কাজল নদীর জলে পর্ব-১৬

0
1019

কাজল নদীর জলে
আফিয়া আপ্পিতা

১৬.
সারাদিনে কল দিয়ে চয়নকে না পেয়ে বিকেলে ছাদে যায় সুরলা। উদ্দেশ্য, চয়নের সান্নিধ্য পাওয়া। চয়ন আসার আগেই পা টিপে টিপে ছাদে গিয়ে এককোণে লুকিয়ে পড়ে সে। নজর দেয় পাশের ছাদে। চয়ন আসে ঠিক ত্রিশ মিনিট পর। কফি মগ হাতে তার। রেলিঙের ঘেঁষে দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রয় আকাশ পানে। পরনে কালো ট্রাউজার আর হলুদ টি-শার্ট। মাথার সিল্কি চুল পড়ন্ত বিকেলের মৃদু বাতাসে দুলছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেই খানিক পর পর হাতে থাকা মগটায় চুমুক দিচ্ছে। সুরলা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে তার ভালোবাসার মানুষটির দিকে। লুকিয়ে লুকিয়ে কয়েকটা ছবিও তুলে নেয়। নিঃশব্দে এগিয়ে যায় রেলিঙের দিকে। চয়নের কাছাকাছি গিয়ে মৃদু স্বরে ডাকে,
“চয়ন?”

কারো মুখে নিজের নাম শুনে আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকায়। সুরলাকে চোখে পড়ে। সকালের কথা পড়ে। রাগত চাহনি দিয়ে চোখ সরায়। সুরলা অভিযোগের স্বরে বলে,
“চয়ন, আপনার কী হয়েছে বলুন তো? ফোন বন্ধ কেন আপনার? আমি আপনাকে কতবার কল করেছি আপনার কোন ধারণা আছে? এমন বিহেভ করছেন কেন! আর সকালের ওই ম্যাসেজের মানে কী চয়ন ? ” এক দমে প্রশ্নে দল ছাড়ে সুরলা। তার কথায় চয়নের মুখভঙ্গির পরিবর্তন হয়।

সুরলাদের ছাদের দিকে এগিয়ে এসে রাগত স্বরে বলে,
” আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করার নিষেধ করেছি না? আর কী চয়ন চয়ন ডাকছেন? নিতু,নিলয় আমাকে ভাইয়া ডাকে। সে হিসেবে আপনারও উচিত আমাকে ভাইয়া ডাকার। ভাইয়া ডাকবেন আমায়।”

চয়নের ‘আপনি’ সম্বোধন আর ‘ভাইয়া’ ডাকতে বলাটা পছন্দ হয় না সুরলা। অবাক হয়ে বলে,
“ভাইয়া!”
” কল মি ভাইয়া, নট চয়ন।”
“ইম্পসিবল। আমি ভাইয়া ডাকতে পারব না।” তড়িৎ বলে সুরলা। চয়ন রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে বলে,
“লিসেন, ভালোয় ভালোয় বলছি দূরে থাকুন আমার থেকে। আমাকে খারাপ হতে বাধ্য করবেন না। আপনার উদ্দেশ্য খুব ভালো করে জানা হয়ে গেছে আমার। একটা কথা কান খুলে শুনে রাখুন, আপনি যে পথে যেতে চাচ্ছেন সে পথে কখনোই যেতে পারবেন না, তাই ভালো হবে আগে থেকেই সেই পথ থেকে সরে যান। আমাকে বিরক্ত করবেন না। না হলে আমার খারাপ রূপটাও দেখতে পাবেন।”

হনহন করে চলে গেল চয়ন। সুরলা ছলছল চোখে চেয়ে থাকে চয়নের যাবার পানে। তারমানে সত্যিই চয়ন তার অনুভূতি বুঝতে পেরেছে! সুরলা চাইতো চয়ন তার অনুভূতিগুলোকে বুঝুক। কিন্তু এটা কখনোই চাইতো না যে চয়ন তার অনুভূতি বুঝে তাকে অগ্রাহ্য করুক। সুরলা মন খারাপ নিয়ে সারা বিকেল বসে থাকে ছাদে। গোধূলি নামতেই নিচে নেমে আসে। সোজা রুমে গিয়ে বালিশে মুখ গুজে শুয়ে পড়ে। চোখের পানি আপনাআপনি ঝরে পড়ে বালিশের বুকে।

