জীবন মানে তুমি পর্ব:১২

জীবন মানে তুমি
লেখিকা:H.B.Irini Ori
পর্ব:১২
(৪৩)
ইয়ারাবী নিচে নেমে ওর শ্বশুড়-শ্বাশুড়িকে সালাম দেয়।ওর লিজা ফুফিকে সালাম দেওয়ার সাথে সাথে উনি মুখ বাকিয়ে বলেন,
-“তোমার কী তোমার বাবা-মা কিছু শেখায়নি বাপু?কালও দেখলাম কাউকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করোনি আর আজও।ভদ্রতা বলতে কিছু নেই নাকী?”
-“ক্ষমা করবেন ফুপি,ছোট মুখে বড় কথা বলছি তাই।কেননা পা ছুয়ে সালাম করা আমাদের ইসলামের বিধান নেই।পায়ে হাত দিয়ে মাথা নতজানু হয়ে সালাম করা ইসলামের কোন বিধান নয়। বরং বলা হয়েছে যে, মুসলমান নত হবে একমাত্র আল্লহ রব্বুল আলামীনের কাছে। সে আর কারও কাছে মাথা নত করবেনা। এবিষয়ে হাদিসে রসুল সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন যে, “আমি যদি কাউকে সেজদা করার অনুমতি দিতাম, তাহলে সেটা হত স্ত্রীর জন্য তার স্বামীকে সেজদা করা”। এধরনের প্রচলিত সালাম পদ্ধতিটা পুরোপুরি হিন্দু সংস্কৃতি। হিন্দুরা তাদের দেবতার পায়ে মাথা রেখে কুর্ণিশ করে।তাই একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারো সামনে মাথানতো করা ঠিক নই।ধরতে গেলে এটা এক প্রকার সমাজের কুসংস্কার,যা আমি মানিনা।”
ফুফি এবার রেগে গজগজ করতে করতে দাঁড়িয়ে বলে,
-“আমাকে ধর্ম শেখাতে এসেনা বেয়াদপ মেয়ে।যত বড় মুখ নই তত বড় কথা।একদিনও হয়নি তুমি এই বাড়িতে এসেছো,আর এসেই।দেখেছো ভাবী এই মেয়ে…”
-“লিজা..নিজেকে সংযত রাখলে আমি খুশি হবো।তাছাড়া ইয়ারাবী মা ভুল কিছু বলেনি।”
মিসেস লিজা পিছনে তাকিয়ে দেখে ওনার বড় বোন মিসেস নিশা দাঁড়িয়ে আছে।কিন্তু মিসেস লিজা কখনো হারতে শিখেননি।আর আবরার এখনো আসেনি তাই উনি মনে মনে ইয়ারাবীকে জব্দ করার প্লান করেন।উনি বুঝাতে চান বাড়ির বৌদের সঠিক স্থান কোথায়।চায়ের কাপটা নিয়ে চুমুক দিয়ে বলেন,
-“তা বিয়ের পরের দিন শাড়ি না পরে জামা পরেছো কেন?নাকী তোমার হাদিসে এটা পরতে বলেছে?”
-“লিজা বড্ড বেশি বলছিস তুই”
ইয়ারাবী ওর শ্বশুড়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আঙ্কেল প্লীজ রাগ করবেননা।উনি আমার বড়,বলতেই পারেন।আর ছোট ফুপি আমি শাড়ি পরতে পারিনা,তাছাড়া ওনি আমাকে শাড়ি পরতে নিষেধ করেছেন।তাই আর পরিনি।”
ইয়ারাবীর শ্বাশুড়ি মুচকি হেসে ওর মাথায় হাত দিয়ে বলেন,
-“আচ্ছা মা এই উনিটা কে?”
-“জ্বি মানে আবরার”
-“এখন বসে পরতো,ব্রেকফাস্ট করতে হবে।লিজার কথায় কিছু মনে করিসনা।ইকরা বললো তুই বলে রাতে অসুস্থ হয়ে পরেছিলি?”
-“জ্বি..আসলে মেডিসিন নিতে মনে ছিলোনা তাই…”
-“এখন থেকে খেয়াল রাখবি,আর আবরার কোথায়?”
-“আন্টি উনার একটা ফোন এসেছে তাই…”
ওর শ্বশুড় হঠাৎ বলে উঠে,
-“তোমার কী আমাদের পছন্দ হয়নি মা?আন্টি-আঙ্কেল এগুলো কেন বলছো?”
-“সরি,কিন্তু আমার কিছুটা সময় লাগবে।”
-“আরে মামনি মন খারাপ করছো কেন?ইকরার সময়ও এমন হয়েছিলো,চিন্তা করনা আমরা রাগ করিনি।”
আস্তে আস্তে সবাই ডাইনিং এ চলে আসে।আবরারদের টেবিলটা অনেক বড়।শুধু তাই নয়,এদের বাড়ির প্রতিটা জিনিস খুব শৌখিন আর দামী।তবে বাচ্চারা তেমন কেউ ওঠেনি।অনু এসে ইয়ারাবীকে জড়িয়ে ধরে গুড মর্নিং বলে।ইয়ারাবী হেসে দেয়।ইয়ারাবী সবে চেয়ারে বসেছে এমন সময় ওর ছোট ফুপি বলে,
-“তুমি কী শো অফের জন্য চশমা ব্যবহার করো নাকী সমস্যা?”
-“ফুপি আমার চোখে সমস্যা তাই”
-“ও তারমানে শেষমেষ যাকে বলে কানি আরকী”
-“আপনার মেয়ে বলে একদম চোখেই দেখেনা,ঘটনাটা কী সত্যি ফুপি?”
