ঘাসেদের ফাগুন পর্ব ৬

0
521

ঘাসেদের ফাগুন পর্ব-৬
__________🖌️নাজনীন নাহার
১৪.০৩.২০২২

আমার এইচএসসি পরীক্ষার প্রায় সাথে সাথেই আমার বাবা আমাকে জোর করে বিয়ে দিতে চাইলে।আমার কান্নাকাটি ও অনুনয়-বিনয়ের পরে মা আমাকে কথা দিয়েছিলেন। আমাকে এখন বিয়ে দেবেন না। কিন্তু মা কথা রাখতে পারেননি। বাবা আমাকে বিয়ে দিয়েই দিলেন।এবং ঘটনাটা ঘটালেন আমাকে না জানিয়ে। বড়ো বোন এসে বলল বাবা আমাকে স্থানীয় কাজি অফিসে গিয়ে পাত্র পক্ষের ও বাবার কিছু পুরুষ আত্মীয়ের উপস্থিতিতে আমার বিয়ে দিয়ে এসেছেন।কাবিন রেজিষ্ট্রি করে। আগামী তিনমাস পরে আমাকে শ্বশুর বাড়ি তুলে দিবেন। খবরটা আমার বড়ো বোনের কাছে শুনে আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না। তাই দৌড়ে মায়ের কাছে গেলাম।

কিন্তু দরজার কাছে গিয়ে বাবার ভয়ে প্রথমে চুপসে গেলাম। নিজের বিয়ের কথা। তাও আবার বিষয়টি সত্যি কী মিথ্যে তা বাবার সামনে কীভাবে জিজ্ঞেস করি। যদি বড়ো আপার কথা মিথ্যে হয়।তাহলে তো বাবার কাছে আর মায়ের কাছে অযথা বকা খেতে হবে আমাকে। নাহ্ মা’কে একা জিজ্ঞেস করতে হবে। কিছুটা ধৈর্য নিয়ে সরে এলাম। কিন্তু বুকের ভেতরে অস্থিরতা কাটছিল না।
মনের ভয়ঙ্কর অস্থিরতা নিয়ে মাগরিবের নামাজ আদায় করলাম। নামাজ শেষে জায়নামাজে বসেই সেজদায় মাথা খুঁটে আল্লাহর কাছে খুব করে কাঁদলাম। আল্লাহ বড়ো আপার কথাগুলো যেন মিথ্যে হয়। আমার জন্য যেন আব্বা এতো বড়ো সর্বনাশটা না করেন।ঘটে যাওয়া ঘটনাও বদল হয় কিনা জানি না। কিন্তু চাইতে বা আকুতি করতে তো কোনো দোষ নেই। মহান আল্লাহ তায়ালাই তো বলেছেন তার কাছে সব আছে। তাই তার কাছেই আকুতি করতে। আমার আল্লাহর উপর পুরোপুরি বিশ্বাসের কারণে মনের মধ্যে কেমন একটা ভীষণ সাহস অনুভব করলাম।

