কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ পর্ব-৯

0
261

কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ
পর্ব ৯
____________________
ভারতবর্ষের বেশিরভাগ কলেজে ক্লাস শুরু হয় জুলাই-আগস্ট মাসে। প্রাইভেট কলেজ গুলো আরও দেরি করে। আর্য কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না তার বাবা হঠাৎ করে তাকে কেন কলেজে ছেড়ে দিয়ে গেল, যেখানে ক্লাস শুরু হতে প্রায় দেড় মাস বাকি আছে। এতদিন এখানে থেকে কি করবে?রাতে বিছানায় শুয়ে যতক্ষণ না ঘুম আসলো ততক্ষণ নিজের মনে বিচার করতে লাগল। বাবার প্রতিটি কথা তার মনের উপর মুদ্রিত হয়ে উঠছে। মাঝেমধ্যে উপহার দিয়ে চমকে দেওয়া…. যে উপহারের আক্ষরিক অর্থ নগণ্য নয়। সে একটা উপহারের মর্ম এখনো বুঝে উঠতে পারেনি।আবার তিনি নিজেই হঠাৎ করে কলেজে ছেড়ে দিয়ে গেলেন। সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। কোনো কিছু মাথায় ঢুকছে না। সমস্ত কিছুর মধ্যে একটি নিবিড় ব্যাপার রয়েছে। আধো আধো ঘুমে রাত কোনো রকম ভাবে কেটে গেল।
একটু একটু করে কর্নাটকের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠছে সে। দীর্ঘ আয়তন বিশিষ্ট হোস্টেল হলেও ছাত্রের সংখ্যা খুবই কম। কলেজে এখন ভ্যাকেশন চলছে। প্রথম বর্ষে কোনো স্টুডেন্ট নেই। সপ্তাহ খানেক পর দ্বিতীয় বর্ষে ক্লাস শুরু হবে, তাই দু-চার জন ছাত্র আসতে শুরু করেছে। পরীক্ষার পর নেপালিরা বাড়ি ফেরেনি, বাড়ি ফেরা একটু কষ্টকর। হোস্টেলে প্রায় সমস্ত নেপালি ছেলেরাই রয়েছে। তাদের সাথে খুব তাড়াতাড়ি পরিচয় হয়ে ওঠে আর্যর। দিন সুন্দর ভাবে গড়ে যায়।
লিমভো আর দর্শন উভয় যখন বাইরে কোথাও বের হয়, তখন অবশ্যই আর্যকে সঙ্গে নিয়ে যায়। সে একবারের জন্য ‘না’ বলে না। মুক্ত স্বাধীন জীবন পেয়েছে। এখানে বাধা দিতে কেউ নেই। তাদের সঙ্গ পেয়ে মেতে উঠেছে। সবকিছু ভালো লাগছে। এখন পড়াশোনাও নেই। প্রায় পনেরো দিনের মত কর্ণাটকে কাটানোর পর বুঝতে পারল, এখানকার মানুষের জীবন যাপন বাঙালি দের মত নয়। অনেক ভিন্ন। মেধাহালিতে পৌছানোর পর লক্ষ করেছে প্রত্যেকদিন বিকেলে হালকা হলেও বৃষ্টি হচ্ছে। আশেপাশে বেশিরভাগ মানুষই খ্রিস্টান আর মুসলিম ধর্মাম্বলী। তবে একটা দারুণ ব্যাপার রয়েছে, যা আর্যকে চরম বিস্মিত এবং কৌতুক করে তুলেছে। এখানে প্রায় প্রত্যেকটি নারী ঘাগরি বা লেহেঙ্গা জাতীয় পোশাক পরে থাকে সবসময়। সে বাচ্চা হোক কিংবা গৃহবধূ তার পরনে রয়েছে ঘাগরি পোশাক আর কোমরে বাঁধা আছে কোমর বন্ধনী। পাশ দিয়ে কোনো মহিলা হেঁটে গেলে একটা ঝুম ঝুম আওয়াজ ভেসে আসে।