অফিস শেষে বাসায় ফিরে নিতিকা। রুমে গিয়ে সুরলাকে শুয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকায়। তার জানা মতে, সুরলার অবেলায় ঘুমানোর অভ্যাস নেই। হাত থেকে ভ্যানিটি ব্যাগ রেখে আগায় বিছানার দিকে। সুরলার পাশে বসে । ফোঁপানোর আওয়াজ শুনতে পায়। সুরলা কাঁদছে! কিন্তু কেন! এই প্রশ্ন তাড়া করে নিতিকাকে। বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে সে বলে,
“সুরু? কী হয়েছে, কাঁদছিস কেন!”

বোনের আওয়াজ শুনতেই সুরলা বালিশ থেকে মুখ উঠায়। সুরলার লাল হওয়া চেহারা দেখে গাবরায় নিতিকা। পরম আদুরে কন্ঠে বলে,
“কী হয়েছে বল আমায়?”
কষ্ট গুলো আর নিজের মাঝে রাখতে পারে না সুরলা। বোনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“চয়ন আমায় রিফিউজ করেছে।”
“ওর সাথে তোর দেখা হলো কখন?”
“বিকেলেই। অনেক কথা শুনিয়েছে আমায়। বলেছে, ভাইয়া ডাকতে, ওর সাথে যোগাযোগ না করতে। আপু আমি ওকে ভালোবাসি, ওকে আমি ছাড়তে পারব না। কী করব আমি? কিভাবে মানাব ওকে?”

ফাঁপাতে থাকে সুরলা। নিতিকা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বোনের চোখের পানি মুছে দিয়ে সান্ত্বনা দেয়,
“শান্ত হ, সব ঠিক হয়ে যাবে। এটা নাটক সিনেমা না যে একদিনেই ভালোবাসা হয়ে যাবে। এটা বাস্তবতা, আর বাস্তবতায় সময়টাই বেশি প্রাধান্য পায়। নিজেকে সময় দে, সম্পর্কটাকে সময় দে। দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। ও ঠিক বুঝতে পারবে তোর ভালোবাসার কথা। হাল ছাড়িস না, লেগে থাক। আজ হয়তো বুঝতে পারছে না তোর অনুভূতি, একদিন ঠিক বুঝতে পারবে।”