ওর ছোট ফুপি পিছনে তাকিয়ে দেখে আবরার আর ইফাজ সিড়ি দিয়ে নেমে এগিয়ে আসে।মিসেস লিজার অটোমেটিক মুখ বন্ধ হয়ে যায়,কেননা আবরার যে কতটা রাগী সেটা ওর ফুপি ভালোই জানে।তাই উনি আর কিছু না বলে চুপ করে বসে থাকেন।আবরার একটা বাকা হাসি দিয়ে ইয়ারাবীর ডান পাশে চেয়ার টেনে বসে পরে।ইফাজ এসে ওকে জড়িয়ে ধরে মাথায় একটা চুমু দিয়ে বলে,
-“পিচ্চি কেমন আছিস এখন?”
-“এখন ঠিক আছি ভাইয়া।”
সবাই ব্রেকফাস্ট করতে বসে যায়।জারবা ফ্রেস হয়েও ঘুমঘুম চোখে হাই তুলতে তুলতে বলে,
-“হাই এভরিবডি,নিউ কাপল কেমন আছো?মাতাজি পেটে ইন্দুর”
-“বসে পর,এতো ঘুম কীভাবে দিস বলতো?বাকী তো ঘুম মনে হয়।”
-“ও তুমি বুঝবেনা,যাই হোক ভাবীকে কী আজ পার্লারে নিয়ে যাবো,নাকী ওরা বাসায় আসবে।”
-“না ওদের বাসায় আসতে বলবি,”
-“বাবা,বৌ ছাড়া যে চলেই না।”
-“মার খাবি কিন্তু আমার হাতে,আম্মু এটাকে চুপ করতে বলো।”
-“জারবা…আবরারকে জ্বালাস না।”
ব্রেকফাস্টে তেমন কিছু ইয়ারাবী খায়না।সবাই বোঝে অসুস্থ তাই খেতে পারছেনা।ওর খাওয়া শেষ হলে ও রুমে এসে খাটের উপর বসে।কিছুক্ষণ পর চেলসি এসে ওর পায়ের উপর মাথা দেয়।ইয়ারাবীর ফোবিয়া থাকলেও একে দেখে তেমন ভয় লাগছেনা।ও চেলসিকে নিজের কাছে নিয়ে আদর করতে থাকে।এর মাঝে ইফাজ রুমে এসে ওর পাশে বসে।
-“পিচ্চি বাসা থেকে কেউ ফোন করেছিলো?”
-“স্টারপু,আর জারা ম্যাসেজ দিয়েছে।”
-“আমি কাদের কথা বলছি তুই বুঝেছিস।”
-“আপদ বিদায় হয়েছে,আর কী চাই তারা।আমি তো শুনেছি মায়েরা দশমাস দশদিন সন্তানকে গর্ভধারন করে জন্ম দেয়,আর সেই সন্তান যদি সাতটা খুন করে তবু তার জন্য টান থাকে।তাহলে আমার বেলায় কেন এমন হয়না।আচ্ছা আমি কী খুব খারাপ?আচ্ছা আমি কী এমন করেছি যাতে করে সবাই আমার সাথে এমন করে।জানো ভাইয়া মাঝে মাঝে নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়।কেননা নিজের মান অভিমান,কষ্ট কাউকে বলতে পারিনা,কান্না পেলে চিৎকার করে কাঁদতে পারিনা।”
-“পিচ্চি তাকা আমার দিকে,দেখ সোনা একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।”
-“হ্যাঁ,আর সেইদিন সব ঠিক থাকলেও আমি আর থাকবোনা।”
ইফাজ হেসে ওর গালটা টেনে বলে,
-“ইউ নো এই কথাটা তুই যদি ২৪ঘন্টা আগে বলতি তাহলে তোকে কী করতাম সেটা আমি নিজেও জানিনা।তবে এখন কিছু বললোনা,কেননা এখন যে বন্ধনে আটকে গেছিস সেখান থেকে বের হওয়া তোর পক্ষে সম্ভব নয়।”
ইয়ারাবী কথাটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।তারপর কিছু একটা মনে করে বলে,
-“আচ্ছা ভাইয়া আদিবা আপু কেমন আছে?একবারো খোঁজ নিতে পারলাম না”
-“ওসব লো কোয়ালিটি ড্রামাবাজদের কথা একদম বলবিনা।ওরা কেউ খোঁজ নিয়েছে যে তুই নিবি।শোন আমি একটু বাইরে যাচ্ছি,প্রোগ্রামের আগেই চলে আসবো।”
আবরার জুস হাতে নিয়ে রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে,
-“কী আলোচনা হচ্ছে ভাই-বোন মিলে?”
