কাজল নদীর জলে’পর্ব-১

0
2729

কাজল নদীর জলে
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

১.
‘শিউলি ঝরানো আজই সন্ধ্যারও বাতাসে
কে গো সাড়া দিয়ে যায় স্বপ্নেরও আভাসে
কার লাগি দোলে ওঠে, ক্ষণে ক্ষণে থর-থর এ হিয়া।’

ছাদ বাগানের গোলাপ গাছ গুলোয় পানি দিচ্ছিল সুরলা। হঠাৎ কারো মৃদুস্বরে গাওয়া গান কানে এলো। ভ্রু কুঁচকায় সুরলা। কন্ঠটা অপরিচিত। খালার বাসায় এসেছে মাস দুয়েক হবে। প্রতিদিন বিকেলে ছাদে আসে। কিন্তু এর আগে কখনো এই কন্ঠ কানে আসে নি। মৃদুস্বরে গাওয়া গানের গায়ক খুঁজতে চারপাশে চোখ বুলায় সে। চোখ আটকায় পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদে। একটা ছেলে তার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে আছে ছাদের মাঝ বরাবর। পরনে কালো গেঞ্জি, সাথে বাদামী থ্রি কোয়াটার প্যান্ট। সামনে ফিরে থাকায় চেহারা দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা করছে ছেলেটা। আন্দাজ করে সুরলা। কী করছে! জানতে উৎসুক সুরলার সরল মন।

হাতে থাকা পানিভর্তি প্লাস্টিকের ঝাঁজরি রেখে রেলিঙের দিকে পা বাড়ায়। গুনগুনিয়ে গাওয়া গান আবারো কানে বাজে তার।

“কাজলো নদীর জলে, ভরা ঢেউ ছল-ছলে
প্রদীপ ভাসাও কারে সরিয়া,
সোনার বরণই মেয়ে, বলো কার পথ চেয়ে
আঁখি দুটি ওঠে জলে ভরিয়া।”

গলার সব মধুর স্বর যেন ঢেলে দিচ্ছে লাইন গুলোয়। এমন মধুর শুনাচ্ছে গান। সুরলা নিশ্চত হয় গায়ক আর কেউ নয় এই ছেলেটাই। গানের গলাটা চমৎকার। মন কাড়ে সুরলার৷ রেলিঙের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সে। ডাগর ডাগর চোখ জোড়ার পূর্ণ দৃষ্টি ফেলে পাশের ছাদে। ছেলেটার সামনে দাঁড় করানো পেইন্টিং হোল্ডার, হোল্ডারে আটকানো পেইন্টিং পেপার চোখে পড়ে। আর্ট প্লেট আর তুলি ধরে রাখা হাত দুটো পেছনে নিয়ে পিঠের সাথে লাগিয়ে রেখে পেন্টিংয়ের দিকে ঝুঁকে থাকাটাও চোখ এড়ায় না। তারুন ব্যানার্জির ‘কাজল নদীর জলে’ গানটা তখনো গুনগুনাচ্ছে ছেলেটা। সুরলা গভীর মনোযোগ দিয়ে সেই গান শুনে। গান শেষ হয়। ছেলেটা সটান দাঁড়ায়। পেইন্টিং পেপার দৃশ্যমান হয়। পেইন্টিংয়ে চোখ বুলায় সুরলা। তারপর আকাশের দিকে তাকায়। চমকায় সে। পড়ন্ত বিকেলের নীলাভ আকাশে এক ঝাক ঘুড়ি আর মেঘের উড়াউড়ি খেলার দৃশ্যটা রং-তুলিতে ফুটিয়ে তুলেছে। যেমনটা আকাশের বর্তমান দৃশ্য। এত নিঁখুত করে কেউ আঁকতে পারে! গানের মত ছেলেটার পেইন্টিং ও মুগ্ধ করেছে সুরলাকে।

