কাজল নদীর জলে পর্ব-১৯

0
971

কাজল নদীর জলে
আফিয়া আপ্পিতা

১৯.
“সরু সত্যি করে বলতো, সেদিন কী হয়েছিল?বাসা থেকে অমন না বলে বেরিয়ে গেলি কেন?” সুরলার বাসায় আসার দিন রাতে অফিস থেকে খালার বাসায় আসে নিতিকা। ঘুমোতে গিয়ে সুরলার মাথায় বিলি কেটে বলে কথাটা। সুরলা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,
“বললাম না? পিয়ামের জন্মদিন উপলক্ষ্যে সারপ্রাইজ দিতেই বেরিয়ে গেছি। ওখান থেকে বাসায় যাব তাই ব্যাগ নিয়ে বেরিয়েছিলাম। ”

নিতিকা সুরলার দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বলে, “আমার কেন যেন মনে হচ্ছে পিয়ামের জন্মদিন নয় অন্য কোন কারণে তুই বাসা থেকে বেরিয়েছিলি? সত্যটা বল আমায়? ”
“এটাই সত্য আর কোন সত্য নেই। তোমার মাথায় শুধুই উদ্ভট চিন্তা আসে।” এড়িয়ে যেতে চায় সুরলা। নিতিকা সুরলার দিকে ভালো করে পরখ করে বলে,
“তোর চোখ মুখ দেখে মনে হয় খুব কেঁদেছিস, আর চোখের নিচে কালচে পড়েছে। কী হয়েছে তোর? চয়ন কিছু বলেছে?”

চয়নের নাম শুনতেই পুরোনো ঘা তাজা হয়। কান্নার দলা বেরিয়ে আসতে চায়। সে গলায় চেপে বলে,
“কেউ কিছু বলেনি। আর না কোন সমস্যা হয়েছে। রাশনার বাসায় রাত জেগে মুভি দেখিছি। তুমি তো জানোই আমি কত ইমোশনাল, একটু ইমোশনাল সিন দেখলেই কেঁদে ভাসাই। কাল রাতে একটা মুভি দেখে খুব কেঁদেছি তাই চোখ ফোলা লাগছে। আর ডার্ক সার্কেল রাত জাগার জন্যই। সব কনফিউশান ক্লিয়ার করলাম। এবার আমি ঘুমাব। বিলি কাটো তুমি।” বলে পাশ ফিরে শোয়। নিতিকা আরো কিছু বলতে চায়, ঘটনা জানতে চায় পারে না। সুরলা তখন চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করে থাকতে ব্যস্ত।

.

দিন পেরোয়, সুরলা আগের মতো চঞ্চলা হয়ে যাও। হেসে খেলে বেড়ায় সবার সাথে। দিন শেষে রাতের মধ্য প্রহরে ঘুমোতে গেলে একাকিত্বের সাথে চয়নের ভাবনা এসে জড়ায় তাকে। সে চায় চয়নকে ঘৃণা করতে। কিন্তু ঘৃণা আসে না মনে। চয়নের প্রেমাসক্তি থেকে নিজেকে দূরে রাখতে ফোন আর ল্যাপটপ থেকে চয়নে ছবি, নাম্বার সব ডিলিট করে দেয়। বেহায়া মন মানে না। ফেসবুকে গিয়ে চয়নের আইডি খুঁজে চয়নকে দেখে আসে। এমনি করে যায় সপ্তাহ খানেক। তারপর হুট করেই তার মন শক্ত হয়ে যায়। চয়নের করা অপমান নতুন করে তার আত্মসম্মানে আঘাত আনে। যখনই চয়নের বলা কথা গুলো মনে পড়ে তখন সে প্রতিজ্ঞা করে দ্বিতীয়বার চয়নের সামনে যাবে না। নিজের ভালোবাসা প্রকাশের চেষ্টা করবে না। ভালোবাসা যদি সম্মান কাড়ে, বেহায়া, আত্মসম্মানহীন করে তবে সে ভালোবাসা থেকে দূরে থাকা উচিত। সুরলা তার খালার বাসায় যাওয়া বন্ধ করে দেয়, যদি চয়নের সাথে দেখা হয়ে যায় এই ভয়ে।