-“তেমন কিছুনা বাইরে যাবো পিচ্চিকে তাই বলছিলাম।”
আবরার গ্লাসটা ইয়ারাবীকে দিয়ে বলে,
-“মম পাঠিয়েছে,নাসপাতির জুস।ব্রেকফাস্ট তো কিছুই করোনি তাই জুসটা খেয়ে নাও ভালো লাগবে।”
-“আমি খায়না।”
-“না খেলেও এখন খেতে হবে,নাও ধরো।আর ভাইয়া আমিও বাইরে যাবো,চলুন এক সাথে যায়।ইয়ারাবী যদি কিছুর প্রয়োজন হয় তাহলে ভাবী বা মমকে বলবে।আর কাল তো দেখিয়েছি,কোথায় কী আছে?আর যদি কিছু না পাও তো চেলসিকে বলবে ও খুঁজে দেবে।আর চেলসি ওর খেয়াল রাখবি।”
চেলসি এমনভাবে ডেকে উঠে বুঝায় যে ও খেয়াল রাখবে।আবরার আর ইফাজ বেরিয়ে পরে।ইয়ারাবী জুসের গ্লাসটা হাতে ধরে রাখে।নাসপাতি ওর কোনো কালে ভালো লাগেনা,আর সেই জুস খেতে হবে।আর না খেলে আবরার যদি কোনো ভাবে জানে তাহলে রেগে যাবে।কোনমতে দু’ঢোক খেয়ে যেই উঠে ফেলতে যায় পিছন থেকে চেলসি ওর কাপড় টেনে চিল্লাতে থাকে।না পেরে ওকে পুরো জুসটা খেতে হয়।
(৪৪)
“রিভেন্স অফ ন্যাচার বলে একটা কথা আছে।কোরআনের ভাষায় যাকে “কিফারাহ”বলা হয়।তুমি যদি কারো ক্ষতি করতে চাও তবে পরবর্তীতে তার শাস্তি তুমি পাবে।যতই তুমি হুসিয়ার হও না কেন?কেননা আল্লাহর দরবারে বান্দার প্রতিটি চোখের পানির হিসাব থাকে।
মিসেস জামান বোনের মেয়ের ক্ষতি করতে চেয়েছিলেন।কিন্তু উল্টে তার মেয়েরর ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে।এই তিনদিনে আদিবার অবস্থা পাগলের মতো প্রায়।বিয়ের পর কাল বাসায় যাওয়ার পর থেকে প্রায় পাগলের মতো আচারন করছে।ফরজের আযানের ঘন্টাখানিক আগে আদিবার ঘুম ভেঙে যায়।যেহেতু ওরা দু’কামরার ফ্লাটে থাকে আর আদিব এখন ওদের সাথে থাকেনা তাই ও নিজের বোনকে নিয়ে আলাদা রুমে শুয়ে ছিলো।
উঠে কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে ওয়াশরুম যাওয়ার জন্য ঘরের দরজা খোলে।হঠাৎ লক্ষ্য করে ডাইনিং এরিয়ায় কারো ছায়া।ওর ভাবে ওর বাবা অথবা মা।ও বেশি খেয়াল না করে ওয়াশরুমে ঢুকতে যাবে এমন সময় কেউ একজন ওর কাধে হাত রাখে। ও ঘুরে তাকিয়ে দেখে হুবহু ওর মতো মেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বাজে ভাবে হাসছে।সাথে সাথে ওখানে সেন্সলেস হয়ে পরে যায়।ওদের বাসার পাশে একটা মসজিদের ইমাম সাহেবকে ওর বাবা ডেকে আনেন।উনি এসে ওকে কিছু দোয়া পরে ফু দিলে ওর জ্ঞান ফেরে।যখন ইমাম জানতে চান কি হয়েছিলো তখন আদিবা এক এক করে সব বলে।আর সেটা শুনে ওনার মুখের রং বদলে যায়।উনি রুম থেকে বেরিয়ে ও বাবা-মাকে বলেন,
-“দেখুন জানি আপনারা কেউ বিশ্বাস করবেন না কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছে কেউ ওর ওপর কালো জাদু করেছে যাকে বলা হয় সিহর।”
-“আপনি কী বলছেন এসব?আমার মেয়েকে কে মারতে চাইবে?”
-“আমি তো জানিনা,আপনারা ভালো কোনো হুজুর দেখান।যদি আজ আবার কোনো সমস্যা হয় তবে আমাকে জানাবেন, আসি আল্লাহ হাফেজ।আসসালামুআলাইকুম। ”
হুজুর চলে যেতেই মিসেস জামানের মাথায় হাত।ওনার মেয়েকে এসব কে করলো?উনি তো আরো ইয়ারাবীর ক্ষতি করতে চাইলেন কিন্তু এসব ঘটনা ওনার মেয়ের সাথে কেন হচ্ছে।উনি আর এক মুহুর্ত দেরি না করে গোবিন্দ নামের লোকটাকে ফোন করেন আর বলেন তিনি দেখা করতে চান।মিসেস জামানের হার্ট এ্যাটাক করার মতো অবস্থা।কেউ ওনার বুকের মানিকের ক্ষতি করবে সেটা উনি কিছুতেই মানবেনা।মেয়ে ওনার কাছে হিরার সমতুল্য। আজ কেন জানি ওনার ইতির কথাটা কানে বাজছে,”ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।”ওনি মনে মনে শপথ করেন,যদি ইয়ারাবীর জন্য এমন কিছু হয় তবে ওকে ছাড়বেনা।
(৪৫)
সকাল দশটার দিকে পার্লার থেকে দু’টা মেয়েকে নিয়ে ঘরে ঢোকে জারবা।ওর শ্বাশুড়ি এসে ওকে হালকা গোল্ডেন-ঘিয়ে কালারের একটা বড় গাউন দিয়ে যায়,সাথে কিছু জুয়েলারি।ইয়ারাবীর ইচ্ছা না থাকলেও নিরুপায় হয়ে সাজতে হয়।মেয়েরা ওকে সাজানো শুরু করে।জারবা ইয়ারাবীরর হাতে চুরি পড়াতে গেলে ওর হাতে ব্রাসলেটটা দেখে ওকে পিন্চ করে বলে,
-“ওমা কত ভালোবাসা?ভাইয়া তাহলে শেষমেষ এটা নিয়েই আসলো।”
-“তাই বুঝি,কিন্তু তোমার কে বললো যে উনি ভালোবাসে?”
