কাজল নদীর জলে পর্ব-১৭

0
1145

কাজল নদীর জলে
আফিয়া আপ্পিতা

১৭.
ঘড়ির কাটায় রাত দশটা চল্লিশ মিনিট। চোখ বন্ধ করে চুপচাপ দোলনায় বসে আছে সুরলা। কানে গুজানো ইয়ারফোনে লো ভলিউমে বাজছে ‘কাজল নদীর জলে’ গানটা। চয়নের গুনগুন করা গাওয়া এই গানটা মুগ্ধ করেছে। সেইদিনের পর থেকে এটা সুরলা পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। গানের প্রতিটা লাইনে সুরলা চয়নকে অনুভব করছে। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসিটা উঁকি দিচ্ছে বারংবার। চিবাদের বাসা থেকে এসেছে কিছুক্ষণ আগেই। চিবার থেকে ছবি নিয়ে ফেরার কথা থাকলেও ফেরে না তারা। জোবায়দা কিছুতেই ডিনার করা ছাড়া ওদের যেতে দিবেন না। এক প্রকার জোর করেই রেখে দেন। না চাইতেও নিতু আর সুরলাকে চিবাদের বাসায় ডিনার করতে হয়। হাসি আড্ডার মাঝে ডিনার শেষ করে তারা বাসায় ফিরেছে। এর মাঝে একবার ও চয়নের দেখা পায় নি সুরলা। খেতে বসে নিতু চয়নের কথা জিজ্ঞেস করলে জোবায়দা জানান, চয়ন বন্ধুদের সাথে ডিনারে গেছে। ফিরতে দেরি হবে। তাই চয়নের সাথে দেখা হওয়ার আশা বাদ দেয় সুরলা। ফিরে আসে।

গান শেষ হয়। সুরলা চোখ খুলে চারদিক চোখ বুলায়। ফোনের সময় দেখে। হুট করেই চয়নকে কল দিয়ে বসে। একটু জ্বালানো যাক। প্রথমবার বন্ধ পায়। আবার চেষ্টা করে। এবারও বন্ধ পায়। খানিক অপেক্ষা করে। তারপর আবার কল দেয়। ভাগ্য সহায় থাকায় এবার কল যায়। সম্ভবত তার কল দেয়ার মাঝেই ফোন সুইচড অন করেছে। সুরলা হাফ ছাড়ে। এবার ধরলেই হয়। এবার প্রথমবার রিসিভ হয় না। দ্বিতীয়বার কল দিলে কেটে দেয়। সুরলা অনবরত কল দিতে থাকে। এক পর্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে কল রিসিভ করে চয়ন। কানে দিয়েই এক ধমক দেয়,
“সমস্যা কী আপনার? বিরক্ত করছেন কেন? দেখছেন কল কেটে দিচ্ছি, তাও কল দিচ্ছেন কেন? বাসায় এসে পাগলামী করে শান্তি হয় নি আপনার? এখন ফোনেও জ্বালাবেন?”

সুরলা ভটকায় না। অনড়তার সাথে বলে,
“হ্যাঁ জ্বালাব, একবার নয় একশোবার। কী করবেন আপনি?”

“দেশে শুধু পুরুষ নির্যাতন আইন থাকলে নির্দ্বিধায় উত্ত্যক্ত করার অপরাধে মামলা ঠুকে দিতাম।” হুমকি দেয়ার মত শোনায় কথাটা। সুরলা শব্দ করে হেসে দেয়। বলে,
“লাভ হতো না খুব একটা। আপনার মত তারাও আমাকে পিচ্ছি ভাবতো, রিপোর্টই নিলেও মামলা ডিসমিস হয়ে যেত সন্নিকটেই। আপনাকে হাজার বার বলার পর ও আপনি আমাকে এডাল্ট বিশ্বাস করেন নি। তারা কিভাবে বিশ্বাস করবে!”

“এটাই আমার জীবনের সব থেকে বড় ভুল ছিল। যাক গে, ঘটনা আর বাড়াতে চাই না আমি। আমাকে বিরক্ত করা ছেড়ে দিন! আমার বাসায় এসে উদ্ভট কান্ড করা বা আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবেন না। এতসব করে আর যাই হোক ভালোবাসার মূল্য পাবেন না, উলটো যা আছে তাই হারাবেন। ”
বলে কল কেটে দেয় চয়ন। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার তুমুল চেষ্টা করছে। বারবার অতীত তাড়া দিচ্ছে। সে চাচ্ছে ভালো ভাবে সুরলাকে ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু মেয়েটা বুঝার চেষ্টাই করছে না। কল কেটে দেয়ার মিনিট খানেকের মাথায় আবার কল করে বসে সুরলা। চয়নের রাগ তখন উর্ধ্বে। দাঁত কটমট করে ফোন রিসিভ করে।
চোয়াল শক্ত করে রাগত কন্ঠে বলে,
” বিন্দু পরিমাণে আত্মসম্মান থাকলে মানুষ এতটা বেহায়া হয় না। এতটা বেহায়া কেন আপনি? লজ্জা আর দ্বিধা হয় না, এতবার নিষেধ করার পর ও আমাকে বিরক্ত করতে? আপনার মত গায়েপড়া মেয়ে আমি দু’টো দেখি নি।” নিয়ন্ত্রণহারা রাগে কী বলছে নিজেই জানে না চয়ন। এতটা কঠিন কথা এর আগে কেউ বলেনি সুরলাকে। প্রথম কেউ বলল তাও সে তার ভালোবাসার মানুষ! সুরলার গলা কাঁপে। বুঝানোর চেষ্টা চালায় তখনো,

“চয়ন…
সুরলাকে থামিয়ে ধমকে উঠে চয়ন।
” আপনি নির্লজ্জতা দেখে অবাক হচ্ছি আমি। এত কথা বলার পর ও আপনি কথা বলছেন? এতটা নিচু মানুষ হয়? আচ্ছা, বলুন তো আপনার সমস্যাটা কী? কী করলে আমার পেছু ছাড়বেন?”

