কিনারে তুই পর্ব : ৩৬

0
2440

মনের কিনারে তুই
লেখিকা: Tarin Niti
পর্ব: ৩৬

আরিয়ানের প্রশ্নে ওর মা বলে, “এটা আমার দোষের কারণে।আমার কারণে আজকে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছে”

আরিয়ান কিছু বলতে চাইলে তার মধ্যেই ইশার বাবা বলে, “আপনার আবার আসতে পারেন প্লিজ”

আরিয়ানের বাবা কিছু বলতে চাইলে ইশার বাবা বলে,

“আমি আর কিছু শুনতে চাই।আপনারা প্লিজ চলে যান। আর আপনারা যদি ইশার সাথে আরিয়ানের সম্পর্কে নিয়ে কিছু বলতে আসেন তাহলে বলবো এটা কখনোই সম্ভব না”

আরিয়ান ইশার বাবাকে বলে, “আঙ্কেল প্লিজ এভাবে বলবেন না।কি হয়েছিল?”

ইশার বাবা রেগে বলে, “সেটা তোমার বাবার থেকে জেনে নিও। ইশা ওনারা চলে গেলে দরজা আটকে দিস”

বলেই আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে ইশার বাবা চলে যায়।ইশার মাও হাসবেন্ডের পেছন পেছন চলে যায়।আর এখানে সবাই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কি থেকে কি হয়ে গেল ইশা কিছু বুঝতে পারছেনা।উপায় না পেয়ে আরিয়ান ওর মাকে বলে,

“আমাদের এই দু পরিবারের সম্পর্কটা কি সত্যি? তাহলে কি হয়েছিল যে আমরা আলাদা থাকি?ইশার আব্বু এভাবে রেগে গেল কেন?”

আরিয়ানের মা কান্না করতে করতে সোফায় বসতে বসতে বলে, “সব আমার দোষ!আমার কারনেই এইসব হয়েছে”

আরিয়ানের বাবা বলে, ” এখন কান্না করে লাভ নেই। যাই হোক আমি আমার ভাইটাকে খুঁজে পেয়েছি এতেই আমি খুশি।কত বছর ধরে ওকে খু্ঁজছি একটু অভিমান করে আছে সব ঠিক হয়ে যাবে,কান্না করো না”

আরিয়ান ওর বাবার কাছে গিয়ে বলে, “ড্যাড আসলে কি হয়েছিল বলবে?”

আরিয়ানের মা সোফায় বসে বলতে থাকে, “তুই হয়তো জানিস ইশার মা অনাথ, ইশার বাবা আর মা দুজন দুজনকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে।ইশার বাবা পরিবারের কাউকে না জানিয়ে ইশার মাকে বিয়ে করে। তখন তোর দাদি ছিল, কিন্তু দাদু ছিল না।তোর বাবা ব্যবসা সামলাতো আর ইশার বাবা সদ্য পড়াশোনা শেষ করেছে।তোর দাদি প্রথমে ওদের সম্পর্কটা মেনে নিতে চায়নি।তোর বাবা আর আমি তোর দাদিকে বুঝিয়েছিলাম।তারপর আস্তে আস্তে সব ঠিক হতে থাকে। তুই হয়তো এতদিনে ইশার মাকে চিনে গিয়েছিস।ও খুব চঞ্চল একটা মেয়ে। খুব সহজে সবাইকে আপন করে নিতে জানে।অনেক ভালো কাজ জানতো।ওর সব কাজে মুগ্ধ হয়ে তোর দাদী ওকে আস্তে আস্তে ভালবাসতে শুরু করে। আমি ও ওকে ছোট বোনের মতো দেখতাম।কিন্তু ওই যে বলে না হিংসা সবাইকে ধ্বংস করে দেয়।আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। হাসি অনেক ভালো রান্না করতে পারতো বাড়ির সবাই ওর রান্নার প্রশংসা করতো।তোর দাদী আস্তে আস্তে আমার থেকে বেশি হাসিকে পছন্দ করতে শুরু করে।সব কাজে ওকে আগে ডাকতো!আমার এগুলো সহ্য হতো না।
আমি ছিলাম বাড়ির বড় বউ সেখানে আমাকে বাদ দিয়ে সব কাজে আগে হাসি! খুব খুব হিংসে হতো যেই মেয়েটাকে আমি আমার ছোট বোনের মতো দেখতাম সেই মেয়েটার বিরুদ্ধে যেতে লাগলাম।এছাড়া প্রতিবেশীর আত্মীয়-স্বজন সবাইকে যেন হাসি নিজের হাতের মুঠে করে নিয়েছিল। সবাই শুধু হাসির প্রশংসা করতো।আমি এগুলো সহ্য করতে পারতাম না।তাই একদিন রেগে আমার একটা ডায়মন্ডের সেট হাসির রুমে হাসির ব্যাগে রেখে আসি। তারপর বাড়ির সবার সামনে হাসির ব্যাগ থেকে সেটা বার করে,অনাথ মেয়ে হীরা দেখে লোভ সামলাতে পারেনি বলে ওকে চোর অপবাদ দি!”