আজকে আর পড়ার টেবিলে বই নিয়ে না বসে। মায়ের বিছানার পাশে হ্যারিকেনের আলোয় আমি ম্যাডিকেলে ভর্তির পড়াশোনা নিয়ে বসলাম। কারণ মা ঘরে আসলেই মায়ের সাথে আমার কথা বলতে হবে। মা তখনও বাইরে কাজ করছেন। সবকিছু দেখে মনে হলো আমার বিয়ের মতো এমন ভয়ানক কিছু আসলেই আজকে ঘটে নাই। মা কেমন চুপচাপ আর স্বাভাবিক ভাবে সব কাজকর্ম করছেন। সত্যি সত্যি যদি নিজের মেয়েটার আজ বিয়ে দিতেন মা।তাহলে কী এতোটা সহজ করে চলতে পারতেন! আমার মনে হলো পারতেন না। নিজের মতো নিজের জন্য পজেটিভ শান্তনা নিয়ে আমি কিছুটা দুশ্চিন্তা ভুলে বইয়ের টপিকে ডুব দিলাম। হঠাৎ মা আমার গা ঘেঁষে এসে বসলেন। আমি বরাবরই মায়ের ন্যাওটা মেয়ে। মা’কে কাছে পেলে পৃথিবী পাওয়া হয়ে যায় আমার। মায়ের শরীরের ঘামের গন্ধটাতে যে কী ভীষণ মায়ার নেশা তা বলে বুঝাতে পারব না। মা সকলের কাছে কেমন আমি জানি না।আমার কাছে আমার মা সৃষ্টিকর্তার পরেই সেরা। মাঝে মাঝে মনে হয় সৃষ্টিকর্তাকে কখনও দেখিনি। মায়ের কথাতেই তো সৃষ্টিকর্তাকেও বিশ্বাস করেছি। মা-ই আমার সবচেয়ে কাছের। মা আমার শিক্ষক। আমার গুরু, আমার আশ্রয় ও বিশ্বাস। সেই মা’কে আজকে আমার কেমন অন্যরকম লাগছিল।

মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। একটা হাতে আমার একটা হাত আদর করে ধরে রেখেছে। আমি এবং মা কেউ কাউকে কিছু বলছি না। আমার খুব কান্না পাচ্ছিল। চোখ দিয়ে গড়গড় করে পানি পড়ছে। মায়ের এই আচরণ আমাকে খুব খারাপ কিছু সংবাদের ইঙ্গিত দিচ্ছে। কেমন করে আজ মায়ের স্পর্শের রং বদলে গেল! কেন গেল! আমার ভাবনা থামিয়ে দিয়ে একসময় মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন।
———-সোনা তোমার বিয়ে হয়ে গেছে।
আমি তখনও শব্দটাকে বুঝতে পারিনি। মা আমাকে আবারও খুব করে বুকের মধ্যে চেপে ধরে বললেন। ———–তোমার আব্বা আজকে তোমাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন।
আমি এক ঝটকায় মায়ের কাছ থেকে সরে গেলাম। আমি চিৎকার করে উঠলাম। আব্বা তখন বাড়িতে ছিলেন না। আত্মীয়দের বাড়িতে মিষ্টি বিতরণে গিয়েছেন। এসব না জেনেই আমি গলা উঁচিয়ে বললাম।
———–মানে কী মা! আপনি এসব কী বলছেন!
আমার বিয়ে কীভাবে হলো! আমিতো কিছুই জানি না। আমি তো বিয়ের কিছুই করিনি মা।
————তোমাকে তোমার বাবা কাবিন রেজিষ্ট্রি করে বিয়ে দিয়েছে। তিন মাস পরে ছেলের বাড়ি তোমাকে তুলে দিবে।
আমি কাবিন বিষয়টি জানি।আমাদের গ্রামে অনেক মেয়ের কাবিনের বিয়ে হয়। তবে বিয়ের কন্যারা বিষয়টি জানে। তাহলে আমি কেন জানলাম না। কীভাবে সম্ভব! কীভাবে কী হলো!
আমি শুধু চিৎকার করে কাঁদলাম। তারপর কিছুটা শান্ত হয়ে মাকে বললাম।
————-মা আব্বা বিয়ে দিলে তো আমার বিয়ে হয়নি। আমি তো সিগনেচার করিনি মা। আমি তো কবুল বলিনি মা। এই বিয়ে হবে না মা। কবুল বলতে হয়। সিগনেচার করতে হয়। মাগো আপনি প্লিজ আব্বাকে বলেন।বড়ো ভাইকে খবর দিন মা। মা আব্বা কোথায়?
———–তোমার আব্বা একটু বাইরে গেছে।
———মা আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো মা। মা আমি পড়াশোনা করব। আমি এখন বিয়ে করব না মা। আব্বা আসার আগে আমাকে একটু কাউকে দিয়ে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিন মা। মা আমি পারব না মা।
তখনকার সময় মোবাইল ছিলো না।আমি কীভাবে কী করব! কার কাছে যাব! আমার পাগলের মতো লাগছে।
———-তুমি এইভাবে চিৎকার চেঁচামিচি আর কান্নাকাটি করলে মানুষ খারাপ বলবে। তোমার আব্বার মান সম্মান যাবে। তুমি একটা মেয়ে।এটা সবসময় মনে রাখবা। যা হয়েছে আল্লাহর হুকুমে হয়েছে।
————মা আপনি আমাকে মেরে ফেলেন মা। মেরে ফেলেন মা। আমি কোনো ভাবেই বিয়ে করতে পারব না।
আমি কেবল কেঁদেই যাচ্ছি।
________ইলোরা মা! তুমি মুখ হাত ধুয়ে একটা নতুন কাপড় পরে নাও।কিছুক্ষণ পরে জামাই আসবে। তোমাকে তার সাথে দেখা করতে হবে।কথা বলতে হবে।
তৎক্ষণাৎ আমার পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে গেল। আমার চোখে মুখে একটা শীতল স্রোত নেমে গেল। দাঁড়ানো থেকে আমি পড়ে যেতে যেতে মায়ের খাটের উঁচু অংশটা শক্ত করে ধরে ফেললাম। আবার আমি কান্না শুরু করলাম। আমি কেমন নিঃস্ব হয়ে গেলাম। আমি কেমন স্বপ্নহীন হয়ে গেলাম। পাথর আর উদভ্রান্ত আমি মা’কে বললাম।

