কাজল নদীর জলে’পর্ব-২

0
1391

কাজল নদীর জলে
আফিয়া আপ্পিতা

২.
প্রায় বছর খানেক আগের কথা, সেমিস্টার ফাইনাল দিয়ে ছুটি পেয়েছে ঢের। সুরলা সময় নষ্ট না করে পরদিনই রওনা দেয় খিলগাঁওয়ের উদ্দেশ্যে। গন্তব্য, খালামণির বাসা। মিরপুর নিজের বাসা থেকে বের হয়ে বাসে উঠে। খালি সিট পেয়ে বাসের ডান পাশের সারির দ্বিতীয় সিটের উইন্ডো সাইডে বসে পড়ে। পাশের সিটটা খালি। কেউ একজন এসে বসবে হয়তো। সেসবে মাথা ঘামায় না সুরলা। জানালার বাইরে মাথা বের করে দেয়। পাশ দিয়ে চলাচল করা গাড়ির ধোঁয়া আর ধুলোবালি এসে বাড়ি খায় নাকে মুখে। চেহারার বিরক্তি টেনে ব্যাগ থেকে কালো কাপড়ের মাস্ক বের করে পরে নেয় সে। সালমন কালার টপস আর কালো প্যান্টের সাথে পড়া কালো ওড়ানাটা টেনে দেয় মাথায়। তারপর আবারো মুখ গুজে জানালায়। বাইরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দেখতে থাকে লোক লোকারণ্যের বিচিত্রতা।

বাসটা তখনো থামানো বাস স্টপে। হঠাৎ সুরলার চোখ পড়ে বাস স্টপের দিকে দৌড়ে আসা এক মানবের দিকে। সাদা কালো ফর্মাল গেট আপে থাকা সাদা চামড়ার একটা ছেলে প্রাণপণে ছুটে আসছে বাসের দিকে। বয়স কত হবে? সাতাশ কী আটাশ? সম্ভবত অফিসে যাচ্ছে। আন্দাজ করে সুরলা।

ছুটাছুটি শেষে বাসের কাছে এসে থামে ছেলেটা। সুরলা পরখ করে। কালো মণির গভীর চোখে ক্লান্তির আভা, প্রশস্ত কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করছে, কান আর নাকের ডগা লাল হয়ে আছে। ছাপ দাঁড়িতে ঢাকা মৃদু পরু ঠোঁটগুলো চেপে হাপাচ্ছে। দৌড়ানোর কারণে মাথা ভর্তি রেসমি কালো চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। কয়েকটা আঁচড়ে পড়েছে কপালে। লম্বা চওড়া বেশ। এত লম্বা মানুষ হয়? উচ্চতা কত হবে? ছয় ফুট? নাহ, এর চেয়ে বেশিই হবে। ছয়-দুই হতে পারে। আন্দাজ করে সুরলা। নিজের হাইট মনে করে। চারফুট আট!নিজেকে লিলিপুট মনে হয়। এই ছেলের কান ধরতে হলে তাকে মই বেয়ে উঠতে হবে।

ছেলেটা বাসে উঠে। সুরলা চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকায়। ছেলেটা এদিক ওদিক তাকিয়ে সিট খুঁজে। একটা খালি সিট চোখে পড়ে। ডান সারির দুই নাম্বার সিট। হাফ ছেড়ে এসে বসে। সিটে গা এলিয়ে দেয়। ছেলেটার সাথে সাথে পাশের সিট ও নড়ে উঠে। সুরলা জানালা থেকে মুখ সরিয়ে তাকায় পাশে। দেখে, তার পাশে আর কেউ নয় সেই ছেলেটাই বসে আছে। ব্যাপারটা ভালো লাগে সুরলার। ছেলেটা চোখ বন্ধ করে আছে। হতে পারে সুরলাকে খেয়াল করে নি। কাছে থেকে ছেলেটাকে দেখতে আরো সুন্দর লাগে। সুরলা তাকিয়ে থাকে। খানিক পরেই মন তাকে ‘বেহায়া’ উপাধি দেয়। চোখ সরিয়ে নেয়। বাস চলতে থাকে। মিনিট খানেক পর এক মধ্যবয়সী মহিলা উঠে। বাসে জায়গা না থাকায় দাঁড়িয়ে থাকে। হুট করেই সুরলার পাশের সেই সুদর্শন যুবক উঠে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে থাকা মহিলার কাছে গিয়ে বলে,
“আন্টি, আপনি আমার সিটে গিয়ে বসুন।”

