মনের কিনারে তুই
লেখিকা: Tarin Niti
পর্ব: ৪০
সকাল এগারোটা,,
আর কিছুক্ষণ পর ইশার বাবার অপারেশন।ইশা চুপচাপ বাবার পাশে বসে আছে। ইশার বাবা ইশার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“অপারেশন আমার আর ভয় পাচ্ছিস তুই?”
ইশা বাবার দিকে তাকিয়ে বলে, “তো ভয় পাবোনা?”
এবার আরিয়ানের বাবা ইশার কাছে এসে বলে, “মামনি এতো চিন্তা করার কিছু নেই।এটাতো পায়ের অপারেশন।চিন্তা করিস না”
ইশা ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “হু..”
তখন আরিয়ানের মা বলে, ” ইশা অপারেশনটা করলে তো তোর বাবা ভালো হয়ে যাবে। এতো চিন্তা করিস না”
কিছুক্ষণ পর নার্স আসে ইশার বাবাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার জন্য।আরিয়ানের মা ইশার মাকে চিন্তা করতে বারন করছে।ইশার বাবাকে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর রাইমা আসে তারপর ইশাকে বলে,
“আঙ্কেলকে অপারেশনের জন্য নিয়ে গেছে?”
ইশা রাইমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “হম..”
রাইমা ইশার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “এতো চিন্তা করছিস কেনো?দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। সকালে খেয়েছিস কিছু?”
“আরিয়ান ভাইয়া নাস্তা এনেছিলো”
রাইমা ইশার কথা শুনে হাসে।ইশা কখনো আরিয়ানকে ভাইয়া বলে আবার কখনো শুধু আরিয়ান বলে। মেয়েটা আরিয়ানকে কি ডাকবে নিজেই বুঝতে পারে না।রাইমা ফোনে রিহানের কল আসলে রাইমা ইশাকে ছেড়ে একটু দূরে যায় কথা বলার জন্য।তখন আরিয়ান ইশার কাছে আসে।তারপর বলে,
“ইশা একটু শান্ত হয়ে বসো”
ইশা আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে পাশে থাকা চেয়ারে বসে পড়ে। আরিয়ানেও ইশার পাশে বসে।তারপর
আরিয়ান একটু অস্বস্তি নিয়ে ইশার হাত ধরে।ইশা আরিয়ানের থেকে হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইছে কিন্তু পারছেনা।কিছু একটা ওকে আঁকড়ে ধরেছে।হয়তো এই মুহূর্তে ইশার আরিয়ানকে ওর পাশে চায় বলে আরিয়ানের থেকে হাত ছাড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করছে না। ওরা একটু দূরে বসে ছিলো তাই কেউ দেখেনি কিন্তু ইশার মা ঠিকই দেখেছে।ইশার মায়ের কেন জানি মন থেকে শান্তি লাগছে। এই মুহূর্তে আরিয়ান ইশাকে এতোটা সাপোর্ট দিচ্ছে বলে। কিভাবে ইশাকে আগলে রেখেছে! ইশার মা সে দিক থেকে চোখ সরিয়ে আবার ওটির দিকে তাকায়।
প্রায় এক ঘণ্টা পর ডাক্তার হাসিমুখে বেরিয়ে আসে। সবাই ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার মুখের মাক্স খুলে বলে,
“আলহামদুলিল্লাহ অপারেশন সাকসেসফুল।উনি কয়েক মাসের মধ্যেই হাঁটতে পারবে”
“সবার মুখে হাসি ফুটে ওঠে।ইশা আর ওর মা দুজন খুশিতে কান্না করে দেয়। ইশার মা ডাক্তারকে বলে,
“আর কোনো অসুবিধা হবে নাতো?”
“আশা করি কোনো অসুবিধা হবে না।এবার থেকে ভালো টেক কেয়ার আর প্রতিদিনের ঠিক মতো ওষুধ খেলে ইনশাল্লাহ সুস্থ হয়ে যাবে”
” আমরা কি ওর সাথে দেখা করতে পারি?”
“এখন তো দেখা করা যাবে না। কেবিনে সিফ্ট করার কয়েক ঘন্টা পর দেখা করতে পারবেন”
ইশার মা হাসিমুখে বলে, ” আচ্ছা ঠিক আছে। আমি অপেক্ষা করবো”
দুপুর তিনটার দিকে ডাক্তার দেখা করার পারমিশন দে। ইশা আর ওর মা আগে কেবিনে যায়।ইশার বাবার পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা, পা উঁচু করে স্ট্যান্ড এর সাথে বেঁধে রাখা। চোখ বুজে আছে।ইশার মা গিয়ে নিঃশব্দে ইশার বাবার পাশে বসে। ইশা মায়ের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে। ইশার বাবা চোখ খুলে সামনে মেয়ে আর বউ কে দেখে একটা হাসি দেয়। ইশার মা কিছু বলে না চুপচাপ ইশার বাবার হাত ধরে বসে থাকে।
কিছুক্ষণ পর আরিয়ানের মা-বাবাও কেবিনে প্রবেশ করে।আরিয়ানের বাবা ইশার মাকে বলে,
” হাসি একদম চিন্তা করো না, আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে এসেছি।ভাই একদম ঠিক হয়ে যাবে”
কিছুক্ষণ পর কেবিনে ডাক্তার প্রবেশ করলো ইশার মা উঠে দাঁড়ায়। ডাক্তার ইশার বাবার কাছে এসে চেকআপ করে। ইশার মা ডাক্তারকে বলে,
” ওকে কবে বাসায় নিয়ে যেতে পারবো?”