এইটুকু বলে আরিয়ানের মা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।আরিয়ান অবাক হয়ে ওর মাকে দেখছে।ওর এতো ভালো মাএরকম করতে পারে,আরিয়ানের বিশ্বাস হচ্ছে না!ইশারও বাবা-মার কথা শুনে চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।আরিয়ানের বাবা বলে,

“আমার ভাইটা বউকে অনেক ভালোবাসতো।তাই কেউ বউকে চোর বলেছে সেটা মেনে নিতে পারেনি।ঐদিন হাসির হাত ধরে এক কাপড়ে দুইজন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে!”

আরিয়ানের মা কান্না করতে করতে বলে,
“ওরা চলে যাওয়ার পর আমি বুঝতে পারি কত বড় ভুল করেছি।তারপর আরিয়ানের বাবার কাছে সব স্বীকার করলে ও আমার উপর অনেক রেগে যায়। আমি সবার কাছে ক্ষমা চেয়েছি, এমনকি তোর দাদির কাছেও। তারপর আরিয়ানের বাবা অনেক চেষ্টা করে ওদের খুঁজতে কিন্তু পায় না।হয়তো ওরা এ শহরে ছিলো না।আমার আজও নিজেকে অপরাধী মনে হয়।কিন্তু আজকে ভাবতে পারিনি আবার ওদের সাথে দেখা হবে।একবার যখন পেয়েছি এবার আমি ঠিক ওদের মানিয়ে নিবো”

সবাই কিছুক্ষণ চুপ হয়ে যায়। আসলে ইশা আর আরিয়ান কি বলবে বুঝতে পারছে না।ওদের ঠিক কি বলা উচিত? আগে ইশা যখনই ওর বাবাকে পরিবারের কথা জিজ্ঞেস করতো তখন ওনি একটাই কথা বলতো, আমার কেউ নেই।মাঝে মাঝে রেগে যেতো তাই ইশা আর এসব নিয়ে কথা বলতো না।কিন্তু আজকে এত বড় একটা সত্যি সামনে এলো,,ইশা স্তব্ধ!
আরিয়ার ওর চাচাতো ভাই? হঠাৎ কেন জানি ইশার হাসি পাচ্ছে! কিন্তু এই সিরিয়াস মুহূর্তে হাসা ঠিক হবে না তাই নিজেকে সামলে নে।

আরিয়ানের বাবা ইশার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“তোরা এতোদিন ঢাকায় ছিলি?আমি তোদের এতো খু্ঁজেও পেলাম না!”

“না আঙ্কেল,আমরা ঢাকায় ছিলাম না।আমি তো ছোটবেলা থেকে কুমিল্লায় বড় হয়েছি।কিন্তু ভার্সিটিতে ওঠার পর আব্বু চেয়েছিল আমি ভালো কোনো ভার্সিটিতে পড়ি, তাই আমরা ঢাকায় এসেছি কয়েক মাস হবে”

“ওও..তোরা কুমিল্লায় ছিলি?তাইতো তোদের খুঁজে পাইনি।আমি তো পুরো ঢাকা শহর তোদের তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি।যাক এখন পেয়ে গেছি, নিজেকে বড্ড হালকা লাগছে”

তারপর আরিয়ানের বাবা হেসে আরিয়ানের কাঁধে হাত রেখে বলে,
“এই প্রথম তুই একটা ভালো কাজ করলি,আমার ভাইকে খুঁজে দিলে”

আরিয়ান একটা হাসি দে।আরিয়ানের বাবা বলে,
“ওরা তো চলে গেলো,কথাও হলো না!”

