কাজল নদীর জলে পর্ব-১৫

0
918

কাজল নদীর জলে
আফিয়া আপ্পিতা

১৫.
রুমে গিয়ে ফোন হাতে নেয় চয়ন। কাল রাতে বাসায় ফিরে যে ফোন সাইলেন্ট করে বালিশের নিচে রেখেছে আর ধরা হয়নি। স্ক্রিন অন করতেই কল ম্যাসেজ নোটিফিকেশনের বন্যা বয়ে যায়। একে একে ডায়াল লিস্ট আর ম্যাসেজ বক্স চেক করে। ম্যাসেজে সুরলার রাগটা চোখ এড়ায় না। সুরলার রাগের কারণ খুঁজে! কাল তার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে পুরোটা সময়ের উপর চোখ বুলায়। কোন কারণ খুঁজে পায় না। অগত্যা কল দেয়। ঘড়ির কাটায় তখন সকাল সাড়ে নয়টা। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে সুরলা। ফোনের ভাইব্রেশনে ঘুম ছুটে যায়। ফোন হাতে নিয়ে আধো চোখে তাকায় ফোন পানে। চয়ন নামটা স্ক্রিনে ভাসতে দেখেই লাফিয়ে উঠে বসে। তড়িঘড়ি করে রিসিভ করে ফোন কানে দেয়। বলে,

” কাল রাতে কতগুলো কল ম্যাসেজ দিয়েছি আপনার কোন রেসপন্স নেই। আমি তো ভেবেছি আজ কবুতরের মাধ্যমে বার্তা পাঠাবো আপনার কাছে।” না চাইতেও অভিমান ঝরে পড়ে সুরলার স্বরে। ”

চয়ন গম্ভীরগলায় বলে,
“ফোন সাইলেন্ট করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তাই চোখে পড়েনি। ম্যাসেজে এত রাগ ঝাড়ার কারণ কী?”
“সুযোগ ফেলে আপনার সবগুলো চুল ছিঁড়তাম। সুযোগ পাইনি তাই ম্যাসেজেই রাগ ঝেড়েছি।”
“কারণ কী জানতে পারি?”
“কাল আপনি আমাকে চিনতে পারেন নি কেন!”
“তোমাকে আজ অন্যরকম লেগেছে, তাই চিনতে পারি নি।”
“অন্যরকম বলতে কেমন? বাজে লেগেছে?”
“না, ভালোই লেগেছে। তবে তোমাকে এত ভারী সাজে এর আগে দেখিনি তো তাই চিনতে অসুবিধা হয়েছে।”
“সবাই না চিনলে এতটা কষ্ট লাগে না, যতটা আপনি আমাকে চিনতে অস্বীকার করলে লাগে। ”
“এতটা কষ্ট লাগার কারণ?” গম্ভীর কণ্ঠে বলে চয়ন। সুরলা লাজুক হেসে বলে,
“আপনি আমার কাছে ভীষণ স্পেশাল তাই।”

চয়ন ভ্রুকুটি করে। কপাল চুলকে কিছু একটা ভাবে। তারপর ভারী গলায় বলে,
“কাল তুমি আবোলতাবোল বকছিলে কেন!”
“কখন!” না জানার ভান করে সুরলা। চয়ন ও ঘাপটি মেরে বসে নিজের কথায়।
“ডিনারের আগে। কীসব আবোলতাবল বকছিলে, বিয়ে, ট্রান্সপার আরো কিসব!”

“এসব আপনার কাছে আবোলতাবোল মনে হয়?” অবাক হয়ে বলে সুরলা। চয়ন নির্দ্বিধায় বলে,
“তাছাড়া আর কী! তোমার সাথে আমার ট্রান্সপার, ঢাকা আসা, বিয়ের কী সম্পর্ক থাকতে পারে?”

