#কল্পনার_কলমদানি
#চন্দ্রা
গল্প : রঙ মিশেলে সেই দশমীর বিকেল—০৫(অন্তিম পর্ব)
আজ আমার চোখের জল ও কুশলের থেমে যাওয়ার কারণ হল না। ওর রাগ আজ মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। আমি ছলছল চোখে তাকাতেই ও এগিয়ে এসে আমার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরল। প্রচন্ড লাগছে। কিন্তু আমি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছি। কুশল দাঁতে দাঁত চেপে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর আমাকে ছেড়ে নীচে নেমে গেল। আমি ওখানেই বসে কেঁদে উঠলাম।
বেশ কিছুক্ষণ পর চোখ মুখ মুছে নীচে নামলাম। সবাই তখনও ড্রয়িং রুমে বসে আছে। কুশল ও সবার সাথেই আছে। বাবা ওর সাথে কথা বলছে। আমি সবার নজর বাঁচিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলাম। হাত মুখ ধুয়ে ঠিকঠাক হয়ে নিলাম। বাইরে এসে সবার সাথে বসলাম। কিন্তু আমার মা যেন কিছু আঁচ করে , একদুবার আমাকে জিজ্ঞেস করে ফেলেছে। আমি কোনো রকমে এড়িয়ে গেছি। সবার সাথে কথা বললেও কুশলের দিকে তাকানোর সাহস আর হয়নি আমার।
প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। শরৎের শেষ বেলায় আজ আকাশে হাজার রঙের কারসাজি। তার দিকে আজ তাকানো দায় হয়েছে। ডুবন্ত সূর্য আর উত্থিত সন্ধ্যা। অদ্ভুত এক রঙের সমন্বয়। আমি ছাদের কোনে দাঁড়িয়ে আছি। এখান থেকেই রাস্তার মোড়ে দাঁড়ানো কুশল কে দেখা যাচ্ছে। আমার বাবা ওদের ফিরে যাওয়ার সময় এগিয়ে দিতে যাচ্ছে। আমি একদৃষ্টিতে যতদূর কুশল কে দেখা যায় দেখে নিচ্ছি। কে জানে আজকের পর আর কখোনো দেখা হবে কি’না…..?! আজ দশমীর বিকেলেই সব হয়ত শেষ হয়ে গেল!
“কেন আসো কল্পনার পসরা সাজিয়ে?
আমার ভাবনার কারাগার থেকে আজ মুক্ত তুমি।
শুনেছ? তুমি মুক্ত!
আমার ছায়া অবসরে, আজ থেকে তোমার পদ শূন্য।
চাইব না আর, তোমার অদৃশ্য ছোঁয়া,
সেই একমুহূর্তের স্বপ্নিল চাওয়া পাওয়া।
কাল্পনিকতায় ধুলো জমিয়েছি যে!”
ডায়েরি টা বন্ধ করেই চোখ বুজলাম। বিরক্ত লাগছে। সেই বিকেলে কুশলরা চলে যাবার পরেই সেই যে ঘরে ঢুকেছি আর বাইরে যাই নি। কুশলের তখনকার চড়টার কথা মনে পড়লেই কান্না পাচ্ছে। ওকেও ঠিক দোষারোপ করতে পারছি না। হয়ত আমার অতটা এগিয়ে না গেলেও হতো। কিন্তু আমিই আর কত সহ্য করতাম….?! কুশল দুদিনে একটু শান্ত হয়ে কথা ও বলেনি আমার সাথে। কথা গুলো মনে করতে করতেই আবার ও কেঁদে ফেললাম। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। সাসু মা কলিং। আমি চোখ মুছতে মুছতেই কল রিসিভ করলাম।
– হ্যালো!
– মিথি!….আমি বলছি। কি করছিস মা…?!
– এই তো। তেমন কিছু না।
– আজ কি হয়েছিল তোর?! সারা দুপুর মন খারাপ করে ছিলিস কেন….?!