-“শোনো ছোট ভাবী, আমি কচি খুকি না সব বুঝি।”
-“তাহলে তোমার বিয়ের ব্যাবস্থা করতে হবে।”
-“নাউজুবিল্লা, ভাইয়ারা শুনলে হাড্ডি একটাও আস্ত থাকবেনা।”
-“ম্যাম,আমার চুল কেমন ভাবে বাধবো।”
-“সরি,আপু বাট্ আমি হিজাব পরি।”
-“ওকে..”
পার্লারের একটা মেয়ে ইয়ারাবীর চুলটা অনেক সুন্দর করে বেধে হিজাব পরিয়ে দেয়।তার সাথে জুয়েলারিতে অনেক সুন্দর লাগছে।এর মাঝে অনু কিছু মেডিসিন হাতে নিয়ে রুমে ঢোকে।
-“ইয়া এই মেডিসিনগুলো নিয়ে নেতো।”
-“এগুলো কোথায় পেলি?”
-“তোর ভাইয়া নিয়ে এসেছে,তাড়াতাড়ি খেয়ে নে।আমাকে আবার রেডি হতে হবে।”
ইয়ারাবী কথা না বারিয়ে খেয়ে নেয়।কেননা ওর এটা খুব প্রয়োজন ছিলো।অনু চলে যেতে গেলেই ইয়ারাবী পিছন থেকে ডেকে বলে,
-“আজ লালটা পরিস…”
-“তুই কী শুরু করেছিস,বলবি আমাকে?”-রাগ দেখিয়ে কথাটা বলে।ইয়ারাবী মন খারাপ করে বলে,
-“তোকে ভালো লাগে তাই বললাম।পরা না পরা তোর ব্যাপার”
-“থাক আর মুখ লটকাতে হবেনা,ওটাই পরবো,আসি..”
ইয়ারাবীকে সাজানোর পরে জারবা পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-“ওয়াও ভাবী,তোমাকে আজ যা লাগছেনা কী?ভাইয়া দেখলে তো পাগল হয়ে যাবে।”
-“সত্যিই আমার জাকে অনেক সুন্দর লাগছে,আচ্ছা নিচে চলো।আর তোমরা কিন্তু খেয়ে তারপর যাবে।”
ইকরা আর জারবার সাথে ইয়ারাবী নিচে নেমে পার্টি ভ্যানুতে নিয়ে যেয়ে বসে।ওর এভাবে সবার ভিতরে বসে থাকতে ভালো লাগছেনা।হঠাৎ ওর চোখ যায় আবরারের উপর।ও আজ সেম কালারের পান্জাবি পরেছে,সবার সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।সবুজ চোখ,চাপ দাড়ির বাঁকা হাসিতে অনেক সুন্দর লাগছে।কিন্তু এ সুখ সইবে তো ওর কপালে?সত্যিই কী ও সুখী হবে?ও যদি এক মিনিট মন খুলে হাসে তো বাকীটা সময় ওকে কাঁদতে হয়।ও মিথ্যা স্বপ্ন দেখতে চায়না কিন্তু বারবার তারা নিজেরা এসে ধরা দেওয়ার মিছে অভিনয় করে।এই দুঃখের সত্য-মিথ্যার মায়াজালে অনেকটা হাফিয়ে গেছে।
হঠাৎ অনু এসে ওর কাধে ধাক্কা দিয়ে বলে,
-“কী রে,তোরাও আমাদের মতো শুভদৃষ্টি করছিস নাকী?”
-“মানে?”
-“মানে এটাই তোরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছিস তাই।”
ইয়ারাবীর নিজের কথাগুলোর ভাবনায় খেয়াল করেনি কখন আবরার ওর দিকে তাকিয়েছে।জারবা দৌঁড়ে ওর ভাইয়ের হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে বলে,
-“চলো ভাইয়া,আমরা সেলফি তুলি।”
বলেই ছবি তুলতে শুরু করলো।একদিনে জারবা অন্যদিকে অনু।এর মধ্যে আবার মেঘ এসে যোগ হলো।ইয়ারাবীর একটা অস্বস্তি হচ্ছে,ওর এভাবে দেখে ইফাজ এগিয়ে আসলো।
-“কী হয়েছে পিচ্চি,ঠিক আছিস তুই?”
-“আমি ঠিক আছি,ভাইয়া বাসা থেকে কেউ আসবেনা।”
-“কে বললো আসবেনা?চলে এসেছি।”
ইয়ারাবী ঘুরে তাকিয়ে দেখে ইরাক আর ওর পরিবার,মিসেস নিকি,মিসেস নিন্দু,ওর ফুপিরা আর ওর বাবা এসেছে।ইয়ারাবী স্টেজ থেকে নেমে ইরাককে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়।ওর ফুপি খালা, খালুর সাথে কথা বলে কিন্তু ওর বাবার সাথে কথা বলেনা।ও মিসেস রহমানকে জড়িয়ে কান্না করছে।
-“আরে আমার মাকে কেউ বকেছে নাকী এভাবে কান্না করছে?আগে তো এমন ছিচ কাদুনি ছিলোনা।”
-“জানো তোমাদের খুব মিস করেছি,মনি তুমিও আমাকে ফোন দাওনি।সবাই ভুলে গেছো আমাকে।”
ওর ফুপি ওর মাথায় হাত রেখে বলে,
-“তোকে তো ফোন দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু তোর এই খালামনি আমাকে নিষেধ করলো।”
-“যাও কথা নাই তোমাদের কারো সাথে।”
-“আচ্ছা বাবা,সরি।খুব বড় ভুল হয়ে গেছে,মনিকে মাফ করেদে।”
-“করে দিয়েছি,এভাবে মুখ করতে হবেনা বুড়ি বুড়ি লাগে।”
টিকলি এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বললো,
-“আপু জানেন আপনাকেনা খুব মিস করেছি।”
-“আমিও তোমাদের সবাইকে খুব মিস করেছি।”
ওর বাবা ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কেমন আছিস মা?”
