কাজল নদীর জলে’পর্ব-৫

0
1165

কাজল নদীর জলে
আফিয়া আপ্পিতা

৫.
পরদিন ভোরে বেশ আক্রোশ নিয়ে খালার সাথে জগিং এ বের হয় সুরলা। আজ চয়নকে একটা শিক্ষা দিবেই সে। কাল সন্ধ্যা থেকে এখন অব্দি কত পরিকল্পনা এঁটেছে তার ইয়াত্তে নেই। রাতে ঘুম ও হয় নি ভালো মতে। ভোর ছ’টা বাজতেই হালকা গোলাপি রঙের জগিং সুট পরে তৈরি হয়ে নেয়। কাধ অব্দি বব কাট সিল্কি চুলকে রূপ দেয় পনিটেইলে। কপাল জুড়ে স্থান পায় সামনের ছোট ছোট চুল। সাড়ে ছ’টা বাজতেই কালবিলম্ব না করে খালার সাথে বেরিয়ে যায়। গতদিনের মতই চয়নের দেখা পায় তাদের গেটে। রীতিমতো রেহানা জাহানকে দেখে চয়নের ভদ্রতা উপছে পড়ে। বিনম্রভাবে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করে।
রেহানা জাহান চয়নের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এই ছেলেটাকে ভীষণ পছন্দ তার। কী চমৎকার ব্যবহার ! তার খুব ইচ্ছে ছিল চয়নকে তার বড় মেয়ের জামাই বানাবেন। কিন্তু মেয়েটা আগেই মুকিফ নামে এক ছেলের সাথে সম্পর্ক এঁটে বসে আছে। বিয়ে করলে মুকিফকেই করবে, নয়তো করবে না। মেয়ের সুখের দিকে তাকিয়ে আর্কিটেক্ট ছেলেকে মেয়ে নেন তিনি। আংটিবদল করে বিয়েটাকে পাঁকা করেন। মুকিফ একটা কোর্সের কারণে কানাডা আছে। ফিরবে বছর খানেক পর। মুকিফ ফিরলেই বিয়ে হবে। এইসবের মাঝে চয়নকে জামাই বানানোর আশা ব্যাক্ত করা হয় না তার। নিতুটা ছোট না হলে চয়নের সাথে নিতুন বিয়ে দিতেন। এমন হীরে কেউ হাতের কাছে পেয়ে ঠেলে দেয়! আক্ষেপ রয়ে যায়।
সেই আক্ষেপ থেকেই এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। চয়নের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাটায় মন দেন। তার হাটার গতি দ্রুত। সুরলা হাটে ধীরে ধীরে। রেহানা জাহান আগে চলে যান। সুরলা পেছনে আসে কচ্ছপের গতিতে।

যাবার আগে পাশে দাঁড়ানো চয়নের দিকে একবার কটমট দৃষ্টিতে তাকায় । চয়ন বুঝতে পারে সুরলা কালকের ব্যাপারটা নিয়ে রেগে আছে। সে হাসে। পা বাড়ায় সুরলাকে ক্ষেপানোর মনোভাব নিয়ে।

“পিচ্ছি, রেগে আছো কেন? রাতে ভাত দেয় নি?” সুরলার পাশাপাশি এসে বলে চয়ন। সুরলা ছোটো ছোটো চোখ করে বলে,
“রাতে ভাত দেয় নি, বকা দিয়েছে। খাবেন?”

“টেস্ট কেমন? ”
“ইয়াম্মি। খাবেন? দিবো? সাথে চুল ছেঁড়া ফ্রি।” দাঁত কিড়মিড় করে বলে সুরলা। চুল ছেঁড়ার কথায় চয়ন মাথায় হাত দিয়ে এক কদম পিছু সরে যায় । তাতে সুরলার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুঁটে। সে বলে,
” চুল ছেড়ার কথায় ভয় পেয়েছেন?”