————-মা আপনারা আমার সাথে কেন এমন করছেন! কেন আমাকে এমন শাস্তি দিচ্ছেন মা। আমাকে মেরে ফেলেন। তবুও আমাকে এমন শাস্তি দিবেন না মা।
মা তখন ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। আর বলতে লাগলেন।
———বাবা তুমি আর কান্না করো না। মেয়েদের জীবনে সবকিছু তার নিজের ইচ্ছেতে হয় না। মেয়েদের সব স্বপ্ন পূরণ হয় না বাবা। তোমার জন্য ভালো সম্বন্ধ এসেছে। ছেলে তোমাকে কলেজের পথ থেকে দেখে পছন্দ করেছে। বড়ো ঘরের ছেলে। বিড়াট ব্যবসা তাদের। ভালো সম্বন্ধ। তুমি ভালো থাকবে মা।
———— কী বললেন মা।লোকটা আমাকে রাস্তায় দেখে পছন্দ করেছে! আর আপনারা বিয়ে দিয়ে দিলেন! তাহলে আমি! আমি যে তাকে দেখলাম না! আমার কোনো পছন্দ থাকবে না মা!
————তোমার বাবা দেখেছেন। সে পছন্দ করেছেন। ছেলে মাশাআল্লাহ খুব সুন্দর দেখতে। ভালো বংশ। বি এ পাশ। আর কী দরকার! সবচেয়ে বড়ো কথা হলো ছেলে তোমার জন্য পাগল। এমন আগ্রহ নিয়ে বিয়ে করা ছেলে তোমাকে সারাজীবন মাথায় করে রাখবে।
———–মা আমি পারব না।আমি কোনো ভাবেই পারব না।আমি মরে যাব তবুও এই বিয়ে আমি মেনে নেব না মা।
——— গলা নামিয়ে কথা বলো। এতো জেদ ভালো না।
মেয়েদের এতো জেদ আর পছন্দ অপছন্দ থাকতে নেই।
হঠাৎ অনুনয় বিনয় করা মায়ের কন্ঠটা কেমন রুঢ় হবে গেল। আমি কাঁদছি আর মাকে শুনছি।
————শোনো বাবা।তোমার ছোট আরও একটা বোন আছে। তার কথাও ভাবতে হবে। এছাড়া তোমার বড়ো আপা আজকে ছয়মাস হলো বাপের বাড়ি পড়ে আছে দু’টো বাচ্চাকে নিয়ে। জামাই একটা খোঁজও নেয় না। এইসব জানলে তোমাকে ভালো ঘরে বিয়েও দিতে পারব না। তোমার জন্য ছেলে পক্ষ যেচে এসেছে। হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতে নেই। তোমার বাবা যা করেছে তোমার ভালোর জন্যই করেছে। মেয়েদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো স্বামী সংসার। এতো লেখাপড়া করে কী হবে। তোমার বয়স বেড়ে গেলে বিয়ে দেয়াটাও কঠিন হয়ে যাবে আমাদের জন্য।