আরিয়ান বলে, “ড্যাড আমার আমার মনে হয় এখন কিছু বলা ঠিক হবে না। এত বছরের অভিমান একটু তো সময় লাগবেই!আজকে বরং চলে যাওয়াই ভালো”

ইশা বলে, “হ্যাঁ আমারও মনে হয় আজকে আপনাদের চলে যাওয়া ভালো হবে।আব্বু যেভাবে রেগেছিল!”

আরিয়ানের বাবা হেসে বলে, “ওর বরাবরই একটু বেশি রাগী।আচ্ছা তাহলে আজকে আসি”

দরজার কাছে গিয়ে আরিয়ান ইশার দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হেসে একটা চোখ টিপ দেয়।ইশা চোখ বড় বড় করে তাকায়।আরিয়ান ঠোঁট কামড়ে বেরিয়ে যায়।ওরা চলে গেলে ইশা দরজা লাগিয়ে পেছন ফিরে দেখে পর্দার আড়াল থেকে ওর মা চলে যাচ্ছে।ইশার মা এতক্ষণ সব কথাই শুনেছে এটা ভেবেই ইশা মুচকি হাসে।

.
পরদিন সকালে খাবার টেবিলে ইশা আর ওর মা-বাবা একসাথে নাস্তা করছে।টেবিলে পিনপিন নীরবতা! শুধু প্লেটের সাথে চামচের আর মাঝে মাঝে গ্লাসের টুং টাং আওয়াজ। কালকে আরিয়ানরা যাওয়ার পর আর ওদের ব্যাপারে কোনো কথা হয়নি। ইশা কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু ওর বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আর বলার সাহস পায়নি।খাবার শেষে ইশা আগে আগে উঠে পড়ে ভার্সিটি যাওয়ার জন্য।ইশা চলে যেতে নিলে ইশার বাবা বলে,

“সাবধানে একটু রাস্তাঘাট দেখে যাবি”

ইশা হাসিমুখে বলে, ” হ্যা আব্বু,তুমি চিন্তা করো না আমি সাবধানেই যাবো”

ইশা দরজার কাছে গেলে কলিংবেল বেজে ওঠে। ইশা অবাক হয়ে ভাবে এই সকালবেলা আবার কে এলো!ইশা দরজা খুলে দেখে আরিয়ানের বাবা দাঁড়িয়ে আছে।ইশা একটু অবাক হয়!তারপর কোনরকমে মুখে হাসি টেনে বলে,

“আসসালামুয়ালাইকুম আঙ্কেল কেমন আছেন?”

আরিয়ানের বাবা হেসে বলে, ” হ্যাঁ ভালো মামনি,তুমি কেমন আছো?”

“জি ভালো”

“তোমার বাবা কই?”

“আছে ভিতরে,আপনি আসুন না”

ইশা আরিয়ানের বাবাকে সোফায় বসতে বলে ভেতরে যায়। গিয়ে দেখে ওর মা টেবিল গোছাচ্ছে ইশার বাবা বসে আছে।ইশাকে ফিরে আসতে দেখে ওর বাবা বলে,

“কিরে, কিছু ফেলে গেলি নাকি?”

ইশা একটু ইতস্ত করে বলে, “আব্বু…আরিয়ানের বাবা এসেছে”

ইশার বাবা অবাক হয়ে ইশার দিকে তাকায়।
তারপর চোখ মুখ শক্ত করে বলে,
“ভাইকে চলে যেতে বল”

তারপর হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে রুমের দিকে চলে যেতে নিলে ইশা বলে,
“ভাই বলছো,আবার এতো অভিমান?”

ইশার বাবা ইশার কথায় একটু থেমে যায়।এবার ইশার মা বলে,
“ওনি কথা বলতে এসেছে এভাবে ওনার সাথে দেখা না করে অপমান করা ঠিক হবে না। তুমি চলো, দেখি কি বলে”

ইশার বাবা অবাক হয়ে বলে, “তুমি এসব বলছো?তুমি কি ঐদিনের অপমানের কথা ভুলে গেলে? তোমাকে কিভাবে চোর অপবাদ দিয়েছিল!তুমি ভুলে গেলেও আমি কিছু বলতে পারব না”

“দেখো যা হওয়ার হয়ে গেছে, উনি তোমার ভাই।একবার দেখা করে এসো”

ইশার বাবা কিছুক্ষণ ভেবে বলে, “আচ্ছা ঠিক আছে চলো..”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here