাইরে চোখ রাখলেন। তিনি চাষী হলেও জানতেন না এমন সুন্দর নারকেল আর কলা গাছের বাগান হতে পারে। বাইরের পরিবেশ এতটা ললিত যে চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করছে না। বাস গ্রাম ছেড়ে আবার শহরের মধ্যিখানে প্রবেশ করল। সেখানেও নারকেল আর কলা গাছের বাগান রয়েছে। তবে এখানে চাষের ভিন্নতা একটু আলাদা। একটা নারকেল গাছ থেকে অন্য একটা নারকেল গাছের মধ্যে ব্যবধান যথেষ্ট রয়েছে। সেই ব্যবধানের মধ্যিখানে চাষীরা কিছু সবজি চাষ করেছে। দূর থেকে বোঝা গেল না -তারা ঠিক কোন সবজি গাছ লাগিয়েছে? শহরের মধ্যিখানে যে এমন সুন্দর ভাবে বাগান গড়ে তোলা যায়,তা এতকাল কল্পনার মধ্যে থাকলেও আজ বাস্তবে উপলব্ধি করতে পারল। মুহূর্তে এই শহরকে ভালোবেসে ফেলল আর্য। শীতকাল আর বাগান দুটোই খুব পছন্দ তার। আর এই শহরে পুরোপুরি পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই উভয়ের সন্ধান পেয়ে গেছে সে।

ওল্ড মাদ্রাসা রোডের একেবারে শেষে নামল তারা। সামান্য হেঁটে যাওয়ার পর কলেজ। অশোক বাবু পকেট থেকে ছোট্ট একটা চিরকুট বের করে দেখে নিলেন ঠিকানা সঠিক আছে কি না! ওল্ড মাদ্রাসা রোড,মেধাহালি সঠিক ঠিকানা….।
হোস্টেল আর কলেজের সমস্ত কাগজপত্র নিখুঁত ভাবে সম্পন্ন করতে প্রায় দুপুর বারোটা বেজে গেল। হোস্টেলের দায়িত্বে থাকা একজন ভদ্রলোক আর্যকে নিয়ে গেল আর অশোকবাবু গেস্টরুমে থাকলেন। হোস্টেলে প্রত্যেকটা রুমে তিনজন করে থাকে। আর্যকে যে রুম দেওয়া হলো সেখানে দুজন নেপালি ছেলে রয়েছে। তার কোনো অসুবিধা হলো না, নেপালি ছেলে দুটো খুব স্পষ্টভাবে হিন্দি বলতে এবং বুঝতে পারে। একজনের নাম দর্শন আর অপর জনের নাম লিমভো হলেও দুজনকে দেখতে সম্পূর্ণ এক। চোখ, নাক, কান, কোনো কিছুতেই পার্থক্য নেই। তারা তাড়াতাড়ি আর্যর সাথে অকপট হতে চাইল, কিন্তু আর্য পারল না। কোনোরকম বিছানা সাজিয়ে তার ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিল। বিছানায় শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের ঘুম চেপে বসলো।
কতক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছিল ঠিক মনে নেই, তবে খুব বেশিক্ষন নয় সে বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত। দুটো ছেলের মধ্যে কোনো একজনের ডাকার শব্দে হুড়মুড় করে উঠে পড়ে সে। দুপুরে লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে। একসঙ্গে তারা খেতে যাবে। খাবার বেশি দূর নয়, নিচের ফ্লোরে দিচ্ছে। তারা একা না গিয়ে তাকে ডেকে নিয়ে গেল, এই ব্যাপারটি তার খুব ভালো লাগলেও বাড়ির কথা মনে পড়তেই অস্বস্তি বোধ হলো। বাড়িতে প্রায় সময় একা খেতো তবুও অনেক শান্তি ছিল। সবাই খেয়েছে কিনা জানতে পারতো। এখানে কিছুই জানতে পারছে না। বাবা কি খেয়ে নিয়েছেন? কোনো রকম অসুবিধা হওয়ার কথা নয় তবুও মনটা খুঁতখুঁত করছে। বাড়িতে মা বোন খেয়েছে? না তারা অভুক্ত আছে? নিশ্চয়ই, আর্যর মতো তারাও মিস করছে বাড়ির একটা সদস্যকে। জীবনভর আলাদা থাকলেও পারিবারিক সম্পর্ক গুলো কখনো ভোলা যায় না।