“এই পুরো আপনিটার সাথেই আমি মনে মনে সম্পর্কবিদ্ধ হয়েছি, সেখানে আপনার সাথে সম্পৃক্ত সব বিষয়ের সাথে সম্পর্ক তো আপনা আপনিই হয়ে গেছে। ” স্বাভাবিক কন্ঠ সুরলা। চয়ন ভ্রু কুঁচকায়। প্রশ্নবিদ্ধ গলায় বলে,
” মানে?”
“কিছু না, সবসময় আপনাকে বুঝানোর দায় নিতে পারব না আমি।” ভেংচি কাটে সুরলা। উনি ছোট শিশু, সব বুঝাতে হবে। সব কথা বুঝিয়ে বলা লাগে? কিছু কথা আকার ইঙ্গিতেই বুঝে নেয়া যায়।

“এত ঘুরিয়ে পেচিয়ে না বলে যা বলার স্পষ্ট বলো। ” গম্ভীর গলায় বলে চয়ন। এতক্ষণে সুরলার খেয়াল হয়। প্রতিদিনের মত আজ চয়নের কন্ঠে চাঞ্চল্য নেই, তার বদলে গম্ভীর্যের আভাস। ব্যাপারটা ভালো ঠেকে না সুরলার। সে প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,
” আপনার কন্ঠটা অন্যরকম লাগছে, আপনি ঠিক আছেন?”
“কথা ঘুরাবে না, আগের কথা ক্লিয়ার করো।” কন্ঠটা ভারী হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। সুরলা ঢোক গিলে। চয়নের গম্ভীরতা তাকে ভীত করছে। সে চুপ থাকে। চয়ন আবার তাড়া দেয়। সুরলার নিরবতা কাটে না। সুরলার আচরণে চয়নের সন্দেহ হয়। সুরলার সাথে পরিচয়ের পর থেকে জার্নিটা সে আরো একবার ভাবে। ইতিপূর্বে না লাগলে ও কাল সন্ধ্যায় বিয়ের কথা এবং একটু আগে বলা কথাটা মনে আওড়ানোর পর তার ভাবনায় একটাই কথা আসে, তা হলো সুরলা তাকে ভাইয়ের চোখে নয় ভিন্ন চোখে দেখে। তার জন্য সুরলার মনে অনুভূতি জমা আছে। এই অনুভূতি একবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত চয়নের জন্য। সে তো সরল মনেই সুরলার সাথে আলাপ করেছিল। সে যদি জানতো সুরলার মনে তার জন্য কোন অনুভূতির জন্ম হবে এতে তবে সে কখনোই আলাপ করতো না সুরলার সাথে। প্রেম শব্দটাকে এড়িয়ে চলে সে। এর পেছনে করুণ কাহিনি আছে। চয়ন চায়না তার জীবনে সেই করুণ কাহিনি আবার রিপিট করুক। তাই প্রেম ভালোবাসা এবং নারী থেকে দূরেই থাকে। এই মুহুর্তে চয়নের নিজের উপর রাগ হয়, কেন সে সুরলাকে পিচ্ছি ভাবতে গেল। তার গম্ভীরতা রাগে পরিণত হয়। খট করে ফোন কেটে দেয়। রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে একটা ম্যাসেজ লিখে পাঠিয়ে দেয় সুরলার নাম্বারে।

কান থেকে ফোন সরিয়ে ভাবুক হয়ে বসে থাকে সুরলা। চয়নের অদ্ভুত আচরণের মানে খুঁজে। পায় না। তখনি ফোনে ম্যাসেজ আসে। চয়নের না দেখে তড়িঘড়ি করে ওপেন করে।
” আমার মনে হয়, এখন আমাদের পরিচয় এবং আলাপচারিতার সমাপ্তি লগ্ন এসে গেছে। আই উইশ, আমাদের আর দেখা না হোক। আমার সাথে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন করলে খুশি হব।”

এক দমে ম্যাসেজটা পড়ে শেষ করে সুরলা। চয়ন এমন ম্যাসেজ দিল কেন! এর মানে কী, চয়ন তার অনুভূতি আভাস পেয়ে গেছে এবং এই অনুভূতিকে সায় দিতে চায় না বলেই এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছে! ভয়ানক কিছুর আভাস পায় সুরলা। মনে মনে দোয়া পড়ে এমন কিছু না হোক। সে সইতে পারবে না। নিজের ভাবনার সত্যতা যাচাই করতে কল দিয়ে বসে। এক নারী সুরলা কন্ঠে বলে, আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটি এই মুহুর্তে বন্ধ আছে….। একবার দু’বার তিনবার এভাবে প্রায় ত্রিশবার কল দেয়। প্রতিবারই নারী সিম অপারেটরের একি কথা ভেসে আসে কানে। এবার কান্না পায় সুরলার।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here