ও একটা তাসছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
-“এখনো মরিনি,বেঁচেই আছি।মারা গেলে খবর পেয়ে যাবেন।”
-“এটা কী ধরনের কথা পুতুল?মামার সাথে প্লীজ আজকে এভাবে কথা বলিস না। জানিস তোর জন্য রাতে কত কান্না করেছে।”
-“সবটাই লোক দেখানো।কান্না করেছে ঠিকই আমার জন্য নয়,অন্যকিছুর জন্য।”
ইরাক বুঝতে পেরেছে ওর মুড সুইং হচ্ছে তাই তাড়াতাড়ি ওকে নিয়ে যায়।ইয়ারাবী সোফায় বসে আছে।সবার সাথে হেসে হেসে কথা বললেও ওর খুব কান্না পাচ্ছে কেননা আজও ওর মা আসেনি।ওর মাঝে মাঝে মনে হয় ওকি আদেও ওনাদের সন্তান।কেননা বাবা-মা কখনো সন্তানকে এতো অবহেলা করেনা।
আবরার মি.ফুয়াদের সাথে কথা বলছে এমন সময় উনি বলেন,
-“কাল কী হয়েছিলো আমাকে একটু বলবে?ইশানি আমাকে কিছু বলেনি,তবে ইয়ারাবীর উপর রেগে ছিলো খুব।ও কী খারাপ কিছু করেছিলো?”
-“তেমন কিছুনা আসলে অসুস্থ হয়ে পরেছিলো,আর আম্মু ও ব্যাগপ্যাক করার সময় মেডিসিনগুলো দেয়নি তাই।”
-“ওহ্,”
-“আম্মু আসেনি কেন?”
-“আসলে তোমরা আজ যাবে তো তাই কাজে ব্যাস্ত আছে।তাছাড়া আমার ভাইয়েরা এসেছে। ”
-“আমিতো শুনেছিলাম ওনারা চলে গেছে…”
-“আর বলোনা ভুল বুঝাবুঝি হয়েছিলো তাই ক্ষমা চাইতে এসেছে।”
আবরার কিছু না বলে চলে গেলো ওখান থেকে।ইয়ারাবী চুপ করে বসে আছে।ওর ফুপি ওর শ্বাশুড়ির সাথে কথা বলে ওর পাশে এসে দাঁড়ায়।
-“মনি,তোমার ভাবী কেন আসেনি?”
-“মায়ের উপর খুব রাগ তোর তাইনা।”
-“আবরার কাল রাতে আমার কাধের দাগগুলো দেখে ফেলেছে।আর কত ছোট হবো আমি।”
-“কাদিস না,আচ্ছা তোর সব প্যাক করা আছে তাইনা।”
-“আমি যাবোনা ওবাড়িতে”
-“না গেলে সবাই খারাপ ভাব্বে,চল সোনা। ওই বাড়িতে তোরও অধিকার আছে”-ওর খালা কথাটা বলে,
-“খালামনি, আমিও মানুষ।আমারো একটা সম্মানবোধ আছে,কোনো রোবট নয় যে যা খুশি বলবে আর আমি মুখ বুজে শুনে যাবো।”
-“কে কী বলেছে তোকে?”
-“কাল সকালে তোমার বোন আমাকে কী বলেছে জানো-“আপদ বিদায় হলে বাঁচবো।তোর মতো মেয়ে থাকার চেয়ে না থাকায় ভালো।তুই গেলে ঘরে শান্তি আসবে।”এসব শোনার পর আর কে আছে যে ও বাড়িতে যাবে।”
-“শোন ইশানি এসব কেন করে জানিনা,ঠিক আছে আমি তোকে কোনোদিন বলবো না।কিন্তু আজকের দিন না করিস না।”
সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান শেষ হলে সবাই বাড়িতে যায়।ইয়ারাবী যখন রুমে এসে বসে তখন আবরার জোর করে ওকে যাওয়ার জন্য।নিরুপায় হয়ে ওকে যেতে হয়।
(৪৬)
ইয়ারাবী ওর মায়ের কথা শুনে এক রকম পন করেছিলো যে এই বাড়ির চৌকাঠে আর পা রাখবেনা।মেয়েরা বলে বিয়ের পরে পর হয়ে যায় কিন্তু ইয়ারাবীর ক্ষেত্রে সেটা ভিন্ন।ওতো বিয়ের আগ থেকেই পর হয়ে আছে।আবরার আর ইয়ারাবী আলাদা গাড়িতে এসেছে।সারা রাস্তা মেয়েটা কোনো কথা বলেনি।আবরারও ওকে ডিস্টার্ব করেনি।মানুষ যে এতটা চুপ করে থাকতে পারে সেটা ইয়ারাবীককে না দেখলে বোঝা যায়না।অনু ওখান থেকেই নিজের বাসায় চলে গেছে।