সঠিক ভাবে বোঝাতে গেলে তাদের পোশাক-আশাক অনেকটা মারাঠীদের মত। ভারী পোশাক সব সময় কেন পরে থাকে? তা জানা নেই। তারা সারাদিনে মাথায় যতবার চিরুনি দেয় ঠিক ততোবারই মাথায় রজনীগন্ধা ফুলের মালা বেণীর সাথে লাগিয়ে নেয়। মাঠে কাজ করছেন,আবার কেউ রান্না করছেন, আবার কেউ কাপড় পরিষ্কার করছেন, আবার কেউ বাসে করে অফিসে যাচ্ছেন; কিন্তু মাথায় ফুল বাঁধতে ভুল করেননি। হোস্টেলে যারা রান্নার কাজে নিযুক্ত আছেন, তারাও এর ব্যতিক্রম নয়। এত ব্যস্ততার মধ্যেও তাদের এমন রুচি, খুব সহজে যে কোনো মানুষকে মুগ্ধ করবে। পশ্চিমবাংলায় মানুষেরা যেখানে মাথায় চিরুনি দিতে সময় পায় না, আর এখানে ওই বিষয়টি কতটা সহজ এবং সৌন্দর্যময়।এখানকার মানুষের শখ আর শৌখিন সর্বভৌম -তা এখানকার নারীদের দেখলে বোঝা যায়। পশ্চিমবাংলায় গ্রামের দিকে আধুনিক জীবনযাপন অনেক আগেই প্রবেশ করেছে। রঙিন ড্রেস, নতুন নতুন ফ্যাশন ডিজাইনের জামা, (বিশেষ করে ইউরোপ কান্ট্রির পোশাক) কাপড় পরতে দেখা যায় সেখানকার ছেলে মেয়েদের। কিন্তু এখানে তেমন নয়। মানুষ গুলো খুবই সাধারণ থেকে অতি সাধারণ। ঝাঁ-চকচকে কোনো কিছুই পরিধান করে না। গ্রাম্য মানুষের চেয়েও খুব সাধারণ। এখনো পর্যন্ত আর্যর চোখে পড়েনি, কোনো মানুষকে উজ্জ্বল রংয়ের জামা পরিধান করতে। অধিকাংশ মানুষই খুব হালকা এবং গ্রাম্য পোশাকগুলো পরিধান করে থাকে। ভারতবর্ষের যদি কোনো মানুষকে জিজ্ঞেস করা হয়, দেশের সবচেয়ে উন্নত শহর গুলোর নাম বলতে,সেখানে প্রথম তিন সারির মধ্যে অবশ্যই বেঙ্গালুরু থাকবে। অথচ এখানকার মানুষের জীবন যাপন খুব সাধারণ। বর্তমানে গ্রামগুলো যেমন নিজেদের ঐতিহ্য সংস্কৃতি হারিয়ে শহরের জীবন যাপনকে পছন্দ করে নিয়েছে, সেখানে একটি উন্নত শহর গ্রাম্য সাধারণ জীবনযাপন বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। এ যে অবিশ্বাস্যকর! আর্য এখনো পুরো কর্নাটকের মানুষের জীবনযাপন সম্পর্কে অবহিত হয়নি, তবে এখানকার মানুষ তাকে বড্ড মুগ্ধ করেছে। নিজেকে এতদিন খুব সরল সাদাসিদে মনে করে এসেছে,কিন্তু আজ তাদেরকে দেখে মনে হচ্ছে, সে তাদের চাইতে অতটা সরল এবং সাদাসিদে নয়। মানুষের জীবন যাপন পছন্দ হলে এখানকার খাবার একদমই পছন্দ হলো না। সমস্ত মানুষই টক জাতীয় খাবার বেশি খায়। মাংস থেকে শুরু করে ডিম সবকিছুতেই টক রয়েছে। যদিও এখানে অধিকাংশ মানুষই নিরামিষ জাতীয় খাবার পছন্দ করে, এই জিনিসটি বড্ড অনিচ্ছাকৃত এবং বিরক্তকর।

১।
পৃথিবীতে প্রত্যেকটি মানুষের জীবনে অতীত থাকে, অতীত থাকাও ভালো, কিন্তু অতীত নিয়ে পড়ে থাকা ভালো নয়। স্নেহার জীবনেও ভয়ংকর অতীত রয়েছে। সেই অতীত মনে করতে চায় না সে। সব কিছু ভুলে নতুন জীবন শুরু করেছে স্বামীর সঙ্গে। স্বামী-সংসার এইগুলো নিয়ে খুশি আছে। স্বামীর কাছ থেকে কিছু লুকোতে চায়নি। কোনো কিছু লুকিয়ে জীবনে এগিয়ে যাওয়া যায় না। বিয়ের আগে স্বামীকে বলে দিয়েছিল তার জীবনে বিক্রম বলে কেউ ছিল। জীবনে প্রথম ভালোবাসা।