চয়ন দু’কদম এগিয়ে সুরলার সামনে এসে দাঁড়ায়। চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
” ‘ভয়’ শব্দটা চয়নের সংবিধানে নেই। তাছাড়া আমি ভালো করেই জানি, তোমার মত পুচকি মেয়ে আমার চুল অবধি পৌঁছাতে পারবে না। তারজন্য কম হলে ও এক যুগ সময় লাগবে।”

সুরলা ভেংচি কেটে বলে, “আপনার চুল অবধি পৌঁছাতে আমার একযুগ নয়, এক মিনিট লাগবে। বড় বলে সম্মান দিয়ে চুল টানার চেষ্টা করছি না, অন্যথায় কাল সন্ধ্যার পর আপনার চুল আপনার মাথায় থাকত না।”

চয়ন হো হো করে হেসে দেয়। যেন সে কোন মজার কথা শুনেছে। হাসতে হাসতে বলে,
” তুমি পৌঁছাবে আমার চুল অবধি! তাও এক মিনিটে! ”
বলে হাসতে থাকে। সুরলা ভ্রু কুঁচকে বলে,
“আপনার কি মনে হয় আমি পারব না?”
“না।” হাসতে হাসতেই উত্তর দেয় চয়ন। হাসি থামিয়ে বলে,
“এটুকুনি পুচকি মেয়ে, আমার চুল টানবে! অসম্ভব। পারবে না তুমি। লাফ দিয়ে ও আমার চুল অবধি পৌঁছাতে পারবে না।”

“পারি কি না পারি তা সময় বলবে। এখন যাই, দেরি হচ্ছে আমার।”

বলে দ্রুত সামনে আগায় সুরলা। চয়ন পেছনে পড়ে যায়। পেছু ডাকে,
“পালিয়ে যাচ্ছ পিচ্ছি?”
সুরলা থামে। পেছু ফিরে তেড়ে যায় চয়নের দিকে। রাগত কন্ঠে বলে,
” আমার নাম সুরলা। যদি ডাকতে হয় তবে নাম ধরে ডাকবেন। অন্যথায় ডাকবেন না। ”

‘সুরলা’ নামটা একবার বিড়বিড় করে চয়ন। তারপর হেসে বলে,
“সুরলা নামটা কেমন যেন বড়দের নাম। তোমার মত পিচ্ছির সাথে যাচ্ছে না। তোমার সাথে যাবে, পিচ্ছি,পুচকি, কিট্টি, মিনি, খুকি, বাবুনী, এসব নাম। আমি আবার পিচ্ছিদের সম্মান করি। যেই সেই নামে ডাকি না। আমার ছোটোবোন চিবাকে খুকি ডাকি। তুমি তো ওর থেকে ও ছোটো। তোমাকে তো আরো বেশি সম্মান দিতে হবে।”

সুরলা নাক ফুলিয়ে বলে,
“আমি ছোটো না, আমি ভার্সিটিতে পড়ি। ”

সুরলার কথায় চয়ন উচ্চস্বরে হেসে দেয়। হাসতে হাসতে বলে,
” নাইস জোক। নেক্সট প্লিজ!”
“সত্যি বলছি আমি। বিশ্বাস না হলে নিতু, নিলয়কে জিজ্ঞেস করে নিতে পারেন।” আবারো নাক ফুলিয়ে বলে সুরলা। চয়ন বিশ্বাস করে না তার কথা। সে ভাবে, সুরলা নিচকই মজা করছে। এই পিচ্ছি মেয়েটা কিভাবে ভার্সিটিতে পড়তে পারে। সম্ভব নাকি। তার মনে হচ্ছে, মেয়েটা এখনো স্কুলের গন্ডিও পেরোয় নি। সে হেসে বলে,
” বড়দের সাথে এত বড়ো মিথ্যা কথা বলে না পিচ্ছি। স্কুলে পড়ে নিজেকে ভার্সিটি ছাত্রী বলা বেমানান। কেউ বিশ্বাস করবে না। আমি ও তোমার কথা বিশ্বাস করছি না। ”

“থাকুন আপনি, আপনার বিশ্বাস নিয়ে। চললাম আমি।” বলে ভেংচি কেটে দৌড়ে দৃষ্টির আড়াল হয়ে যায় সুরলা। চয়ন মাথা চুলকায়। বিড়বিড় করে বলে, ‘কী হল এটা! সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে চয়ন ও সামনে আগায়। উভয়ে জগিং করতে যায় জোড়পুকুর মাঠ বা ময়দানে। সুরলা ময়দানের এক কোণে তার খালাকে দেখে সেদিকে যায়। চয়ন অন্যদিকে চলে যায়। সুরলাকে দেখে রেহানা জাহান হাফ ছাড়েন। ভ্রু কুঁচকে বলেন,
“তোর আসতে এত সময় লাগল কেন! আমি তো সেই কখন চলে এসেছি। ”