এত প্রতিভা সম্পন্ন ব্যক্তির চেহারাটা এক পলক দেখার শখ জাগে সুরলার। অপেক্ষায় থাকে ছেলেটার পেছন ফেরার৷ মিনিট দশেক পার হয় কিন্তু ছেলেটা পেছন ফিরে না। আরেকটা পেইন্টিং শুরু করে। সুরলা একবার ভাবে ডাকবে ছেলেটাকে। পরে আবার ভাবে, কী বলে ডাকবে? অচেনা একজনকে এভাবে ডাকাটা হ্যাংলামো হয়ে যাবে৷ আর হ্যাংলামো করার মানে হয় না।
গোধূলি নামে। গাছে পানি দিয়ে সিড়ির দিকে পা বাড়ায় সে ।

সুরলা, পুরো নাম- সুরলা তাবাসসুম। আইইউবিতে ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়ছে, চতুর্থ সেমিস্টার। গায়ের রঙটা হলুদে ফর্সা। ডাগর ডাগর চোখ, সরু ঠোঁট, সরু নাকের সমন্বয়ে পুতুল চেহারা। বব কাট কাধ অবধি চুল আর চার ফুট নয়ের হাইটটা লোক সম্মুখে সুরলাকে নিচকই পনেরো ষোল বছরের কিশোরী হিসেবে উপস্থাপন করে। অথচ সুরলা কৈশোর জীবন শেষ করেছে সেই কবে! কুড়িতে বুড়ি হওয়ার রীতিটা সুরলাকে শুনতে হয় না। কেননা, তাকে দেখে মনেই হয়না সে কুড়ির ঘর পার করে এসেছে।

স্বভাবেও বাচ্চামোর আভা। এই যে, এখন সুরলা লাফিয়ে লাফিয়ে সিড়ির বেয়ে নিচে নামছে। কখনো এক সিড়ি কখনো দুই সিড়ি বাদ দিয়ে আগাচ্ছে। এভাবে ছয়তলা থেকে পাঁচতলায় আসে। থামে সে। সিড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। ভাবে, এক সিড়ি, দুই সিড়ি বাদ দিয়ে তো এগুলাম। এবার তিন সিড়ি বাদ দিয়ে এগুবো। এই ভেবেই তিনটা সিড়ি বাদ দিয়ে চতুর্থ সিড়িতে লাফ দেয়। থামে। ‘ইয়েএএ পেরেছি’ বলে এক চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে উঠে। চোখে মুখে উৎফুল্লতা উপচে পড়ে। যেন সে সিড়ি নয় বিশ্বজয় করেছে। তিন সিড়ি বাদ দিয়ে নামার ট্রিকস ফলো করে তৃতীয় তলা অবধি চলে আসে। তৃতীয় তলায় দু’টো ফ্ল্যাট। বাম পাশের ফ্ল্যাটের সদর দরজার কাছে এসে থামে। কারুকাজে আবৃত কাঠের দরজাটার বাম পাশে থাকে সুইচে চাপ দেয়। হাঁটুতে হাত দিয়ে ঝুকে হাফাতে থাকে। লাফিয়ে লাফিয়ে সিড়ি বেয়ে এসে হাফিয়ে গেছে।

ডোরবেল বেজে উঠে। সেকেন্ড বিশেকের মাথায় খট করে দরজা খুলে যায়। দরজার ওপাশ থেকে বেরিয়ে আসে ফিরোজা রঙের সেলোয়াল কামিজ পরিহিতা এক মধ্যবয়সী মহিলা। সম্পর্কে সুরলার খালা। নাম, রেহানা জাহান। সুরলার দিকে এক পলক তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকান। সুরলাকে হাফাতে দেখে ব্যতিব্যস্ত হয়ে কাছে আসেন। বলেন,
“কী হয়েছে সরু? হাফাচ্ছিস কেন! ”

সুরলা হাফাতে হাফাতে বলে,
” খালামণি পানি দাও এক গ্লাস। সিড়ি বেয়ে এসে হাফিয়ে গেছি। ”