তার চোখে দেখা প্রথম সুন্দর পুরুষ ছিল বিক্রম।সবকিছু জেনেই বিয়ে হয়েছে। কোনো কিছুতে দ্বিধাবোধ করেনি সে। ফুলশয্যার রাতে স্নেহা জানতে চিয়েছিল, স্বামীর অল্প বয়সে আবেগ ছিল কিনা! অবশ্যই অল্প বয়সে প্রচন্ড আবেগ ছিল তবে আবেগময় মানুষটি ছিল না। সে খুব সাধারণভাবে ছোটবেলা কাটিয়েছে। মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা ততটা পছন্দ করত না। পড়াশোনা ভবিষ্যৎ এইগুলো নিয়ে ছোটবেলা কাটিয়েছে। সে ঠিক করে রেখেছিল বিয়ের পর প্রেম করবে। বিয়ের আগে যদি সমস্ত কিছু সম্পন্ন হয়ে যায়, তাহলে বিয়ের পর কি করবে? স্বামীর বুকের মধ্যে নিজের মুখ লুকিয়ে বলেছিল, কোনদিন ছেড়ে যাবে না তো! স্নেহাকে পুরো বুকের মধ্যে জাপ্টে ধরে মাথায় আলতো করে হাত বোলিয়ে দেয়। ছেড়ে দেওয়ার কোনো প্রসঙ্গ ওঠে না। চার হাত এক হয়েছে।হাত গুলো কখনো আলাদা হতে দেবে না। জীবনে যাই হোক না কেন, কখনো কেউ কাউকে ছেড়ে যাবে না। আজ দ্বিরাগমন থেকে শ্বশুর বাড়িতে ফিরেছে স্নেহা। ফিরে আসার সময় বাবার চোখের কোনে জল, মায়ের চোখের চাপ আনন্দের হাসি তাকে স্লান করে তুলেছে। তার সঙ্গে ঋষি এসেছে, তাই মন একটু প্রফুল্ল। ভাইকে খাইয়ে-দাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। তারপর নিজের রুমে এসে দেখে, স্বামী নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তার মন ভাল নেই। কোথায় তাকে একটু সান্ত্বনা দেবে, একটু মনের কথা বলবে, তা না করে নিজের কাজ করে যাচ্ছে । বিরক্ত হয়ে রুমের বাইরে বেরিয়ে আসলো। বেলকুনির উপর দাঁড়িয়ে বাইরে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। তার পরনে গোলাপি রঙের শাড়ি আছে। আকাশের বুকে থালার মতো একখান চাঁদ। চাঁদের আলোয় চারদিক ঝিকমিক করছে। চারপাশ থেকে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। মনমুগ্ধকর দৃশ্য।
অল্প সময়ের মধ্যে নিজের কাজ ফেলে স্নেহার কাছে আসলো। তাকে কাছে ডেকে পাশাপাশি বসল। কাঁধের উপর হাত রাখল।
“কষ্ট হচ্ছে?” স্নেহা মাথা নাড়ালো।
“কষ্ট হওয়া স্বাভাবিক। বাবা-মাকে ছেড়ে আসার সূক্ষ্ম অনুভূতি খুব সহজে বিসর্জন দেওয়া সহজ নয়। একদিকে তোমার পুরনো অতীত অন্যদিকে বাবা-মাকে ছেড়ে আসার বেদনা তোমাকে দগ্ধে দগ্ধে মারছে।”
“খোঁটা দিচ্ছ?”
“সে অধিকার আমার নেই। আমি সবকিছু জেনে তোমাকে গ্রহণ করেছি, খোঁটা দেয়ার প্রসঙ্গ আসে না। এমন বিব্রতকর প্রশ্নের মুখোমুখি দ্বিতীয় বার আর যদি না হই তাহলে খুব ভালো হতো।” আবার তীব্র নীরবতা। স্নেহার চোখের কোনে জল জমে গেছে। খুব দ্রুত কেঁদে ফেলে সে। বাধা দিল না, কাঁদতে দিল। একটু অস্বস্তিকর লাগছে, যদিও কয়েক মুহূর্ত পেরিয়ে গেলে ঠিক হয়ে যাবে।
“একটা কথা জিজ্ঞেস করব? সঠিক উত্তর দেবে তো?”