মহিলা ভদ্রতার খাতিরে বলে,
“না বাবা, তুমি বসো। ”
ছেলেটা হেসে বলে,
“সমস্যা নেই আন্টি, বসেন। আমি সামনেই নেমে যাবো।”

ছেলেটার জোরাজোরিতে মহিলা বসে পড়েন সুরলার পাশের সিটে। সামনে নেমে যাবে বললেও নেমে নি ছেলেটা। শাহবাগ অবধি ঘন্টাখানেকের পথ দাঁড়িয়েই যায়।

পুরো ব্যাপারটা পরখ করে সুরলা। ছেলেটার পর উপকারী ভাবনা ভালো লাগে তার। বাসে আরো অনেক ছেলে ছিল কেউ মহিলার কথা ভাবল না ছেলেটাই ভাবল। নিশ্চয়ই মহৎ ভাবনা তার! ছেলেটার জন্য মনে শ্রদ্ধা জাগে সুরলার। সেই মহৎ ভাবনার ছেলেটা আর কেউ নয় স্বয়ং পাশের ছাদের ছেলেটা। অনিশ্চিতভাবে যাকে চয়ন বলা যায়। সেদিন ছেলেটাকে প্রথম দেখার এর পর আরো দশ পনেরো দিন দেখেছিল। কখনো পথশিশুদের সাথে, কখনো আবার রক্তকণিকায়, কখনো বাসে, কখনো কাউকে রাস্তা পার হতে সাহায্য করছে। তবে সেদিনের মত নিকটে আর কখনোই পায় নি। মাস দুয়েকের ব্যবধানে হারিয়ে যায় ছেলেটা। আর দেখেনি ছেলেটাকে । কত খুঁজেছে! বাসা থেকে বের হলেই চারদিকে চোখ বুলায়, শাহবাগ গেলে এদিকে ঘুরে আনমনে। মিরপুর ও বাদ যায় না। কিন্তু ছেলেটাকে চোখে আর পড়ে না। পরশু খালামণির সাথে শপিংয়ে গিয়ে ও খুঁজেছিল। কিন্তু কে জানতো হন্য হয়ে খোঁজা ছেলেটা দূরে নয় তার নাকের ডগায় ঘাপটি মেরে বসে আছে!

ছেলেদের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া মেয়েরা চার শ্রেনীর হয়। প্রথম শ্রেনীর মেয়েরা বিত্তবান ছেলেদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। দ্বিতীয় শ্রেণীর মেয়েরা সুদর্শন যুবকদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তৃতীয় শ্রেণীর মেয়েরা মহান ভাবনা এবং মহান কাজ নিমগ্ন ছেলেদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। চতুর্থ শ্রেণীর মেয়েরা সাধারণ কারণ ছাড়াই কারো প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যায়। আকৃষ্ট হওয়ার জন্য রূপ গুন চায় না এরা।

এক্ষেত্রে সুরলা কোন এক শ্রেণীর নয়। বরং যৌথ শ্রেণীর। সে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শ্রেণীর মধ্যে পড়ে। অচেনা ছেলেটার মহৎ কাজ এবং রূপ দেখে আকৃষ্ট হয় তার প্রতি। পরিচয়ের শখ জাগে।

