কাজল নদীর জলে পর্ব-১৮

0
1020

কাজল নদীর জলে
আফিয়া আপ্পিতা

১৮.
সকাল সাতটা নাগাদ ঘুম ভাঙে নিতিকার। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে, তাকায় পাশে। সুরলার ঘুমানোর জায়গাটা খালি পায়। কাল বারান্দায় বসে ছিল, কয়েকবার ডাকার পর ও আসেনি। চোখে ঘুম ভর করায় কাল বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুম নেমেছে চোখে। এরপর আর কোন খেয়াল ছিল না। সম্ভবত বারান্দায় ঘুমিয়েছে সুরলা। ভাবে নিতিকা। বিছানা ছেড়ে বারান্দার দিকে এগুয়। বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে চারপাশটা চোখ বুলিয়ে সুরলাকে পায় না। রুমে ফিরে আসে। রুমের দরজা খোলা দেখে ধরে নেয়, সুরলা উঠে গেছে, হতে পারে রুমের বাইরে বা মায়ের সাথে জগিং-এ গেছে। ফেরে নি হয়তো। এসব ভেবে ফ্রেশ হতে চলে যায় ওয়াশরুমে। ফ্রেশ হয়ে অফিসের জন্য তৈরি হয়ে আটটা নাগাদ ড্রয়িংরুমে আসে। রেহানা জাহান তখন টেবিলে নাস্তা সাজাচ্ছেন। রেহানা জাহানের স্বামী নাবিদ আহমেদ চেয়ারে বসে পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছেন। নিতিকাকে রেহানা বলেন,
“তুই একা উঠে এলি, সরুকে উঠিয়ে আনলি না কেন?”

নিতিকা চেয়ারে বসতে বসতে উত্তর দেয়,
” সুরলা রুমে নেই। তোমরা জগিং-এ যাও নি?”

” পা টা ব্যাথা করছে, তাই যাই নি আজ। ও কী একা গেল?” বললেন রেহানা। নিতিকা ভ্রু কুঁচকে বলে,
” ও একা কখনো যায় না। রুমে ও নেই, জগিং-এ ও যায় নি। গেলো কোথায়?”

নাবিদ আহমেদ পত্রিকা থেকে চোখ উঠিয়ে বলেন,
“নিতুর রুমে গিয়ে ঘুমাচ্ছে কি-না দেখো!”

খাবার ছেড়ে উঠে যায় নিতিকা। নিতু রুমে গিয়ে দেখে পায় না। সুরলার ব্যাগ ও নেই। ব্যাগপত্র গুছিয়ে গেল কোথায়? পুরো বাসা খুঁজে সুরলার দেখা মেলে না। কল দিলে ও দেখে ফোন বন্ধ। সবাই চিন্তায় পড়ে যায়। রেহানা বোনের কাছে ফোন দিয়ে ওখানে গেছে কি-না জিজ্ঞেস করে। নেতিবাচক উত্তর আসে। চিন্তা এসে আকঁড়ে ধরে তাদের ও। জগিং পার্ক, ছাদ এদিক ওদিক খুঁজে, পায় না। সাবিনা আর রেহানা রীতিমতো কান্না জুড়ে দিয়েছেন। সুরলার বাবা তানভীর মাহমুদের কানে কথাটা যেতেই তার কপালে চিন্তার ভাজ পড়ে। স্ত্রীর মতো ভেঙে না পড়ে নিজেকে শান্ত রেখে চিন্তায় মগ্ন হোন। মাথায় আসে সুরলার বন্ধুদের কথা। কল দিয়ে বসেন সুরলার বান্ধবী রাশনার নাম্বারে। প্রথমবারে রিসিভ হয় না। দ্বিতীয়বারে রিসিভ হয়। রাশনা সালাম দেয়। তানভীর সাহেব কোন ভণিতা না করেই বলেন,
“সুরলা আছে তোমার সাথে?”
“হ্যাঁ সুরলা আমার সাথেই আছে।”

হাফ ছাড়েন তানভীর আহমেদ। তারপর তড়িৎ বলেন,
“তোমরা এখন কোথায় আছো? ঠিকানা বলো, আমরা আসছি।”