“অবশ্যই।”স্নেহার কণ্ঠস্বর হালকা।
“বিক্রমের সঙ্গে তোমার কি করে বিচ্ছেদ হলো?” মৃদু হাসল স্নেহা। অন্ধকারের মধ্যে তার মুখশ্রীতে হাসির রেখা ফুটে উঠল না। এতগুলো দিনের পর ওই মানুষটির কথা মনে করতে চাইছিল না। অন্ধকারের মধ্যে পুরোনো সেই অভিমানী আর রাগান্বিত চোখ দুটো ভেসে উঠল।
“কখনও কখনও তাকে ছেড়ে আসতে হয় যাকে ছেড়ে আসার কথা আমরা কখনো চিন্তা করিনি। আবার তার হাতটা ধরে বাঁচতে হয় যাকে স্বপ্নেও ভাবেনি। আসলে বাস্তবতা খুব কঠিন। আর তার চাইতেও কঠিন বাস্তবতাটাকে মেনে নেওয়া।” তার কণ্ঠস্বরে বিদ্রূপ আর শ্লেষের আভায় স্পষ্ট। স্নেহা বড্ড ইমোশনাল হয়ে পড়েছে। তাকে আটকানোর চেষ্টা করেও পারলো না। সে আবার বলল,”তুমি সব সময় জানতে চাও না আমার এত কষ্ট কিসের? কেন এত সার্থকতা পরেও আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে কান্না করতে হয়? কেন আমার চোখে এত তৃষ্ণা? কেন আমার বুকে এত হাহাকার? আসলে কি জানো তো, আমি একসময় আমাদের বিচ্ছেদ মেনে নিয়েছিলাম। নিজের দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা ভুলে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আমার বিচ্ছেদের কারণ কি ছিল জানো? আমি খুব কল্পনা প্রেমী মানুষ। বাস্তব নিয়ে কখনো ভাবি না। কল্পনা নিয়ে বাঁচা যায় না। এটাই ছিল আমাদের বিচ্ছেদের মূল কারণ। অথচ আজ বিক্রম রিম্পির সঙ্গে দিব্যি সংসার করছে। যে মানুষটার সঙ্গে সংসার করছে সেই মানুষটি আমার চেয়েও বেশি কল্পনা প্রেমী। সে মানুষটি কখনো সিরিয়াস হয় না। তার সঙ্গে যদি থাকতে অসুবিধা হচ্ছে না,তাহলে আমার সঙ্গে থাকতে কোথায় অসুবিধা হচ্ছিল? আসলেই কি বিচ্ছেদের কারণ এটা ছিল, -না ছিল শুধু মাত্র একটা অজুহাত?” স্নেহা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠল। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করুল। স্নেহা আবার বলল,”বিক্রম বড্ড গাছ আর বই ভালোবাসতো। দু’বছর ধরে তার রুম আমার মতো করে সাজিয়েছি। ওখানে ওই বইটি রাখবে, সেখানে সেই গাছটি লাগাবে, রুমটি এমন করে সাজাবে, বিছানায় এমন রঙের বেডশীট পাতাবে ….। সেও আমার সব কথা শোনে ঘরটি সুন্দর করে সাজাতো। ধীরে ধীরে ঘরটি সৌন্দর্য পূর্ণ হয়ে ওঠে। শুধু একটা শূন্যতা ছিল। ওই ঘরের শূন্যতা আজ পরিপূর্ণতা পেয়েছে। অথচ শূন্যের ঢেউয়ের মধ্যে সাজানো ঘরের মালিক হারিয়ে গেছে, -তাকে কেউ খুঁজেনি।পুরোনো চেনা রাস্তায় সে যখন অন্যের হাত ধরে ঘুরে, তখন আমার চোখ তীব্র তৃষ্ণায় ভরে ওঠে। এই তৃষ্ণা কেউ কোনোদিন মেটাতে পারেনি আর পারবেও না।” স্নেহাকে বুকে জড়িয়ে নেয়।চোখের জল মুছে মাথায় আলতো করে হাত বোলিয়ে দেয়।
“থাক না সেই সব কথা। সেগুলো অনেক পুরনো। কি হবে ভেবে? যা পেয়েছো তা নিয়ে এগিয়ে যাও। জীবনে অতিরিক্ত আকাঙ্ক্ষা না থাকাই ভালো। তোমার জীবনে অতীত রয়েছে, আমি সেই অতীত মেনে নিয়েছি। কিন্তু এখন যদি সেই অতীত টেনে এনে বর্তমানে বাঁচতে চাও কিংবা পুরনো অতীতে ফিরে যেতে চাও তাহলে তুমি আমাকে অসম্মান করবে। আমাদের সম্পর্ক নড়বড়ে হবে। তুমি কি করবে সেটা তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।” স্নেহা স্বামীর বুকে নিজেকে গুটিয়ে নিল। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। এতটা আবেগপ্রবণ হওয়া উচিত নয়। বিক্রম যদি সুখি হতে পারে তাহলে সে কেন সুখী হতে পারবে না? সুখী হওয়া অত্যন্ত জরুরী। আজ তার জীবনের সাথে কেবল সে একা জড়িত নয়, আরও একজন জড়িয়ে আছে। তাদের সুখ দুঃখ কেড়ে নেওয়ার অধিকার তার নেই।সে হাসার চেষ্টা করল। স্বামী স্নেহাকে কোলে তুলে নিল। স্নেহা লজ্জায় মুখ নিচু করে ফেললো। সে একটু হাসিমুখে বলল,”জানো,আমি যখন ছোটবেলায় কান্না করতাম তখন আমার বাবা একটা কবিতা শোনাতো।এখন তা তোমাকে শোনাতে ইচ্ছা করছে।”
“আচ্ছা, শোনায়।”
“কান্দে না কান্দে না বাবু।
বাঁশ গাছে হনু
মা গেছে ঘাস কাটতে
আইনে দূধু খাবু।” (উক্ত কবিতাটি গ্রাম্য ভাষায়) স্বামীর মুখে বাচ্চা ভোলানো কবিতা শুনে হা হা হা করে হেসে উঠলো। তার বুকে ইচ্ছেমত কিল ঘুষি বসালো।
“আমি কি বাচ্চা? বাচ্চাদের মত কবিতা শোনাচ্ছো।”
“হুঁ,ছোট বাচ্চা তুমি। না হলে এই বয়সে এসে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদো!”