মায়ের কিছু কথা আমার কানে গেলো কিছু গেলো না।মা শুধু বলেই যাচ্ছেন।
———–তুমি যদি এখন ওদের সাথে উল্টা পালটা কোনো আচরণ করো।তাহলে তাতে তোমার বাবার ইজ্জত যাবে। আমি তোমার কাছে হাত জোর করছি মা।তুমি মাথাটা একটু ঠাণ্ডা করো। তোমার এখন বিয়ে হয়ে গেছে। তোমার স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির লোকজনের সাথে তোমাকে এখন ভালো ব্যবহার করতে হবে। উঠো সোনা। হাতমুখ ধুয়ে আসো। আর পাগলামি করে না। তোমার এখন বিয়ে হয়ে গেছে।
———কীসের বিয়ে মা! আমি জানি নাই শুনি নাই আর আমার বিয়ে হয়ে গেলো! আমি এই বিয়ে মানি না মা। আমি মানি না। এই বিয়ে হয়নি আমার।
———–বিয়ে তোমার হয়ে গেছে। ইসলামের নিয়মে মেয়ের বাবা নিজে মেয়ের অভিভাবক হয়ে মেয়েকে বিয়ে দিতে পারে। তাই তোমার আব্বা নিজে দস্তখত করে তোমার কাবিন রেজিষ্ট্রি করে তোমাকে বিয়ে দিয়েছে। তোমার বিয়ে হয়ে গেছে।
ওঠো তৈরি হয়ে নাও। তৈরি হয়ে তোমার রুমে যাও জামাই আসতেছে। তার সাথে ভালোভাবে কথা বলবা। সালাম দিবা। মনে রাখবা মা।স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত। কোনো বেয়াদবি করো না।

আমার মুখে আর কোনো কথা বের হলো না। আমি যেন বেঁচে থেকেও একরকম মরে গেলাম।খুব ইচ্ছে হলো একটা ভোঁ দৌড়ে আমি সবার কাছ থেকে সবকিছু থেকে পালিয়ে যাই। পালিয়ে যাই এইরকম ভয়ঙ্কর বাবা-মা ও পরিবেশ থেকে।
কিন্তু কিচ্ছু করলাম না।কান্নাটাও হঠাৎ শুকিয়ে গেলো আমার। ঠাঁয় বসে রইলাম। এরপর মায়ের ঠেলাঠেলিতে চুপচাপ চলে গেলাম ঘরের বাইরে চাপ কলের কাছে। চাপকলের হাতল চেপে পানি উঠানোর শক্তি পেলাম না। সবকিছু কেমন কেয়ামতের মতো লাগছে। শুনেছি কেয়ামতের সময় সব কেমন অন্ধকার হয়ে যাবে। মানুষ ঠিকমতো চোখে দেখবে না। সকলে উদভ্রান্তের মতো দৌড়াবে। কেউ কারও কথা শুনবে না। যে যার মতো ইয়া নাফসি ইয়া নফসি করবে। চারিদিকে ধুলার ঝড় উঠবে।সবকিছু উলটপালট হয়ে যাবে।পৃথিবী ভেঙেচুরে একাকার হয়ে যাবে। আমার কাছে এখন ঠিক তেমনই লাগছে। কী ভীষণ অস্থিরতা! আহা কী ভীষণ কষ্ট আমার!