রাশনা ঢোক গিলে। পাশে বসা কান্নারত সুরলার দিকে চোখ বুলায়। এখন এখানে এলে লঙ্কা কান্ড হয়ে যাবে। কেঁদে কেটে সুরলার চেহারার ভয়াবহ অবস্থা। রাশনা তড়িৎ বলে,
“সুরলা আমার বাসায় আছে। একদম ঠিক আছে। আপনার আসা লাগবে না আংকেল।”
“কখন গেছে?”
“এই তো সকালে।”
“ওকে ফোনটা দাও তো! আমি কথা বলি।”

রাশনা সুরলাকে ইশারায় কথা বলবে কি-না জিজ্ঞেস করলে সুরলা নিষেধ করে। এই অবস্থায় সে কথা বলতে পারবেনা। রাশনা বুঝতে পারে সুরলার অবস্থা। সে বলে,
“আংকেল সুরলা তো ওয়াশরুমে গেছে। এলে ফোন দিতে বলি?”
“আচ্ছা, আমি অপেক্ষায় আছি।” ফোন রাখেন তানভীর সাহেব। মেয়ের সাথে কথা না বলা অবধি তার মন শান্ত হচ্ছে না।

কান থেকে ফোন সরিয়ে রাশনা বান্ধবীর দিকে তাকায়। কেঁদে কেঁদে সুরলা নাক মুখ ফুলিয়ে কী করেছে! চয়নের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। মেয়েটা রিজেক্ট করার হলে ভালোভাবে বললে তো এত বাজে কথা বলার কী দরকার ছিল! সুরলার ফোনে রেকর্ডার অন থাকায় চয়নের সব কথাই রেকর্ড হয়েছে। সকালে যখন সুরলা ফোন দিয়ে কেঁদে কেঁদে এক পার্কে যেতে বলে তখন তড়িঘড়ি করে সেখানে যায় রাশনা। বান্ধবীকে কাঁদতে দেখে ভড়কায়। কারণ জিজ্ঞেস করে। কান্নার বেগে কথা বেরোয় না সুরলার। ফোন এগিয়ে দেয় বান্ধবীর হাতে। স্ক্রিনে ভাসছে রেকর্ড লিপি। ক্লিক করে সব শুনে রাশনা। রাগে ইচ্ছে করছিল চয়নকে খুন করতে। রাগ ক্ষোভ মনে চেপে বান্ধবীকে সান্ত্বনা দেয়ায় মন দিয়েছিল তখন। বুঝিয়ে নিজের বাসায় নিয়ে আসে। ঘুমে থাকায় তার বাসার কেউ টের পায় নি। পিয়ামকেও ফোন দিয়ে আসতে বলেছে। কলিংবেল বাজে। রাশনা গিয়ে দরজা খুলেছে। পিয়াম এসেছে। রাশনাকে দেখেই পিয়াম হুলস্থুল হয়ে বলে,
“কী হয়েছে? এত জুরুরি তলব করলি কেন? ফোন দিয়ে বাসায় আসতে বললি, কোন কারণ বললি না। ঘটনা কী?”

ঘুম লেগে থাকা পিয়ামের চেহারার দিকে চোখ বুলায় রাশনা। ঘুম চোখেই দৌড়ে এসেছে, পরনের কাপড় ও ছাড়েনি। থ্রি কোয়ার্টার পরনে। রাশনা মৃদুস্বরে বলে,
“সরুটা খুব কাঁদছে। একবারেই ভেঙে পড়েছে। আমি পারছি না ওকে সামলাতে।”
“সুরলা কাঁদছে? কেন? কী হয়েছে ওর? ও তোর বাসায় কেন! ও তো চয়নের বোনের জন্মদিন পার্টি উপলক্ষে খালার বাসায় গেছে। ওখানে কিছু হয়েছে? চয়ন কিছু বলেছে?” হুলস্থুল হয়ে একদমে প্রশ্নের দলা ছুড়ে থামে পিয়াম। দরজা দাঁড়িয়েই ধীরে সব কথা খুলে বলে। সব শুনতেই চেহারায় রক্তিম আভা দেখা দেয় পিয়ামের। রাগত স্বরে বলে,

“ওই লোক নিজেরে কী মনে করে? কোথাকার কোন শাহরুখ খান হয়েছে যে আমার বান্ধবীকে এমন কথা বলার সাহস পায়! ইচ্ছে করছে গিয়ে পিটিয়ে আসি। ” বলে সিড়ির দিকে পা বাড়ায়। রাশনা হাত চেপে টেনে বলে,