সুরলার চোখের কোণে জলেরা ভীড় করেছে। সে ভরাট গলায় বলে,
“আপনাকে ভালোবাসা-ই আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা। আপনার ভালোবাসা পেতে চাওয়াই আমার সমস্যা।”

চয়ন বাঁকা হাসে। তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,
“আপনার মতো মেয়েরাই পারে এত নাটক করতে। সিনেমাটিক ডায়লগ বলে ছেলের ফাঁদে ফেলতে। ছেলেটাকে কাবু করে কয়েকদিন ক্রেডিট কার্ড হিসেবে ইউজ করে টিস্যুর মত ছুড়ে ফেলতে। আপনারা সবাই স্বার্থপর, কাউকে ভালোবাসতেই জানেন না। আমাকে যে ভালোবাসার বুলি শুনাচ্ছেন এটাতেও নিশ্চয়ই কোন না কোন স্বার্থ লুকিয়ে আছে। আচ্ছা? আপনি কী দেখে ভালোবেসেছেন? আমার টাকা? ভালো জব? নাকি এট্রাক্টিভ বডি। কোনটা? বলে ফেলুন? জানেন, আমার কাছে বেশ টাকা আছে, আপনার কত টাকা লাগব? কত অর্থের বিনিময়ে আমার পেছু ছাড়বেন বলুন? আমি এখুনি টাকা দিয়ে দিচ্ছি। তাও দয়া করে আমাকে বিরক্ত করবেন না। গত দু’দিনেই আমি পেড আপ হয়ে গেছি। আর এসব ঢং দেখতে পারছি না। এমাউন্ট কত আপনার?”

ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে সুরলা। উত্তর দেয় না। চয়ন তখনো রাগে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য। সুরলার ফুপিয়ে কান্না ভেল্কি তার কান অবধি যায়। অতীতে পাওয়া শিক্ষা তাকে বলে এটা অভিনয় ছাড়া আর কিছুই নয়। সে শব্দ করেই হেসে ওঠে। বলে,

“আপনারা মেয়ে আর কিছু না পারলে ও অভিনয়টা ভালোই পারে। মানুষকে কাবু করার চোখের পানি যেন আপনারা সবসময় তৈরি রাখেন। রঙে ঢঙে অজুহাত বানিয়ে ফেলেন। যাতে মানুষ আপনাদের ভালো আর সঠিক ভাবে। তবে আর যাই আমার কাছে আপনাদের চলনা একদম পরিস্কার। আপনি যদি ভেবে থাকেন, আপনার কান্নার শব্দ শুনে আমি গলে যাব, তবে আমি দুঃখিত। আপনার ভাবনা ভুল। আপনি গলছিনা। তাই এই নাটক বন্ধ করে আপনার এমাউন্ট বলুন? কত টাকা হলে আপনি বিদায় হবেন? বিশ্বাস করুন আমি কাউকেই বলব না।”

সুরলা তখনো নিরবে কাঁদতে ব্যস্ত। চয়ন তার টপিকেই অনড়।
“আচ্ছা একটা সত্য কথা বলুন তো? চিবার বার্থডে পার্টিতে আপনি এমন নর্তকীর সাজে সেজেছেন কেন? আমার জন্য নিশ্চয়ই! যাতে আমি আপনার প্রতি আকর্ষিত হই। আপনারা মেয়েরা এত নিচু কিভাবে হতে পারেন? মানুষের অনুভূতি নিয়ে খেলা আপনাদের নেশা। আমার ভাবতেই রাগ লাগে, আমি আপনার সাথে যেচে কথা বলেছি। ছিঃ হাউ চিপ আই এম! আপনাদের মত মেয়ের মুখোশ ইতিপূর্বে দেখার পর ও কেন চিনলাম না। ভাবতেই রাগ লাগছে। যাক গে, এখন আপনার এমাউন্ট বলুন। আপনার নর্তকীর সাজের দামটাও বলবেন। আপটার অল, আমার জন্যই সেজেছেন।”

সুরলা নিরবে চোখের পানি ফেলে। চয়ন তাড়া দেয়,
“কী হলো বলুন? লজ্জা করছে বলতে? অবশ্য আপনার তো লজ্জাই নেই।”
সুরলা গলা দিয়ে কথা বের হয় না। গলা কাঁপে। বহু কষ্টে ভেজা গলায় বলে,
” আই এম স্যরি! যদি আপনাকে ভালো না বাসতাম!”
বলে কল কেটে দেয়। হাটুতে মুখ গুজে কান্নায় ভেঙে পড়ে। তার কান্নায় শব্দ হয় না। নিরবে ফেলে যায় অশ্রু। চয়নের বলা প্রতিটা কথা তার বুকে তীরের মত বিধেছে। বুকটা ভারি হয় তার। রাতটা কেঁদেই কাটায়। নিতিকা ঘুমানোর জন্য ডাকতে এলে কোনমতে নিজেকে স্বাভাবিক করে বাহানা দিয়েছে। সকাল হতেই ব্যাগ গুছিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। ঘুমে থাকায় কেউ টের পায় না। নিরুদ্দেশ ঘুরে বেড়ায় এদিক ওদিক। সব কিছু অসহ্য লাগে তার কাছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here