একটা সিলভারের বালতিতে পানি রাখা ছিল। আমি ইচ্ছে মতো আমার চোখে মুখে পানি দিয়ে ধুয়ে নিলাম।ধুয়েমুছে নিলাম আমার সব দুঃখ, সব কান্না। বারবার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম নিয়তিকে মেনে নিতে।কিন্তু মনে মন পারছিলাম না।এরপর কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিলাম।

ঘরের পেছনে আসলাম। কাছেই একটা বড়ো তেঁতুল গাছ ছিলো। আমি বেশ ভালোই গাছে উঠতে পারি। সিদ্ধান্ত নিলাম তেঁতুল গাছে উঠে ওড়না গলায় পেঁচিয়ে ঝুলে পরব। যেই ভাবা সেই কাজ। গেলাম চুপচাপ তেঁতুল গাছের কাছে।
এদিকে আমার মা ও বড়ো বোন নতুন জামাইয়ের জন্য খাবারের আয়োজনে ব্যস্ত।

আমি গিয়ে আমাদের ঘরের পেছনের বড়ো তেঁতুল গাছটার নিচে দাঁড়ালাম। একটা অদ্ভুত বিষয় অনুভব করলাম। গাছটাকে আজকে বেশি উঁচু মনে হচ্ছে। দিনের বেলা আমি বহু বহুবার গাছে উঠেছি। কিন্তু কখনোই রাতের বেলা আমার গাছে উঠা হয়নি। গাছে উঠার সাথে দিন আর রাতের যে একটা বিস্তর ফারাক আছে তা আমি আগে বুঝিনি।

গায়ের ওড়নাটা খুলে দেখে নিলাম হাত দিয়ে টেনে টেনে।শক্ত আর লম্বা কীরকম তা পরখ করলাম। আমি নিশ্চিত যে আমি আত্মহত্যা করে আমার জীবনের সব সমস্যা ও কষ্টের সমাধান করে নেব। কিন্তু আমি কিছুতেই পারব না আমার জন্য এমন বিয়ে মেনে নিতে। খুব মনে পড়ল গল্প উপন্যাসে পড়া নায়কের কথা নায়িকার কথা। আহা আমার কেউ থাকলে খুব ভালো হতো। এখন আমি তার সাথে পালিয়ে যেতে পারতাম। কী হতো পরে তা জানি না।
তবে এখন তো মুক্তি পেতাম।