ছেলেটাকে চোখের সামনে দেখে সুরলা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। চোখ ঢলে আবার ও সামনে তাকায়। একই মানব একই দৃশ্য চোখে পড়ে। সুরলা পৃথিবীটা যেন থমকে যায়। অবশেষে খুঁজে পেল তাকে! খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করে সুরলার। ছাদে ড্রামে লাগানো মোটা আম গাছটার আড়ালে হয়ে দুই এক স্টেপ ডান্স ও করে নেয় সে। নিতু আসে ছাদে। চারপাশ চোখ বুলিয়ে সুরলাকে খুঁজে। গাছের আড়ালে চোখ পড়ে। এগিয়ে যায়। ভ্রু কুঁচকে বলে,
“সুরলা আপু নাচো কেন? কারণ কী!”

সুরলা নাচ থামায়। ভেংচি কেটে বলে,
“পিচ্ছি মেয়ে এত কারণ শুনে কী করবি?”

নিতু এসে সুরলার পাশে দাঁড়ায়। কাধে কাধ লাগিয়ে হাইট মাপে। বলে,
“আমি পিচ্ছি নাকি তুমি পিচ্ছি দেখো! তুমি আমার থেকে পাঁচ ইঞ্চি খাটো। দেখতে তোমাকে আমার ছোটো বোন মনে হয়। পিচ্ছি মেয়ে!” তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় নিতু।

সুরলা চোখ রাঙিয়ে বলে,
” একদম পিচ্ছি বলবি না! আমি ভার্সিটিতে পড়ি। বড়োদের কাতারে পড়ি । আর তুই কিসে পড়িস? সবে একাদশে! বয়স সবে সতেরোর ঘরে। আমি সতেরো পেরিয়েছি সেই কবে! কথাটা মাথায় রাখবি! আমি তোর বড়। সম্মান দিয়ে কথা বলবি।”

“আমার থেকে বড় হয়ে দেখাও। সম্মান দিব। এ টুকুনি মেয়ে আবার বলে সম্মান দিতে! হুহ! ” ভেংচি কাটে নিতু।
সুরলা ক্ষেপে যায়। হাইট নিয়ে কটু কথা শুনতে পারে না সে। তেড়ে আসে নিতুর দিকে। নিতু তার কোমর অবধি খোলা চুলগুলো খোঁপা করে নেয় ঝটপট। সে জানে এখন সুরলা তার চুল ধরে টানবে। হলো ও তাই। খোঁপা করে ও বেঁচে যেতে পারে না নিতু। খোঁপা ধরেই টান দেয় সুরলা। ব্যাথায় কুকড়ে উঠে নিতু। চুল ছাড়াতে চায়। সুরলা ছাড়ে না।

শক্ত করে চুল টেনে ধরে বলে,
“আমার এই হাইট কি আমি বানিয়েছি! আমার কি হাত ছিল? আমি কি স্রষ্টাকে বলেছি আমাকে খাটো করে বানাও? উত্তর দে!”

ব্যাথাতুর কন্ঠে নিতু বলে,
“না।”
“তাহলে আমাকে খোটা দিস কেন! কেন প্রতিদিন আমার কাধে কাধ মিলিয়ে হাইট মেপে আমাকে ইশারায় অপমান করিস! যেখানে আমার হাত নেই, সেখানে আমাকে অপমানিত হতে হবে কেন! আমাকে অপমানিত করার অধিকার কে দিয়েছে তোকে? ”

চুলের মুঠো ধরে ঝাকাতে ঝাকাতে বলে সুরলা। নিতু অনেক কষ্টে নিজের চুল ছাড়ে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। দু’পা বাড়াতেই খপ করে ধরে সুরলা। নিতু আকুতি করে বলে,

“আপু আর জীবনেও তোমাকে পিচ্ছি বলব না। সবাই তোমাকে পিচ্ছি বলে মিছিল করলেও আমি স্বীকৃতি করব না। কখনো কাধে কাধ ও মেলাব না। এবারের মত ছেড়ে দাও! ব্যাথা পাচ্ছি। ”