ইদ আসে। ইদের সপ্তাহ খানেক আগে কেনাকাটা করতে যমুনা ফিউচার পার্ক শপিংমলে যায় সুরলা। সাথে মা আর ভাই ও আছে। ঘুরেফিরে ড্রেস দেখছে সুরলা। একটা ড্রেস দেখছে আর মাকে জিজ্ঞেস করছে,
“দেখো তো মা এটা কেমন?”
খানিক পরখ করে সাবিনা বলেন,
“অন্যগুলো দেখ। ” বেশ চুজি সাবিনা। যে কোন কিছু সহজে পছন্দ হয় না। সুরলা অন্য ড্রেস দেখায় মন দেয়। হুট করে কেউ পেছন থেকে ডেকে উঠে,
“সুরলা আপু?”
সুরলা সাবিনা দুজনেই পেছনে তাকায়। দুটো মেয়ে আর একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। সাবিনা পরখ করে চেনার চেষ্টা করে। তিনজনের মাঝে একটা মেয়েকে চেনে। মেয়েটা নিতুর বান্ধবী। পাশের বিল্ডিংয়ে থাকে। নামটা মনে পড়ে না। কবে যেন নিতুদের বাসায় দেখা হয়েছিল মেয়েটার সাথে! চিবা সাবিনার দিকে তাকিয়ে হেসে সালাম দেয়। কুশল বিনিময় করে। বাকিদের না চিনতে পারায় সাবিনা বলেন,
“এদের তো চিনলাম না।”
চিবা তার সাথে থাকা ছেলে মেয়ে দুটোকে দেখিয়ে বলে,
“আমার মেঝোভাই চরণ আর কাজিন তিশা। ”

সবাই একে অপরের সাথে কুশল বিনিময় করে। সুরলা বলে,
“তা তোমরা এখানে কী করছো?”
“ইদের কেনাকাটা করতে আসা। ” জবাব দেয় চিবা। চরণ বলে,
“তোমরাও ইদের কেনাকাটা করতে এসেছো?”
“হ্যাঁ ” জবাব দেয় সুরলা।
টুকটাক কথাবার্তা সেরে অন্যদিকে চলে যায় চিবারা। পুরোটা সময় চরণ সুরলাকে পরখ করে। সুরলার চোখে মুখে তার ভাইয়ের জন্য ফিলিং খুঁজে। পায় না। যাবার আগে সুরলার কাছে গিয়ে ধীর কন্ঠে বলে,
“চরণ ভাইয়ার বিয়ে ইদের পর, তুমি আমন্ত্রিত। ” চয়নের কথা শুনতেই হাসিমুখটা নিমেষেই চুপসে যায়। পুরো ঘা তাজা হয়। কষ্টরা দলা বেধে বেরিয়ে আসতে চায়। বেরিয়ে আসতে দেয় না সুরলা। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টায় মত্ত হয়ে কৃত্রিম হেসে বলে,
“দারুণ খবর। অনেকদিন বিয়ে শাদী খাই না। এবার সুযোগ হবে। পাত্র পাত্রীর জন্য শুভকামনা। ”

সুরলা চুপসে যাওয়া মুখ আর হাসির কৃত্রিমতা চোখ এড়ায় না চরণের। চয়ন আর সুরলার মাঝে কী হয়েছে জানে না সে। তবে সে আন্দাজ করে তার ভাই সুরলাকে জঘন্যভাবে অপমান করেছে । তাই মেয়েটা অমন বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। চিবার থেকে জেনেছে আজকাল সুরলা নাকি নিতুদের বাসায় ও আসে না। এর মানে এখনো মনে আঘাত পুষে রেখেছে মেয়েটা। তাই ভাইয়ের মিথ্যা বিয়ের কথা উঠিয়ে সুরলার অনুভূতি যাচাই করতে চেয়েছে। সুরলার মুখভঙ্গি আর কৃত্রিম হাসি দেখে সে বুঝে নেয় সুরলার মনে এখনো চয়নের জন্য ফিলিংস আছে। এবার এটাকে কাজে লাগাবে সে। এই পুচকি মেয়েটাকে আর কষ্ট পেতে দেয়া যাবে না। এই মেয়েটাকে দিয়েই ভাইয়ের জীবন বদলাতে হবে। চরণ চলে যায়। সুরলা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। চয়ন বিয়ে করছে! নিশ্চয়ই মেয়ে তার থেকে অনেক সুন্দর আর স্মার্ট? তার মত গায়ে পড়া স্বভাব তার থাকবে না নিশ্চয়ই। এমন অনেক ভাবনা আসে। ভাবনাকে শাসায় সে। চয়ন আর তার রাস্তা এখন আলাদা। সুতারাং তার ভাবনায় চয়নের আসা নিষেধ।