“আজকে অপারেশন হয়েছে।২/৩ দিন তো থাকতেই হবে।তিনদিন পর নিয়ে যেতে পারবেন”
তারপর আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ডাক্তার চলে যায়। ডাক্তার চলে গেলে আরিয়ানের বাবা বলে,
” ভাই এবার সোজা তুই তোর নিজের বাড়ি যাবি”
ইশা বাবাকে বলে, “আমরা ওই বাড়িতে কেনো যাবো না। যেখানে আছি সেখানেই থাকবো”
আরিয়ানের বাবা বলে, “আগের বাড়িতে থাকবি মানে? তুই আমাদের বাড়িতে যাবিনা?”
তখন ইশার মা বলে, ” আমরা আগের বাসায় থাকবো।প্লিজ আর জোর করবেন না”
ইশার মায়ের কথা শুনে আরিয়ানের মা ইশার মায়ের কাছে এসে বলে, “হাসি তুই এখনো আমাকে ক্ষমা করতে পারিস নি তাই না?”
ইশার মা হেসে বলে, “না না কি বলছেন?আমি তো আপনাদের কবেই ক্ষমা করে দিয়েছি”
“তাহলে বাড়ি যাবিনা কেন?”
“আসলে..”
“আমি আর কিছু শুনতে চাই না।তোরা হাসপাতাল থেকে সোজা আমাদের বাড়ি যাবি”
আরিয়ানের বাবা ইশার বাবাকে বলে, “হ্যাঁ ভাই।আমি আর তোকে দূরে রাখতে চাইনা। তাছাড়া তুই এখন অসুস্থ আমাদের সবার মধ্যে থাকলে ভালো হবে।তুই রাজি হয়ে যা”
ইশার বাবা ইশার দিকে তাকায়। ইশা কেবিনের এক কোনায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে আর সবার কথা শুনছে।ইশার বাবা হাতের ইশারায় ইশাকে কাছে ডাক। ইশা গুটিগুটি পায়ে বাবার কাছে আসে।ইশার বাবা ইশার দিকে তাকিয়ে বলে,
“ইশা তুই বল।তোর নিজের বাড়ি যাবি?”
ইশা সবার দিকে তাকায়, সবাই এখন ওর দিকে তাকিয়ে আছে!ইশা আমতা আমতা করে বলে,
“আমি কি বলবো?তোমরা যেটা বলবে সেটাই”
.
ইশা আজকে অনেক খুশি।কিন্তু ও এতো খুশি কেনো নিজেই বুঝতে পারছেনা। আজকে ওরা নিজেদের বাসায় যাবে। ইশার বাবা অপারেশনের তিন দিন হয়ে গিয়েছে।ডাক্তার বলেছে এখন বাসায় নিয়ে যাওয়া যাবে।মাঝে মাঝে চেকআপের জন্য আসতে হবে। ঐদিন আরিয়ানের মা-বাবা এতো করে বলার পর ইশার বাবা রাজি হয়ে যায়।
ইশার বাবাও নিজের বাড়ি যেতে চায়।কত বছর আগে নিজের বাড়ি ছেড়েছে। আবার আগের মতো সবাই একসাথে থাকবে। তাছাড়া এতোবছর রাগ করে থেকে কি লাভ!
আর এদিকে আরিয়ান তো খুশিতে শেষ।ও কি করবে বুঝতে পারছে না। এবার থেকে ইশা আর ও এক বাড়িতেই থাকবে।আরিয়ানের প্রচুর খুশি লাগছে।আরিয়ান কেবিনে ঢুকে সবাইকে বলে,
“সব রেডি,, চলো”
আরিয়ানের মা আজকে আসেনি।ইশারা যাবে তাই ওদের রুম পরিষ্কার করা হচ্ছে।উনি সার্ভেন্টদের দেখিয়ে দিচ্ছে। আরিয়ান আর ওর বাবা ইশাদের নিতে আসে।আরিয়ানের বাবা ইশার বাবাকে ধরে হুইল চেয়ারে বসায়।তারপর হসপিটালের সব ফর্মালিটি পূরণ করে ওরা গাড়িতে উঠে।
ইশা ওর বাবার কিছু ওষুধ বাকি ছিল ওগুলো নিয়ে একটু পরে আসে।এসে দেখে ওর মা-বাবা গাড়ির পেছনের সিটে বসে আছে আর ইশার বাবার পাশে আরিয়ানের বাবা। ড্রাইভিং সিটে আরিয়ান।এখন শুধু আরিয়ানের পাশের সিট টাই খালি আছে!ইশাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওর মা বলে,
“কি রে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?গাড়িতে উঠ”
ইশা আর কোনো উপায় না পেয়ে গাড়িতে উঠে আরিয়ানের পাশের সিটে বসে।আরিয়ান ইশার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দেয়।আরিয়ানের হাসিটা ইশার কাছে অসহ্য লাগছে। এবার থেকে প্রতিদিন এই অসহ্য টাকে দেখতে হবে!ভাল্লাগেনা..