একসঙ্গে তিনজন খাবার নিয়ে এসে দ্বিতীয়বার হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসলো। খাবার খেতে গিয়ে দারুন একটা ঝটকা লাগল আর্যর -কি বিচ্ছিরি খাবার ! এগুলো কি করে খায় এরা? খেতে পারল না। আংগুল দিয়ে ভাতের থালায় আঁকিঝুকি করতে থাকলো। তাকে খেতে না দেখে একজন বলল,”খাচ্ছো না কেন? খিদে নেই?” আর্য মুখ তুলে ছেলেটিকে দেখল। ভাবলো এই সম্ভবত দর্শন। কিন্তু দ্বিতীয় ছেলেটি প্রথম ছেলেটিকে নাম ধরে ডাকায় তার ভুল সংশোধিত হলো। ভালো করে দুটো ছেলেকে আপাদমস্তক প্রখর করল, তাদের মধ্যে পার্থক্য খুঁজলো। অবশেষে সফলও হলো। দুজনের মধ্যে চুলের বিশাল পার্থক্য রয়েছে। যার মাথায় বড় বড় চুল সে দর্শন, আর যার মাথায় ছোট ছোট চুল সে লিমভো।
“কি বিচ্ছিরি খাবার! একটা ফ্যাকাশে গন্ধ বের হচ্ছে। চটচটে একটা ব্যাপারও রয়েছে। এগুলো মানুষের পক্ষে খাওয়া সম্ভব! এত টক কেন? ” আর্যর কাছে এমন উত্তর প্রত্যাশা করে নি। সংকুচিত হয়ে দর্শন বললো,”মানুষের খাবার নিয়ে এমন মন্তব্য করা উচিত নয়। আমাদেরও প্রথম প্রথম খাবারগুলো খেতে অসুবিধা হয়েছিল। অনেকদিন থাকার পর এগুলো অভ্যাস হয়ে গেছে। তোমারও প্রথম অসুবিধা হচ্ছে পরে ঠিক হয়ে যাবে। এইসব খাবার কিন্তু এখানকার মানুষের প্রিয়। তারা যদি খেতে পারে তাহলে আমরা কেন খেতে পারব না?” আর্য ছেলেটিকে আবার ভালো করে দেখল। মনে মনে ভাবলো, খাবার সম্বন্ধে এমন মন্তব্য করা তার উচিত হয়নি। অনেক আগে স্কুলের মাস্টারমশায়ের কাছে শোনেছিল নেপালিরা খুব ধর্মভীরু হয়। নিজেদের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা আর বিশ্বাস দেখাতে তারা কখনো কার্পন্য করে না, -নিজস্ব স্বার্থ সিদ্ধির থাকে না। তাদের বিনম্র ব্যবহার বারবার মুগ্ধ করছে। খুব সহজে মানুষের সঙ্গে মিশতে পারে। মুহূর্তের মধ্যে তারা আর্যকে আপন করে নিয়েছে, সে তাদের মধ্যে একজন। অথচ তাদেরকে এখনো মন থেকে গ্রহণ করতে পারছে না আর্য। সে এবার তাদের সঙ্গে অকপট হওয়ার চেষ্টা করল।খাবার মুখে দেওয়ার পর থেকেই বুঝতে পেরেছিল এগুলো সরষের তেলে রান্না নয়। কৌতুহল বাড় ছিল। ছেলে দুটিকে সহজ-সরল ভাবে মিশতে দেখে তার কৌতুহল চরমে পৌঁছালো। হাসিমুখে বলল,”আচ্ছা এই খাবারগুলো কোন তেলে রান্না? আমি সঠিক বুঝতে পারছি না তাই আর কি….”