সুরলা তাও চুল ছাড়ে না। সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বলে,
“এই কথাটা সব সময় বলিস। কখনো মানিস না। আজ তোর চুল আমি ছিড়েই ফেলব। এরপর তোর টাক মাথা নিয়ে মজা করব। ”

নিতু কান ধরে বলে,
“সত্যি আর বলব না আপু। এবারই শেষ। ছেড়ে দাও না প্লিজ! ”

ছাদের পেয়ারা গাছে মুকুল এসেছে নাকি! কাল এই সংবাদ দিয়েছে সুরলা। ঘটনা যাচাই করতে ছাদে এলেন রেহানা জাহান। সিড়িঘর পেরিয়ে ছাদে পা দিতেই দেখেন মেয়ে দুটো ঝগড়া করছে। রীতিমতো মারামারি বেধে দিয়েছে। তিনি আশেপাশের ছাদ গুলোয় চোখ বুলালেন। তারপর দ্রুত বেগে মেয়ে দুটোর দিকে এগুলেন। কাছে গিয়ে বলেন,
” সরু, নিতু ঝগড়া করছিস কেন? কী হয়েছে?”

মাকে দেখে নিতু অসহায় গলায় বলে,
“মা বাঁচাও আমাকে! তোমার মেয়ে আমার সব চুল ছিড়ে ফেলল। খুব ব্যাথা পাচ্ছি।”

রেহানা জাহান সুরলার হাত থেকে নিতুর চুল ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলেন,
“সরু, নিতুর চুল ছাড়। ব্যাথা পাচ্ছে মেয়েটা! নিতুর উপর ক্ষেপেছিস কেন বল আমায়? আমি ওর বিচার করব। ”

“সত্যিই বিচার করবে?” প্রশ্নবোধক চাহনি সুরলার। রেহানা জাহান সায় জানিয়ে জানান,
“হ্যাঁ বিচার করব। আমার সরুকে কেউ পঁচা বললে তার বিচার করা বাধ্যতামূলক। দরকার হলে নিতুর বিরুদ্ধে পুলিশ কেস করব। তুই শুধু ওর চুল ছেড়ে দিয়ে বল ঘটনা কী?”

মামলা করার কথা শুনে নিতু ভীত চোখে তাকায় মায়ের দিকে। রেহানা জাহান সুরলার অলক্ষে ইশারা করেন। বুঝান এটা সুরলাকে ক্ষান্ত করার বাহানা মাত্র। খালামণির কথায় ভরসা পায় সুরলা। চুল ছেড়ে দেয়। ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,
“খালামণি তোমার মেয়ে আমাকে খাটো বলে খোটা দেয়। কাধ কাধ মিলিয়ে হাইট মাপার বাহানায় আমাকে নিচু দেখায়। খাটো হওয়ায় আমার কী দোষ বলো? ও সবসময় আমার সাথে এমন করে কেন! তুমি ওর বিচার কর!”

রেহানা জাহান সুরলার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“বিচারটা বাসায় গিয়ে করি? দেখ, পাশের ছাদের ছেলেটা কীভাবে তাকিয়ে আছে!”

রেহানা জাহানের কথায় সুরলা, নিতু দুজনেই তাকায় পাশের ছাদে তাকায়। দেখে পেইন্টিংয়ে ব্যস্ত থাকা ছেলেটা পেইন্টিং রেখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। চোখে এক রাশ বিস্ময়। সুরলার কান্না পায়। এতদিন পর ছেলেটাকে খুঁজে পেল। তার সামনে কিনা এমন কান্ড বাধাল! ছেলেটা কী ভাববে! ঝগড়াটে মেয়ের তালিকায় নিজের নাম লেখাল নিজ হাতে! তাও কিনা পছন্দনীয় ছেলের সামনে! নিজের বোকামিতে লজ্জা পায় সুরলা। বড়ো পা ফেলে সিড়ির দিকে এগায়। পেছন আসে বাকিরাও।

নিতু কপট রেগে বলে,
“চয়ন ভাইয়ার সামনে প্রেজটিজটাকে ধূলোয় মিশিয়ে দিলে! কত ভালো জানে আমায়! এখন ভাববে আমি ঝগড়াটে। মারামারি, চুল টানাটানি করি। চিবাকে ও আমার সাথে মিশতে দিবে না। ধ্যাৎ ভালো লাগে না!”