ইয়ারাবী দরজায় পা রাখতেই দেখে ওর শ্রদ্ধেয় চাচারা তার পরিবার নিয়ে উপস্থিত।ও আবরারের সামনে কোনো সিনক্রেট করতে চাইনা।মিসেস ইশানি হাসি মুখে আবরারের সাথে কথা বলে কিন্তু ইয়ারাবী ওনার সাইড কেটে ভিতরে ঢুকে যায়।ভদ্রতার খাতিরে আবরার সবার সাথে কথা বলে ফ্রেস হতে রুমে যেয়ে দেখে ইয়ারাবী কান্না করছে।
-“নিজের জীবনের লড়াই নিজেকে লড়তে হয়,মাঝপথে জ্ঞান অনেকে দেবে,কেউ পিছু থেকে টেনে ধরে থামাবার চেষ্টা করবে,কেই আবার নিন্দাও করবে।তাই বলে থেমে গেলে চলবেনা।”
ইয়ারাবী আবরারের আওয়াজ শুনে তাড়াতাড়ি চোখ মুছে ফেলে।আবরার ওর ডানহাতটা ইয়ারাবী মুখে দিয়ে বলে,
-“তোমাকে একদিন বলেছি, চাইলে তুমি তোমার চোখের দৃষ্টি আমার থেকে এড়াতে পারবেনা।আজ লাস্টবার বলছি তোমার চোখে কখনো পানি না দেখি।আচ্ছা অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে ফ্রেস হতে হবে।আমি ফ্রেস হয়ে আসি তারপর তুমি যেও।”
আবরার ওর দু’টা ফোন বেডের উপর রেখে ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে ওয়াশরুমে চলে যায়।কিছুক্ষণ পরে আবরারের ফোন বাজতে থাকে।ও ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে কিটি নামের কেউ কল করেছে।পরপর দু’বার বাজার পর কেটে যায়।ইয়ারাবী কল রিসিব করতে সাহস পায়না কেননা আবরার ওকে বলে যায়নি।তাছাড়া ইয়ারাবীর সম্পর্কটাও ওভাবে সহজ হয়নি।হঠাৎ একটা ম্যাসেজ আসে ওর ফোনে।ওর বিরক্তি নিয়ে নিজের ফোন থেকে মুখটা উঠিয়ে আবরারের ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখে কিটি ম্যাসেজ করেছে-“আবরার,প্লীজ কল ব্যাক্।দিস্ ইজ্ এ্যান ইমার্জেন্সি,প্লীজ।ডোন্ট এ্যাংরি,আই নিড্ ইউর হেল্প।”
ম্যাসেজটা পরে ওর মাথায় তেমন কোনো খারাপ চিন্তা আসেনা।কেননা আবরারের লন্ডনের কোনো ফ্রেন্ড হতে পারে।
-“কী ব্যাপার ইয়ারাবী?কী দেখছো আমার ফোনে?”
আচমকা কথাটা শুনে ইয়ারাবীর ভয়তে হাত থেকে ফোনটা পরে যায়।
-“স্ সরি,আসলে আমি ব্ বুঝতে…”
-“ওকে রিল্যাক্স, কিছু হয়নি ভয় পাচ্ছো কেন?তাছাড়া আমার সব কিছুতে তোমার হাত দেওয়া অধিকার আছে।”
ইয়ারাবী চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।যেহেতু ফোনটা কার্পেটের উপর পরেছে তাই ব্যাটারিটা খুলে যায়।আবরার নিচু হয়ে ফোনটা উঠিয়ে ঠিক করে অন করে নেই।
-“কোনো কল এসেছিলো?”
-“হ্ হ্যাঁ”
-“জানো কে কল করেছিলো?.”
-“কিটি নামের কেউ, ইনফেক্ট ম্যাসেজও করেছিলো।”
-“ওহ্, আচ্ছা তুমি যেয়ে ফ্রেস হয়ে আসো।আর সিম্পিল কোনো ড্রেস পরবে। ”
ইয়ারাবী কাবার্ড থেকে একটা প্লাজু আর গেন্জি বের করে।জুয়েলারি আর হিজাবটা খুলে রেখে ওয়াশরুমে যেয়ে ফ্রেস হয়ে আসে।রোজকার মতো একই লুক।আর জুয়েলারি বলতে পেনডেন্ট, আংটি আর ব্রাসলেটটা।আবরার ফোনে কথা বলা শেষ করে ওর দিকে তাকিয়ে হাসে।এর মাঝে ইয়ামিলা আসে ডিনারের জন্য ডাকতে।
নিচে নেমে দেখে সবাই বসে আছে ওদের জন্য।ওর কাজিনদের দেখে ওর রাগে শরীরটা জ্বলে যাচ্ছে।ইরাক ওর দিকে তাকিয়ে ইশারায় নিষেধ করলো।ওর মা আর ফুপি সবাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে।এমন সময় ইয়ারাবীর প্লেটে দিতে গেলে ও নিষেধ করে।
-“মনি আমি খাবোনা।”
-“কেন খাবিনা কেন?”