“কবে বুঝতে পারবে?” ঠোঁট উলটে বলে সুরলা। নিতিকা মৃদু হেসে বলে,
“মুকিফ আমার পেছনে ছ’মাস ঘুরেছিল তারপর আমি ওকে গ্রহন করেছিলাম। তুই ও সময় দে দেখবি চয়ন ঠিক তোকে গ্রহন করবে।”
“যদি না করে?”
“তুলে এনে তোর সাথে বিয়ে দিয়ে দিব, আমার বোনকে কষ্ট দিয়ে পার পাবে নাকি!” বলে বোনের গাল টেনে দে নিতিকা। সুরলা ভাবনায় পড়ে। খানিক পর পর ফোঁপায়। নিতিকা ফ্রেশ হতে যায়। ফ্রেশ হয়ে সুরলাকে বুঝিয়ে রুমের বাইরে নিয়ে যায়। বসার রুমে সবার সাথে আড্ডায় মেতে উঠে। সুরলা খানিকক্ষণের জন্য ভুলে যায় সব। রাত আটটা নাগাদ আড্ডা শেষ হয়। রেহানা জাহান রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন, নিতু নিলয় পড়ালেখায়। নিতিকার কল আসায় সে চলে যায় ফোন হাতে বারান্দায়। মুকিফ ফোন দিয়েছে, ঘন্টা দুয়েকের আগে অন্তত ছাড়বে না। ভালো করেই জানে সুরলা। একাকিত্ব এসে ভর করে তাকে। চয়ন আবার হানা দেয় তার ভাবনায়। চয়নকে নিয়ে ভাবতে গিয়ে মাথায় অদ্ভুত ভাবনা আসে। সে সিদ্ধান্ত নেয়, সে অনবরত চয়নকে বিরক্ত করে যাবে, চয়নের কাছে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করে যাবে, যতক্ষণ না চয়ন তাকে গ্রহণ করে। চয়নকে বিরক্ত করার মিশনে নামে সে। এখনি চয়নের বাসায় যাবে, সবার সামনে চয়নকে অস্বস্তিতে ফেলবে। চয়নের বাসায় যাওয়ার বাহানা খুঁজে। পেয়েও যায়। খুশি মনে নিতুর কাছে বলে,
“নিতু, শুন না?”
নিতু পড়ছিল তখন। পড়ায় ব্যাঘাত ঘটায় বিরক্তি চাহনি দেয়। বলে,
“কী হয়েছে? পড়ায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছো কেন?”
“চিবাদের বাসায় যাবি আমার সাথে?” দেনামনা করে বলে সুরলা। নিতু ভ্রু কুঁচকে বলে,
“কেন!”
“কাল পার্টিতে ওর ফোনে যে সেলফি নিয়েছি সেগুলো নেয়ার জন্য।”
“ছবির জন্য ওর বাসায় যাওয়া লাগে নাকি! তুমি দাঁড়াও আমি ওকে হোয়াটসঅ্যাপে নক দিয়ে বলি পাঠিয়ে দিতে।” বলে ফোন হাতে নেয় নিতু। সুরলা বাধা দিয়ে বলে,
“না না, আমি গিয়েই আনব। তুই আমার সাথে যাবি।”
“আমার অনেক পড়া বাকি। আমি এখন কোথাও যেতে পারব না। ছবি আমি ফোনেই নিয়ে নিচ্ছি। ” ফোন ঘাটতে ব্যস্ত হয় নিতু। সুরলা চো মেরে ফোন কেড়ে নেয়। চোখ রাঙিয়ে বলে,
” যদি চুল টানা না খেতে চাস তবে চল আমার সাথে।”

সুরলার রাগের মাত্রা বাড়তে থাকায় দমে যায় নিতু। আমতা আমতা করে বলে,
“কিন্তু আমার পড়া!”
” ফিরে এসে পড়া শেষ করিস এখন চল।” বলে টেনে বসা থেকে উঠায় নিতুকে। বিছানায় পড়া থাকা ওড়নাটা নিয়ে পরিয়ে দেয়। দু’জনে চলে যায় চিবাদের বাসায়। কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুলে চরণ। নিতু আর সুরলাকে দেখে চমকায়। উৎফুল্ল গলায় বলে,
“আরে নিতু আর সুরলা যে! কেমন আছো?” সুরলার সাথে পার্টিতে টুকটাক কথা হয়েছে চরণের। সেই সুবাধে চেনে।
“ভালো, আপনি কেমন আছেন ভাইয়া?” সুরলাও হেসে জবাব দেয়। নিতু বলে,
“চিবা আছে বাসায়?”
“আছে, আসো ভিতরে।” দরজা থেকে সরে যায় চরণ। দুজনে ভিতরে প্রবেশ করে। ড্রয়িংরুমে চয়ন আর জোবায়দা কোন একটা বিষয় নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। জোবায়দা বলছেন আর চয়ন শুনছে মনোযোগ দিয়ে। নিতু আর সুরলাকে দেখে থামেন জোবায়দা। সুরলা হেসে সালাম দেয়,
“আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”
“ওয়ালাইকুস সালাম। কেমন আছো তোমরা?” হেসে বলেন জোবায়দা। দুজনেই কুশল বিনিময় করে। নিতু চলে যায় চিবার রুমে। চিবা পড়ছে। দুই বান্ধবী আড্ডা জুড়ে দেয়। সুরলা তখনো ড্রয়িংরুমে। জোবায়দা নানান কথা জিজ্ঞেস করছেন সুরলাকে। সুরলা স্বাভাবিক ভঙিতে সব কথার উত্তর দিচ্ছে। ফাঁকে ফাঁকে চয়নের দিকে তাকাচ্ছে। প্রতিবারই চয়ন রাগত্ব চাহনি দিয়ে চোখ সরাচ্ছে। চরণ ও এসে যোগ দেয় তাদের সাথে। চয়নের অস্বস্তি হয়। সে উঠে যায়। বলে,
“তোমরা কথা বলো, আমি রুমে যাচ্ছি।”