বলে হনহন করে এগিয়ে গেল। সুরলা না বুঝার ভান করে বলে,
” খালামণি চয়ন আর চিবা কে? নিতু কার কথা বলছে!”

রেহানা জাহান সুরলার পেছনের সিড়িতে ছিলেন। তিনি উত্তর দেন,
“পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদে যেই ছেলেটা দাঁড়িয়ে ছিল ওর নাম চয়ন। ওই বিল্ডিংয়ের বাড়িওয়ালার ছেলে। আর চিবা হলো চয়নের বোন। যে কিনা নিতুর বান্ধবী। চয়নের খালাতো ভাই রবিন আবার নিলয়ের বন্ধু। সেই সুত্রেই নিতু, নিলয়কে চিনে চয়ন। ছোট ভাই বোনের মত দেখে ওদের। ভারী চমৎকার ছেলে!”

এবার চয়নের ব্যাপারে নিশ্চিত হয় সুরলা। ‘চয়ন’ শব্দটা একবার বিড়বিড় করে। ঠোঁটের কোণে খেলে যায় মৃদু হাসি। চিবার কথা মাথা থেকে সরে গিয়েছে সুরলার। চিবাকে সে চিনে। নিতুর জন্মদিন অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছে। টুকটাক কথা ও হয়েছে। তবে চিবার যে ভাই আছে, আর সে যে চয়নই সেটা জানত না সুরলা। জানলে তো এত খুঁজতে হতো না।

মনে পড়ে ঝগড়ার কথা। স্বপ্নপুরুষের সামনে এমন বাজে ঘটনা ঘটিয়েছে ভাবতেই লজ্জায় কুঁকড়ে যায়। মুখটা মলিন হয়। রেহানা জাহান ভাবেন নিতুর কথায় কষ্ট পেয়ে মন খারাপ করেছে সুরলা। তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
” তুই এখন বড় হচ্ছিস। যে কোন কাজ করার আগে ভেবেচিন্তে করবি। যখন তখন যার তার সাথে ঝগড়া, মারামারি লেগে গেলে ভালো দেখায়? মানায় এসব? কাল এক ভাড়াটে বলছিল, বাড়িওয়ালার মেয়েরা কেমন ঝগড়া করে! একটু ও ম্যানারস জানে না! আমার এসব শুনতে ভালো লাগে বল? ঝগড়াঝাটি ভালো না মা। ছেড়ে দে এসব। ”