“সুরলা চল ওদিকটায় দেখি। ?”
সাবিনা মেয়েকে ডাকেন। মেয়ের সেদিকে খেয়াল নেই। সুরলার ভাই সরল এসে বোনকে মৃদু ধাক্কা দেয়। বলে,
“আপি, চলো?” বাস্তবে ফিরে সুরলা। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
“কোথায় যাবো?”
“অন্য শপে চল, এখানে পছন্দ হচ্ছে না কিছু। ” উত্তর দিয়ে সামনে আগান সাবিনা। মায়ের কথামতো সামনে আগায় সুরলা। কয়েক দোকান ঘুরে সবার জন্য জামা কাপড় কিনে দুপুরের দিকে বাসায় ফিরে। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসে হাসফাস করে। সুরলার মন তখনো চয়নের বিয়েতে আটকে আছে। ভাববে না বললেও ভাবনায় এসে হানা দিচ্ছে চয়ন। না পেরে রাশনাকে কল দেয়। রিসিভ হওয়ার পর সুরলা হ্যালো বলতেই রাশনা বুঝতে পারে সুরলা মন খারাপ। সে বলে,
” মন খারাপ কেন তোর?”
“হ্যালো বলতেই ধরে ফেললি?” অবাক হয়ে বলে সুরলা। রাশনার উত্তর,
” ওই এক শব্দের মাঝে আমি কোন চাঞ্চলত্য পাই নি, তাই ধরে নিলাম। তা বল, মন খারাপের কারণ কী?”
“চয়ন বিয়ে করছে, ইদের পর বিয়ে।” কোন ভণিতা ছাড়াই বলে দেয় সুরলা।
“ওই লোক তোকে কল দিয়ে জানিয়েছে?” রাগত স্বরে প্রশ্ন করে রাশনা।
“না ও কল দেয় নি। আজ শপিংমলে চয়নের ভাই বোনের সাথে দেখা হয়েছে। যাবার সময় চয়নের ভাই জানাল। আমন্ত্রণ ও দিল। ”
“এক ভাই কষ্ট দেয় আরেক ভাই এসে কাটা গায়ে লবনের চিটা দেয়। এরা চায় কী আসলে?” রাগ ঝরে পড়ে রাশনার গলায়।
“জানি না কী চায় ওরা। আমি তো সরেই এলাম ওসব থেকে। চয়নকে ভুলতে চাচ্ছি খুব করে। এখন এই বিয়ের সংবাদ শুনে চয়ন আবার ভাবনায় হানা দিচ্ছে। ” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে সুরলা। রাশনা ধমকে উঠে,

“ওকে তোর ভাবনায় আসার অনুমতি দিবি কেন? ওর করা অপমান ভুলে গেলি? ও তোকে নর্তকী, বেহায়া, নির্লজ্জ, আত্মসম্মানহীন বলেছে। কতটা জঘন্য! তোর ভালোবাসাকে কিনতে চেয়েছে টাকার বিনিময়ে, তারপর তোকে বিদায় করতে চেয়েছে। ভালোবাসার অপরাধে তোকে কতটা বাজে কথা শুনিয়েছে ভুলে গেলি! ও বিয়ে করুক না হয় মরুক তাতে তোর কী? তুই কেন ওর জন্য মন খারাপ করবি? তোর কি আত্মসম্মানবোধ নেই!”