সুরলা মাথা চুলকায়। খালামণিকে যদি বলে এতক্ষণ সে চয়নের সাথে ঝগড়া করতে ব্যস্ত ছিল, তখন খালামণি কী বকবেন? যদি উল্টোপাল্টা ভাবেন! তখন প্রেম শুরুর আগেই শেষ হবে। তাই ব্যাপারটা চেপে যায়। বলে,
“আমি তোমার মত এত দ্রুত দৌঁড়াতে পারি না। আমি ধীরে ধীরে দৌঁড়াই। এ ক্ষেত্রে তোমার গতি খরগোশের মত, আর আমার গতি কচ্ছপের মত। ”

সুরলার কথায় রেহানা জাহান হেসে ফেলেন। বলেন,
“শুধু পাঁকা পাঁকা কথা বলিস। শুন, জগিং করতে হবে নিয়মমাফিক । কচ্ছপের গতিতে জগিং করলে তো চলবে না। এতক্ষণ অনেক ফাঁকিবাজ করেছিস। এবার গতি বাড়া। সঠিন নিয়মে জগিং কর।”

“ধীর গতিতে হেটেও কচ্ছপ ফিটনেস দেখেছ! আমি ও কচ্ছপের মত হেটে ফিট থাকব। তাছাড়া, আমার হাইটের সাথে ওয়েট একদম পারফেক্ট। আর বাড়াতে কমাতে হবে না। তোমার ওয়েট লুজ করতে হবে। তুমি নিয়ম মানো। আমি এত নিয়মে নেই।” বলে ভেংচি কাটে সুরলা।

রেহানা জাহানের কপট রাগ হয়। ভেংচি কাটা এবং জগিং নিয়ে মজা করা তার পছন্দ নয়। তিনি গম্ভীর কন্ঠে বলেন,
“গ্রামীণ মেয়েদের মত কথায় কথায় ভেংচি কাটিস কেন? নিষেধ করেছি না ভেংচি কাটতে! ”

সুরলা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। রেহানা জাহান আবার ও ধমকে উঠেন,
“আর, তোকে কত বার বলব? জগিং শুধু ওয়েট লসের জন্য নয়, সুস্থ থাকার জন্য ও জুরুরি। জগিং করলে পায়ের পেশী মজবুত ও শক্তিশালী করে, হাড় মজবুত রাখে, কার্ডিওভাসকুলার ফিটনেস বাড়ায়, সুনির্দিষ্ট ওজন নিয়ন্তণে রাখে, এনার্জি বাড়িয়ে তোলে, ফিট থাকতে সাহায্য করে
ভালো ঘুম, হজমে সাহায্য, ও মস্তিষ্কের বিকাশে সাহায্য করে। এই কথাগুলো প্রতিদিন বলি, তাও মূর্খের মত কথা বলিস! নিজের মেয়েদের তো জগিংএ অভ্যস্ত করাতে পারলাম না। ভেবেছিলাম, তোকে করব। এখন দেখি সেটাও ব্যর্থ হবে। ”

সুরলা আড়চোখে তাকায় খালামণির দিকে। খালামণি রেগে আছেন ভীষণ। এই রাগকে ভীষণ ভয় পায় সুরলা। তাই খালামণির অপছন্দের কাজ তার সামনে করে না। আজ একে একে দুইটা ভুল একসাথে করে ফেলেছে। এখন তার সামনে থাকা মানে নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনা। তারচেয়ে ভালোয় ভালোয় কেটে পড়া মঙ্গল। সুরলা কান ধরে বলে,
“সরি আর হবে না। এই দেখ, আমি ঠিক নিয়মে জগিং করছি।”

বলে কান ধরে রেহানা জাহানের দিকে তাকিয়ে উলটো দৌড় দেয়। রেহানা জাহান অন্যদিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দেন। এই মেয়েটার উপর তার রাগ ঠিকে না । এতক্ষণ বহু কষ্টে গম্ভীরতার ভান করেছিলেন। মেয়েটা দিন দিন বখে যাচ্ছে। একটু আধটু শাসন না করলেই নয়। বোনটা যে শাসনের দায়িত্ব তাকে দিয়েছে!