“নারকেল তেল। সাউথ ইন্ডিয়ায় প্রায় বেশিরভাগ খাবার নারকেল তেল দিয়ে তৈরি হয়।” দর্শনের কথা শোনে আর্য বমি বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো,-সে কোথায় এসে পরল? বারবার শুধু ঝটকা খাচ্ছে।এখানে এসে প্রথমে যে জিনিস গুলো ভালো লাগছে পরে সেই গুলো তার কাছে বিরক্ত হয়ে উঠছে। প্রথমে মহিলা কন্ডাক্টরকে দেখে তার মন প্রফুল্ল হয়ে উঠেছিল,কিন্তু পরবর্তীতে ওই মহিলার কিছু কথা শোনে তার খারাপ লাগতে শুরু করে। বাসে বসা থাকালীন নারকেল গাছের বাগান দেখে মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠেছিল, আর এখন তাকে নারকেল তেল দিয়ে তৈরি খাবার খেতে হবে। বিধাতার এ কেমন লীলা? বেশ কিছুক্ষণ পর আর্য লক্ষ্য করলো তার খাওয়া অর্ধেকের বেশি হয়ে গেছে। অথচ কিছুক্ষণ আগে সেই খাবার দেখে নাক বাঁকিয়ে ছিল। বাবার কথা মনে পড়ছে। তিনি একবার মাঠে কাজ করছিলেন। খুব তৃষ্ণার্থ বোধ করায় বাড়িতে হাঁক ছেড়ে, জল আনতে বলেছিলেন। কোনো বিশেষ কারণে জল নিয়ে যেতে দেরি হয়। এতটাই তৃষ্ণার্ত ছিলেন যে জমিতে জমে থাকা জল তুলে পান করেছিলেন। বাবার কথা সে অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করছিল, আজ নিজে তা উপলব্ধি করতে ও পারলো।

ঘড়ির কাঁটা ভোর ছয়টা পূর্ণ হওয়ার কিছুক্ষণ আগে ঘুম ভেঙ্গে গেল আর্যর। খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস রয়েছে। উঠে দেখল তার অনেক আগে নেপালি ছেলে দুটো উঠে পড়েছে। আকাশ পরিষ্কার হলেও সূর্যের মিষ্টি আলো তখনও ছড়িয়ে পড়েনি। দক্ষিণ ভারতের সূর্যিমামা একটু দেরি করে উঠে। তিন দিনের মতো হয়ে গেলে,সে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে পারেনি,আবার স্নান ও করতে পারেনি।আর এই দিনগুলো খুব বিরক্তকর ভাবে কেটেছে। এতদিন তার মনে হতো বাবা তাকে কুসংস্কার শিখিয়েছেন। কিন্তু আজ অন্য কিছু মনে হচ্ছে, রোজ সকালে স্নান করে পুজো করার পর নিজেকে যতটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সচ্ছল উজ্জ্বল লাগতো এখন কিন্তু তেমনটা লাগে না। তখন কোনো কাজের প্রতি বিরক্ত আসতো না এখন খুব সহজে বিরক্ত চলে আসে।সকালে স্নান করলে মনে হতো নতুন একটা দিন শুরু হয়েছে, আপনা আপনি মনের মধ্যে স্নিগ্ধতা চলে আসতো ভালো লাগতো। এখন সেই ভালোলাগাটা নেই। স্বাভাবিক হলো সে। অতিরিক্ত ভেবে ফেলছে। তবে যাই হোক, পুরনো আর্যকে হারিয়ে যেতে দেবে না। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো, কাল সকাল থেকে পূর্বের সমস্ত কিছু নিয়ম মেনে চলবে।