বাবা-মা ও বড়ো দুই ভাইয়ের ভয়ে প্রেম নিয়ে তো চিন্তাই করিনি কোনোদিন। আমার বড়ো দু’বোনকে মা পরিষ্কার বলে দিয়েছিলেন। আমাদেরকে সামনে রেখে। প্রেমট্রেম করবা তো একদম রাতের বেলা হাত পা বেঁধে মুখের মধ্যে কাপড় গুজে জবাই করে ঘরের মেঝেতে গর্ত করে পুঁতে রাখব।
এই ভয়ে আমার বড়ো বোনেরা ও আমি প্রেমের কথা চিন্তাও করতে পারিনি। মা জবাই করতো কিনা জানি না। তবে বাবা-মাকে আমরা ভাই বোনেরা ভীষণ ভয় পেতাম। আমাদেরকে কঠিন শাসনে রাখতেন বাবা-মা।
তাই প্রেম নিয়ে ভয়েও ভাবা হয়নি আমার।
এখন আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে। এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ সময় আমি কত কী সব ভাবছি। তারপরও মনে পড়লো একজনের কথা। একটা ছেলে বাই সাইকেল নিয়ে প্রতিদিন দুই বেলা করে আমার স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকত। কোচিং এ ছেলেদের ব্যাচে পড়ত সে। আমারই ক্লাসমেট। ওরা বয়েজ এ পড়ত।আমরা গার্লস এ। আমার বান্ধবী পারভীন বেশ একটু সোজা টাইপ মেয়ে ছিলো। একদিন ওকে স্কুলের পথে একা পেয়ে সেই ছেলেটা একটা গাইড বই ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলো। বইটি ইলোরাকে দিবা।ইলোরা বইটি চেয়েছে। তাকে বইটি দিয়ে বলো পড়ে ফেরত দিলেই হবে।পারভীন বইটা এনে আমাকে দিল। বইটা খুলে দেখি একটা চিঠি আর একটা গাঢ় লাল রঙের গোলাপ ফুল। চিঠিটা খুলে দেখি ছেলেটির লেখা চিঠি আমার নামে।
প্রিয় ইলেরা…..। তার যত ভালোবাসার কথা। চিঠিটা পড়েই প্রেম তো দূরের কথা ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপছিল। মা জানতে পারলে আমাকে জবাই করবেন।তাই যেভাবে ছিলো ওভাবেই চিঠি আর গোলাপ ফুল রেখে বইটি পারভীনকে দিয়ে বলেছিলাম ফেরত দিতে। ও ফেরত দিয়ে দিয়েছিল। তবে ছেলেটা রোজ কম করে হলেও দু’বেলা আমার আসেপাশে আসত।

কেন যেন আজ আত্মহত্যা করতে গিয়ে সেই ছেলেটার কথা খুব মনে পড়ল। খুব মনে হলো প্রেমটা করলে মন্দ হতো না। আজকে অন্তত তার কাছে যাওয়া যেতো। তার সাহায্য পাওয়া যেতো। হঠাৎ আমার আবারও খুব কান্না পেলো। সেই ছেলেটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে আপন মনে হতে লাগল। আমি কাঁদতে কাঁদতে খুব করে চেষ্টা করলাম তেঁতুল গাছে উঠতে।
কিন্তু পারছিলাম না। আমার ভীষণ ভয় লাগছিল। ভয়ে হাত-পা কাঁপছিল।
তারপরও বহু কষ্টে আমি তেঁতুল গাছে তিন-চার হাতের মতো উঁচুতে উঠলাম। হঠাৎ দেখি ইয়া বড়ো একটা হুতুম পেঁচা। গোল গোল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। রাতের অন্ধকারেও তার চোখ দু’টো ঘোলাটে হলদে রঙে জ্বল জ্বল করছিল। হুতুম পেঁচার চোখ দু’টো আমাকে মনে করিয়ে দিলো জান কবজের আজরাইলের কথা।দোজখের কথা। আমি ধপাশ করে পড়ে গেলাম গাছ থেকে। বেশি উঁচুতে উঠিনি বলে বেশি ব্যথা পেলাম না।তেঁতুলের চিকন ডালের সাথে লেগে আমার হাতের বেশ কিছু যায়গায় চামড়া উঠে গেল। খুব জ্বালা করছিল। মাটিতে বসেই মনে পড়লো আত্মহত্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর মায়ের বলা কথার ভয়। আর তাই আমি আত্মহত্যা করতে পারলাম না। মা সবসময় বলেছেন। আত্মহত্যা করলে কোনোদিন বেহেশতে যেতে পারবো না। অনন্তকাল দোজখের আগুনে জ্বলতে হবে। আমি আমার না দেখা পরকালের দোজখের আগুনের ভয়ে আত্মহত্যা করা থেকে ফিরে আসলাম। ফিরে আসলাম দুনিয়ায় আগুন দুঃখ পোহাতে।