সুরলার কানে এত কথা যায় না। সে তো আছে তার স্বপ্নপুরুষ তাকে নিয়ে কী ভাবছে এটা নিয়ে। রেহানা জাহান আরো অনেক কথা বলেন। সুরলা নিরব শ্রোতার মত ভান করে থাকে। বাসায় গিয়ে সোজা কর্ণারের রুমটায় চলে যায়। খাট, কাভার্ড, ড্রেসিংটেবিল, পড়ার টেবিলের সমন্বয়ে গোছানো একটা রুম। এই রুমটা নিতিকার। এখানে সুরলা থাকে নিতিকার সাথে। নিতুর সাথে ভাব না থাকলেও নিতিকার সাথে ভীষণ ভাব সুরলার। নিতিকা একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকুরি করে। সকালে যায় সন্ধায় ফিরে। আজ এখনো আসে নি। সুরলা ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আয়নায় নিজেকে দেখে। চুলগুলো এলোমেলো, পরনে সফেদা রঙের কুচকানো টি-শার্ট আর বেগুনি রঙের প্লাজো। বেগুনি ওড়নাটা দলা হয়ে গলায় আটকে আছে। নিতুর সাথে ধস্তাধস্তিতে সব এলোমেলো হয়েছে। কেমন বাজে দেখাচ্ছে! একটু ও ভালো দেখাচ্ছে না। এই বাজে অবস্থায় দেখেছিল চয়ন! ভাবতেই মুখ কুঁচকায়। তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে চুল আঁচড়ায়, জামা ওড়না ঠিক করে। ডেসিংটেবিলের ড্রয়ার থেকে লিপস্টিকের বক্স বের করে। সব বেছে হুদা বিউটির হালকা গোলাপি গ্লস লিপস্টিক তুলে নেয়। ঠোঁট লাগিয়ে নিজেকে আয়নায় দেখে। ফাউট করে দেখে, মুখ বাঁকা করে দেখে। খারাপ লাগছে না। চয়নের পছন্দ হবে তাকে? নাকি দেখেই রিজেক্ট করবে? ভাবতে বসে যায় সুরলা।

অফিস থেকে ফিরে নিতিকা। রুমে এসে সুরলাকে সেজেগুজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়। সুরলা সাজে না খুব একটা। আয়নাও দেখে না। আজ কী হলো! হাতের ব্যাগ বিছানায় রেখে বোনের কাছে যায়। সুরলার পেছনে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে,
” আমার বোনটার কী হলো আজ! এত সাজগোজ করছে!”

সুরলা বাস্তবে ফিরে। আয়নায় নিতিকাকে দেখে লজ্জা পায় সে। লাজুক হেসে বলে,
“কিছু হয় নি। এমনিই মন চাইল।”

নিতিকা সুরলাকে ঘুরিয়ে গাল টেনে বলে,
“প্রেমে পড়েছিস?”

সুরলা চমকায়। সে প্রেমে পড়েছে? সত্যিই প্রেমে পড়েছে! তার জীবনে প্রেম এসেছে! চয়নের ছবিটা চোখে ভাসে। সে নিশ্চিত হয়, প্রেমের ভেলা নিয়ে চয়ন এসেছে তার জীবনে। হ্যাঁ, সে প্রেমে পড়েছে। এক রাশ লজ্জা এসে ভর করে তাকে। দু’গাল লাল হয়। মাথা নিচু করে। নিতিকা পরখ করে সুরলাকে। বিস্মিত কন্ঠে বলে,
“তুই ব্লাশ করছিস সরু! আমার ছোট্ট বোনটা প্রেমে পড়েছে! কে রে সে?”

বোনের কাছে ধরা দিতে চায় না সুরলা। দৌড়ে পালায়। ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসে পড়ে।

পরদিন রেহানা জাহানের সাথে হাটতে বের হয় সুরলা। ঘড়ির কাটায় তখন সকাল সাড়ে ছয়টা। কমলা রঙের হুড়ি-ট্রাইজার পরে খালার পিছন পিছন এগিয়ে যায় । কালো জগিং ড্রেস পরে পানির বোতল হাতে গেট পেরিয়ে রাস্তায় আসে চয়ন। সুরলারা তখন চয়নদের বাড়ির গেটের সামনে দিয়ে হাটছে। রেহানা জাহানকে দেখে সালাম দেয় চয়ন। সালামের উত্তর নিয়ে কুশল বিনিময় করে সামনে এগিয়ে যান রেহানা জাহান। পেছনে থেকে যায় সুরলা। চয়নের দৃষ্টিগোচর হয়। চোখাচোখি হয় দুজনের। চয়নের হাত আপনাআপনি চলে যায় মাথায়। চুল হাতে দিয়ে থাকে। যেন কেউ তার চুল ছিঁড়ে নিবে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here