কিছুদূর গিয়ে থামে সুরলা। আশপাশ চোখ বুলায়। নাহ, খালামণিকে দেখা যাচ্ছে না। ময়দানের এক কোণে বসার জায়গায় গিয়ে বসে পড়ে। গালে হাত দিয়ে মানুষের হাটাচলার দৃশ্য দেখতে থাকে। চয়নকে চোখে পড়ে। মাঠের মাঝে দৌড়াচ্ছে চয়ন। চয়নের সাথে তার মাথাভর্তি চুলগুলো ও দৌড়াচ্ছে যেন। সুরলার মনে পড়ে প্রথম দিনের কথা। সেদিন ও তো এমনই দৌঁড়াচ্ছিল, তবে ভিন্ন উদ্দেশ্যে।

চয়নের পরনে নীল টি-শার্ট, সাথে কালো ট্রাউজার। পায়ে কালো জগিং সু। দরদর করে ঘামছে। কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। গায়ের টি-শার্ট ঘামে ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। পেশিবহুল শরীরটা বুঝা যাচ্ছে। সুরলা মুগ্ধচোখে তাকিয়ে থাকে। এই মানুষটাকে সে ভালোবাসে। এই মানুষটাকে নিজের করে পাবার ইচ্ছে ভীষণ। সে-ই ইচ্ছে আদৌ পূরণ হবে কিনা জানে না।। তবে সে চেষ্টা করবে। ঝগড়ার পর্ব চুকিয়ে দু’জনের মাঝে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে নিবে, তারপর সুযোগ বুঝে ভালোবাসার কথাটাও জানিয়ে দিবে। এমনই ভাবনা সুরলার।

জগিং করতে করতে পানি তৃষ্ণা পায় চয়নের। মাঠের মাঝে বসে পড়ে। ঘাসের উপর রাখা বোতলের ক্যাপ খুলে ঢকঢক করে অর্ধেক পানি পান করে। চয়নের পানি খাওয়ার দৃশ্য চোখ এড়ায় না সুরলার। মুহুর্তেই তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়।

পানি খেয়ে উঠে দাঁড়ায় চয়ন। একবার চোখ বুলায় চারদিকটায় । চোখ যায় সুরলার দিকে। সুরলা হাত উঠিয়ে ডাকে তাকে। সুরলার আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পায় না। একা একা পিচ্ছি ওখানে কী করছে! কোন বিপদ হল নাকি এই ভেবে সুরলার কাছে যায় চয়ন। গিয়ে বলে,
“পিচ্ছি একা একা এদিকে কী করো!”

সুরলা যেন এরই অপেক্ষায় ছিল। সে অসহায় চেহারায় বলে,
“আসলে জগিং করতে করতে হাফিয়ে গিয়েছে। তাই এখানে এসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছি।”

চয়নের মায়া হয়। আজকাল বড়োদের বলে বলে ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করা যায় না। ব্যায়াম করতে বললে বাহানা খুঁজে। সকালের এই আরামদায়ক ঘুম ছেড়ে ব্যায়াম করাটা অর্থহীন মনে হয় তাদের কাছে।
সেখানে এই ছোটো মেয়েটা নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে কতটা সচেতন! ঘুম ছেড়ে কাকডাকা ভোরে উঠে জগিংয়ের জন্য বের হয়! ব্যাপারটা মুগ্ন করে চয়নকে।

“পানি খাবে?” চয়নের মনে হচ্ছে সুরলার পানির পিপাসা পেয়েছে। তার ধারণাকে সঠিক প্রমাণ করে সুরলা।
“পানির পিপাসা পেয়েছে। বোতল আনতে ভুলে গিয়েছি। আপনার কাছে পানি আছে?”
“আছে। তুমি বসো, আমি পানি নিয়ে আসি।” বলে মাঠের মাঝে চলে যায়। ফেরত আসে পানির বোতল হাতে। বোতলের ক্যাপ খুলে সুরলার দিকে বাড়িয়ে দেয়। বলে,
“নাও, পানি।”

বোতল হাতে নেয় সুরলা। মুখে দেয় না। চয়নের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বসুন। আপনি সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে আমি পানি খেতে পারব না।”

চয়ন বিনাবাক্যে বসে পড়ে সুরলার পাশে। সুরলা বোতলে মুখ না লাগিয়ে একটুখানি পানি খায়। তারপর বোতল ফেরত দেয়। চয়ন বোতল হাতে নিয়ে ক্যাপ লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই ফাঁকে সুরলা উঠে চয়নের সামনে এসে দাঁড়ায়। কিছু বুঝে উঠার আগেই চয়নের মাথার চুল দু’হাতে সর্বশক্তি দিয়ে টেনে দৌড় দেয়। কিছুদূর গিয়ে পেছন ফিরে বলে,
” একমিনিট পুরো লাগে নি।”

চয়ন মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। ঘটনা এখনো বুঝে উঠতে পারে নি সে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here