সকালের ব্রেকফাস্ট করতে গিয়ে তার মন আবার আপ্লুত হয়ে উঠল। ব্রেকফাস্টে পাটিসাপটা আর দই পিঠে দিচ্ছে। এরা বাঙালি খাবার বানাতে না পারলেও বাঙালি পিঠা বানাতে পারে। বাহ দারুন ব্যাপার তো!গভীর আগ্রহে খাবার নিল। পিঠের সাথে নারকেলের সাম্বার দিচ্ছে,সে সাম্বার নিল না -এতেই হবে। সে যে বড় একটা ঝটকা খেতে চলেছে তা বুঝতে পারল না। বুঝতে পারলে কখনো এতটা প্রফুল্ল হয়ে উঠতো না। রুমে এসে পিঠে একটা কামড় দিতে তার মুখটা বাংলার পাঁচের মতো হয়ে গেল। সে যেগুলোকে পাটিসাপটা ভাবছিল আসলে সেগুলো ধোসা। সম্পূর্ণ পাটিসাপটার মতো দেখতে তবে তার মধ্যে নারকেলের ছৌ নেই রয়েছে সেদ্ধ আলু। আর যেগুলো দই পিঠে ভাবছিল, আসলে সেগুলো ইডলি। দেখতে একই হলেও খেতে সম্পূর্ণ টক। এখানকার মানুষেরা সকালে এত টক কি করে খায় তা জানা নেই। হয়তো দীর্ঘ দিনের অভ্যাস। এগুলোই তাদের খাদ্যাভাস। আর্য অবাক হলো না। এখানে প্রথমে সবকিছুই ভালো লাগে বাট পরে….।

প্লাটফর্মে পূর্বের বেঞ্চে বসে আছেন অশোকবাবু আর উনার ছেলে। রাতের ট্রেনে বাড়ি ফিরবেন। সকালে ব্রেকফাস্ট করার পর আর্য বাবার সঙ্গে দেখা করে, পরে আর হোস্টেল ফেরা হয়নি। সারাটা দুপুর বিকাল বাবার সঙ্গে থেকেছে। আজ তো শেষ, এরপর আবার কবে বাবার সঙ্গে দেখা হবে জানা নেই। রাত সাতটার পর হোস্টেলে প্রবেশ করার কোনো অনুমতি নেই, তাই সে আগে থেকে অনুমতি নিয়ে নিয়েছে। চুপচাপ বসে আছে কেউ কারোর মুখের দিকে তাকাচ্ছে না।অশোক বাবুর যেমন নিজের ছেলেকে একা রেখে দিয়ে বাড়ি ফিরতে কষ্ট হচ্ছে, তেমনি আর্যর ও বাবাকে ছাড়তে কষ্ট হচ্ছে। কষ্টগুলো বহিঃপ্রকাশ করতে পারছে না। এগুলো কেবল নিজস্ব ও একান্ত। প্ল্যাটফর্মের ট্রেন আসতে বেশী সময় বাকি নেই, অশোক বাবু কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। দুজনের মুখ ম্লান হয়ে আছে।ছেলের মুখের দিকে তিনি কিছুতেই তাকাতে পারছেন না। তবুও শেষ বিদায়, একটু আদর করতেই হবে।ওর দিকে ঘুরতে লক্ষ্য করলেন আর্যর চোখের কোণে জল জমেছে। বড্ড আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন তিনি। চোখের জল মুছে দিয়ে বললেন,”বাবা-মা সব সময় সন্তানের পাশে থাকে, কখনো দূরে সরে যায় না। আমাদের মৃত্যুও সন্তানের থেকে দূরত্ব বানাতে পারে না। শারীরিকভাবে বিচ্ছিন্ন হলেও আত্মার সঙ্গে সম্পর্ক থেকে যায়। কোনো বাবা-মা চায় না তার সন্তান খারাপ হোক। তারা সবসময় সন্তানকে সঠিক শিক্ষা দেয়, কিন্তু তারা কতটা গ্রহণ করতে পারে তারাই জানে। যদি সবটা গ্রহণ করতে পারে তাহলে তারা কখনও অসৎ পথে যাবে না। কয়েকটা বছর সুন্দর ভাবে কেটে যাবে, যখন ছুটি পাবি তখন বাড়ি চলে আসিস। জীবনে বড় হতে হলে কষ্ট করতে হবে। একবার রকেটের কথা চিন্তা কর,সে যখন উপরের দিকে উঠা শুরু করে তখন নিচের অংশ গুলো একটু একটু করে ফেলে দেয়। নিজেকে হালকা করে নেয়, তাই রকেট অনেক উপরে যেতে পারে। জীবনটাও তেমন, যত ত্যাগ করতে পারবি ততই বড় হতে পারবি।”
