আমার সামনেই আব্বা আম্মার গলা চেপে ধরলেন।আমি বাধা দিতে গেলে আমাকেও ধাক্কা দিলেন।
পড়ে গিয়ে মাথাটা টাবিলের কোনায় লেগে বেশ ব্যাথা পেলাম।আর মা তো একটু অক্সিজেনের জন্য গোঙাচ্ছিলো।চোখও উল্টে যাওয়ার মতো অবস্থা।মায়ের অবস্থা বেগতিক দেখে মা’কে ছেড়ে দিলেন বাবা।ছাড়া পেয়ে কাশতে কাশতে বসে পড়লেন মা।সেইসাথে চোখ দিয়েও পানি বের হয়ে গেলো।বাবা গর্জন করে বললেন,’আমার কথার খেলাফ করলে এর চেয়েও ভয়াবহ শাস্তি আছে মা মাইয়ার।যা ওরে রেডি কর।পাত্রপক্ষ আসবো।’
এটা বলেই বাবা চলে গেলেন।বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আমি কাঁদতে কাঁদতে আম্মার কাছে এসে বললাম,’এখন কি হবে আম্মা।’
‘জানি না।’আম্মা কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিলেন।
আমাদের দো’তলা এই বাড়িটা করার জন্য বাবা একজনের কাছ থেকে মোটা টাকার লোন নিয়েছিলো কিন্তু তা শোধ করতে না পারায় লোকটা বারবার বাবাকে চাপ দেয় টাকা পরিশোধ করার জন্য।কিন্তু বাবা সামান্য একটা চাকরি করে এতোটাকা আনবে কোথা থেকে।তো একদিন লোকটা বাবাকে প্রস্তাব দেয় হয় লোনের টাকা দিতে হবে নয় আমাকে তার ছেলের সাথে বিয়ে দিতে হবে।টাকা দেওয়া তো সম্ভব না বাবা আমাকেই ওই লোকের ছেলের কাছে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।জন্ম থেকেই আমার গায়ের রঙ কালো।তাই নানান জনে নানান কথা।অনেকের ভবিষ্যৎ বাণী অনুসারে আমাকে বিয়ে দিতে অনেক বেগ পেতে হবে।ভালো জামাই জুটবে না একমাত্র গায়ের রঙ শ্যামলা বলে।জন্মের পর থেকেই আত্মীয় স্বজন এমনকি আমার বাবারও আমার বিয়ে নিয়ে প্রচুর চিন্তা ছিলো কিন্তু মা কখনোই আমাকে গায়ের রঙ নিয়ে কিছু বলতো না।এমন নয় যে আমার মা কালো!আমার মা বাবা দু’জনই ফর্সা।বাবা মায়ের মতো দুই ভাই হলেও আমি হলাম না।যাইহোক আমাকে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা হয়তো এবার বাবার মাথা থেকে নামলো।এমন ছেলে কোথায় পাওয়া যাবে যে কালো মেয়েকে বিয়ে করবে তাও যৌতুক ছাড়া!বিয়ের বাজারে কালো মেয়েদের দাম নেই।যতো দাম গল্প,উপন্যাসে।বাস্তবে ভালোবাসা কালো মেয়েদের জন্য নয়।কখনো কোনো কালো মেয়েকে কেউ ভালোবাসে নি!ভালোবেসে কৃষ্ণবতী বলেও ডাকে নি। আর এমন কালো মেয়েকে যে বিয়ে করতে চাইলো তাকে একদমই হাতছাড়া করতে চাইলেন না বাবা।
কিন্তু মা এই বিয়ের পক্ষে না।তিনি চাইতেন আমি যেনো নিজের পায়ে দাড়াই কেউ যেনো আমাকে আমার গায়ের রঙ নিয়ে খোঁটা না দেয় সবাই যেনো আমার গুণটাই দেখে।কিন্তু মায়ের এই প্রতিবাদটাই কাল হলো তার জন্য।বাবার হাতে মারও খেলো।আর মায়ের কষ্ট ছোটো থেকেই আমি সহ্য করতে পারি না।তাই বুকে পাথর বেঁধে সাজতে বসলাম।
আমাকে সাজিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো পাত্রপক্ষের সামনে।আজই বিয়ে।খুব সাদামাটা ভাবেই আমার বিয়েটা হয়ে গেলো।মা আটকাতে চেয়েও পারলেন না।আমার তো কষ্টে চোখ দিয়ে কান্নাই বের হচ্ছে না।পাথর হয়ে গেছি মনে হচ্ছে।বিদায়ের সময় মা’কে জড়িয়ে ধরে কাঁদলাম কিন্তু বাবার কাছেও গেলাম না কেনো যেনো প্রচন্ড রাগ হচ্ছে আমার।ঋণের টাকার জন্য এভাবে আমাকে বিক্রি করে দিলো!