এবার আমি থতমত খেয়ে গেলাম। আমার মা তো বুঝেই ছিল এখন কুশলের মা ও বুঝে গেল!
– কি হল? বল ! কি হয়েছিল আজ?! ……….কুশল কিছু বলেছে তাই না’রে?! ওর সাথেই কিছু হয়েছে তাই তো?!
এবার মনে হয় আবার কেঁদেই ফেলব। কি ভাবে যে মায়েরা সব বুঝে ফেলে….?!
– এই মেয়ে! হয়েছে টা কি…?!
– কি আর হবে…..?! তোমার ছেলে চড় মেরেছে আমাকে।
– ছিহ্?! বাবান….?! ওর এত সাহস!
এবার আমি বাঁকা হাসলাম। কেন জানিনা কুশলের ব্যাপারে আমার মনটা দিন দিন মহাশয়তান তৈরী হচ্ছে….?!
– হ্যাঁ। জানো কত জোরে মেরেছে….?!
– কেন মেরেছে রে….?! ওর এত সাহস তোর গায়ে হাত তোলে…?! কি করেছিস তুই?!
এই রে! এবার কি বলব?! আসল কারণ টা মরে গেলেও বলতে পারব না।
– কি’রে বল! কেন মেরেছে তোকে?!
– জানিনা । হঠাৎ রেগে গিয়ে মেরে দিল। তারপর ছাদ থেকে নেমে গেল। তোমার রাক্ষস ছেলের মতিগতি আমি বুঝি না।
– দাঁড়া ওকে আমি দেখছি! ওর এত রাগ কিসের?!….আসলে কি জানিস তো পুরুষজাতি এমনই হয় সহজে কিছু পেলে এমন পায়েই ঠেলে।
কুশলের মা বকবক করলেও আমার এবার ভয় লাগছে। কুশল যদি রাগের বসে সত্যি টা বলে দেয়?! তাহলে তো আমি লজ্জায় শেষ!
– না না । তুমি ওকে কিছু বোলো না।
– বলব না মানে?! দেখ আমি কি করি….?!
উনি কল কাট করলেন। এদিকে আমার চিন্তা শুরু হল।ধ্যাত…..কি যে করি না আমি?! এখন ওই কুশল কোনো ঝোলঝাল না করলেই হল!
পরদিন দুপুরে…..
আমি সেই কাল থেকেই ফোন হাতে ঘুরছি। কিন্তু কিছুতেই কুশলের মা’কে কল করতে পারছি না। লজ্জা লাগছে। যদি কুশল ওনাকে সত্যি টা বলে দিয়ে থাকে….?!
বাবা বাড়িতে নেই। মা ও নিজের কাজে ব্যস্ত। আর আমি চিন্তা করে মরছি। আশ্চর্য জনক ভাবে কুশল কে পাওয়ার নেশাটা আর কাজ করছে না। কোথাও না কোথাও এই ব্যাপারটা নিয়ে নিশ্চিন্ত আছি।
হঠাৎ ডাইনিং টেবিলের উপরে রাখা মায়ের ফোনটা বেজে উঠল। বাবার নম্বর দেখে আমিই কলটা রিসিভ করলাম। আমি হ্যালো বলার আগেই বাবা বলে উঠল,
কুশলের অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেছে। খুব গুরুতর কিছু নয়।আমি হসপিটালে যাচ্ছি দেরি হবে ফিরতে।
– কোন হসপিটাল বাবা?!
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বলতেই বাবা বলল, ওহ্ মিথি! চিন্তা করিস না মা কুশল একদম ঠিক আছে। তেমন কিছু হয়নি।….ওর বাইকের সামনে একটা কুকুর হঠাৎ চলে আসায় ডিজব্যালেন্স হয়ে গেছিল। এখন ঠিক আছে মা।
এই মুহূর্তে আমি ট্রেনে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছি। বিকেল হয়ে সন্ধ্যা নামবে। কেঁদে ইতিমধ্যেই চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছি। কুশলের অ্যাক্সিডেন্ট এর কথা শুনে আর ঘরে থাকার ইচ্ছে হয়নি। মাকে জানিয়েই বেরিয়ে এসেছি। এখন তো এই ট্রেনটাও বিরক্ত লাগছে। একটু তাড়াতাড়ি চলতে পারে না?! কে জানে কুশল কেমন আছে….?!