“মনে রাখবে, আমি মোটেও বাচ্চা নয়।” স্নেহের কথা বলার ধরন এবং হাত নাড়ানোর ছিরি দেখে উভয় খুব জোরে হেসে ফেললো।
ঘন অন্ধকার, অন্ধকারের মধ্যে ঘুমোতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে স্নেহা। অন্ধকার ঘরটিকে আঁকড়ে ধরেছে এক মুঠো নিস্তব্ধতা।পাশে মানুষটি বারবার দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ছে। স্নেহার মত তার চোখেও ঘুম নেই। পাস ঘুরে জড়িয়ে ধরলো। বুকের মধ্যে নিজের মুখ লুকিয়ে চুপ হয়ে যায়। কি শান্তি! সারা জীবন এভাবে আগলে রাখতে হবে। এভাবে ভালবাসতে হবে। ভালোবাসার ধরন বদলে নতুন নতুন ভাবে ভালোবাসতে হবে। বারবার এপাশ-ওপাশ করতে রইল, আবার কখন স্বামীর বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে ফেললো, বুঝতে পারল না।
“কি হলো!”
“কিছু না।” স্নেহার কণ্ঠস্বরের প্রচন্ড রকমের স্নেহ আর আবেগের আবছা রয়েছে। বুকের মধ্যে মুখ রেখে আলতো গলায় বলল,”তোমাদের বাড়িতে কটা রুম রয়েছে?”
“নীচে দুটো, ওপরে দুটো, নিচে একটা রুমের বাবা-মা থাকেন আর একটা রুমে বোন। উপরের একটা রুমে আমারা থাকি আর একটা ঠাকুর ঘর।”
“আরো দুটো রুম চাই, তাড়াতাড়ি হলে ভালো হয়।”
“সে কি! আমরা তো দুজন মানুষ, চারটা রুম কি হবে?”
“ও মা! আরও দুটো রুম কী হবে তাও বলে দিতে হবে। তোমার মত বদমাশের সঙ্গে থাকলে দুজনে থেকে চারজন, চারজন থেকে পাঁচজন পাঁচজন থেকে সাত জন হতে কত সময় লাগবে শুনি?”
“বাহ!বাহ! উপন্যাস থেকে ডায়লগ কপি করে মেরে দিচ্ছ! নিজের মন থেকে কিছু বল।”
“বইপ্রেমীকে বিয়ে করেছো। মাঝেমধ্যে আমায় বইয়ের অনেক নায়িকা রূপে দেখতে পাবে। কিছু করার নেই বুদ্ধু।” তার ঠোঁট ফেটে হাসি বেরিয়ে আসলো। হাসতে হাসতে অস্থির হয়ে ওঠল। স্ত্রীর ঠোঁটে ভালোবাসা ঢেলে দিল। চোখের কোনে আর জল নেই, তৃপ্তির রেশ ফুটে উঠেছে। ছোট দুটো চোখ মিটমিট করে গভীরভাবে আরও দুটো চোখকে খুব কাছে পেতে চাইছে। তার ঘাড়ে কালো তিল এবং কানের কাছে কাটা অংশ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এক অন্য অনুভূতি,যার নাম নেই।

পর্ব ১০ আসছে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here