ছোটো ভাই দু’টোকে আদর করে আমি গাড়িতে উঠে বসলাম পাশে ‘স্বামী’ নামের মানুষটা বসলো।সামনে ড্রাইভার আর ওনার কোনো আত্মীয় হবে হয় তো!আমি জানালার বাইরে তাকিয়ে গুমরে গুমরে কাঁদছি।পাশে যে একটা মানুষ বসে আছে সেদিকে আমার খেয়ালই নেই।থাকবে কিভাবে সবচেয়ে বড় আঘাতটাই তো সহ্য করতে পারছি না।শ্বশুর বাড়ি আসার পর শ্বাশুড়ি আর কিছু মহিলা আসলো আমাকে বরণ করতে।ভেতরে নিয়ে বসানো হলো আমাকে।আশেপাশের প্রতিবেশীরা আমাকে দেখতে আসলো।যেই আসে দেখে আর বলে,’মেয়েটা তো কালো।আর মেয়ে ছিলো না?এটাকেই আনতে হলো।’
বেশিরভাগেরই এসব কথা শুনে আমার খুব খারাপ লাগছিলো।চিৎকার দিয়ে কান্না করতে ইচ্ছা করছিলো কিন্তু পারলাম না নতুন বউ বলে!অবশ্য ছোটকাল থেকেই এসব কটুকথা আমি শুনে এসেছি।যেনো দুনিয়ার সব কালো আমার শরীরে মাখিয়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেশীরা চলে যাওয়ার পর আমাকে কয়েকটা মেয়ে মিলে ঘরে দিয়ে চলে গেলো।আমি চুপচাপ বসে আছি হঠাৎ একটা মেয়ে ঢুকলো আমার ঘরে।আমি ওনার দিকে তাকালাম দেখলাম আমার দিকেই তাকিয়ে আছে ছলছল দৃষ্টিতে।অনেক সুন্দরী সে।মেয়েটা বোধহয় আমাকে কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু পারলো না তার আগেই পেছন থেকে কেউ কড়া গলায় বলল,’নতুন বউয়ের ঘরে কি করো সেতু?এদিকে আসো আম্মা ডাকে।’
সেই ডাকেই বেরিয়ে গেলো মেয়েটা আমি অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম সেদিকে।এই মেয়েটা কে হতে পারে?
এই প্রশ্ন মনে আসলেও উত্তর জানা নেই।এখানো কাউকে ঠিকমতো চিনিও না আমি।এরা যৌথ পরিবার।সবাই একসাথে থাকে।
রাত এগারোটায় একটা লোক ঘরে ঢুকলো বুঝলাম।ইনিই স্বামী।লোকটার নাম মাহমুদ।নিচে নামলাম সালাম করার জন্য।সালাম করে উঠে দাড়ালাম।মাহমুদ হ্যাঁ,না কিছুই বলল না।তাই আমিও আর কিছু না বলে বিছানায় বসলাম।সে আমার দিকে একনজর দেখে ওয়াশরুমে চলে গেলো।আমি খাটের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম।হয়তো তার বউ পছন্দ হয় নি!হতেই পারে!
চোখ বন্ধ করার কিছুক্ষণ পরই টের পেলাম আমার শরীরে একটা হাত ঘোরাফেরা করছে।চট করেই চোখ খুলে ফেললাম।দেখলাম সাথেই মাহমুদ শুয়ে আছে।আমি বললাম,’আমার অস্বস্তি লাগছে!আমাকে সময় দিন কিছুদিন।’
গম্ভীর গলায় বলল সে,’সময় দেওয়ার জন্য কিন্তু বিয়ে করি নি আমি।’
তারপর আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না।কারণ আমার মুখ চেপে ধরে রেখেছিলো।কষ্ট পাচ্ছিলাম খুব।এই সতেরো বছর বয়সে এই কষ্ট যেনো বেশিই হয়ে যাচ্ছিলো।মুখফুটে কিছু বলতে না পারলেও চোখের পানি কথা বলছিলো শব্দহীন!
এখন মধ্যরাত বিয়ের শাড়িটা কোনোরকম পেচিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার ছেড়ে বসে রইলাম।ঠান্ডা পানি আমার শরীর বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিলো সাথে বাধ না মানা অশ্রু!প্রায় ঘন্টাখানেকের মতো ভিজে আমি ঠান্ডায় কাঁপছি।কোনোরকমে জামাকাপড় পরে খাটে শোয়া মাত্রই মাহমুদ আমাকে লাথি মেরে নিচে ফেলে দিলো।অন্ধকারে হিসহিসিয়ে বলল,’ভোরে গোসল করলে চলতো না?এখনি গোসল করলি কেনো?খাটে উঠবি না একদম।’
আমার কান্না পেয়ে গেলো।মেঝেতে শুয়েই কাঁদছিলাম।কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি জানি না।আজানের সময় ঘুম ভাঙলো আমার।দেরি করে ঘুমালেও সবসময়ই খুব ভোরেই ঘুম ভাঙে আমার।তবে মাথাটা প্রচন্ড ব্যাথা করছে ঠিকমতো ঘুম না হওয়ায় তবুও আমি উঠলাম।খাটের দিকে একবার তাকাতেই দেখলাম মাহমুদ ঘুমাচ্ছে।দরজা খুলে বাইরে চলে এলাম।এখনো কেউ ওঠে নি।আমি নিচে নেমে রান্নাঘরে আসলাম চা করতে কিন্তু এসে দেখলাম একটা মেয়ে দাড়িয়ে রুটি বানাচ্ছে।পাশে গিয়ে দাড়াতেই দেখলাম কাল রাতের সেতু নামের মেয়েটা।সেতু আমাকে দেখে খানিকটা চমকালেও পরবর্তী মুহুর্তে একটুখানি হেসে বলল,’এতো তাড়াতাড়ি উঠে এলেন কেনো?’
আমি বললাম,’এমনিই।আচ্ছা আপনি কাল বোধহয় আমাকে কিছু বলতে চেয়েছিলেন।’
সেতু আমার দিকে চেয়ে একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,’না,কিছু না।’
‘প্লিজ বলুন না!’আমি মরিয়া হয়ে বললাম।
‘আপনাকে এই বাড়িতে কেনো আনা হয়েছে জানেন?’সেতু আমার দিকে চেয়ে জিগ্যেস করলো।
আমি বললাম,’কেনো?’
‘বিক্রি করে দেওয়ার জন্য।’
চলবে…….
#কৃষ্ণবতী
#পর্বঃ০১
#Arshi_Ayat
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।নতুন গল্প দিলাম।সবাই রেসপন্স করবেন আশাকরি।)