বাড়ির গেটে দিয়ে গাড়ি ঢুকলে ইশা অবাক হয়ে চারদিক দেখছে। দুপাশে ফুলের বাগান মধ্যে দিয়ে রাস্তা।সামনে একটা দোতলা ডুপ্লেক্স বাড়ি।ইশা গাড়ি থাকেই ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে বাড়িটা দিকে।এটা ওদের বাড়ি ইশার বিশ্বাসই হচ্ছেনা!
ও এত বড় বাড়ির মেয়ে? ইশার বাবাও নিজের বাড়ীটাকে দেখছে।কিচ্ছু বদলায়নি, সব মনে হয় আগের মতোই আছে।ওনার চোখ ছল ছল করে ওঠে।
সবাই গাড়ী থেকে নামলে আরিয়ানের মা হন্তদন্ত করে আসে।
তারপর হাসি মুখে বলে, “আরে তোমরা এসে পরেছো?এসো ভিতরে আসো”
ইশার মা চোখ ঘুড়িয়ে সবকিছু দেখছে।বিয়ের পর যখন প্রথমে বাড়িতে এসেছিল তখন অন্যরকম একটা অনুভূতি হয়েছিলো।আজকেও কেন জানি সেই অনুভূতি হচ্ছে। যদিও ইশার মা এই বাড়িতে বেশিদিন থাকেনি,দুই তিন মাস হবে।তবুও বাড়িটার প্রতি একটা টান অনুভব করে। শত হলে ওনিয়ে এই বাড়ির বউ। আরিয়ানের বাবা বলে আরিয়ানের মাকে বলে, “সব ঠিকঠাক আছে তো?”
” হ্যাঁ সব পরিস্কার করা শেষ”
আরিয়ানের বাবা ইশার বাবাকে বলে, ” তোদের রুমটা নিচে দিয়েছি।তুই তো এখন উপরে যেতে পারবি না”
ইশার মা বলে, “হ্যাঁ, আমাদের নিচেই ঠিক আছে”
আরিয়ানের মা বলে, “তোমরা সবাই হসপিটাল থেকে এসেছো।এখন রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।আর ইশা তোমার রুমটা উপরে। আরিয়ান ইশাকে ওর রুমটা দেখিয়ে দে তো”
ইশার মা ইশাকে বলে, “যা মা রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে।তোর উপর দিয়ে অনেক ধকল গিয়েছে”
ইশা একটু হেসে বলে, “যাচ্ছি।তোমরাও একটু রেস্ট করো”
তারপর ইশা আরিয়ানের দিকে তাকায়। আরিয়ান চোখের ইশারায় ওর পিছনে আসতে বলে।ইশাও আরিয়ানের পিছু পিছু যায়।আরিয়ান সিড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে একটা রুমের সামনে দাঁড়ায়।তারপর রুমের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে।ইশা লাগেজ নিয়ে ভেতরে ঢুকে। ইশা আগের বাসা থেকে বেশি জামাকাপড় আনেনি।আস্তে আস্তে সব আনবে।এখন শুধু একটা লাগেজে ওর সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এনেছে।আরিয়ান ইশার দিকে তাকিয়ে বলে,
“এই যে ম্যাডাম আপনার রুম পছন্দ হয়েছে?”
ইশা চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়।ঠিক ওর পছন্দ মতো একটা রুম। রুমের রংটা আকাশী কালার। আরিয়ান জানে ইশার আকাশী রং অনেক পছন্দের।
আকাশী রঙ্গের সাথে পর্দা গুলো সাদা। আকাশী আর সাদার কম্বিনেশনে ফার্নিচার গুলোও।রুমটা দেখলে মন প্রশান্তিতে ভরে যায়। ইশা ঘুরে ঘুরে রুমটা দেখছে তখন আরিয়ান বলে,
” তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও আমি আসছি”
এটা বলে আরিয়ান চলেছে যায়। ইশা আরিয়ানের পিছু পিছু ওর রুমের দরজার সামনে আসে। দেখে আরিয়ান ওর রুম থেকে আরও দুই রুম পরে একটা রুমে ঢুকছে।ইশা ভাবে হয়তো এটাই আরিয়ানের রুম।ওর রুম থেকে এতো কাছে!
চলবে…