রেহানা জাহানের চোখে মুখে খেলে যায় রাগ। রাগত কন্ঠে বলে উঠেন,
” আজও লিফট ব্যবহার না করে খরগোশের মত লাফিয়ে সিড়ি বেয়ে এসেছিস? কতবার নিষেধ করি লাফালাফি করিস না। একটা কথাও শুনিস না। এখন কীভাবে হাফাচ্ছিস! আমি আজই তোর মায়ের কাছে বিচার দিব। আচ্চা করে বকলে শান্ত হবি তুই।”

সুরলা ফ্লোরে চোখ রেখে বাঁকা দাঁতগুলো বের করে হাসে৷ সে জানে রেহানা জাহান কখনো তার মায়ের কাছে বিচার দিবে না। এই মানুষটা তাকে ভীষণ ভালোবাসে। সুরলার পিঠাপিঠি রেহানা জাহানের একটা মেয়ে ছিল। নাম, ঋতু। জন্মের মাস খানেকের মাথায় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। দিশেহারা হয়ে যান রেহানা। বোনের কষ্ট দেখে সুরলার মা সাবিনা জাহান কোলের মেয়ে সুরলাকে নিয়ে এসে থাকেন বোনের কাছে। দুই বোনের কোলে মানুষ হয় সুরলা। ঋতুর জায়গাটা নিয়ে নেয় সুরলা। ঋতুর পর নিতু আর নিলয় ভুবনে পা রাখলেও ঋতুর জায়গাটা সুরলারই থেকে যায়। এসব কথা জানে সুরলা। সে মুখ তুলে তাকায় খালার দিকে। করুণ চাহনি দিয়ে বলে,
“খালামণি তুমি সত্যিই আমাকে বকা খাওয়াবে?”

সুরলার চোখের দিকে তাকাতেই রাগ পড়ে যায় রেহানার। সুরলাকে দাঁড় করিয়ে মৃদুস্বরে বলেন,
” কথা না শুনলে বকা খাওয়াতেই হবে। কথা কেন শুনিস না? যদি পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙতি তখন ব্যাথা কে পেত?”

“আমি পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেলে আমার থেকে বেশি ব্যাথা তুমি আর আম্মু পেতে। আমি না কাঁদলে ও দুই বোন মিলে পাটি বিছিয়ে কান্না জুড়ে দিতে। যেমনটা ছোটবেলায় পড়ে যাওয়ার পর দিয়েছিলে। যাক গে, পানি দিতে বললাম দিলে না। এখন সরো। আমি গিয়ে পানি পান করি। ”

বলে লাফিয়ে লাফিয়ে ভিতরে চলে গেল সুরলা। ‘লাফাস না! পড়ে যাবি।’ বলে বকতে বকতে দরজা লাগিয়ে ঘরে এলেন রেহানা।
সুরলা ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল নিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে। সুরলাকে বসতে দেখে হাফ ছেড়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যান রেহানা। অর্ধেক বানিয়ে রাখা বিকেলের নাস্তা ফুলকপির পকোড়া বানানোয় মনোযোগ দেন।

পানি খেয়ে সোফায় গা এলিয়ে দেয় সুরলা। হঠাৎ মনে পড়ে পড়ন্ত বিকেলে দেখা সেই অচেনা মানবের কথা। তখনি ব্যাট বল হাতে ড্রয়িংরুমে আসে নিলয়। সবে মাঠ থেকে ক্রিকেট খেলে এসেছে। সুরলা নিলয়ের দিকে তাকায়। ভাবে, নিলয়কে জিজ্ঞেস করবে ছেলেটার ব্যাপারে। তবে সোজাসাপ্টা জিজ্ঞেস করা যাবে না। কথার প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করতে হবে। সে সোজা হয়ে বসে। ভাব জামানোর জন্য নিলয়কে বলে,
“আজ তোর স্কোর কী রে?”