হসপিটালের রিসেপশন থেকেই বেরিয়ে এলাম। কুশল কে একটু আগেই বাড়িতে নিয়ে গেছে। এখন ওর বাড়িতেই যেতে হবে। বাবা ও ওখানেই আছে।
আমি হন্তদন্ত হয়ে কুশলদের বাড়িতে ঢুকতেই নজরে এল সেই ছেলেগুলো। ওরাও কুশলদের বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখেই সরে গেল। আমি দৌড়ে বাড়িতে ঢুকলাম। ড্রয়িং রুমে আমার আর কুশল দুজনের বাবা বসে আছে। আমাকে দেখেই বাবা উঠে এল। আমার চোখ মুখ মুছিয়ে বলল, কি অবস্থা করেছিস নিজের মা…?! কুশল ঠিক আছে। আয় দেখবি চল।
আমি বাবার সাথেই চললাম। কুশলের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বাবা আমাকে ভিতরে যেতে বলে চলে গেল। আমি ঘরে ঢুকলাম। বিছানায় বসে কুশল আর ওর মা ওকে খাইয়ে দিচ্ছে। কুশলের মাথায় , ডান হাতে আর পায়ে ছোটো ছোটো ব্যান্ডেজ।
দুজনেই আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
– আয় ! এই সন্ধ্যা বেলা একা একা চলে এসেছিস… ?! চোখ মুখের ও কি অবস্থা…?!
আমি একটু হাসার চেষ্টা করলাম।
– দেখেছিস বাবান! এই মেয়েটাকে কাল তুই মেরেছিস আর আজ দেখ! ও তোর জন্য ছুটে ছুটে চলে এসেছে। কবে আর মর্ম বুঝবি….?!
আমি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছি। কুশলের মা ওর মুখ মুছিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আমি ও ওনার পিছু পিছু বেরোতে গিয়েও থেমে গেলাম।
– দাঁড়াও!…..এদিকে এসো।
আমি তবুও ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম।
কুশলের আবার ধমকে উঠল, আমি তোমাকে এদিকে আসতে বলেছি!
অসহ্য রাক্ষস! কোনোদিন কথাই বলতে শেখেনি!….. মুখ খুললেই ঝাড়ি মারে!
আমি চুপচাপ এগিয়ে গেলাম।
– মা’কে বলে দিয়েছ আমি তোমাকে মেরেছি….?!
আমি চুপ!
– কি হল?!…..বলেছ মা’কে?!
আমি মাথা নাড়লাম।
– এটা বলেছ যে কেন মেরেছি….?! কি হল? মেরেছি সেটা যখন বলতে পেরেছ তাহলে কারণটা বলোনি কেন…..?!
এবার আমার রাগ হচ্ছে।
– বুদ্ধিসুদ্ধি কি নেই…?! আমি কি মা’কে বলব যে আমি…..
এতটুকু বলেই থেমে গেলাম।
– হ্যাঁ। যে তুমি…?! কি হল?! সেন্টেন্সটা কমপ্লিট করো !
– পারব না। বুঝেছ….?! আমি পারব না!
আমি বিরক্ত হয়ে চিৎকার করে বললাম। আর ওই খচ্চরটা হেসে বলল, তো কি পারো….?! কিসটাও তো ঠিক করে করতে পারো না!