“সরুটাকে সামলা আগে। আংকেল ফোন দিয়ে আসতে চাইছেন। ওনারা চিন্তা করছেন। সুরলাকে দিয়ে কথা না বলিয়ে দিলে ওনারা চলে আসবেন বাসায়। তখন সুরলাকে কাঁদতে দেখলে ব্যাপারটা কেমন হবে? তারচেয়ে ওকে একটু শান্ত কর প্লিজ!” অনুরোধ ঝরে পড়ে রাশনার কথায়। পিয়াম খানিক ভেবে বাসায় ঢুকে। রাশনার রুমে গিয়ে সুরলাকে কাঁদতে দেখে। এগিয়ে যায় বান্ধবীর দিকে। পাশে বসে সান্ত্বনা দেয়, নানানভাবে বুঝায়। বাবার সাথে কথা বলাতে রাজি করায়। চোখ মুছে নিজেকে খানিক স্বাভাবিক করে বাবার সাথে কথা বলে। খালা, মা, নিতিকা সবার সাথে কথা বলে। হুট করে কাউকে কিছু না বলে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে বলে,
“আজ পিয়ামের জন্মদিন তো তাই আমরা ওকে সারপ্রাইজ দেয়ার পরিকল্পনা করছিলাম। পিয়ামকে সারপ্রাইজ দিতেই সকাল সকাল আমি রাশনার বাসা এসে পড়লাম।”
সেই সাথে বান্ধবীর বাসায় দু’দিন থাকবে বলেও জানায়। সুরলার সাথে কথা বলে সবাই নিশ্চিন্ত হয়।

সুরলাকে না পাওয়ার খবরটা নিতুর কাছ থেকে শুনে চিবা। সকালের নাস্তা করতে বসে সবার সামনে বলে কথাটা। জোবায়েদা আফসোস করে, ফিরে পাওয়ার দোয়া করে। চরণ ও সায় জানায়। চয়ন না শোনার ভান করে। যেন,কে আসল কে হারাল তা শুনতে চায় না সে। চরণ ভাইয়ের পাশে বসা ছিল। ভাইয়ের চেহারায় চোখ বুলায়। চেহারায় কোন আফসোসের লেশ মাত্র নেই। যেন, সুরলাকে না পেলেই বাঁচে সে। চরণ ভাইয়ের কাছে ঘেঁষে বলে,
” কোথাও সুরলার নিখোঁজ হওয়ার পেছনে তোমার হাত নেই তো! তুমি কিছু বলো নি তো ওকে?”

খাওয়া থামিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকায় চয়ন। চোখ রাঙিয়ে বলে,
“চুপচাপ খা।” চরণ বুঝে যায় এতে তার ভাইয়েরই হাত আছে। সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এক মেয়ের জন্য আর কতজনকে আঘাত করে ক্ষান্ত হবে কে জানে! কবে আবার কাউকে জীবনে আসতে দিবে?

সুরলাকে তার দুই বন্ধু মিলে বুঝায়। সুরলা কখনো শান্ত হয় কখনো আবার অপমানে কেঁদে উঠে। ভালোবাসার অপরাধে এত অপমানিত হতে হবে ভাবে নি সে। চয়নের বলা কথাগুলো মনে পড়তেই কান্না পাচ্ছে তার। বিশেষ করে নর্তকীর সাথে সুরলার তুলনা করাটা। তার ভালোবাসাকে টাকা দিয়ে মাপতে চাইছে চয়ন, টাকার বিনিময়ে সুরলাকে ভালোবাসা থেকে দূরে রাখতে চেয়েছে ব্যাপারটা ব্যাপারকে কষ্ট দেয় সুরলাকে। অপমানে সুরলার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। চয়ন যে এত কঠিন ভাষায় কথা বলতে পারে তা জানা ছিল না সুরলার। দিন যায় এসবের ভাবনাতেই। রাত নামে, পিয়াম সুরলাকে বুঝিয়ে চলে যায় বাসায়। সুরলা রুম থেকে বেরোয় না। সুরলার সাথে রাশনার মা বোন দেখা করতে এলে রাশনা এটা সেটা বলে রুমের দরজা থেকে ফিরেয়ে দেয়। বান্ধবীকে আগলে রাখে সে। দু’দিন কাটে এভাবে। সুরলা খানিক স্বাভাবিক হয়ে বাসায় ফিরে আসে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here