-“তুমি তো দেখলে আসার সময় খেয়ে এসেছি আর পারবোনা।”
-“না পারলেও খেতে হবে।ওটা বিকালের দিকে খেয়েছিলে আর এটা রাতের ডিনার।সো কোনো বাহানা না করে খেয়ে নাও।”
আবরার খাবার চামচ দিয়ে নাড়তে নাড়তে কথাগুলো বললো।সবাই মুচকি হাসলেও কিছু মানুষের সহ্য হলোনা।ও ইরাকের দিকে অসহায় ফেস করে তাকায়।
-“আমার দিকে তাকিয়ে কোনো লাভ নেই,আমি আবরারের সাথে পুরো এগ্রি।”
-“আমি সত্যি একটা কিছু খেতে পারবোনা।জোর করে খেলে অসুবিধা হবে।”
-“কিছু হবেনা আস্তে আস্তে খা,মা।”
ইয়ারাবী নিরুপায় হয়ে অল্প একটু ফ্রাইড রাইচ আর সালাদ নিয়ে চার পাঁচ গালের মতো খাবার খেলো।খাওয়া দাওয়ার পরে সবাই কথা বলছে।সবাই অনেক হাসাহাসি করছে।জারাতো এক এক কথা বলে আবরারকে পিন্চ করছে কিন্তু পেরে উঠছেনা।এদিকে তারা ইফাজের দিকে তাকিয়ে মিটমিট হাসছে কিন্তু ইফাজ তাকালে চোখ অন্যদিকে নিচ্ছে।ইয়ারাবী ওর ফুপির সাথে রুমে কথা বলে নিজের রুমে যাচ্ছিলো।এমন সময় আচমকা হৃদয় ওকে ধাক্কা দেয়।তাও আঘাতটা বুকে লাগে।
-“আহ্,দেখে চলতে পারিস না তুই?”
-“মাফ করে দে,ভুল হয়ে গেছে।”
-“তোদের কী নূন্যতম লজ্জাটুকুও নেই।সেদিন ইরাক ভাইয়া তোদের বাসার থেকে বের করে দিলো তারপরও আবার এসেছিস।”
-“আমরা এমনি আসেনি তোর বাবাই আমাদের ডেকেছে”
কথাটা বলে খপ করে ইয়ারাবীর হাত টেনে ধরে আর বলে,
-“প্লীজ ওইদিনের জন্য মাফ করে দে।ভুল তো সবার হয়, আমাদেরও হয়েছে।এমনিতেও এই নরম হাতটা আদর করার জন্য ভালো মারা জন্যনা।”
কথাটা বলে হাতটা শক্ত করে ধরে ডলতে থাকে।ইয়ারাবী হাত ছাড়ানোর অনেক ট্রাই করে,কিন্তু হয়না।
-“হৃদয় ভালোই ভালোই বলছি হাতটা ছাড় কিন্তু নয়তো ভালো হবেনা।”
-“কেনরে,তোর বর দেখে নেবে তাই।তোর বরের থেকে ভালো মজা আমি দিতে পারবো।একটা রাত কাটা বুঝতে পারবি,তোর বর তো মনে হয় কিছুই করেনি।”
-“তোকে লাস্টবারের মতো ওয়ার্ন করছি হাতটা ছাড়।”
তবুও হৃদয় হাতটা ছাড়েনা বরং আরো শক্ত করে ধরে।ইয়ারাবী না পেরে ওর মেইন পার্টে একটা কিক মারে।ও সাথে সাথে ব্যাথায় ওর হাত ছেড়ে দেয়।
-“তোরা মেয়েকে খেলার পুতুল পেয়েছিস নাকী?জানিস নারী যখন বোন হয় তখন সে নিয়ামত হয় কিন্তু তোদের মতো কিছু মানুষরুপী জানোয়ার তাদের ভোগ করার পাত্র ভাবে।”
ইয়ারাবী না দাঁড়িয়ে সাথে সাথে রুমে চলে আসে।হৃদয়ের কথাগুলো এখনো কানে বাজছে।কীভাবে একটা ভাই তার বোনকে এসব বলতে পারে।সবাই বলে,চাচাতো ভাই আপনের মতো।যেখানে রক্ষা করার কথা সেখানে ভোগ করতে চায়।অপরদিকে ওর খালাতো ভাইয়েরা সব সময় ছায়ার মতো পাশে থেকে।সেদিন যদি ইফাজ না থাকতো তবে ও কবেই শেষ হয়ে যেত।সেদিনের কথা মনে পড়লে এখনো ওর ভয় হয়,গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে।
রাত সাড়ে এগারোটার দিকে আবরার রুমে এসে দেখে ইয়ারাবী বিছানার মাঝখানে কোলবালিশ আর সোফার কুশন দিয়ে রাখছে।
-“তো ম্যাডাম,বাংলাদেশ ইন্ডিয়া বর্ডার তৈরি করছেন।কিন্তু আমিতো ভেবেছিলাম আমাদের ফার্স্ট নাইট আজ সেরে ফেলবো।”
বলেই আবরার রুমের দরজা বন্ধ করে একপা দু’পা করে ওর দিকে এগিয়ে যায়।একদম ওর কাছে যেয়ে ওর সামনে ঝুঁকে বলে,
-“তুমি কী বলো?”