ঘরে ফিরে এলাম। রাত বাড়ল। আমি আমার রুমে বসেছিলাম। একটা চাবি দেয়া পুতুলের মতো। একটা টিমটিম আলোর হ্যারিকেন জ্বলছিল একপাশে। আধো আলো আধো অন্ধকার। আমার ভীষণ ও ভয়ঙ্কর মনখারাপ। একটা ভয়ঙ্কর কিছুর জন্য অপেক্ষা করছি আমি।
আমার বাবা একটা অপরিচিত লোকের সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন নিজে দস্তখত করে। তাতেই সেই লোকটা আমার বৈধ স্বামী হয়ে গেছেন। সে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার রুমে আসবেন। সে এখন আমার সাথে সবকিছুর অধিকার পেয়ে গেলেন।

মা বলেছেন আমার সাথে একটু দেখা করবেন আর কিছুক্ষণ কথা বলে তিনি আজ চলে যাবেন।
মা আরও বলে দিয়েছেন আমি যেন আমার সেই স্বামীর সাথে খুব নম্র ও ভদ্র আচরণ করি। নইলে আমার বাবার মান ইজ্জত নষ্ট হবে। একজন মা।যাকে সবসময় ভীষণ ভয় পেয়ে ও মান্য করে এসেছি। যার মায়া আমার কাছে পৃথিবীর সেরা মায়া।সেই মা আমাকে আজকে হাত ধরে অনুনয় বিনয় করে বলেছেন।আমি যেন আমার বাবার মান রাখি। তাই আমি একটি পুতুল বসে আছি। আমি এখন এমন একজন মানুষ। যার স্বপ্ন উজার হয়ে গেছে। যাকে আর কোনোদিন পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার জন্য কিংবা ডাক্তার হওয়ার জন্য ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি ও বায়োলজি পড়তে হবে না। মুখস্থ করতে হবে না ফিজিক্সের কঠিন কঠিন সব সূত্র। ডাক্তারি পড়তে গিয়ে মৃত মানুষের লাশ কাটতে হবে না। সাদা এপ্রোন গায়ে দিয়ে পেন্সিল হিল পরে ঢাকা মেডিকেলের করিডোরে খট খট করে হেঁটে যাওয়া হবে না। ছোটবেলা থেকে দেখা সেই সকল স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যাবে। আমার আর সেই সকল স্মার্ট কমবয়সী ডাক্তার মেয়েদের হাইহিলের খট খট শব্দের অংশিদার হওয়া হবে না।
জরজায় একটা কড়ড়র শব্দ হলো। চমকে উঠলাম আমি। আমার রুমে বাবার বিয়ে করা আমার স্বামীটি ঢুকলেন। আমি তার দিকে তাকাতে ভয় পাচ্ছি। স্বামীর জন্য আজ আর আমার নতুন কাপড় পরা হয়নি।মাথায় চিরুনি দেয়া হয়নি। মায়ের নির্দেশ মতো শুধু মাথায় কাপড় দিয়ে রেখেছি।এতে অনেক সুবিধা হয়েছে আমার।কারণ মাথার সাথে মুখের অধিকাংশ অংশভাগ ঢেকে বসে আছি। কিছুক্ষণ আগে ফাঁসি দিতে যাওয়া সেই ফাঁসির ওড়নাটা দিয়ে আমার মাথা মুখ ঢাকা। এই মুহূর্তে এই ওড়নাটার ফাঁসে আমার মরে ঝুলে থাকার কথা ছিল। অথচ আমি সেই ওড়নাটায় মাথা মুখ ঢেকে বসে আছি আমার বৈধ কিংবা অবৈধ স্বামীর সামনে।
লোকটি মানে আমার স্বামীটি এগিয়ে এসে আমার অনেকটা নিকটবর্তীতে একটা চেয়ার টেনে বসলেন। আমি দুঃখ, কষ্ট, ভয় সব মিলিয়ে মিশিয়ে শক্ত পাথর হয়ে নিজেকে জড়োসড়ো করে বসে রইলাম। লোকটি তার হাত বাড়িয়ে আমার………..

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here