নাইন পড়ুয়া নিলয় উৎফুল্লতার সাথে বলে,
“তিনটে ছয়, দুটো চারের সমন্বয়ে চার ওভারে হাফ সেঞ্চুরি। ”

নিলয়ের পিঠে চাপড় মেয়ে সুরলা বলে,
“আই প্রাউড অফ ইউ ভাই। একদিন ভালো ব্যাটসম্যান হিসেবে জাতীয় দলে স্থান পাবি। ”

নিলয়ের চোখ মুখের আনন্দ উপচে পড়ে। খুশিতে গদগদ হয়ে বলে,
“ধন্যবাদ আপু। আমার স্বপ্ন জাতীয় দলে নাম লিখানো।”

সুরলা ধীরে ধীরে মূল কথায় আসে।
“নিলয় শুন না?”
“হ্যাঁ বলো?”
” এই বিল্ডিংয়ের কোন গায়ক আছে? বিকেলে গানের আওয়াজ পেলাম।”

নিলয় বলে,
“না নেই। ” থেমে গিয়ে খানিক ভেবে বলে,
” তুমি বোধহয় চয়ন ভাইয়ার গান শুনেছো। চয়ন ভাইয়া মাঝে মাঝে গিটার বাজিয়ে গান গায়।”

সুরলা বলে,
“গিটার ছাড়া গানের আওয়াজ পেয়েছিলাম। ”
” আমার জানামতে আমাদের আশেপাশে কয়েক বিল্ডিংয়ে চয়ন ভাইয়া ছাড়া আর কেউ গান গায় না। তুমি চয়ন ভাইয়ারই গান শুনেছো। আজ হয়তো গিটার ছাড়া গান গেয়েছে। ”
“উনি কি সিংগার?”

” না। চয়ন চট্রগ্রামে ভাইয়া জব করে। ছুটিতে বাসায় আসে। এলে প্রতিদিন বিকেলে পেইন্টিং করে আর গান গায়। এগুলো চয়ন ভাইয়ার পছন্দনীয় কাজ। এখন সম্ভবত বাসায় এসেছে। অনেকদিন দেখিনি। ” পেইন্টিং করে শুনে সুরলা কিছুটা নিশ্চিত হয় বিকেলের দেখা ছেলেটা চয়ন। সে বলে,
” তুই চিনিস কিভাবে!”

নিলয় বলে,
” আমার বন্ধ রবিন হচ্ছে চয়ন ভাইয়ার খালাতো ভাই। রবিনের সুত্রেই চিনি। রবিনের সাথে কয়েকদিন চয়ন ভাইয়াদের বাসায় গিয়েছি। সেখানেই আলাপ হয়েছে।”

রেহানা জাহান রান্নাঘর থেকে তাড়া দেন।
‘নিলয়, যা ফ্রেশ হয় আয়। ধুলোবালি নিয়ে বসে আছিস কেন!”

“যাচ্ছি।” বলে ড্রয়িংরুম ছাড়ে নিলয়। সুরলা ভাবে ছেলেটার ব্যাপারে। সিদ্ধান্ত নেয় কাল বিকেলে গিয়ে দেখবে ছেলেটাকে। যেই ভাবা সেই কাজ পরদিন বিকেলে সুরলা হাজির হয় ছাদে। আজও ছেলেটার দেখা পায়। তবে আজ ছেলেটা তার দিকে পিঠ করে নয় বরং মুখ করে পেইন্টিং করছে। দূরে থাকায় চেহারাটা স্পষ্ট না। সুরলা ছাদের এক কোণে গিয়ে গাছে আড়ালে দাঁড়ায়। ছেলেটার চেহারা স্পষ্ট হয়। সুরলা এক পলক তাকাতেই চমকায়। আরে এ তো সেই ছেলেটা! যাকে হন্য হয়ে খুঁজছে সুরলা।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here