“আমার আত্মসম্মানবোধ আছে বলেই ওই দিনের পর চয়নের কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছি। নিজেকে বারবার শাসাচ্ছি। ওর করা অপমানের কথা মনে পড়তেই ওর কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার সাহস পাই। আজকাল ও আমার ভাবনায় ও আসে নি। লুকিয়ে লুকিয়ে এখন আর ফেসবুকে গিয়ে ওর প্রোফাইল ছবি দেখি না, ওর কথা ভেবে কাঁদি না। নিজেকে অনেক শক্ত করে ফেলেছি। কিন্তু এত দিন পর হুট করে ওর বিয়ের কথা শুনে কেন যেন সব সাহস যেন ফিকে পড়ছে। না চাইতেও সে ভাবনায় এসে যাচ্ছে। মনটা নিয়ন্ত্রণহারা হয়ে গেছে। কী করব আমি?”

“ওই বাজে লোকের কথা ভাববি না তুই। ওর করা অপমানের কথা ভাব, সাহস পাবি। তোর যদি বিন্দুমাত্র আত্মসম্মানবোধ থাকে তবে ওর জন্য মন খারাপ করবি না। ”
“হু।”
“হু কী!”
“কিছু না।”
“একা থাকলে নানান ভাবনা এসে হাজির হবে, আমি আসছি তোর বাসায়। তোর মন থেকে চয়নের ভূত নামাব।”
“আয়।”


বিকেল সাড়ে চারটা। রান্নাঘরে ইফতার বানাতে ব্যস্ত জোবায়েদা। কাজের বুয়া দুপুরে এসে সব কেটেকুটে দিয়ে গেছে। তরকারি রান্না করে ইফতারি বানাবেন এখন। তারাবির নামায পড়তে যাবার সময় চুলায় ভাত বসিয়ে দিয়ে যাবেন। এমনি নিত্য রুটিন জোবায়েদার।
এখন বেসনের গোলায় চুবিয়ে বেগুনি বানাচ্ছেন। এক হাতে খুন্তি আরেক হাতে স্লাইড করে কাটা বেগুন। অনান্যদিন চিবা মাকে সাহায্য করে ইফতার বানাতে। আজ শপিং করে এসে ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে ঘুম দিয়েছে দুপুরের দিকে। এখনো উঠেনি। ডাইনিং টেবিল থেকে পানির জগ হাতে নিয়ে রান্নাঘরে প্রবেশ করে চরণ। ফিল্টার থেকে পানি ভরে জগে। তারপর জগ হাতে এসে দাঁড়ায় মায়ের পাশে। জোবায়েদা ছেলের দিকে তাকান একবার। তারপর বেসনে বেগুন চুবাতে চুবাতে বলেন,
“কিছু বলবি?”
“আমি কিছু বলার আগেই কিভাবে বুঝে যাও তুমি বলতো?” হেসে বলে চরণ। জোবায়েদা হেসে বলেন,
“তোর চেহারাই বলে যে তুই কিছু বলতে চাস আমাকে। তা কী বলতে চাস বলে ফেল।”

চরণ খানিক সময় নেয়। কথাটা কিভাবে শুরু করবে ভেবে পায় না সে। জোবায়েদা ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন,
“তুই কী বিয়ে শাদীর কথা ভাবছিস?”
“হ্যাঁ।” আনমনে উত্তর দেয় চরণ। জোবায়দা সন্দিহান চোখে তাকান ছেলের দিকে। সর্তক করে বলেন,
“আমি আগেই বলে দিচ্ছে, চয়নের বিয়ের আগে তোকে বিয়ে করাচ্ছিনা আমি। তাই এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল।”
কিচেন সিঙ্কের পাশে হাতে থাকা জগ রাখে চরণ। হেসে বলে,
” তুমি আজকাল বেশি বুঝো মা। আমি আমার বিয়ের কথা বলছি না।”
“তবে কার বিয়ের কথা বলছিস?”
“আর কার? অবশ্যই ভাইয়ার!”
“চয়ন যে কবে বিয়ের জন্য রাজি হবে আল্লাহ জানে। এত করে বলি তাও রাজি হয় না। দেখি এবার ইদে এলে রাজি করাব। তা তুই কী ভাবছিস?”
“আচ্ছা মা, নিতুর খালাতো বোন সুরলাকে তোমার কেমন লাগে?”

খানিক ভাবেন জোবায়েদা। তারপর বলেন,
“দেখতে বাচ্চা লাগে ওকে। ভারী মিষ্টি মেয়ে।”
“ভাইয়ার সাথে ওকে কেমন লাগবে?”
জোবায়েদা অবাক চোখে তাকান ছেলের দিকে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here