হাটা ধরে চয়ন। দরজা অবধি গিয়ে পেছু ফিরে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,
“আমি এখন অফিসের কাজ করব, কেউ যাতে বিরক্ত না করে।” চয়নের দৃঢ়বিশ্বাস ইঁচড়েপাকা সুরলা তার জন্যই এই বাসায় এসেছে। সুযোগ বুঝে রুমে গিয়ে তাকে জেরা করবে। তাই সে মায়ের উদ্দেশ্যে কথাটা বলে সুরলাকে সতর্ক করে দেয়। যাবার আগে সুরলার দিকে রাগত্ব চাহনি দেয়। সুরলা হেসে চোখ মেরে দেয়। চয়ন হনহন করে চলে যায় রুমে। শব্দ করে দরজা লাগায়, সেই শব্দ ড্রয়িংরুম অবধি এসে ঠেকে। জোবায়দা অবাক হয়ে বলে,
“চয়নের হঠাৎ কী হলো! অদ্ভুত বিহেভ করছে কেন!”

চরণ ঘটনা খানিক আঁচ করে। সুরলার দিকে তাকায়। সুরলাকে ঠোঁট চেপে হাসি আটকে রাখার চেষ্টায় মগ্ন থাকতে দেখে। দুয়ে দুয়ে চার মেলায়। তারপর ঘটনা মায়ের চোখ থেকে আড়াল করতে বলে,
” ভাইয়ার অফিসের কাজ আছে, তাই সম্ভবত দ্রুত চলে গেল। তাড়াহুড়ায় শব্দ করে ডোর লক করেছে।”

জোবায়দা ঘটনা আর ঘাটান না। কথায় মন দেন। এদিকে সুরলার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। জোবায়দার সামনে হাসা উচিত হবে না, আবার কী না কী ভেবে বসেন। হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করে। হাসি চেপে রাখা সম্ভব হয় না তার পক্ষে। চিবার কাছে যাওয়ার বাহানায় উঠে যায়। ড্রয়িংরুম থেকে বেরিয়ে ফিক করে হেসে দেয়। হাসতে হাসতে এগোয় চয়নের রুমের দিকে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নক করে, সাড়া পায় না। আবার নক করে। ভেতর থেকে চয়নের রাগত কন্ঠ ভেসে আসে।
“ডোন্ট ডিস্টার্ব মি। ”

সুরলা আবার নক করে। অনবরত নক করতে থাকে। না পারতে চয়ন এসে দরজা খুলে। সুরলাকে কয়েকটা কথা শুনাবেই সে। এই মনোভাব তার। দরজা খুলে সামনে কাউকে দেখতে পায় না। চোখ বুলাতে গিয়ে দরজার সামনে মেঝেতে একটা সাদা চিরকুট চোখে পড়ে। চিরকুটটা তুলে চয়ন। চোখ বুলায় তাতে।
” তুমি যদি ভেবে থাকো ফোন বন্ধ করে, আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে পার পেয়ে যাবে। তবে তুমি ভুল ভাবছো। আমি তোমাকে ভালোবাসি, যতক্ষণ না তুমি আমাকে গ্রহণ করছো ততক্ষণ তোমার পেছু ছাড়ছি না। আমার সাথে রুড বিহেভ না করে আগের মতো নরলাম বিহেভ করো। নয়তো আজ তোমার বাসায় এসেছি, অন্যদিন…….

ইতি,
তোমার কিট্টি”

চিবার রুম থেকে সুরলার হাসির আওয়াজ আসে। রাগে ফেটে পড়ে চয়ন। ইচ্ছে করে এখনি গিয়ে দু’টো থাপ্পড় দিয়ে আসতে। কিন্তু মা বোনের সামনে মান মর্যাদা সব হারাবে। চিরকুটটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে বিনে ফেলে দেয়। অতীত মনে পড়ে যায়। রাগের মাত্রা বাড়ে। নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে যাবে খানিক পরেই। তখন কী না কী করে বসে। তার আগেই বাসা থেকে বেরিয়ে ছাদে চলে যায়। অন্ধকার আর নিকোটিনের ধোঁয়ায় নিজেকে ডুবায়।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here