ইয়ারাবী প্রচুর ভয় পেয়ে যায়।ঘামতে শুরু করে,ওর চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকার সাহস না করে চোখ বন্ধ করে ভয়ে ভয়ে বলে,
-“দ্ দেখুন,আমার সময় লাগবে।আই নো আপনার অধিকার আ আছে,কিন্তু আমি এ এসবের জ্ জন্য এখনো প্রস্তুত না। প্লীজ আমাকে ক্ কিছু সময় দিন।তারপর আপনি যা চাইবেন আমি তাই দিবো।”
বলেই কান্না করে দেয়।আবরার জাস্ট ওর সাথে মজা করতে চেয়েছিলো কিন্তু ও কান্না দেখে ওর খুব খারাপ লাগে।আবরার ওর চোখ মুছে দিয়ে মুখটা উঠিয়ে বললো,
-“ডোন্ট ওরি,আই জাস্ট কিডিং। আমি জানি তুমি জাস্ট আঠারোতে।তাই এত তাড়াতাড়ি কিছু করবোনা।আর তোমার যত সময় নেওয়ার নাও আমি জোর করবোনা।আর হ্যাঁ,আমি বাঘ ভাল্লুক নই যে আমাকে ভয় পেতে হবে।চলো শুয়ে পরি।”
ইয়ারাবী মেডিসিন খেয়ে শুরু পরে।আবরার ওর কথাগুলো মনে করে হাসতে থাকে।
রোজ রাতের মতো আজও একটা তিরিশের দিকে ইয়ারাবীর ঘুম ভেঙে যায়।এই সময়টাই ইয়ারাবীর ঘুম ভাঙলে খুব ভয় পায়।এই সমস্যাটা ওর কলেজে উঠার পর থেকে।এজন্য ও ওর মাকে অনেক সময় ওর কাছে ঘুমাতো বলতো।কিন্তু মিসেস ইশানি ওর কথাগুলো অবহেলা করতো,মজা করে উড়িয়ে দিতো।যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ ওকে টাচ না করে বা হাত না ধরে ওর শরীর প্রচন্ড ভাবে কাঁপতে থাকে।রাতে না ঘুমানোর এটা আরেকটা কারন ওর।
ইয়ারাবী ঘুম থেকে উঠে শরীরে ভালো করে চাদরটা দিয়ে গুটিশুটি মেরে বসে।ওর বেডটা অনেক বড়।আবরার একপাশে মাঝে বালিশ দেওয়া আর তার থেকে ও আরেকটু দূরে ঘুমিয়েছে।ও প্রচুর কাঁপতে থাকে,ঘেমে ওর খয়েরী রঙের নাইট ড্রেসটার কলার হালকা ভিজে গেছে।যেহেতু শীত এখনো পরেনি তাই মাথার ওপর ফ্যানটা হালকা স্প্রীডে চলছে।ও আস্তে আস্তে আবরারের দিকে এগিয়ে যায়।আবরারের এক হাত মাথার নিচে আরেক হাত বালিশের উপরে রাখা।ও আস্তে করে আবরারের হাতটা ধরে।যদি কিছুটা ভয় কমে।ওর বারবার মনে হচ্ছে কেউ ওকে দেখছে দাঁড়িয়ে,ওর কাছে আসছে।
আবরারের ঘুম প্রচুর পাতলা।কেউ ওর হাত ধরেছে অনুভব হচ্ছে আরো ভেজা ভেজা লাগছে।ও চোখ খুলে পাশে তাকিয়ে দেখে ইয়ারাবী গুটিশুটি মেরে ওর হাত ধরে বসে আছে।ঘামছে,কান্না করছে আর প্রচুর কাঁপছে। আবরার তাড়াতাড়ি উঠে বসে।
-“ইয়ারাবী কী হয়েছে তোমার?”
-“কই কিছুনা।”
-“মিথ্যা বলোনা,ভয় পাচ্ছো কেন আমাকে বলো।খারাপ স্বপ্ন দেখেছো?”
ইয়ারাবী মাথা নাড়ায় যার অর্থ না।আবরার অনেকক্ষণ ধরে প্রশ্ন করতে করতে ও একটা সময় পুরোটা খুলে বলে।আবরার সবটা শুনে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-“এটা তোমার মনের ভুল তাছাড়া আর কিছুই না।ডোন্ট প্যানিক।”
-“এটা মনের ভুল নয় আবরার,যার সাথে ঘটে শুধু সেই বোঝে।আমি লাস্ট চার বছর ধরে সাফার করছি, এজন্যই আপনাকে বলতে চাইছিলাম না।বিকজ্ আপনি একজন সাইক্রেটিস তাই আপনার কাছে এগুলো ভ্রম।”
আবরার কথাটা শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।মেয়েটা ভুল বলনি কিছু।তবে এটাও ঠিক ও অনেক ডিপ্রেশনে আছে।আবরার ওকে চোখ মুছে দিয়ে বলে,
-“শুয়ে পরো এখন,এমনিতে সিক আছে, আরো খারাপ করবে।”
-“ঘুমালে আবার হবে।”
-“তাহলে কী তুমি না ঘুমিয়ে রাত কভার করো।”
ইয়ারাবী চুপ করে মাথা নিচু করে নেয়।আবরার বেডের মাঝ থেকে বালিশগুলো সরিয়ে দিয়ে বলে,
-“ডোন্ট ওরি আমি আছিতো,আর এগুলো সরিয়েছি বলে মনে করোনা আমি উল্টো-পাল্টা কিছু করবো।”
এই বলে ইয়ারাবীকে শুয়ে দেয় আর ওর বাম হাতটা শক্ত করে ধরে রাখে।তবে ইয়ারাবী অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখেছে।আবরার ওর মাথায় হাত বুলাতে থাকে।এক পর্যায়ে ইয়ারাবী স্বাভাবিক হয়ে ঘুমিয়ে যায়।তবে আবরারের চোখের ঘুম উড়ে যায়।
আবরার এটাই চিন্তা করতে থাকে,একটা মেয়ে কতটা অবহেলা পেলে ডিপ্রেশনে চলে যায়।ভয়ে পেলে কান্না পর্যন্ত করে কিন্তু সবাই মজা নিবে ভেবে চুপ করে থাকে।ভয়ের জন্য রাতে ঘুমাতে পর্যন্ত পারেনা।অথচ এর পরিবার এর ব্যাপারে কিছু জানেনা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here