ছিহ্, কি অসভ্য…?! এবার তো আমার লজ্জা লাগছে।
আমি মাথা নীচু করেই দাঁড়িয়ে রইলাম। যদিও আড়চোখে কুশল কে দেখছি।
ও পা ভাঁজ করে কোনোরকমে বসতে বসতে বলল, তবে ঠোঁটের টেস্ট টা দারুন । আই লাইক ইট!
হে ভগবান! আমার পক্ষে আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না। আমি সরে যেতে গেলেই কুশল আমার হাতটা চেপে ধরল। এদিকে আমি শুকনো ঢোক গিলতে গিলতেই নিজের হার্টবিট শুনতে পারছি।
– এই যে ম্যাডাম! সারা জীবন আমার কাছে কিস করা শিখবে….?!
হায় রাম! এ সব কি কথা….?! আমি আমার হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পারছি না।
– উঁহু, এত সহজ নাকি ছাড়িয়ে নেওয়া….?! তুমি ফেঁসে গেছো।…তোমার জন্য কাল আমার মা আমাকে চড় মেরেছে। অনেক কথা শুনিয়েছে। আর এই সব কিছুর জন্য দায়ী তোমার ওই আনারি টাইপ কিস।……তাই আমি সারা জীবন তোমাকে কিস করা শেখাবো। আর তুমি শিখতে বাধ্য।
লজ্জা লাগলেও মুচকি হাসলাম আমি। আড়চোখে তাকাতেই নজরে এল কুশলের ঘরের ড্রেসিং টেবিলের আয়নার দিকে। ওই আয়নার মধ্যেই কুশল আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। আমি তাকাতেই চোখ মেরে হেসে ফেলল শয়তানটা! আর আমি ঘুরে সোজা ওর বুকে মুখ লুকিয়ে ফেললাম।
সেদিনের পর বছর ঘুরে আজ আবার বিজয়া দশমী। আমাদের বিয়ের পর প্রথম পূজো। হ্যাঁ, তিন দেবতার কারসাজিতে সেই দিনের ঠিকানাটাই আমার বর্তমান ঠিকানা। চওড়া লাল পাড় সাদা রঙের বেনারসী। সিঁথিতে মোটা করে সিঁদুর, হাতে শাখা পলার সাথে সোনার চুড়ি। খোঁপার মালাটা ঠিকঠাক আটকে নিলাম। আজ প্রথমবার মামনি মানে কুশলের মায়ের সাথে ওদের পাড়ার মন্ডপে সিঁদুর খেলতে গিয়েছিলাম। আমার গালে আর কপাল জুড়ে সিঁদুরের লাল। মামনি আর বাবাই কে প্রণাম সেরে ঘরে ঢুকতেই কোথা থেকে কুশল আমাকে আঁকড়ে ধরল। আর কিছু বোঝার আগেই ওর মুঠো ভর্তি সিঁদুরে আবার আমার সিঁথি রাঙিয়ে দিল। আমি চোখ বুজে ফেললাম। চোখ খুলতেই আমার গালে সিঁদুর রাঙিয়ে দিল। আমিও কুশলের দু গালে সিঁদুর লাগিয়ে দিলাম। ওকে প্রণাম করতে গেলেই আমাকে আটকে বলল,
– উঁহু, এসব প্রণাম করে আমার মন গলবে না। আমি তো স্পেশাল তাই না….?! তাই এক্সপেনসিভ জিনিস চাই।
কথাটা বলেই আমার ঠোঁট জোরা দখল করে নিল। আমিও বাঁধা দিলাম না। কিছুক্ষণ পর আমাকে ছেড়ে নিজের ঠোঁট মুছতে মুছতে বলল, উফ! তুমি এখোনো শিখলে না…! ঠিক আছে। আমি তো আছি সারা জীবন শেখাবো।
চোখ মেরে দিল অসভ্যটা। কি জ্বালাতন…..?!
“কোনো এক সিঁদূরে দিনে শুরু আমাদের গল্পের পাতাটা,
মনে পড়ে কি?!
ওই যে, রঙ মিশেলে সেই দশমীর বিকেল।”
***********************************