তিনি থামলেন। আর্য কিছু বলল না। বাবা পাস ঘুরে সামনের দিকে দাঁড়ালেন। ট্রেন আসার অপেক্ষা করছেন। তিনি আবার ছেলের কাঁধে হাত রেখে বললেন,”এতদিন ধরে আমি আদর যত্ন শাসন দিয়ে বড় করেছি। সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পাসনি। ওই গুলো তুই কোন দৃষ্টিতে নিয়েছিস -তা জানি না। আজ থেকে তুই এখানে,কি করবি,না করবি -তা আমরা কখনো জানতে পারবো না।যদি ভাবিস, মিথ্যা বলে কিংবা নানান ধরনের অজুহাত দেখিয়ে জীবনে এগিয়ে যাবি তাহলে সবচেয়ে বড় ভুল করবি। জীবনে অতিরিক্ত স্বাধীনতার প্রয়োজন নেই। স্বাধীনতা যেমন মানুষকে মুক্ত করে তেমনি স্বাধীনতা মানুষকে উপরে নিয়ে গিয়ে নিচে ফেলে দেয়। ওই যে মাছের একটা গল্প আছে না তেমনটা। জীবনে যাই হয়ে যাক না কেন -কখনো নিজের পরিবার আর সৃষ্টিকর্তাকে ভুলে যাবি না।একটা মানুষ তখনই অসুখী হয় যখন সে নিজের পরিবার আর তার সৃষ্টিকর্তা থেকে দূরে চলে যায়। তাদেরকে অস্বীকার করে। জীবনে এমন স্বপ্ন দেখা উচিত নয় যেগুলোর জন্য নিজের পরিবার এবং সৃষ্টিকর্তাকে ভুলে যেতে হয়…..। হঠাৎ করে প্ল্যাটফর্মের মধ্যে ট্রেন চলে আসায় তাদের কথাসূত্র ছিঁড়ে গেল। দ্রুত ট্রেনে উঠে পড়ার আগে,ছেলের হাতে একটা অনেক পুরনো টাকার কয়েন গুঁজে দিলেন, আর্য উপহার। মিনিট তিনেকের পর লাল সিগন্যাল সবুজ হলো। ট্রেন আস্তে আস্তে করে বেরিয়ে গেল। আর্য কলের পুতুলের মত সেই সরু বেঞ্চের উপর বসে পড়ল। কিছু ভালো লাগছে না। বাবাকে না হলে এক মুহূর্ত চলতো না, আজ থেকে ওই মানুষটাকে ছেড়ে চলতে হবে। কষ্ট হচ্ছে! বাবার দেওয়া কয়েনটি বারবার নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখলো। এটা কোনো সাধারণ কয়েন নয়, পুরনো দিনের কয়েন, যা এখন বাজারে চলে না। আবার বাবার দেওয়া তৃতীয় উপহারও বটে। জীবনের আর এক সূত্র। এখনো পর্যন্ত সামনে দুটো উপহারের সূত্র খুঁজে পায়নি তার উপর আবার একটা উপহার এসে জুটল। প্রথমে একটা বই যে বইতে কিছু লেখা নেই, দ্বিতীয় একটা দাবা যা আর্যর সবচেয়ে অপছন্দ, তৃতীয় একটি পুরনো কয়েন…… কি রয়েছে এগুলোর মধ্যে? এই উপহার গুলোর সাহায্যে তিনি কি বোঝাতে চাইছেন?

পর্ব ৯ আসছে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here